তাজউদ্দীন আহমদের ৯১তম জন্মবার্ষিকী আজ
মাহবুব এইচ শাহীনঃ তাজউদ্দীন আহমদ (জুলাই ২৩, ১৯২৫ – নভেম্বর ৩, ১৯৭৫) বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম রূপকার বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের ৯১তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৌলভি মুহাম্মদ ইয়াসিন খান এবং মাতা মেহেরুন্নেসা খানম। এদেশের রাজনীতিতে মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা ও আদর্শের এক অনন্য প্রতীক তাজউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা।
সবুজ শ্যামলের অবগাহে, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বতীরবর্তী ঐতিহাসিক গ্রামের নাম দরদরিয়া। খাঁন ফখরুদ্দীন চতুর্দশ শতকের গোড়ার দিকে দিল্লি থেকে পূর্ব বাংলার ময়মনসিংহের নিগুয়ারিতে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর ৬ষ্ঠ উত্তর পুরুষ ইব্রাহিম খাঁন দরদরিয়া বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পুত্র মৌলভী মুহাম্মদ ইয়াছিন খাঁনের চার ছেলে ছয় কন্যা। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় পিতা মৌলভী মুহাম্মদ ইয়াছিন খাঁনের কাছে মক্তবে আরবি শিক্ষার মাধ্যমে। একই সময় তিনি ভর্তি হন বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরবর্তী ভূলেশ্বর প্রাইমারি স্কুলে। প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন প্রথম হয়ে। এ জন্য স্কুল থেকে জীবনের প্রথম ১০ পয়সা মূল্যমানের পুরস্কারও লাভ করেন। দেড় পয়সার কালির দোয়াত ও সাড়ে আট পয়সার একটি কলম। চতুর্থ শ্রেণীতে উঠে তিনি ভর্তি হন গ্রামের বাড়ি হতে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে কাপাসিয়া মাইনর ইংরেজি স্কুলে। কাপাসিয়ায় যাতায়াত বাইসাইকেল বা পায়ে হেঁটে। কাপাসিয়া থেকে কালীগঞ্জের সেন্ট নিকোলাস ইন্সস্টিটিউশনে ভর্তি করা হয়। এখানেও তাঁর মেধা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই স্কুলের শিক্ষকদের পরামর্শে ১৯৪০ সালে তিনি ভর্তি হন ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাইস্কুলে। পরবর্তীতে সেন্ট গেগ্ররীস হাইস্কুলে। স্কুলে বরাবরই প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। ষষ্ঠ শ্রেণীর এমই স্কলারশিপ পরীক্ষায় তিনি ঢাকা জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে দ্বাদশ স্থানের ও ১৯৪৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে চতুর্থ স্থানের অধিকারী হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪২ সালে তিনি সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং নেন। স্কুলে ছাত্র থাকাবস্থায় পুরাতন ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় কয়েক মাস নিয়মিত রাতের বেলায় নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিরাতের জন্য তখন সম্মানী পেতেন ৮ আনা। কিশোর বয়সেই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কণ্ঠ ছিল সোচ্চার। নানা বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক পরিবেশে কেটেছে কিশোর, যৌবনকাল।
মানবতার সেবায় নিবেদিত স্কাউটিংয়ের সঙ্গেও সম্পৃক্ত হন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। স্কুলজীবন থেকে সমাজ ও মানব সেবায় নিয়োজিত তথা প্রগতিশীল রাজনীতি ও আন্দোলনের সঙ্গে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন বিধায় শিক্ষাজীবনে মাঝে মাঝে বিঘ¥ ঘটে। পরীক্ষা দিতে হয়েছে অনিয়মিত। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফন্টের প্রার্থী হিসেবে অংশ নেওয়ার কারণে এমএ পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি। এমএলএ নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। জেলে বন্দী থাকাবস্থায় এলএলবি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।
১৯৫৯ সালে এপ্রিলের ২৬ তারিখে সৈয়দা জোহরা খাতুনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিন কন্যা ও এক ছেলে। তাঁর স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। তাঁদের ৪ সন্তান রয়েছে। বড় মেয়ে শারমিন আহমদ রিতি; মেজো মেয়ে বিশিষ্ট লেখিকা ও কলামিস্ট এবং গাজীপুর-৪ আসনের সাংসদ ছিলেন সিমিন হোসেন রিমি এবং কনিষ্ঠা মেয়ে মাহজাবিন আহমদ মিমি। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ গাজীপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে আসীন অবস্থায় পদত্যাগ করেন ও ৭ জুলাই, ২০১২ইং তারিখে তাঁর আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়।
১৯৪৩ সালে তাজউদ্দীন আহমদ মুসলিম লীগের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হন। ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় মুসলীম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তার সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন শুরু। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৪৮-এর ১১ এবং ১৩ মার্চ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ধর্মঘট-কর্মসূচী ও বৈঠক করেন। ২৪ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতারাসহ তিনি বৈঠক করেন। তিনি ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ঢাকা জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের (১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় আওয়ামী লীগ) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদককে পরাজিত করে পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে যে সর্বদলীয় নেতৃসম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন, সেই সম্মেলনে শেখ মুজিবের সাথে তিনিও যোগদান করেন। সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে তাজউদ্দীন ছিলেন অন্যতম সদস্য। এই বছরের ৮ মে তিনি দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার হন। ১৯৬৮ সালে জেলে থাকা অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে পুণঃনির্বাচিত হন। ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯৭০ সালে তৃতীয় বারের মতো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। এই বছরের সাধারণ নির্বাচনের জন্য গঠিত আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
তাজউদ্দীন আহমদের উন্নত নীতিবোধ, দূরদর্শিতা ও যুক্তির সংস্পর্শে এসে “অতি ক্ষমতাধর মানুষও দুর্বল ও নিষ্প্রভ হয়ে যেত।” আর তাই তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন পাকিস্তানীদের আতংক স্বরূপ । ১৯৭১ সালে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠককালীন সময়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো দুজন সহকর্মীর সঙ্গে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠেন, “আলোচনা বৈঠকে মুজিবকে আমি ভয় পাই না । ইমোশনাল অ্যাপ্রোচে মুজিবকে কাবু করা যায় কিন্তু তাঁর পেছনে ফাইল বগলে চুপচাপ যে নটোরিয়াস লোকটি বসে থাকে তাঁকে কাবু করা শক্ত। দিস তাজউদ্দীন, আই টেল ইউ, উইল বি ইউর মেইন প্রবলেম” (আমি তোমাদের বলছি এই তাজউদ্দীনই হবে তোমাদের জন্য বড় সমস্যা)।
বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও তাজউদ্দীন আহমদ নিজের প্রতিফলনের জন্য আগ্রহী ছিলেন না । তিনি ছিলেন সর্বদা প্রচার বিমুখ । সহকর্মী আরহাম সিদ্দিক বলেন, তাজউদ্দীন আহমদ স্টেটমেন্টের ব্যাপারে বলতেন, “আমার প্রেসিডেন্টের যেটা যাবে সেটা যাবে সবচেয়ে ভালো, জেনারেল সেক্রেটারির যেটা যাবে সেইটা আরেকটু কম (মানগত) যেতে হবে” । আরহাম সিদ্দিকি বলেন, “একটা লোক নিজের প্রতিফলন বেশি চায়, কিন্তু এখানে তো উনি নিজের পার্সোনালিটি সেটাকে উনি আরেকজনের নিচে রাখার চেষ্টা করেছেন”। তোফায়েল আহমেদের ভাষায়, তাজউদ্দীন আহমদ তোফায়েল আহমেদকে বলেছিলেন, “তোফায়েল; জীবনে যা অর্জন করেছি সব মুজিব ভাইয়ের খাতায় জমা দিয়েছি”।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তাজউদ্দীনের ভাষায়, ‘আমি সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা হলো : একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য কাজ শুরু করা।
একটি লুঙ্গি এবং ফতুয়া পরা অবস্থায় কাঁধে একটি ব্যাগ নিয়ে তাৎক্ষণিক তিনি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরেন। যাবার সময় পরিবার পরিজনকে কিছুই বলে যেতে পারেন নি। তাই পরবর্তীতে একটি চিরকুট পাঠিয়েছিলেন সহধর্মিণী জোহরা তাজউদ্দীনের নিকট। এতে লিখা ছিল, “খুব তাড়াতাড়ি করে চলে আসার সময় তোমাদের কাউকে কিছু বলে আসতে পারিনি। আমি চলে গেলাম। তোমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও। কবে দেখা হবে জানি না – – – মুক্তির পর”। চিরকুটের নিচে লিখা ছিল “দোলন চাপা” (ছদ্মনাম)। তাজউদ্দিন আহমদ আত্মগোপন করেন এবং যুদ্ধকে সংগঠিত করার জন্য সীমান্তের দিকে যাত্রা করেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পদার্পণ করেন। সীমান্তে পৌঁছে তাজউদ্দিন দেখেন যে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনাদের সমর্থনে ভারত সরকার থেকে নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ভারতীয় সামরিক বাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কিছুই করার নেই। মুক্তিফৌজ গঠনের ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদ বিএসএফ এর সাহায্য চাইলে তৎকালীন বিএসএফ প্রধান তাকে বলেন যে মুক্তি সেনা ট্রেনিং এবং অস্ত্র প্রদান সময় সাপেক্ষ কাজ। তিনি আরো বলেন যে ট্রেনিং বিষয়ে তখন পর্যন্ত ভারত সরকারের কোন নির্দেশ না থাকায় তিনি মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং ও অস্ত্র দিতে পারবেন না। কেএফ রুস্তামজী দিল্লির ঊর্ধ্বতন এর সাথে যোগাযোগ করলে তাকে জানানো হয় তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে দিল্লি চলে আসার জন্য। উদ্দেশ্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং তাজউদ্দিন আহমদের বৈঠক। দিল্লিতে যাবার পর ভারত সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হন যে, তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের আগে ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদের কয়েক দফা বৈঠক হয় এবং তিনি তাদের বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার জন্য যেসব সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন তা বুঝিয়ে বলেন। এসময় তিনি উপলব্ধি করেন যে আওয়ামী লীগের একজন নেতা হিসেবে তিনি যদি সাক্ষাৎ করেন তবে সামান্য সহানুভূতি ও সমবেদনা ছাড়া তেমন কিছু আশা করা যায় না। সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐ সরকারের দৃঢ় সমর্থন ছাড়া বিশ্বের কোন দেশই বাংলাদেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না। এছাড়া ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের আগের দিন এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চান যে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে কোন সরকার গঠিত হয়েছে কিনা। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে বৈঠকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরূপে নিজেকে তুলে ধরবেন। কারণ এতে ‘পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামকে সাহায্য করার জন্য ৩১ মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়’ তা কার্যকর ও রূপলাভ করতে পারে বলে তাজউদ্দিনের ধারণা হয়। ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের সূচনাতে তাজউদ্দিন জানান যে পাকিস্তানী আক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ২৫/২৬ মার্চেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে সরকার গঠন করা হয়েছে। শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব – ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সকল প্রবীণ সহকর্মীই মন্ত্রীসভার সদস্য। মুজিবের গ্রেফতার ছাড়া তখন পর্যন্ত দলের অন্যান্য প্রবীণ নেতা-কর্মীর খবর অজানা থাকায় সমাবেত দলীয় প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শক্রমে দিল্লির উক্ত সভায় তাজউদ্দীন নিজেকে প্রধানমন্ত্রীরূপে তুলে ধরেন। ঐ বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, উপযুক্ত সময়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হবে। এভাবেই অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ধারণার সূচনা। ৪ঠা এপ্রিল দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীনের আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। ১০ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়। ১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন বেতারে ভাষণ দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরের মেহেরপুর আ¤্রকাননে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীন সূর্য উদয় হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আ¤্রকাননে অস্তমিত বাংলার স্বাধীনতা ১৯৭১ সনের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও স্বাধীনতার সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধর মাধ্যমের অর্জিত হয়। চরম প্রতিকুলতার মধ্যে অতি অল্প সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক, রাজনৈতিক, কুটনৈতিকসহ সকল বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত সফল করে তোলেন মাত্র নয় মাসেই মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধকালে তার ত্যাগ নিষ্ঠা, দক্ষতা, ও স্বদেশ প্রেম সমগ্রবিশ্ব অনুপ্রাণিত করে। প্রেরণা, উৎসাহ দেশ প্রেমের মা-মাটি মানুষকে ভালবাসার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যা কোন দিন ভুলা যায় না। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত প্রধান মন্ত্রির দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় সেই মন্ত্রিসভায় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পালন করে যুদ্ধ পরবর্তী দেশের অর্থনৈতিক ও পরিকল্পনায় সে অবদান রেখে গেছেন। তাঁর রেখে যাওয়া কর্ম-ভাবনা আলোকদ্রুতি ছড়ায় বাংলার আকাশে বাতাসে। বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে লেখা থাকবে বঙ্গতাজের অবদান।
১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের পর তাজউদ্দিন আহমদ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু ভারতের সীমান্তে পৌঁছে, তিনি বিনা প্রটোকলে ভারতে প্রবেশ করেন নাই। তিনি ঐ সময় বলেন, একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্য দেশে তিনি কোন প্রটোকল ও আমন্ত্রন ছাড়া প্রবেশ করতে পারেন না। এটা করলেও তার দেশের জন্য অসম্মানজনক। অতঃপর ওপারের ভারতীয় বাহিনী তাকে গার্ড অফ অর্নার দিয়ে ভারতে নিয়ে যায়।
২২শে ডিসেম্বর তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসলে, ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে নতুন মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবর রহমানের কাছে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার সমর্পণ করলেন। উদ্দীপ্ত ঝলমলে হাসিভরা মুখে তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, “আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন । নেতার অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত থেকে দেশকে স্বাধীন করেছি। আবার নেতাকে মুক্ত করে তাঁরই হাতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার তুলে দিয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। অন্তত ইতিহাসের পাতার এককোণায় আমার নামটা লেখা থাকবে”। ক্ষমতা নির্লোভী আত্মপ্রচার বিমুখ তাজউদ্দীন আহমদ’র এই ত্যাগ ইতিহাসে সত্যিই বিরল ! তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধে বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশটির অর্থনীতিকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হন ।
১৯৭৩-এ ঢাকা-২২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় বাজেট পেশ করেন, প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।
১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনের বক্তৃতায় তিনি দল, সরকার এবং নেতা ও কর্মীদের মাঝে দূরত্ব দূর করে, সংগঠন এবং সরকারের মাঝে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানান।
পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘ ৩০ বছরের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহকর্মীকে ভুল বুঝেন। ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর দুপুর ১২ টা ২২ মিনিটে তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ঐতিহাসিক চরমপত্রের রচয়িতা এম. আর আখতার মুকুল তাজউদ্দীন আহমদ’র পদত্যাগ সম্পর্কে লিখেছেন, “মন্ত্রী থেকে তাজউদ্দীন বিদায় নিলেন। মনে হলো বঙ্গবন্ধুর কোমর থেকে শানিত তরবারি অদৃশ্য হয়ে গেল। … ছায়ার মত যে নির্লোভ ব্যক্তি অসাধারণ নিষ্ঠার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করেছেন এবং নিঃস্বার্থভাবে পরামর্শ দিয়ে বহু বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন এক গোপন চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে শেখ সাহেব সেই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করলেন”।
পরবর্তীতে তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবকে বললেন, মুজিব ভাই, আমি আপনাকে সিরিয়াসলি একটা কথা বলি। আমার অনুরোধ, আপনি গোয়েন্দাদের দিকে একটু দৃষ্টি দেবেন। তা না হলে আপনি বাঁচতে পারবেন না। শেখ মুজিব যে রাতে খুন হলেন সে রাতেই গভীর ব্যথিত কণ্ঠে তাজউদ্দিন স্বগতোক্তি করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু জানতে পারলেন না-কে তার শত্রু আর কে তার বন্ধু ছিল?
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করার পর হত্যাকারীদের নির্দেশে তাজউদ্দীন আহমদকে গৃহবন্দী করা হয়। ২২ আগস্ট সামরিক আইনের অধীনে তাজউদ্দীন আহমদ-সহ ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরিবারের সদস্যদের প্রতি শুধু বলে গেলেন- ‘ধরে নাও আজীবনের জন্য’ যাচ্ছি। কন্যা, ১ পুত্রসহ স্ত্রীকে ছেড়ে যাবার সময় একটুও বিচলিত ছিলেন না।
গ্রেফতারের পর তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। কারা অন্তরীণ হলেন আরো ৩ জন জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলখানার মধ্যে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় এই নিঃসঙ্গ সারথি-কে… তৃষ্ণার্ত এই লোকটির “পানি পানের ইচ্ছা”-কে বেয়োনেট চার্জ দ্বারা মিটিয়ে দেয়া হয় চিরতরে…। যে তাজউদ্দীনকে স্পর্শ করতে পারেনি পাকিস্তানী হানাদারের বুলেট, সে তাজউদ্দীনকে স্বাধীন বাংলার মাটিতে শহীদ হতে হল স্ব-জাতির চক্রান্তকারীদের বুলেটে ! যার নেতৃত্বে স্বাধীন হল বাংলাদেশ তাঁর রক্তেই রঞ্জিত হল বাংলার মাটি ! একই দিনে জেলখনায় বন্দি অবস্থায় তাঁর সাথে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মোঃ মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকেও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে জেলহত্যা নামে কুখ্যাত হয়ে আছে।
তাজউদ্দিন আহমদ মহাবিশ্বের, মহাকালের, যা হৃদয়ে লালন করা যায়, যার সমাজ ভাবনাকে অনুসরণ করার মত। আদর্শকে লালন করার মত ব্যক্তি বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ।
মরুভূমি, সাগর, পাহাড়, যেমন রাষ্ট্র নয়, তেমন সার্বভৌমত্বহীন, জনগণহীন, সরকারহীন কোন স্থান বা দেশ কে রাষ্ট্র বলা যায় না, বাংলাদেশকে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন করে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে নিয়ে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দেয়ার মুখ্য ভূমিকায় বঙ্গতাজ।
সূত্রঃ
১। তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা
২। তাজউদ্দীন আহমদ নিঃসঙ্গ সারথি। প্রামাণ্য চিত্র।
৩।ওয়েবসাইড-তাজউদ্দীন আহমদ ডট কম