সেলিনা জাহান প্রিয়ার ধারাবাহিক গল্প: ‘অ-মানব’-(৩৭ তম পর্ব)
অ-মানব-৩৭-তম-পর্ব
——————— সেলিনা জাহান প্রিয়া
নিজ টেবিলে জেলার চুপ করে বসে রইল। বার বার চিঠিটা পড়তে লাগলো । চিঠির বাহক কে বলল মাস্টার সাব আপনি কি এই চিঠির কথা বিশ্বাস করেন ।
—- মাস্টার একটু হেসে বলল দেখুন সত্য মিথ্যা দেখার মালিক আল্লাহ্ । তবে এই যে চিঠি টা আমার হাতে লেখাইছে সে খুব ভাল মহিলা । এই জিবনে আর বিবাহ করে নাই। একটা মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে জীবন কাঁটিয়ে দিয়েছে ।
—- তাহলে কি আপনি বিশ্বাস করেন এই চিঠি সত্য ।
—- দেখুন চিঠি যে সত্য তা আপনার চোখের পানি দেখে বুঝা যায়। মানুষ খুব সত্যের মুখা মুখি হলে এমন করে কাঁদে ।। আমাকে চিঠি তা দেন আমি উনাকে কথা দিয়েছি চিঠি টা পড়া হলে ছিরে ফেলতে হবে। না হয় আপনার সম্মান আর আমার ওয়াদা ঠিক রাখতে হবে । জেলার তার হাতে চিঠিটা দেয় মাস্টার সাব চিঠিটা খুব ভাল করে ছিরে ফেলে ।
জেলার সাহেব মাস্টার কে নিয়ে একটা ভাল হোটেলে যায় । খুব ভাল করে তাকে খাওয়ায় । তার পর বলে পারুলের মেয়ের নাম কি ?
—- স্যার মেয়েটার নাম কাজল । কিন্তু গায়ের রং ফর্সা । দেখতে মনে হয় মেম সাব । মেয়েটা বিয়ে দিয়েছিল যে ছেলের কাছে । ছেলেটা ভাল ছিল । ঐ মেম্বার ছেলেটাকে নষ্ট করেছে । কাজলের জামাইকে মেম্বার যত নষ্ট বুদ্ধি দেয় ।
—- আচ্ছা মাস্টার সাব আপনি তো সত্য বাদী মানুষ । এই টাকা গুলো পারুল কে দিবেন । বলবেন তার মেয়ে তার কাছে সম্মান নিয়ে যাবে । আর ঠিকানা টা লিখে দিয়ে যান পারুলের । আচ্ছা কাজলের ছেলে না মেয়ে ।
—— কাজলের চাঁদের মত সুন্দর একটা ছেলে । জামাই তাকে ছেড়ে দিয়েছে । গ্রামের মানুষ তো রাগের কথায় তিন তালাক দিয়েছে । চেঙরা ছেলে রাগের মাথায় কিনা কি বলেছে? তাই মেম্বার রাজ্জাক বলল তালাক হয়েছে । সব কিছুতেই ঐ রাজ্জাক মেম্বার দায়ী । সে কাজল কে আগে বিয়ে করতে চাইছিল । কাজল
বলল ঐ বেটা কে বিয়ে করা যায় । তার তো আগের বউ আছে। কেন রাজ্জাক মেম্বারের তিন নাম্বার বউ হল না। তাই কাজলের কপালে এত কষ্ট ।
—– কাজলের জামাই থাকে কোথায় ।
—– নেত্রকোনা শহরে একটা চাউলের মিলে কেরানির কাজ করে । ছেলেটা এখন কাজল কাজল করে । একদিন আসছিল জেলে কাজল কে দেখতে । কাজল তার সাথে দেখা করে নাই । কাজল বলল যে মানুষের কথায় বউ কে তালাক দেয় । তার সাথে আমার কোন দেখা নাই ।
—— আচ্ছা মাস্টার সাহেব চলুন আমার সাথে । জেলার সাহেব মার্কেট থেকে বাচ্চার জন্য অনেক গুলো কাপড় আর খাবার কিনে দিল । মাস্টার ১১ টায় বিদায় নিয়ে চলে গেল । জেলার উকিলের কাছে গেল । উকিলের সাথে কথা বলে । জাবিনের ব্যবস্তা করতে যা যা করা দরকার করার কথা বলে চলে আসে অফিসে।
জেলার চিন্তায় পরে গেল । কি করবে । একজন কে ডেকে বলল মহিলা কয়েদি আছে নাম কাজল তাকে আমার অফিসে নিয়ে এসো । নিজ টেবিলে চুপ চাপ বসে আছে। মনের অবস্তা খারাপ । এমন সময় বাসা থেকে ফোন।
—– হ্যালো কি করছ ।
—— আমি আর কি চোর ডাকাতের সেবা করি
——- সব জেলার তাই করে ।।
——- দুপুরের খাবার কি কি দিব ?
——- শুনো দুই জনের খাবার দিও ।
——– আরেক জন কে?
——– ধরে নাও আমার আপন জন কেউ ।
——– তোমার জাতে কি চোর ডাকাত আছে ?
——— আরে আমার জাতে আছে বলেই তো খাবার পাঠাবে ।
——— আচ্ছা খাবার দিচ্ছি কিন্তু তোমার কি মন ভাল না। কণ্ঠ টা জানি কেমন কেমন লাগছে । সকালের বিষয়টা ভুলে যাও । আমি এক হুজুরের সাথে কথা বলেছি । উনি বলেছে এই সব পাগলের কথা বিশ্বাস করলে ইমান নষ্ট হবে। তার চেয়ে ভাল উনি বলেছে কিছু টাকা দান করে দিতে মসজিদে । আর একটা মিলাদ দিতে । আমি বলে দিয়েছি কাল সব ব্যবস্তা করব ।।
—– আচ্ছা ঠিক আছে যা ভাল হয় কর । কিন্তু পাগল কেন জানি মনে সত্য বলেছে ।
—— দেখ ফজলামি কর না।আর ফান করতে ভাল লাগে না। পাগলের বেটা কে এবার পেলে হয় … ।
—— মনে করে দু জনের ভাল খাবার দিও । জেলার ফোন রাখে । এমন সময় একটা মেয়ে এসে সামনে দাড়ায় । জেলার কে সালাম দিয়ে বলে স্যার আমি তো কোন অন্যায় করি না । আমাকে কেন ডাকছেন ? স্যার আমাকে মাপ করে দেন সকালের খাবার খাই নাই । আমার পেটের ছেলেটা জানি কি খাইছে এই চিন্তা করে । কাজল ভয়ে শেষ । জেলখানার সবার বড় স্যার তাকে ডাকছে এই ভয়ে সে শেষ । কাজলের পা কাঁপছে । দুই জন সেপাই দাঁড়িয়ে জেলারের সামনে । জেলার বলল আরে মা তুমি ভয় পাচ্ছ কেন । আমি তোমাকে ডাকছি অন্য কারনে । তুমি ভয় পেও না। নাও বস । কাজল জেলারের পাশে মাটিতে বসে দুই হাত তুলে জেলারের দিকে ক্ষমা চাওয়ার মত করে চেয়ে আছে । কাজলের চোখে পানি পড়ছে ভয়ে ।
—- জেলার বলল আরে মা তুমি নিচে বসলে কেন এই চেয়ারে বস । জেলার হাত ধরে নিয়ে চেয়ারে বসাইলো। তুমি কান্না করো না মা । জেলার তার চেয়ারের তোয়ালে দিল মুখ মুছার জন্য । আর বলল আশা করি মা তুমি আগামী কাল জামিন পাবে । এই কে আছ কিছু ফল কেটে দাও । আর ওকে একটা ভাল রুমে থাকতে দাও । খুব সুন্দর করে ভাল বিছানা দাও । আর সবাইকে বলে দিলাম আজ থেকে মনে করবে ও আমার মেয়ে । আমার মেয়ে হিসাবে তোমরা তাকে দেখবে । যে কয় দিন জেলে আছে ।
—– কাজল বলল স্যার আপনি কেন আমার জন্য এত কিছু করবেন ?
—– থাক সে কথা মা । তোমার কথা বল । তোমার কথা শুনি ।
—— আমার কি কথা স্যার বলব ? আমার মা আর বাচ্চা ছাড়া দুনিয়ায় কেউ নাই। জন্মের পরে বাপ কে দেখি নাই। নানা বাড়িতে বড় হইছি । মায়ে অনেক কষ্ট করে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ায় । নাইনে উঠলে রাজ্জাক মেম্বার খালি রাস্তায় জালায় । পরে মা একটা ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দেয় । কিন্তু রাজ্জাক মেম্বার আমার জামাই রে খারাপ বানায় । একদিন কি জানি নেশা পানি খাওয়ে দেয় । সেই দিন বলে ৫০ হজার টাকা লাগবে । এত টাকা আমরা গরীব মানুষ কোথায় পাই । সবার সামনে আমাকে নেশা করা অবস্তায় আমাকে তালাক দেয় । গ্রামের বিচারে বলে আগে রাজ্জাক মেম্বারের বিয়ে করতে হবে । তার পর রাজ্জাক মেম্বার তালাক দিলে আমি আগের স্বামীর কাছে যেতে পারব । পরে আমি বলছি । আমি কাউকে বিয়ে করব না। মায়ের সাথে রাইস মিলে কাজে যাই । রাইস মিলের মহাজন তার বাড়িতে আমাকে যেতে বলে তার বউ নাকি অসুক । আমি সেই খানে গেলে দেখি মেম্বার । আমি এক দৌড়ে চলে আসি । রাইস মিলের মালিক আমাকে একটা মিথ্যা চুরির মামলা দেয়। আমি নাকি তার ঘরে থেকে ১০ হজার টাকা আর তার বউয়ের কানের দুল চুড়ি করেছি । কত বড় মিথ্যা কথা । বলে আমার নামে স্যার । কাজল জেলারের দিকে তাকায় দেখে জেলার তার কথা শুনছে আর কাঁদছে ।
কাজল বলে স্যার আপনে কাদছেন কেন ?
—- এমনেই কাদছি মা। একটু পরে তুমি আরও কাদবে অনেক খুশিতে ।
—– স্যার কি বলেন ? মানুষ কি খুশিতে কান্না করে ।
—– আচ্ছা তোমার বাবার নাম কি ?
—— স্যার আমার মা বলে আমার বাবার নাম মঞ্জু ?
——- তোমার বাবা কথা আর কি কি জান ।
——- মা বলেছে বাবা নাকি বিদেশে পড়তে গিয়ে হারিয়ে গেছে ।
——তাহলে তোমার বাবার নাম মঞ্জু ।
—— জি স্যার । আমার মা বলেছে । কিন্তু কোন দিন দেখা হয় নাই ।
—— বাবা কে দেখলে তুমি কি করবে ?
——- বাবা কে দেখলে আমি তাকে জরিয়ে ধরে বলব । আমাকে যেন আমার ছেলের কাছে নিয়ে যায় স্যার ।
—– কাজল কান্না কর না। কালই তোমাকে তোমার ছেলের কাছে নিয়ে যাব ।
—— স্যার বলেন কি? আমার উকিল বলছে জামিন পেতে আরও ১০ হাজার টাকা লাগবে । না হয় জামিন হবে না। আমার মায়ের পক্ষে এত টাকা দেয়া সম্ভব না!!
—— আচ্ছা বাদ দাও এই চিন্তা তোমার না। এই সব খাবার খাও । এই খানে কে আছ দুই মগ চা দিয়ে যাও ।
একজন এসে বলল স্যার উকিল সাব এসেছে আপনি নাকি আসতে বলেছেন।
—- কোথায় ভিতরে পাঠাও ।
—– স্যার সালাম , সব কিছু তুলে নিয়ে এসেছি । সামান্য চুরি কেইস । আজ বিকালেই জামিন করা সম্ভব । মেয়েটার কয়টা সাক্ষর লাগবে । আর জামিন দার কে হবে ?
—– উকিল সাব এই মেয়ে সাক্ষর নেন । মা তুমি পেপার গুলো সাইন কর । আমি জামিন দার ।
—– বলেন কি স্যার । কি হয় এই মেয়ে আপনার ?
—– উকিল সাহেব বাবার নাম কি মেয়েটার ।
—— মঞ্জু মিয়া ।
—— ঐ খানে লিখেন আজাহারুল ইসলাম মঞ্জু মিয়া ।
—— স্যার এটা তো আপনার নাম । হ্যাঁ উকিল সাহেব ও আমার মেয়ে । ছোট বেলায় হারিয়ে যায় । কাজল জেলারের মুখে দিকে তাকিয়ে বলে আপনি কি বলছেন স্যার । জেলার মেয়ের কাছে গিয়ে বলে । আর স্যার বলিস না। আমি তোর বাবা । এই বলে মেয়ে দিকে তাকায়ে বলে মা আমাকে তুই বাবা বলে ডাক দে । আল্লাহ্ হয়ত আর এই জন্যই আমাকে কোন সন্তান দেই নাই। যে আমি আমার একমাত্র সন্তানের খুঁজ রাখি নাই ।
কাজল জেলারের দিকে চেয়ে বলে আমার বাবার নাকি বুকের মাঝ খানে একটা কালো জন্ম দাগ আছে । জেলার তার সার্ট খুলে বলে এই দেখ মা। কাজল বাবা বলে বুকে জরিয়ে ধরে ।। উকিল বলে স্যার তিনটার মধ্যে আমি জামিনের কাগজ নিয়ে চলে আসব । আপনি একটু ফোন করবেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব কে ? আল্লাহ্ আপনার মেয়ে কে শান্তি দিক । উকিল বলল মা কাজল কোন চিন্তা কর না। সারা জেল খানায় খবর পৌঁছে গেল । জেলার সাহেবের হারিয়ে যাওয়া মেয়ে পাওয়া গেছে । জেলার নিঃসন্তান না। জেলার সাহেব স্ত্রীর কাছে ও কিছু সময়ের মধ্যে খবর চলে যায় । জেলারের স্ত্রী বলে কি ভাবে তার মেয়ে হয় । কবে তার মেয়ে হারিয়ে ছিল । আচ্ছা আমি আসছি । খাবার নিয়ে জেলার সাহেবের চেম্বারে আসে মিসেস জেলার ।।
—- অবাক হয়ে দেখে জেলার সাব কান্না করছে । একটা মেয়ে কান্না করছে ।
—- মঞ্জু আমি কি শুনলাম ?
কাজল চেয়ার থেকে উঠে দাড়ায় । জেলার বলে এই মেয়েটা আমার মেয়ে । আমি তোমাকে সব পরে বলছি । আগে বল তুমি খুশি হয়েছ কি না।
—- তুমি কি বল আমি খুশি হব না। মানে তোমার মেয়ে কি আমার মেয়ে না।
—– জেলার বলল মা কাজল এটা তোমার মা। কাজল এসে পা ছুঁয়ে সালাম করে ।
—– জেলার তার স্ত্রী কে কাজলের বর্তমান অবস্তার কথা বলে । আর বলে একটু একটা ডায়রি পরে জানতে চেয়ে ছিলে পারুল কে। এ হল পারুলের মেয়ে ।
—– মুক্তা বলল আমাকে আর বলতে হবে না। ওর বাচ্চা এখন কোথায় জামিনের কাগজ আসলে ওকে নিয়ে চল রাতেই আমারা যাই । আর একটা কথা মঞ্জু আমি তোমাকে মাপ করে দিব । কারন আমি আজ মা ডাক শুনলাম কিন্তু তুমি রাজ্জাক মেম্বার আর রাইস মিলের মালিক কে ছারবা না। রাত ১০ টা গ্রামের রাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি আসে । পারুলের বাড়ির সামনে এসে থামে । কাজল গাড়ি থেকে নামে তার ছেলে কে কুলে তুলে নেয় । পারুল আর মঞ্জুর সামনে আসে না। মুক্তা পারুলের কাছে যায় । পারুল বলে আপনি হয়ত মনে
অনেক কষ্ট পেয়েছেন বোন । মুক্তা পারুল কে বুকে জরিয়ে বলে বোন তুমি আজ কত বছর কত বড় কষ্ট বুকে চেপে বেঁচে আছ । আজ থেকে তোমার সকল কষ্ট আমার । আমারা দু জন মিলে কাজলের ছেলে দেখে রাখব । কাজল আবার লিখা পড়া করবে । একজন এসে বলল স্যার মেম্বার আর মেইল মালিক এরেস্ট । কাল তাদের কোটে চালান হবে বাকিটা আপনার জেলে । সারা রাত বাবা আর মেয়ের কত কথা । জেলার নাতি
কুলে নিয়ে বলে মুক্তা ওকে নাও । আমার সকালে অনেক কাজ । এখন রাত ৪ টা । পারুল বলল কাজল মা তুমি তোমার বাবার সাথে যাও । তোমার বাবা এই এত গরমে ঘুনাতে পারবে না। কাজলের ছেলে কাজল আর মুক্তা কে নিয়ে ভোরে ময়মনসিংহ রওনা দেয় । মুক্তা বলে পারু আপা কাজল যখন মনে চায় চলে আসবে । আপনি চিন্তা করবেন না। খুব সকাল গাড়িটা সম্মুগঞ্জ ব্রিজে উপরে উঠে । এমন সময় একটা হাত গাড়ির সামনে । একজন মানুষ এসে দাড়ায়ে বলে
—– স্যার সালাম আমি অ-মানব । আমার পাওনা টাকা টা ।
চলমান ——–
অ-মানব-প্রথম পর্ব অ-মানব-দ্বিতীয় পর্ব অ-মানব-তৃতীয় পর্ব অ-মানব-চতুর্থ পর্ব