অবশেষে শেকড় সন্ধানী বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ডেনিশ নাগরিক মিন্টো কারস্টেন সোনিক আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন।
সৈয়দ আকতারুজ্জামান রুমী, পাবনা প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ডেনমার্কের নাগরিক এনিটি হোলমিহেভ নামের এক চিকিৎসককে বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করেন। তাদের দাম্পত্য জীবনে এক ছেলে ও মেয়ে জন্ম নেয়। জীবনের শুরুত তেমন সমস্যার সৃষ্টি না হলেও বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথেই তিনি সব সময় হীনমন্যতায় ভুগতেন। পরিবারের লোকজনের সাথে খুবই দুর্ব্যবহার করতেন। মাঝে মধ্যেই মেজাজ খিটমিটে হয়ে যেত, তার কোনো কিছুই ভালো লাগতো না। অবশেষে পরিবারের সবার সিদ্ধান্তে ড্যানিশ স্ত্রীকে সাথে নিয়ে ছোট বেলার একটি ছবিকে অবলম্বন করেই ছুটে আসেন নাড়ীর টানে পাবনায়। গত দু সপ্তাহ ধরে বাবা-মা কিংবা স্বজনদের খোঁজে পাবনা শহর সহ নগরবাড়ি এলাকায় চষে বেড়াচ্ছেন এই দম্পতি ।
আত্মপরিচয়ের সন্ধানে পাবনার ভীনদেশি মিন্টো ও এনিটি নামের এক দম্পতির অলিতে গলিতে ঘুরে জনে জনে লিফলেট দিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস করছেন। বহুদিনের পুরোনো এক বালকের ছবি দেখিয়ে জানতে চাইছেন কেউ চেনেন কিনা। বিতরণ করা লিফলেটে লেখায় মিন্টো বলছেন,আমি সম্ভবত নগরবাড়ি ঘাট থেকে হারিয়ে যায়। বর্তমান আমার বয়স ৪৭ বছর। আমি ডেনমার্কের বাসিন্দা। পাবনার নগরবাড়ির আশে পাশে আমার বাবার বাড়ি ছিলো বলে ধারণা করছি। সেখান থেকে ঢাকায় একটি হোমে কিছুদিন থাকার পরে আমাকে ডেনমার্কের একটি পরিবার দত্তক হিসাবে নিয়ে যায়। যদি কেউ আমার বাবা মা’ বা আত্মীয় স্বজনদের খোঁজ পান তবে আমাকে জানাবেন। আমি ডিএন এ পরীক্ষার মাধ্যমে আমার স্বজনদের সনাক্ত করবো। এ নিয়ে গত বুধবার বেলা ১২টায় পাবনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তার প্রত্যাশার কথা তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে মিন্টুর বন্ধু পাবনার স্বাধীন বিশ্বাস এই লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এ সময় স্বাধীন বিশ্বাসের সহযোগি বন্ধু মঞ্জু মোল্লা ও মিন্টুর স্ত্রী এনিটি হোলমিহেভ উপস্থিত ছিলেন।
তথ্য সুত্রে আরো জানা যায়, ১৯৭৭ সালে মাত্র ছয় বছর বয়সে পাবনার নগড়বাড়ী ঘাটে হারিয়ে যান মিন্টো। সেখান থেকে চৌধুরী কামরুল হোসেন নামের কোনো এক ব্যক্তি মিন্টোকে পৌঁছে দেন ঢাকার ঠাটারি বাজারের এক আশ্রমে। সেখান থেকে ১৯৭৮ সালের ১২ এপ্রিল ওলে ও বেনফি নামের ডেনিশ দম্পতি দত্তক নিয়ে মিন্টোকে ডেনমার্ক নিয়ে যান । কেটে যায় ৪০ বছর।
অবশেষে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে সস্ত্রীক পাবনায় এসেছেন মিন্টো কারস্টেন সনিক। কিছুদিন আগে ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন তিনি পাবনায় স্বাধীন বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তির সাথে। আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে চলে আসেন বাংলাদেশে। পাবনায় এসে উঠেছেন শহরের একটি হোটেলে।
মিন্টো বলেন, যদিও ডেনমার্কে আমার পালক পিতা-মাতা ও স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে খুব সুখেই আছি, তবুও আমার অন্তর এখনো বার বার কঁদে ওঠে বাংলাদেশের বাবা-মা ও তার স্বজনদের জন্যে। মনে হয় তাদের পেলেই তার জীবনটা সম্পূর্ণ হয়ে উঠবে। আমি চোখ বন্ধ করে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেই, মনে হয় আমার সেই স্বজনদের গন্ধ পাচ্ছি। প্রতিটি মানুষই নিজের বাবা মায়ের পরিচয় জানতে চায়। যদি বাবা, মায়ের খোঁজ পাই তাহলে সেটা অসাধারণ হবে। না পেলে মৃত্যুর আগে জানব তাদের খুঁজে পেতে আমি চেষ্টা করেছিলাম।
মিন্টো কারস্টেন সনিক জানায়, আমার মনে হচ্ছে যেন ডাঙায় থাকা একটি মাছ পানিতে ফিরেছে। প্রতিটি মানুষকে মনে হচ্ছে আমার আপন, আমার চেহারার সাথে তাদের মিল। যেন আমি আয়নায় নিজেকেই দেখছি। মিন্টোর আবেগকে শ্রদ্ধা করে তার পরিবারও। আশ্রমে থাকাকালীন ছোটবেলার দু,একটি ছবি ছাড়া কোনো সূত্র নেই। এরপরও এক বুক আশা নিয়ে পাবনার পথে পথে মিন্টোর শেকড় খুঁজে বেড়াচ্ছেন তারা।
অথচ আজ ছেলেবেলার কোনো স্মৃতিই মনে নেই তার। তিনি জানেন না বাংলা ভাষা। তবে, পেশায় চিত্রশিল্পী মিন্টোর গায়ের রং জানান দেয় তার বাঙালী নৃতাত্ত্বিক পরিচয়। নাটা’ই ছেঁড়া ঘুরির মতো জীবনে সব সময়ই তাড়া করে ফিরেছে বাবা মায়ের পরিচয় জানার আকুতি। অসম্ভব এই অভিযাত্রায় জয়ী হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তবু সর্বশেষ প্রচেষ্টা টুকুই সান্তনা যেন তার কাছে। তিনি আরো জানান, পুরনো কাগজ ঘেঁটে জেনেছেন মাত্র ৬ বছর বয়সে পাবনার বেড়া উপজেলার নগরবাড়ী ঘাট এলাকা থেকে হারিয়ে যান তিনি। তারপর ঢাকার ঠাটারীবাজার টেরি ডেস হোমস নামের শিশু সদনে ছিলেন। পরে শিশু সদন সেখান থেকে ১৯৭৮ সালে ডেনমার্কের এক নিঃসন্তন দম্পতি মিন্টুকে দত্তক নিয়ে যায়। সেখানেই তার শৈশব কৈশোর কাটে। বিত্ত বৈভবের মাঝে লেখাপড়া শিখে বড় হন।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মিন্টোর স্ত্রী এনিটি হোলমিহেভ বলেন, এ দেশে মিন্টোর কাটানো শৈশবের কোনো স্মৃতিই মনে নেই। যে আশ্রমে সে ছিল তারও অস্তিত্ব খুঁজে পাই নি আমরা। জানি এটা খুব কঠিন। তারপরও মিন্টো যদি তার স্বজনদের খুঁজে পায় তবে তা দারুণ কিছু হবে। বাবা-মাকে খুঁজতে আসা মিন্টোর আবেগ ছুঁয়েছে পাবনাবাসীকেও। প্রশাসন ও দিয়েছেন তাদের সহযোগিতার আশ্বাস।
পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস বলেন, পূর্ব পুরুষদের খুঁজতে আশা মিন্টোর সন্ধান আমরা গত ১০ সেপ্টেম্বর পেরেছি। আমরা তার সাথে যোগাযোগ করেছি। এবং তার নিরাপত্তার বিষয়টা তখন থেকে দেকভাল করছি। এ সংক্রান্ত পাবনা সদর থানায় একটি জিডিও হয়েছে।
পূর্ব পুরুষদের খুঁজতে আশার বিষয়টা পুলিশি নিয়ম কানুন অনুযায়ী আমরা সব জায়গায় ম্যাসেস দিয়েছি। পাশাপাশি নিজস্ব ফেসবুক সহ যে সমস্ত যোগাযোগ মাধ্যম রয়েছে সেখানেও প্রচার করেছি। ইতোমধ্যে সিলেট জেলা থেকে এক ব্যক্তি রেসপন্স করেছেন। আশা করছি, বিভিন্ মিডিয়া ও পুলিশি তৎপরতায় যদি মিন্টো তার পূর্ব পুরুষদের খুঁজে পায়। সেটা নি:সন্দেহে তার জন্য এবং আমাদের জন্য অনেক আনন্দের বিষয়।
মিন্টোর বাংলাদেশী বন্ধু স্বাধীন বিশ্বাস বলেন, মিন্টো ভাই, বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণ করেছেন। তিনি তার বাবা মাকে ফিরে পেতে চান। আমি আশা করি হয়তো মহান সৃষ্টি কর্তার আর্শিবাদে তিনি তার বাবা মাকে অথবা ভাই বোন কে ফিরে পাবেন। ইতোমধ্যে
৫টি পরিবার দাবি করছেন যে তারা তাদের ভাইকে হারিয়েছেন। তাদের সন্তানকে হারিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আগে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্তর পর্ব শেষে যদি মেলে তবে আমরা ডিএন এ টেষ্ট করবো।
মঞ্জু মোল্লা (স্বাধীন বিশ্বাসের সহপাঠি) বলেন, গত দুই সপ্তাহ যাবত তিনি তার বন্ধু স্বাধীন,মিন্টো ও এনিটি হোলমিহেভ পাবনার নগরবাড়ির নানা স্তরে লিফলেট বিতরণ করেছেন। মিন্টোর পরিবারের সন্ধান পাওয়ার আশায় স্থানীয় চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য সহ বেশ কয়েকটি স্কুলে গেছেন, এমনকি থানা পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছেন।
অবশেষে আশার আলো ঃ পাবনার আতাইকুলা থানার সাদুল্লাপুর ইউনিয়নের খালিশপুর গ্রামের জয়ধর শেখের ছেলে ময়েজউদ্দিন শেখ (৬০) তিনি তার হারিয়ে যাওয়া ছোট ভাই বলে দাবি করছেন। ইতোমধ্যে ১৫ সেপ্টেম্বর শনিবার সকালে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মিন্টো ও তার স্ত্রী এনিটি হোলমিহেভ এর সাথে দেখা করেছেন। তারা উভয়ে আবেগ আপ্লুপ্ত হয়ে অন্তরঙ্গ মুর্হুতের একে পর্যায়ে একে অপরকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। পরস্পর চুম্বনে লিপ্ত হয়েছেন।
সাবেক ইউপি সদস্য ময়েজউদ্দিন শেখ বলেন, ৪০/৪২ বছর আগে তার মায়ের সাথে তার ছোট ভাই তার এক আত্মীয়র বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার পথে নগরবাড়ি ঘাট থেকে হারিয়ে যায়। এ সময় তার এক খালাতো ভাইও তাদের সফর সঙ্গী ছিলো। ভাগ্যের লিখনে তিনি ও তার পরিবার তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজনের সন্ধান পেয়েছেন। যদিও তার বাবা মা আজ বেচেঁ নেই। এখন ময়েজউদ্দিন শেখ ও তার নাতি পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া নাতি মামুন চাইছেন ডিএন এ টেষ্ট এর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তাদের মাঝে মিন্টোকে ফিরিয়ে দিতে সরকার সহযোগিতা করবে এমনটাই প্রত্যাশা তাদের।
আত্মপরিচয়ের শেকড় সন্ধানী মিন্টো স্বজনদের দেখা পেয়ে জন্মভূমি থেকে সুখস্মৃতি নিয়ে ফিরবেন এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।