জাতপাতের অবসানকল্পে “বৈষম্য বিলোপ আইন-২০১৪” পাস করা হোক
ঐতিহাসিক ২১ মার্চ আজ। আন্তর্জাতিক বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবস (International day for the elimination of racial discrimination)। বৈষম্যহীন ও জাতপাতের মতো অভিশপ্ত সামাজিক ব্যধিমুক্ত সমাজ গড়ার অনুপ্রেরণার দিন আজ। কলঙ্কমুক্ত মানবিক সমাজের স্বপ্ন দেখার দিন আজ। যেখানে উঁচু-নিচু, ফর্সা-কালো, পৃথিবীর তাবৎ ধর্ম-বর্ণ-জাতি-শ্রেণি নির্বিশেষে সর্বত্র সমতা ও সম্প্রীতি বিরাজ করবে। প্রতিবছরের মত এই বছরও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই দিনটিকে যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হচ্ছে।
এই মহান দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়: দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভ্যালিতে সাধারণ জনগণ জাতিগত বর্ণ বৈষম্য বিল পাশের বিরুদ্ধে ১৯৬০ সালে একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করে এবং পুলিশ বিনা উস্কানিতে মিছিলে গুলি করে ৬৯ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। মর্মান্তিক এই ঘটনাকে উল্লেখ করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৬৬ সালে সকল দেশের সকল মানুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য কমানোর জন্য সকল দেশের প্রতি জোরালোভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ জাতিগত বৈষম্য কমানোর জন্য সংহতি সপ্তাহ ঘোষণাসহ প্রতিবছর ২১ মার্চকে আন্তর্জাতিক বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবস ঘোষণা করে। সেই থেকে ২১ মার্চ সারা বিশে^ একযোগে এই দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘আন্তর্জাতিক বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। এই দিবস পালনের সময়কাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ বৈষম্য আইন বিলোপ ঘোষণা করা হয় যার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত বর্ণবাদ আইন এবং চর্চা বাতিল করতে বাধ্য হয়। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয়ভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও প্রায় সকল প্রকার ধর্ম চর্চা, ব্যক্তি বিশেষের মননে ও চিন্তায়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বর্ণবাদ প্রথা বিদ্যমান থাকায় এখনও মানুষ বৈষম্য থেকে মুক্তি পায়নি।
বর্ণবাদ হলো সেই দৃষ্টিভঙ্গি, চর্চা এবং ক্রিয়াকলাপ যেখানে বিশ্বাস করা হয় যে: মানুষ বৈজ্ঞানিকভাবেই অনেকগুলো গোষ্ঠীতে (races) বিভক্ত এবং একই সাথে বিশ্বাস করা হয় কোন কোন গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য উঁচু অথবা নিচু; কিংবা তার উপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী; অথবা বেশি যোগ্য কিংবা অযোগ্য। বর্ণবাদের সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করাটা কঠিন। গবেষকদের মতে, বর্ণবাদ কখোনো গায়ের চামড়ার রং দিয়ে হতে পারে, কখোনো আঞ্চলিকতা দিয়ে হতে পারে, কখোনো গোত্র দিয়ে হতে পারে, কখোনো বর্ণ (caste) দিয়ে হতে পারে। কিছু কিছু সংজ্ঞা অনুসারে, কোনো মানুষের আচরণ যদি কখোনো তার জাতি বা বর্ণ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, সেটি অন্য কারো জন্য ক্ষতিকর না হলেও তাকে বর্ণবাদ বলা হবে। অন্যান্য সংজ্ঞায় শুধুমাত্র বর্ণবাদ দিয়ে প্রভাবিত হয়ে শোষণ এবং অত্যাচার করাই বর্ণবাদ।
যদিও কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘মানুষ জাতি’ কবিতায় বলে গেছেন- “কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভিতরে সবারই সমান রাঙা”। তবুও সাদা আর কালোতে, জাতি আর ধর্মের নানা বর্ণবাদী বৈষম্যে নিপীড়িত হয়েছেন, সহিংসতায় প্রাণ দিয়েছেন অগণিত মানুষ। আবার এই বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামেও প্রাণ দিতে হয়েছে অগণিত মানুষকে। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশেই জন্ম ও পেশাগত কারনে অস্পৃশ্যতার চর্চা ও অমানবিক আচরণের দৃষ্টান্ত অহরহ। বাংলাদেশে এই একবিংশ শতাব্দীতেও দলিত ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীরা প্রতিনিয়ত অস্পৃশ্যতার শিকার হন বৃহত্তর সমাজের কাছ থেকে। খাবারের হোটেল থেকে শুরু করে উপাসনালয়, সেলুনসহ অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হন তারা। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই তাদের জীবন যাপন করতে হয়, ‘পাবলিক স্পেস’ ব্যবহারের সুযোগ তারা পাননা। এই বিচ্ছিন্নতা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানসিক। এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর এ জন্য অতি সত্ত্বর বৈষম্য বিলোপ আইন সংসদে পাঠাতে হবে এবং তা পাস করার ব্যাবস্থা করতে হবে।
দেশের অনগ্রসর দলিত, হরিজন, তৃতীয় লিঙ্গসহ পিছিয়েপড়া তথাকথিত অস্পৃশ্য নাগরিকদের প্রতি সকল ধরণের বৈষম্য বিলোপে আইন প্রণয়নের দাবি দীর্ঘদিনের। ‘অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়নের জন্য ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের আইন মন্ত্রণালয় “বৈষম্য বিলোপ আইন ২০১৪” খসড়া তৈরি করেছে যা এখনও চূড়ান্তভাবে আইন আকারে অনুমোদিত হয়নি। এটি কার্যকর হলে বৈষম্যের শিকার ব্যক্তি মামলা করতে পারবেন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অবহেলিত মানুষগুলো উপকৃত হবেন। অবহেলিত জনগোষ্ঠীর প্রায় এক কোটি মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে। এতে বৈষম্য বিলোপ বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্য করার অপরাধে নানা দন্ডের সুপারিশ রয়েছে। সুপারিশে বলা হয়, সরকার প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক ‘বৈষম্য বিলোপ বিশেষ আদালত’ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে জেলা জজ বা দায়রা জজকে এ আদালতের বিচারক নিযুক্ত করবে। অভিযোগ গঠনের তারিখ থেকে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করতে হবে। এটি কার্যকর হলে বৈষম্যের শিকার ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করার অধিকারী হবেন। খসড়া আইনে বলা আছে; ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, শারীরিক, মানুষিক ও লৈঙ্গিক প্রতিবন্ধিতা এবং কথিত অস্পৃশ্যতার অজুহাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বৈষম্যমূলক কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। প্রস্তাবিত খসড়ায় অবহেলিত জনগোষ্ঠির লোকদের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা লাভে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হলে প্রথমবার ২ বছরের কারাদন্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড দিতে পারবেন আদালত। পরে প্রতিবারের জন্য ৫ বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড দেওয়া যাবে। শিক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণে বাধা; কর্মলাভে বাধা, জনস্থল, সার্বজনীন উৎসব, নিজ উপাসানালয়ে প্রবেশ ও অংশগ্রহণে বাধা প্রভৃতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। কিন্তু খসড়াটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হলেও চার বছরে আর কোনো অগ্রগতি নেই। সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তি আইনটি প্রণয়নে নানা সময়ে নানা কথা বললেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। চার বছর আগে খসড়াটি প্রস্তুত করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি না হওয়াটা দুঃখজনক। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন ও সনদ বাস্তবায়নেও বৈষম্য বিলোপে আইন করাটা জরুরি। এ বিষয়ে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আরো আন্তরিক হতে হবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি যখন রাষ্ট্রক্ষমতায়, তখন সেটা আমাদের দাবী পূরণের জন্য প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেয় বহুগুন।
বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে ভাষা-সংস্কৃতি-পেশার বৈচিত্র্যকে ধারণ করে। এবং তা স্বীকৃতি দেওয়ার নজির বাহবা পাবার যোগ্যও বটে। বৈচিত্রের বৈভব ও বহুত্ববাদের এই দেশে সবকিছুরই ভিন্নতা পাবে এক অনন্য মর্যাদা, এমনটাই প্রত্যাশিত। আন্তর্জাতিক বর্ণ বৈষম্য দিবসে আজ আমাদের সকলের অঙ্গীকার হোক দেশের সকল জাতি ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পেশা, লিঙ্গভিত্তিক বিদ্যমান বৈষম্য বিলোপের মাধ্যমে একটি বহুত্ববাদী সমাজ গঠনে অবদান রাখার। যেখানে দেশের সকল মানুষ সমঅধিকারের ভিত্তিতে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে। কন্ঠে কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হোক: “জাতপাত নিপাত যাক, মানবতা মুক্তি পাক”।
লেখক: শিপন রবিদাস প্রাণকৃষ্ণ, মহাসচিব, বাংলাদেশ রবিদাস ফোরাম (বিআরএফ), কেন্দ্রীয় কমিটি, ঢাকা-১২০৩।