সেলিনা জাহান প্রিয়ার গল্প: ‘অ-মানব’- (১৯ তম পর্ব)
‘অ-মানব’- (১৯ তম পর্ব)
—————————–সেলিনা জাহান প্রিয়া
পাগল হাসিয়া শিলার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল- ১৯৭১ সালের যুদ্দের সময় এই বাড়ির সবার গহনা আপনার দাদীর নিকট রাখে। বাড়িতে পাক বাহিনী আসলে আপনার দাদী এই সব গহনা রক্ষা করার জন্য, শিমুল গাছের গোঁড়ার নিকট, পুকুরে এই বাক্সে ভরে পানিতে ফেলে দেয়। আপনার দাদী মৃত্যুর সময় আপনার মা কে গহনার কথা বলে যায়। আপনার মা বুঝতে পারে নাই। পুকুরের কোন পাশে সেই গহনার বাক্স টি আছে। তাই প্রায় ই রাতের বেলা একা একা পুকুরে নেমে সেই গহনা খুঁজত । এক দিন প্রেসার জনিত কারনে পুকুর পারে পরে বাক শক্তি হারায়। তিনি আর কাউ কে বলে যেতে পারেন নাই। এটাই হল আপনার মায়ের বার বার পুকুরে নামার ঘটনা। এবার আসুন তিনটি বাচ্চা মারা যাওয়ার ঘটনা। প্রথমে একটি বাচ্চা পানিতে পরে তখন দুপুর ছিল, আপনার চাচী ঘুমাচ্ছিল। ঐ বাচ্চা কে পানি থেকে তুলতে যেয়ে পরে ঐ দুই বাচ্চাও পানিতে পরে যায় । পুকুরের পানিতে অনেক গাছের পাতা পচে নাইট্রোজেন গ্যাস হয় ঐ গ্যাসে একই পরিবারের তিন বাচ্চাই মারা যায়। এখন আসুন পাগল ব্যক্তি কিভাবে মারা যায় শুনি। ঐ পাগল ব্যক্তি আসলে একজন গাঁজা সেবী মাতাল ছিল। ঐ দিন মাজার থেকে অতিরিক্ত গাঁজা সেবন করে। পুকুর পার দিয়ে যাওয়ার সময় পা পিছলে পুকুরে পরে যায় ঢালু পার থেকে সে আর উঠতে পারে না। বর্ষা কাল পুকুর ছিল পানিতে ভরা আর কচুরি পানা পায়ে পেচিয়ে যায়। সে এই পুকুরেই মারা যায়। আপনারা তখন অন্ন্য বাড়িতে বিয়ের দাওয়াতে ছিলেন। শিলার বাবা বলল হ্যাঁ তুমি ঠিক বলেছ আমরা বিয়ে বাড়ি থেকে এই পাগল মরার খবর পেয়ে আসি, কিন্ত আমার চাচা কেন ফাঁসী নিল? পাগল বলল এটা আমি বলতে চাই না। নাদিরা বলল – খারাপ কিছু । পাগল বলল না। আসলে বিষয় টা জানলে আপনাদের বাড়ির ভাগ হয়ে যাবে । শিলার আব্বু বলল- যাই হউক তোমার কথার যুক্তি আছে । বাক্স কুলে দেখল শিলার বাবা সত্যি বাক্সে তাদের পরিবারের সব গহনা । শিলার বাবা তার মায়ের গলার হার চিনতে পাড়ল । দাদুর হাতের চুরি এবং মায়ের সেই হীরার আংটি । সবাই খুশি । হুজুর বলল- আল্লাহ ভালই করেছে । আমার একটু কাজ আছে আমি চলে যাই । পাগল বলল হুজুর একটা কথা বলতে চাই । আপনার জন্য । যদি আমার কথা রাখেন , আমি খুব খুশি হব । হুজুর বলল কি কথা বাবা বল- তুমি খুব জ্ঞানী মানুষ । আমরা যে টুকু হাদিস কুরান পড়েছি তা থেকেই বলি । পাগল নাজু আপা কে বলল- আমার জন্য রেজিয়া আপু একটা প্যাকেট রেখেছে । নাজু প্যাকেট টা এনে দিল পাগলের হাতে । পাগল প্যাকেট টা হুজুরের হাতে দিয়ে বলল আমাকে কোন প্রস্ন করবেন না। এটা আপনার মেয়ের জন্য । যেই মেয়ের জামাই টাকার জন্য অনেক দিন হল আপনার মেয়ে কে তার ঘরে নেয় না। আপনি সেই মেয়ের জন্য খুব চিন্তায় আছেন ।
হুজুর পাগল কে জরিয়ে ধরে কেদে দিল । বলল বাবা তুমি কি করে জানো ? পাগল বলল দুনিয়ায় যা কিছু ঘটে তা মানুষের মনে জমা থাকে । যখন মানুষের মন অতি প্রাকৃতিক হয়ে যায় তখন তার কাছে সব খবর চলে আসে । দেখুন আপনি প্রতিদিন মানুষ কে পানি পড়া দেন । কিন্তু আপনি তো আল্লাহর নামেই ফু দেন । তবে তারা কেন প্রতিদিন নিজেরাই আল্লাহর নামে ফু দিয়ে পানি খায় না। আল্লাহ তাদের জন্য যিনি সব কিছুতেই আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখে । নাদিয়া অবাক হয়ে নাজুর দিকে চেয়ে হুজুরের কান্নার সাথে তারাও তাদের চোখ মুছে । পাগল বলল চাচার ঘটনা বিকেলে বলব । এখন আমি পুকুরের মাটি কাটা দেখব । নাজু বলে গহনা কি করব । নাজুর স্বামী বলে এই গহনা তোমার ভাই যা বলবে তাই হবে । পাগল বলে তিন ভাগ করে, এক ভাগ বিক্রি করে ব্যবসা করেন । একমাত্র মেয়ে কে রেখে আর লন্ডন যাওয়ার দরকার নাই । একভাগ চাচার জন্য রাখেন কারন চাচার একজন ওয়ারিশ বেচে আছে । বাকি একভাগ আপনার স্ত্রী শ্যালী ও মেয়ের জন্য রাখেন । শিলার বাবা বলে তোমার জন্য । পাগল বলে আমি তো আপনাদের সবার জন্য । যে সবার জন্য তার জন্য রাখতে হয় না।
নাদিয়া বলে ভাইয়া তুমি তো আমাদের সবার ভুল ভেঙ্গে দিলে । আসলেই আমরা কত না ভুলে ছিলাম । রইস মিয়া বলে -আমার মনে হয় ভাগ্নের সাথে জিন আছে ।
— পাগল বলে মামা মানুষ তো জিনের চাইতে শক্তিশালি । কারন মানুষ কে আল্লাহ জিন থেকে বেশি সম্মান দিয়েছে । হুজুর খুব খুব অবাক হয়ে দেখল যে এই মানুষ টা আসলেই একটু অন্য রকম ।
নাদিয়া পুকুর পারে বসে আছে শীতে শিমুল গাছের সব পাতা ঝরে গেছে । লেবার রা পুকুরের পার ঠিক করছে । রইস মিয়া বলে মানুষের জানার সেস নাই । নাজ কোচিং এ যাবে রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে । পাগল পুকুরে মধ্য মাটি কাটছিল । নাদিয়া কে বলল – এই নাদিয়া
— জি ভাইয়া বল কি ?
— তুমি নাজের পিছনে পিছনে যাও । তার পর আমাকে এসে বল।
— জি ভাইয়া , যাচ্ছি । নাজু আর শিলা পাগলের পরিশ্রম দেখে বলে আমার আপন ভাই আমার জন্য এত কিছু করবে না। শিলা বলে মা আসলেই জিনিয়াস মামা অসাধারন ।
নাদিয়া কোচিং এসে দেখে নাজ নাই । অনেক সময় কোচিং এ বসে থেকেও দেখে নাজু আসছে না। তাহলে কোথায় গেল । নাদিয়া বাসায় এসে বড় বোন নাজু কে নাদিয়া বলে নাজ কোচিং এ যায় নাই । গত এক মাসে মাত্র ১১ বার গিয়েছে ।
রইস মিয়া কে ডেকে নাজু বলে মামা দেখুন আপনার আদরের ভাগ্নি । মা যদি আজ থাকত তাহলে কি অবস্তা হত । আমি পড়ের সংসার করি । কোচিং এ না যেয়ে কোথায়
যায় । মা বাবা আমার জন্য কি রেখে গেছে ।
রইস মিয়া বলল চিন্তা করিস না দেখি পাগল ভাইগ্না কি বলে । পুকুর পারে এসে রইস মিয়া বলে – ভাইগ্না খবর একটা । পাগল বলে মামা নাদিয়া কে দরকার । নাদিয়া এসে বলে এই যে আমি !
—- কি পাইছ !
—- না পাই নাই ।
— তা নিজেও বি এ ভর্তি হলে না। বোন কোথায় যায় সেই খবর ও রাখ না। তোমার মত মেয়ে আয়নার সামনেও যাও না। যদি একটু আয়নার সামনে যেতে তাহলে বুঝতে
বোন কেন কোচিং থেকে দেরী করে ।। হাতের কাজ শেষ করি । আমার জন্য কি চা হবে । নাদিয়া পাগলের কথায় একটু রাগ করে বলে ।
—ভাইয়া চা তো হবে । কাউকে উপদেশ দেয়া সহজ কিন্তু নিজে পালন করা কঠিন ।
— আচ্ছা আমি কি পালন করি না। একটা উধারন দে ।।
— ভাইয়া এই যে সবাই বলে তোমার ভাইয়ের নাম কি ? আমি বলতে পারি না।
— ঠিক আছে যারা নাম জানতে চায় বলবি আমার কাছে আসতে ।
আপনার কাছে আসতে বলা আর পাবনা যাওয়া সমান কথা । পাগল তার কথা শুনে
হাসতে থাকে ।
সন্ধ্যা সময় নাজ বাসায় আসে । খুব হাসি খুশি । পাগল বসে একটা পুথি বই পড়ছে ।
বাসার সবাই নাজের দিকে জানি কেমন কেমন করে দেখছে । এমন সময় শিলা এসে বলল জিনিয়াস মামা আমার হাসপাতাল থেকে একজন সেবিকা অ্যান্টি এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে ।
পাগল নাদিয়া আর নাজ কে সাথে নিয়ে বসার ঘরে গিয়ে দেখে সেবিকা বসা ।।
সেবিকা বলল – আমার বিশ্বাস ছিল যে আমি আপনাকে এই বাসায় পাব ।
— পাগল বলল বিশ্বাস যদি মন থেকে করা হয় তাহলে তার ফল পাওয়া যায় ।
— আমি একটা খুবেই গোপন বিষয় নিয়ে আপনার কাছে আসছি । ঐ দিনের ঐ
কথা গুলো আমার খুব ভাল লেগেছিল । মনে হচ্ছিল আপনি পারবেন ।
— দেখুন ভাল কিছু হলে সাহায্যের জন্য স্রষ্টার দয়া অপরিসীম ।।
— আমি কথা গুলো গোপনে বলতে চাই ।
— দেখুন এরা আমার বোন আপনার কথা যদি এরা শুনে তা হবে আমার কাছে বলার
সমান । আর জিবন কি তাই তারা জানবে । আপনি বলুন ।।