অহংকার ও বিএনপি

অহংকার ও বিএনপি
কালাম ফয়েজী

২য় আদম হিসেবে পরিচিত হযরত নূহ (আ.) আল্লাহ্র একজন সেরা নবী ছিলেন। তিনি মৃত্যুকালে তার সন্তানদের কিছু উপদেশ দেন। যে দুটো কাজকে সবসময়ের জন্য নিষিদ্ধ করেন, তা হল আল্লাহ্র সাথে অপর কাউকে শরীক করা এবং অহংকার প্রদর্শন করা।
ঠিক একইভাবে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কেও আল্লাহ বারবার শিরক না করার তাকিদ দিয়েছেন। বলেছেন, অতীতে যারা আল্লাহ্র সাথে শরীক করেছে সেই মোশরেকরা ধ্বংস হয়ে গেছে। এজন্য নবী মুহাম্মদের প্রথম দাওয়াতই ছিল এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন। দ্বিতীয় যে কাজটি আল্লার অপছন্দ তা হল অতিরিক্ত অহংকার। পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছেÑ লা তামশি ফিল আরদি মারহা অর্থাৎ আমার জমিনে তোমরা দম্ভ দেখিয়ে চলিও না। অনেক প্রতাপশালী ব্যক্তি ও জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে অতিরিক্ত দম্ভ-অহংকারের জন্যই।
সকলে জানেন, মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের যেমন আলাদা আলাদ নাম আছে, তেমনি আছে আলাদা চেহারা, পরিচিতি ও সম্মান। মানুষ পশু না, তার ব্যক্তিত্ব আছে এবং ব্যক্তিত্ব রক্ষা করে চলার প্রয়োজনও আছে। সেজন্যে তার কিছু অহংকার দরকার। ব্যক্তিত্বের অহম না থাকলে মানুষ পশুর মত মর্যাদাহীন হয়ে যায়। পশু কখনো বিত্ত বা ক্ষমতার মালিক হতে পারে না, তার জ্ঞান অজর্নের সুযোগও নেই। সেজন্যে পশুদের সবসময় পশুবৎ হয়েই দিন যাপন করতে হয় এবং কেনা গোলামের মত মনিবের ইচ্ছানুসারে চলতে হয়।
কিন্তু মানুষ স্বাধীন। কেউ কেউ আপাতত পরাধীন হলেও সে তার বুদ্ধি ও শক্তিবলে স্বাধীন হয়ে যেতে পারে। শ্রম ও সাধনার বলে সে গৌরব-সৌরভও অর্জন করতে পারে। অর্জনের পরিমাণ যত বেশি হবে তার অহমের পরিমাণ ততই বৃদ্ধি পাবে। একজন রাজা কিসের বলে রাজা? উত্তর হলÑ তিনি তার শক্তি-বুদ্ধি আর লোকবল-জনবলের জন্যই রাজা। রাজার হাতে থাকে রাজদ-। তিনি ইচ্ছে করলে দ-ের ন্যায়ত ব্যবহারও করতে পারেন, অন্যায় ব্যবহারও করতে পারেন। কিন্তু খোদা কেবল এর অন্যায় ব্যবহারকেই নিষেধ করেছেন।
যুগে যুগে অত্যাচারী রাজা আর স্বৈরচারী শাসকরা রাজত্ব করেছেন, জুলুম-অত্যাচার করেছেন, নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছেন। তাদের কারো কারো দোর্দ- প্রতাপে মাটি পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে। সেই অত্যাচারী স্বৈরশাসকদের পরিণতিও পৃথিবীর মানুষ দেখেছে, ইতিহাসেও তার বিবরণ উল্লেখ আছে ভুরি ভুরি। বর্তমানে বাংলাদেশে যে স্বৈরশাসন চলছে, তার ভয়াবহ রূপ, ভয়ংকর আস্ফালন, দাম্ভিক আচরণ মানুষ দেখছে এবং প্রতি মুহূর্তে দুর্বল মানুষরা তার শিকার হচ্ছে। আমি সেদিকে যাব না। কারণ গণবিচ্ছিন্ন একটি দল, অনির্বাচিত একটি সরকার, মানুষের ভালো-মন্দ, উন্নতি-অগ্রগতি নিয়ে না ভাবলেও পারে। তারা গায়ের জোরে টিকে আছে, চাপার জোরে প্রতিপক্ষকে হারাচ্ছে এবং বন্দুকের জোরে নাগরিকদের দাবিয়ে রেখেছে। এছাড়া তো তাদের টিকে থাকার আর কোন উপায় নেই। তাদের কথা এখানে মোটেই আলোচ্য নয়। কারণ দুর্বিনীত দাম্ভিক দর্প-দম্ভ দেখাবে হাঁক-ডাক করবে, হম্বি-তম্বি দেখাবে। দুষ্ট-ধৃষ্ট-দুশ্চরিত্রের জন্য এসব হয়ত অমূলক নয়। কিন্তু ভদ্রলোকের জন্য এর অনেক কর্মই শোভনীয় নয়। যতদিন আওয়ামী লীগ জনগণের দল ছিল ততদিন জনতার স্বার্থেই কর্ম করেছে, কথা বলেছে। জনগণ তা মেনে নিয়েছে। আজ আর সে দলটি জনতার দল নয়। দশটি দলীয় লোকদের দল। এজন্য বলা চলে দলটি এখন দলীয় লোকের স্বার্থ দেখে এবং রক্ষা করে চলে। দেশের কথা তাদের না ভাবলেও চলে। কিন্তু বিএনপি কখনো জনবিচ্ছিন্ন দল নয়, কখনো তা ছিলও না। আজও তাদের উপর এত নির্যাতন-নিষ্পেষণ তবুও দেশের ৬০% ভোটার তাদের পক্ষে। এত ভোট আর এত জনসমর্থন সত্ত্বেও তারা পিছিয়ে আছে। তারা না পারছে গণবিচ্ছিন্ন লীগ সরকারকে জনতার শক্তি দিয়ে কুপোকাত করতে, না পারছে তাদের আস্ফালন কমাতে। এর নেপথ্যে যতগুলো কারণ বিদ্যমান, তার একটি অন্যতম কারণ হল, নেতাদের অপ্রয়োজনীয় দেমাগ ও অহংকার এবং নিষ্ঠাবান কর্মীবিচ্ছিন্নতা।
একটি দল বা সংগঠন এককভাবে কোন ব্যক্তিকে দিয়ে চলে না। দল বা সংগঠনে থাকে একই মতাদর্শের অনেক লোক। তাদের মধ্যে কেউ থাকেন নেতৃস্থানীয়, কেউ থাকেন কর্মী-সমর্থক। যে সংগঠন বা দলে কর্মী-সমর্থক বেশি সে সংগঠন বা দল বড় দল হিসেবে বিবেচিত। বিএনপির মত একটি জনপ্রিয়তম রাজনৈতিক দলে নেতার সংখ্যার চেয়ে সহস্রগুণ বেশি কর্মী-সমর্থকের সংখ্যা। একজন দায়িত্বশীল রাখালের অধীন অনেক গরু-মহিষ মেষ-ভেড়া নিরাপদে থাকে। তেমনি একজন দায়িত্বশীল নেতার তত্ত্বাবধানে অনেক কর্মী-সমর্থক পরিচালিত হয়। রাখাল কেবল তার তত্ত্বাবধানে থাকা পশুদের ঘাস খাইয়েই দায়িত্ব শেষ করে না, বাঘ-সিংহ বা অপর হিংস্র প্রাণীদের আক্রমণ থেকে তাদের জীবন রক্ষা করাও তার দায়িত্ব। একজন নেতা কর্মীদের খোঁজ-খবর নেবেন, ভাল-মন্দ দেখবেন, তাদের কথা শুনবেন এবং প্রতিটি প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দেবেন, সমস্যায় পড়ে গেলে প্রতিকারেরও ব্যবস্থা করবেন। একটি ডাকাত দলের সর্দারও তার সহকর্মীদের সমস্যাকে সহানুভূতির সঙ্গে দেখে। বিএনপি কখনো ডাকাদের দল নয়, দুষ্ট-দুরাচারের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যও এ দল পরিচালিত হয় না। অথচ কি আশ্চর্য এ দলের নেতৃস্থানীয় অনেক নেতার চরিত্র এমন যে তাদের জমিদার বা জমিদারের পেয়াদা-বরকন্দাজের মত দেমাগে মাটিতে পা পড়ে না। তারা কর্মীর ভাল-মন্দ দেখবে কি, মনযোগ দিয়ে কখনো কর্মীর কথাও শুনতে চায় না। পরামর্শ গ্রহণ দূরে থাক, ব্রাহ্মণের মত নাক উঁচু স্বভাবের কেউ কেউ সাধারণদের পাত্তাই দেন না। তাদের ভালোবাসবেন, তাদের জন্য আত্মত্যাগ করবেন, তার তো প্রশ্নই ওঠে না।
সকলে জানেন, বৃষ্টির পানিতে কৃষকের সকল চাহিদা পূরণ হয় না। প্রয়োজনীয় পানির জন্য তাকে নির্ভর করতে হয় নদী বা তলদেশের পানির উপর। শতবর্ষ পূর্বেও তলদেশের পানি উত্তোলনের পদ্ধতি এ দেশের মানুষের জানা ছিল না। তারা বেশি নির্ভর করতো নদী বা পুকুরে পানির উপর। রাজারা তাদের প্রজাদের সুপেয় পানির জন্য বড় বড় দীঘি খনন করতেন। সেই দীঘির পানি প্রজারা কলসি ভরে নিয়ে যেতো। নদীর পানি খাল বা নালা বেয়ে কৃষকের জমিতে আসতো। কৃষক সে পানি দিয়ে ফসল উৎপাদন করতো। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অধিক ফসলের জন্য প্রথম অধিক খাল খননকে গুরুত্ব দেন এবং স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে খাল খনন প্রক্রিয়া চালু করেন। দেশের যে কোন প্রান্তে সফরে গিয়ে তিনি যে কাজগুলো রুটিনমাফিক করতেন, তার একটি অন্যতম কাজ ছিল খালকাটা। তিনি নিজে কোদাল হাতে মাটিতে কোপ বসাতেন, তাকে দেখে অন্যরাও বেজায় উৎসাহিত হতেন। তিনি দেশের মানুষকে জানাতে সক্ষম হন যে, শুধু বৃষ্টির পানির উপর নির্ভর করলে চলবে না, আমাদের প্রয়োজনীয় পানির জন্য খাল খনন করতে হবে। খাল থাকলে নদীর পানি কৃষকের জমির কাছ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তারপর কৃষক পাম্প করে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি তুলে অধিক ফসল ফলাতে পারে।
আমরা জানিÑ নদীতে অফুরন্ত পানি থাকলেও সে পানি কৃষকের জমির নাগাল পর্যন্ত পৌঁছার জন্য খাল বা নালা দরকার। তেমনি দলের মধ্যসারি ও পাতিসারির নেতারা খাল বা নালার দায়িত্ব পালন করেন। দেশনেতার বক্তব্য ও আদর্শকে সাধারণ জনতার কাছ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য তারা বাহকের ভূমিকা পালন করতে পারেন। এক্ষেত্রে উচ্চসারির নেতাÑমধ্য সারির নেতারা যদি অহংকারী হন, সাধারণ কর্মী ও সমর্থকদের আপন ভাবতে না পারেন, তাদের সাথে দলীয় বিষয়াদি নিয়ে আন্তরিকভাবে মতবিনিময় না করেন, মাঠপর্যায়ের নেতাদের গুরুত্ব না দেন, তাদের কথা আমলে না নেন, তবে দুর্যোগ-দুঃসময়ে কে তার পাশে থাকবে, কে তার কাজ করবে? এদিক থেকে আওয়ামী লীগ নেতাদের চরিত্র ব্যতিক্রম। তারা কর্মীবান্ধব ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন।
একটা উদাহরণ দেই। আমি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার দায়িত্বশীল পদে আছি। সে সুবাদে অনেক সময় আলোচিত ব্যক্তিগণের সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ হয়। আমি এ পর্যন্ত অনেক সরকারি-বেসরকারি আমলা-ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি এবং পত্রিকায় ছেপেছি। এর মধ্যে আওয়ামী ঘরানার দু’জন আলোচিত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছি। দুজনের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও একজন উচ্চপদস্থ আমলা।
মজার ব্যাপার হল, দু’জন লোকই সময় নিয়ে আন্তরিকভাবে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ব্যস্ততার কথা বলে এড়িয়ে যাননি বা গরিমা দেখিয়ে কোনরকম চোটপাট করেননি। সর্বোপরি তাদের বক্তব্য প্রকাশের পর আশাব্যঞ্জক সম্মানি দিতেও তারা কার্পণ্য করেননি। তাদের কথা এবং কাজের মধ্যে চমৎকার পেশাদারিত্বের প্রকাশ পেয়েছে। দুজন ব্যক্তি কঠিনভাবে আওয়ামী মতাদর্শে বিশ্বাসী হলেও কেউই দলীয় কোন পদের অধিকারী নন। বর্তমানে চরম আওয়ামী দুঃশাসনের সময়েও তারা একান্তই আওয়ামী লীগের ভক্ত এবং একটি কথাও সরকার এবং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যায়নি। তাদের বক্তব্য হলÑ শেখ হাসিনা যতদিন ক্ষমতায় থাকবে, দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইতে থাকবে।
এর বিপরীতে আমরা বিএনপি মতাদর্শে বিশ্বাসী আমলা-ব্যবসায়ী-শিল্পপতি বা রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কী ব্যবহার পেয়েছি? সত্যি বলতে কি, বিএনপি নেতাদের মধ্যে বেসিক পেশাদারিত্বের যথেষ্ট অভাব। তাদের কথায় অপ্রয়োজনেও অহম ও বাগাড়ম্বর প্রকাশ পায়। ভাবখানা এমন যেন তিনি দলের একমাত্র কর্ণধার। অথচ সংগঠনের কোথাও তার কোন অবদান নেই। কথা প্রসঙ্গে দলের মধ্য ও নিম্নসারির অনেক নেতা দল ও দলের উচ্চপদস্থ লোকদের তীব্র সমালোচনা করেন। বিএনপি মতাদর্শে বিশ্বাসী ব্যবসায়ী আমলা বা রাজনীতিকরা সাক্ষাৎকার এড়িয়ে যান কিংবা সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলেও তারা মিনিমাম দায়িত্ব পালন করেন না। ভাবেন তার নামে যে বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে, এটা তার পাওনা। একজন ব্যক্তি যে খেটে, পরিশ্রম করে, সময় ও অর্থ ব্যয় সাপেক্ষে তার যে বক্তব্য প্রকাশ করলেন, তার জন্য তাদের থেকে কোনরকম কৃতজ্ঞতাবোধও প্রকাশ পায় না। ভাবখানা এমন যে, আপনি তো কষ্ট করে তার বক্তব্য ছেপেছেন, এখন পারলে তাকে কয়টা টাকাও দিয়ে যান। তাহলেই কেবল তিনি আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন।
বিএনপি নেতা-কর্মীদের নন-প্রফেশনাল হওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ হল, এখানে অর্থের বিনিময়ে বড় বড় পদ ও পদবী কিনতে পাওয়া যায়। এ প্রবণতা আওয়ামী লীগে থাকলেও তারা দায়িত্বশীল পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে খুব সাবধানী। ঐতিহ্যগতভাবে এবং আন্তরিকভাবে কেউ আওয়ামী লীগার নয়, এমন কাউকে তারা বড় পদ দেয় না ও ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনের মত আওয়ামী লীগে রাতারাতি মস্ত পদাধিকারী হওয়ার কোন সুযোগ নেই।
অথচ এর বিপরীত হাল বিএনপিতে। বিএনপি সমর্থিত অনেক লোক আছেন যারা অর্থের বিনিময়ে পদ কিনে ঘাপটি মেরে বসে আছেন। তারা কোন দায়িত্বও নেন না, ঝুঁকিতেও যেতে চান না। আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়াও কখনো কোন কর্মসূচিতে তাদের দেখা যায় না। কেবল তারা অপেক্ষায় থাকেন কখন পালাবদল হবে। বদলের সাথে সাথে তাদের চেহারা পাল্টে যায়। তাদের দাপটে তখন ত্যাগী কর্মী-সমর্থকরা বড় নেতাদের সংস্পর্শেও যেতে পারে না। কোনরকম সুযোগ নেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।
বিএনপির মত একটি অতীব শক্তিশালী এবং অতিশয় জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের বড় সমস্যা হল এর হোমড়া-চোমড়া নেতাদের কেউ গণমুখী নন। তারা জিয়াউর রহমানের আদর্শের ঠিক বিপরীত কর্ম করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া এত ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন যেন দৈনিক তিনি জনসংযোগ করতেন, দৈনিক তিনি দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলিত হতেন এবং তাদের নানারকম সৃজনশীল ও উৎপাদনশীল কর্মে উৎসাহ দিয়ে বেড়াতেন। অথচ এখন বড় নেতারা সাধারণ কর্মীদের কাছে যান না। কর্মীরা বরং উৎসাহী হয়ে নেতার শরণাপন্ন হন। নেতারা এক্ষেত্রে বেশিরভাগই নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পাছে কর্মীর বিপদে তার অর্থব্যয় হয়, এজন্য বলতে গেলে অনেক নেতা পালিয়ে চুরিয়ে থাকেন। সহসা কর্মীকে দেখাও দিতে চান না, সান্ত¡না বা উৎসাহ দেয়া তো সুদূরপরাহত। এভাবে কি এত বড় একটা দল চলতে পারে? পারে না। পারে যে না, তার প্রমাণ হল নেতা যখন বন্দি হন, সরকারের পেটোয়া বাহিনী দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তখন তার দলের সাধারণ নেতা-কর্মীরা তার প্রতি সম্মান জানিয়ে একটা প্রতিবাদ মিছিলও বের করে না। আমি মনে করি, এর জন্য কর্মীরা যতটা দায়ী তার চেয়ে সহস্রগুণ বেশি দায়ী দলের সর্বভুক বাজখাঁই নেতা।
নেতা যিনি হবেন বুঝতে হবে তার ধৈর্য্য বেশি, অভিজ্ঞতা বেশি, সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করেছেন বেশি। সাধারণ কর্মীরা বিপদে পড়ে বা হতাশ হয়ে তার কাছে ছুটে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। নেতার অভ্যন্তরীণ কষ্ট থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে একজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর মত তার মুখেও হাসি ফুটিয়ে রাখতে হয়, যাতে কর্মীগণ নিরুৎসাহিত না হন। কিন্তু কর্মীরা যদি এর বিপরীত আচরণের মুখোমুখি হন, তাদের কী প্রতিক্রিয়া হয়? এজন্যই বলা হয়, বিএনপি সমর্থিত লোকের অভাব নেই। এখানে কেবল অভাব দায়িত্বশীল ও সাহসী নেতার।
বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তার বড় সমস্যা হলÑ এর বেশিরভাগ নেতা কর্মীবান্ধব নন। কর্মীদের সুখ-দুঃখ নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। এমনকি কর্মী-সমর্থকদের যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্যও তাদের কোন পরিকল্পনা নেই। দলের মধ্যসারি থেকে নিচের দিকে লোকের অভাব নেই। কিন্তু ঝুঁকি নেয়া বা দুর্দিনে হাল ধরা বা যথাসময়ে যথাযথ নির্দেশ প্রদান করার মত সাহসী নেতার বড় অভাব। অথচ আওয়ামী লীগ ও জামায়াত সম্পূর্ণ কর্মীবান্ধব দল। কিন্তু তারা জনগণের সুখ-দুঃখ বুঝতে চনা না বলে ধীরে ধীরে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। কতক দল আছে নেতাসর্বস্ব। অথচ সৌভাগ্য বিএনপির। তারা কখনো জনবিচ্ছিন্ন দল না। জনস্বার্থের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিবিড়। এখন প্রয়োজন কর্মীদের প্রতি নজর দেয়া এবং তাদের গিয়ারআপ করে উপরে নিয়ে আসা। নিজেদের অযোগ্য অথর্ব পোষ্যদের বদলে মাঠের দক্ষ লোকদের ভাল পদে পদায়ন করা। তবেই দলটির পক্ষে দীনতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
বিএনপি’র সিনিয়র নেতাদের অনেকে পেশাদার রাজনীতিবিদ নন। রাজনীতির ছত্রছায়ায় তাদের তারা অনেকে সম্মান-সমৃদ্ধির মালিক হলেও সেটা স্বীকার করতে চান না। অনেকে দলের প্রতি ন্যায়ত কোন দায় অনুভব করেন না বরং দলের ব্যাপারে সাংঘাতিকরকম দাম্ভিক ও উন্নাসিক। যখন রাজনীতি করার সময় হয় তখন রাজনীতি নিয়ে ভাবেন, অন্য সময় নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ, ব্যবসা এবং অন্যান্য লাভজনক কর্মে নিয়োজিত থাকেন। অথচ যারা দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদ তাদের কর্তব্য হল, দিনের একটা লম্বা সময় রাজনীতি নিয়ে ভাবা, এর পেছনে সময় ব্যয় করা এবং কর্মী-সহকর্মীদের সাহস ও উৎসাহ যোগানো।
বিএনপি নেতা-কর্মীদের আরেক সীমাবদ্ধতা হল, তারা পাঠবিমুখ ও জ্ঞানবিমুখ। আওয়ামী লীগের কর্মীরা পাঠবিমুখ হলেও তাদের চলে। কারণ অর্থকড়ির প্রতি তাদের বেজায় দুর্বলতা এবং যে কোনরকম শক্তি-অপশক্তি ব্যবহার করে তারা যে কোনো মূল্যে তালগাছটা নিজেদের বাগে নিয়ে নিতে পারে। বিএনপি কর্মীরা যেহেতু এতটা নির্মম-নিষ্ঠুর হতে পারে না, সেজন্য তাদের কর্তব্য হওয়া উচিত বেশি বেশি জ্ঞানার্জন, এবং উৎরে যাবার মত কিছু কৌশল জেনে রাখা। কারণ অন্তত বুদ্ধি আর কৌশল জানা থাকলে তারা প্রতিপক্ষের অপশক্তি সহজে মোকাবেলা করতে পারবে। মনে রাখতে হবে, অসুরকে প্রতিহত করার জন্য অসুরনাশি কৌশলটা জানা থাকা লাগে। সর্পের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য সর্পদেবির পূজাও করা যাবে না। যদি তা করচে যান তবে তো সর্পদেবির কাছে আপনি পরাজয় স্বীকার করলেন। আপনাকে তাবৎ অপশক্তির বিপরীতে এমন শক্তি অর্জন করতে হবে, যাতে শয়তান আপনার নাম শুনলেই আঁতকে ওঠে। সেই শক্তি হল জনতার শক্তি, সেই শক্তি হল সততা-নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার শক্তি। আপনি যদি সে শক্তি অর্জন করতে পারেন এবং ঘাতকমন্ত্রের মত তার সঠিক প্রয়োগ কৌশলও আয়ত্ত করতে পারেন, আমি হলফ করে বলতে পারি, আপনার জনপদে আপনি হবেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী বড় নেতা।
অহম ত্যাগ করতে হবে, মানুষের সাথে মিশতে হবে, দরদ দিয়ে তাদের কথা শুনতে হবে। বই পড়তে হবে। ইতিহাস ও সাহিত্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পুস্তকগত জ্ঞানই আপনাকে পারদর্শী হতে সাহায্য করবে। বিএনপিতে ত্যাগী, পরিশ্রমী, পারদর্শী ও দক্ষ নেতার বড় অভাব। অন্যরা যা করছে, আপনাকে তা-ই করতে হবে, তার দরকার নেই। আপনি আপনার ভাললাগা কাজগুলোকেই অগ্রাধিকার দিন। আপনার কর্মী-সমর্থকরা চিরকাল আপনাকে মাথায় তুলে রাখবে। আপনি স্বাভাবিক হোন, সাধারণ হোন, সাবলীল হোন। সাধারণ না হয়ে কেউ অসাধারণ হতে পারে না।
একজন নেতাকে সাহসের সাথে বুক টান টান করে হাঁটতে হয়। বিশেষ করে তিনি যখন কোন সভাস্থলে প্রবেশ করেন, তাকে সালাম দেয়ার জন্য অনেক শুভানুধ্যায়ীরা অপেক্ষায় থাকেন। কেউ কেউ দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে নেতার দৃষ্টি কাড়তে চান। এই যে কর্মী-সমর্থকদের অপেক্ষায় থাকা, প্রটোকল দেয়া, এজন্য অনেক ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। কিন্তু নেতা যদি মহিলাদের মত মাথা নিচু করে সভাস্থলে প্রবেশ করেন, তাহলে কর্মী-সমর্থকরা বেজায় আহত বোধ করে। কর্মীরা অনেক সময় নিজেদের জরুরী কাজ ফেলে এসে দাঁড়িয়ে থাকে, তারা যদি নেতার একটু হাসিও দেখতে না পায়, তাদের কষ্টটাই বৃথা।
বিএননি’র উচ্চ পর্যায়ের অনেক নেতা বিশেষ করে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যারা এ মুহূর্তে দলে কা-ারীর ভূমিকায় আছেন, তারা কেন জানি কর্মীদের চোখে চোখ রাখতে ভয় পান। অনেক নেতাকে দেখা যায়, সালাম দিলেও ভ্রƒক্ষেপ করেন না। হাসার বদলে মুখ গম্ভীর করে রাখেন কেউ কেউ। এসব একজন নেতার জন্য কখনো শোভনীয় নয়।
বিএনপি নেতারা এক যুগ ধরে ক্ষমতার ধারে কাছে নেই। কেউ কেউ তো কর্মীদের চা-ও খাওয়াতে পারেন না। তা সত্ত্বেও নেতা যদি ভাবে থাকেন, গরিমা দেখান, দলীয় কর্মী-সমর্থকদের মনোভাব কী হতে পারে? দলীয় কর্মীরা টাকা চায় না। তারা দেখতে চায় নেতার সুন্দর হাসি, পেতে চায় সুন্দর ব্যবহার ও দুঃসময়ে প্রেরণা। নেতা যদি এসব দেখাতে না পারেন, তার উচিত বিএনপির রাজনীতি ছেড়ে দেয়া।
আওয়ামী নেতারা প্রভাপ-প্রতাপ-দাপট-দাদাগিরি দেখায় প্রতিপক্ষ দলের সাথে। তাদের দাপটের পরিমাণ এত বেশি থাকে যে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিএনপির মত একটা দলকে পাত্তাই দেয়নি। একটা শক্তি বলে স্বীকারও করতে চায়নি। অথচ তাদের দলের অভ্যন্তরে নেতা-কর্মীরা একে অন্যের প্রতি অতিশয় সহানুভূতিশীল। তারা তাদের দলের একজন সমর্থককেও বন্ধু ভাবে এবং সে বন্ধুর উন্নতিতে বৈধ-অবৈধ সকল পন্থায় সাহায্য-সহযোগিতা করে। অথচ বিএনপি’র দিকে তাকালে আপনারা ভিন্ন চিত্র দেখতে পাবেন। দলের অনেক বড় নেতা-কর্মীদের দিকে মুখ করে বসার বদলে পাছা দিয়ে বসেন। বিএনপির উপর দিয়ে এত ঝড়, এত দুর্যোগ যাচ্ছে যেন নেতা-কর্মীর অভ্যন্তরীণ দূরত্ব ঘুচছে না, কেউ উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসেন না। নেতা ভাবেন, কর্মীকে তো আমার কাছে আসতেই হবে। আবার কর্মীরা ভাবেন ভোট চাওয়ার জন্য হলেও আমাকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই, যেহেতু আমি মাঠ পর্যায়ের দক্ষ কর্মী। দু-পর্যায়ের নেতাদের মধ্যকার অহম এবং নিজেদের বড় ও অপরিহার্য ভাবার প্রবণতা, এ কারণে বৃহৎ জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও তারা একটা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে না।
বিএনপির বড় নেতাদের আরেকটা সমস্যা হল তাদের বেশিরভাগই পেশাদার রাজনীতিবিদ নন, অধিকাংশই মৌসুমী রাজনীতিক। যখন রাজনীতির সময় আসে, দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের যে কি প্রতাপ! তাদের কেউ কেউ দুই হাতে পয়সা কামায়। কিন্তু দল যখন বিপদে পড়ে, তখন তারা আপ্সে আড়ালে চলে যায়। সুদিনে তারা দল ও পদের প্রভাব খাটিয়ে প্রচুর অর্থকড়ি কামান, বিত্ত বেসাতির পাহাড় গড়ে তোলেন। কিন্তু দলের দুঃসময়ে তারা কিছুতেই হাতের মুষ্ঠি খুলতে চান না। বরং যক্ষের ধনের মত সকল ধন আটকে রাখেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা নেতা-কর্মীদের সাথে দেখা করেন না বা সুন্দর ব্যবহার পর্যন্ত করেন না টাকার খরচের ভয়ে। নেতা পদাধিকারী এবং বিত্তের মালিক অথচ তারা দলের প্রতি আন্তরিক নন। তার বিপরীত চিত্র কর্মীদের মধ্যে। কর্মী-সমর্থকরা এত আন্তরিক যে, প্রয়োজনে দলের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। কিন্তু তাদের চালনা করার মত গরিমাহীন মধ্যসারির বলিষ্ঠ নেতার বড় অভাব।
সকল ভেদাভেদ ভুলে নানা শ্রেণি-পেশায় নিয়োজিত বিএনপি নেতা-কর্মীদের আজ ঐক্যবদ্ধ হওয়া একান্ত প্রয়োজন। অহম এড়িয়ে বৃহত্তর স্বার্থে তারা যদি এক কাতারে মিলিত হতে না পারেনÑ তাদের মাথার উপর থেকে কালো মেঘ দূরীভূত হবে না।


  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

কাগজ টুয়েন্টিফোর বিডি ডটকম এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!