নারী-পুরুষের সম-অধিকারঃ সংবিধানে ও বাস্তবে(১)
নারী-পুরুষের সম-অধিকারঃ সংবিধানে ও বাস্তবে(১)
সিডনীর কথামালা -৬৭
রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
শিরোনামে বর্ণিত বিষয় নিয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মৌল ধারণার (ঈড়হপবঢ়ঃ) পটভূমিকে মাথায় রেখে আজও যে লেখালেখি করতে হয় এর চাইতে লজ্জার আর কোন কিছু দেখি না। সংবিধানের কথা শিরোনামেই উল্লেখ করছি। আর সংবিধানটি প্রণীত হয়েছিল ১৯৭২ সালে – আজ থেকে ৪৫ বছর আগে। এই দীর্ঘ সময় ধরেই নারী-পুরুষের সম-অধিকারের স্বীকৃতি এবং উভয়ের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যের অবসান ঘটানোর দায়িত্ব উপেক্ষিত হয়ে রয়েছে রাষ্ট্রীয় ভাবেই।
আসলে এই লিঙ্গ-বৈষম্য সকল ক্ষেত্রেই বিরাজমান। কি রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে, কি সমাজে, কি পরিবারে, কি ধর্মীয় অনুশাসনে সর্বত্র। যদি তাই হয় তাহলে আমরা বললে কি ভুল হবে যে সমাজ যেমন সংবিধান মানছে না-পরিবার যেমন সংবিধানকে গুরুত্ব দিচ্ছে না – ধর্মের নামেও যেখানে নানা তথাকথিত অনুশাসন দেখিয়ে বৈষম্যকে নিদারুণ ভাবে টিকিয়ে রাখছে – সেখানে রাষ্ট্রও তার আচরণ ও বিরাজমান বৈষম্যগুলির প্রতি নীরব, নিশ্চুপ, নিস্পৃহ থেকে রাষ্ট্রের নিজস্ব সংবিধানকেই অবজ্ঞা করে চলছে?
যে সংসদ সার্বভৌম বলে সংবিধানে বলা হয়েছে, সেই জাতীয় সংসদে আজও এক তৃতীয়াংশ (অর্ধেক তো দূরের কথা) আসনও মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত রাখা এবং যে কটি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে সেগুলিতেও সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচনের দাবী আজও স্বীকৃতি পায় নি। নির্বাচিত তাঁরা অবশ্য হন তবে তা নির্বাচিত ৩০০ সদস্যের ভোটে। পরিণতি? দলীয় মনোনয়ন পেলেই মিটে গেল। ঐ সংসদ সদস্যদের ভোটেরও আর প্রয়োজন নেই। কারণ সংসদের যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েআছেন তাঁরাই তো ভোটে জিতবেন অর্থাৎ সেই দলের মনোনীত যাঁরা সেই মহিলা প্রার্থীরাই নিশ্চিতভাবে জিতবেন। এটা যেহেতু অবধারিত – তাই সংসদে বিরোধীদলের যদি অস্তিত্ব থাকেও (বর্তমানের গৃহপালিত তথাকথিত বিরোধী দল নয়) তাঁরা কেনই বা পরাজয় নিশ্চিত জেনেও কোন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবেন?
এই ব্যবস্থার ফলে সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে বরাবরই যেন একধরণের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির আয়োজন দেখা যায়। এঁরা আদৌ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন না। তা যাতে করতে পারেন তেমন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবী নারী সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে বারংবার উত্থাপিত হলেও তা বরাবরই উপেক্ষিত হয়ে চলেছে। এর অবসান ঘটার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
একই অবস্থা সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রে। প্রথমবার ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী সেখ হাসিনা শতকরা ৩০ ভাগ আসনে মহিলাদেরকে ঠিক যে তাঁর তিন দফার প্রধান মন্ত্রীত্বকালেই অতীতের তুলনায় সর্বাধিক সংখ্যক মহিলা সরকারী চাকুরীতে নিয়োগ পেয়েছেন কিন্তু তাঁর শাসনের এই ত্রয়োদশ বছরে ও তা ঐ শতকরা ৩০ ভাগের ১৫ ভাগেও পৌঁছেনি।
কোন বিভাগে কতজন মহিলা বর্তমানে কর্মরত তার কোন তথ্য আমার হাতে অবশ্য নেই কিন্তু কি সাধারণ প্রশাসন, ব্যাংক, আধা-সরাকারী প্রতিষ্ঠানগুলি, শিক্ষা, যোগাযোগ (ডাক, তার, রেল বিভাগ সহ) বিচার বিভাগ, নানা মন্ত্রনালয় সরকারী আইনজীবী, ব্যাংক ও অপরাপর আর্থিক সেক্টরে, পুলিশ, র্যাব,বিজিবি ও নৌ, বিমান ও সেনাবাহিনী প্রভৃতির দিকে তাকালে যে দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওয়ে তাতে তো সরকারী পদগুলিতে এ যাবত কাল পর্য্যন্ত নিয়োগ শতকরা ১০ ভাগও হয়েছে কি না তাতে রীতিমত সংসয়ের জন্ম দেয়। যদি সরকার তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতো অর্থাৎ ৩০ শতাংশ সরকারী আধা সরকারী পদগুলোতে মহিলাদের নিয়োগ দিতো তা হলে বিপুল সংখ্যক উচ্চ ও স্বল্প শিক্ষিত মহিলারা বহুলাংশে নিজের পথে দাঁড়াতে পারতেন। ফলে পারিবারিক পর্য্যায়ে অন্ত:পক্ষে তাঁদের অনেকেই সম-অধিকার অর্জনে সক্ষম হতেন। কারণ নারীর অর্থনৈতিক নিভরতাই যে তার তাবৎ ক্ষেত্রে বৈষম্যের পীড়াদায়ক উপাদান তা নিয়ে তেমন একটা বিতর্ক থাকার কথা নয়। নেইও।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নারীর প্রবেশাধিকার থাকলেও অধিকারটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাস্তবে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। দু’চার জন সচ্ছল পরিবারের মেয়ে সেদিকে আকৃষ্ট হয়ে সফলও হয়েছেন বটে, কিন্তু কোন দোকানে বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে দোকানে তাদেরকে খুব একটা কাজ করতে দেখা যায় না। সেল্স্-গার্ল হিসেবে ঢাকা-চট্টগ্রামের বিশেষ বিশেষ বণিজ্যিক ভবনে অবশ্য কিছু কিছু মেয়েকে দেখা যায়। এক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এবং নারীর দৈহিক নিরাপত্তার প্রশ্নটিও বিবেচনায় নিয়ে অনেকেই এ কাজে নারীর নিয়োগ দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হন। তবে যত অধিকসংখ্যক তরুণী এ কাজে এগিয়ে আসবেন ততই ঐ বাধা-বিপত্তিও কমে আসবে। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক সহযোগতিা এবং প্রণোদনা নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদেরকে বেকারত্ব দূরীকরণে অনেকটা সহায়ক হতে পারে।
কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পুরুষ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের চাইতে নারীর মালিকাধীন প্রতিষ্ঠানেই মেয়েরা কাজে স্বচ্ছন্দ্য বেশী পরিমাণে বোধ করতে পারে কিন্তু তাদের মালিকানা অর্জন আজও অত্যন্ত দুরুহ। এই ক্ষেত্রে তাদের যে ভয়াবহ পুঁজির অভাব বা স্বল্পতা রয়েছে-সরকারীভাবে ব্যাংগুলিকে তা দূরীকরণে উৎসাহিত করলে এবং ব্যাংকগুলি এগিয়ে এলে ধীরে ধীরে, এই ক্ষেত্রে প্রসারিত হতে পারে। এক্ষেত্রে অত্যন্ত সহজ শর্তে বেশী অংকের ঋণ-ব্যবস্থা নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে চালু হওয়া প্রয়োজন দীর্ঘ মেয়াদের ভিত্তিতে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্যগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল, একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, বাঙালি জাতীয়তাবাদী, অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠন এবং বাংলাদেশের মাটি থেকে সকল প্রকার বৈষম্য তা সে ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা লিঙ্গ বৈষম্য যাই হোক না কেন-তার সমূলে উৎপাটন। এই লক্ষ্যেই উপরোক্ত বিষয়গুলি সুষ্পষ্টভবে সন্নিবেশিত করে বাহাত্তরের সংবিধান রচিত ও অনুমোদিত হয়েছিল।
আমরা সবাই জানি, উপরোক্ত লক্ষগুলি শুধুমাত্র কেতাবে লেখা থাকলেই চলবে না-তার বাস্তব প্রয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের সাথে সঙ্গতি রেখে আইন কানুন ও প্রণয়ন করতে হবে। সে কাজও বহুলাংশে (পূর্ণাঙ্গ রুপে-হয় নি আজও) সম্পন্ন হয়েছে কিন্তু তার প্রয়োগ না হওয়াতে নারী-পুরুষের বৈষম্য কাটছে না। এর সুযোগ নিচ্ছেন সুবিধাবাদী – মৌলবাদী চরিত্রের লোকেরা ও দূর্নীতিবাজেরা। এমন কথাও মাঝে-মধ্যে শুনা যায় যে, পুরুষরাও নির্য্যাতীত হচ্ছে নারীর দ্বারা- যার বাস্তব প্রমাণ আজতক তেমন একটা কারও চোখে পড়েছে এমন দাবী কাউকে উত্থাপন করতে শুনিনি। স্ত্রীর অত্যাধিক বিলাসী চাহিদা কোন কোন ক্ষেত্রে যে চোখে পড়ে না তা নয় – তবে তা ধনী দাবী পরিবারেই ঘটে, আর দাবী উত্থাপন আর নির্য্যাতন নিশ্চয়ই একই সংজ্ঞার আওতাধীন নয়।
অপরাপক্ষে বাস, ট্রেন, লঞ্চ, স্টীমার এবং এমন কি, স্কুটার-ট্যাকিসতে পর্য্যন্ত ড্রাইভার কন্টাকটর-হেলপার বা কখনও কখনও সুবিধামত পুরুষ প্যাসেঞ্জার দ্বারাও প্রকাশিত-অপ্রকাশিত নারী নির্য্যাতনের কাহিনী বাংলাদেশে-ভারতে সীমাহীন। আর এর প্রতিকার খুঁজে পাওয়াও দুরুহ। একটি হতে পারে, নারী অধিক সংখ্যায় যদি ড্রাইভিং পেশা গ্রহণ করেন, ট্রাফিক পুলিশ হিসাবে অধিক সংখ্যক নারী নিয়োগ করা হয় এবং আইন পেশায় অধিকতর সংখ্যায় নারী এগিয়ে এলে ও বিচারকের পদে প্রচুর সংখ্যক নারী নিয়োগ পেলে। তবে এগুলি সবই সময় সাপেক্ষ। কিন্তু তা হলেও এ পথে হাটতেই হবে নারীর জীবন শংকারমুক্ত রাখতে হলে ও তাদের জীবনের নিরাপত্তা ধীরে ধীরে নিশ্চিত করতে হলে। তবে মৌলিকভাবে এই পদ্ধতি স্থায়ীভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এর মধ্যেও পক্ষপাতিত্ব ও পুরুষের প্রতি ঢালাও অবিশ্বাসের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। তাই এটি স্থায়ী কোন ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণের সুপারিশ আদৌ করছি না। নিয়োগ একদা যোগ্যতার ভিত্তিতেই হতে হবে সে পরিবেশ যত দ্রুত সৃষ্টি হয় ততই মঙ্গল।
আমাদের দেশের উত্তরাধিকার আইনগুলি ধর্মভিত্তিক। এই ভিত্তিতে অন্য কোন আইনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না অর্পিত সম্পত্তি আইন ছাড়া। যেমন চুরী , ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি প্রকৃতি করণে অপরাধী যে কোন ধর্মের বিশ্বাসীই হোন না কেন-অপরাধ প্রমাণিত হলে একই সাজার বিধান রয়েছে আইনে। এগুলিকে আমরা অব্যশ ফৌজদারী অপরাধ বলে চিহ্নিত করেছি এবং ফৌজদারী আইনেই তার বিচার চলে। সেক্ষেত্রেও যে বৈষম্য দেখা যায় বাংলাদেশে তা হলো ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্য্যাতনের ক্ষেত্রে। সংখ্যালঘু নির্য্যাতনও ফৌজদারী অপরাধ। কিন্তু তাই তার বিচারের ব্যবস্থা আইনে বিদ্যমান এবং সংবিধান তাকে বাধ্যতামূলক করেছে। তবে বাস্তব ঘটনা হলো ঐ অপরাধের বিচার বাংলাদেশে হয় না। হিন্দু নারী নির্য্যাতন যেন বেহেশতের দরজাই খুলেদেয়।
যা হোক, বলছিলাম উত্তরাধিকার আইন প্রসঙ্গে। আগেই বলেছি, এই আইনের নামকরণের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। বলা হয়,“হিন্দু আইন”, “মুসলিম আইন” প্রভৃতি। সাথে আরও একটি কথা বলে দেওয়া হয় যে এই আইনের রচয়িতা স্বয়ং ভগবান বা আল্লাহ্ । ফলে তার সংস্কার ও সময়োপযোগী পরিবর্তন করা যাবে না-এ জাতীয় অভিমত ধর্মীয় পন্ডিতগণ-যাঁরা মৌলবাদী ভঅবধারায় দীক্ষিত তাঁরা বলে থাকেন এবং উত্তরাধিকার আইন সংস্কারের দাবী তুললেই তাঁরা তার বিরোধিতায় পথে নামতে দ্বিধা করেন না। আবার তাঁদের মুখে মানবাধিকার – বৈষম্যের অবসান প্রভৃতি দাবীতেও দিব্যি খই ফুটতে থাকে।
কী আছে হিন্দু আইনে? ইত্তরাধিকার আইনে নারী – সে যিনিই হোন-মা, স্ত্রী, বোন, কন্যা-কেইই-পুত্র, স্বামী, ভাই বা বাবার মৃত্যু হলে তাঁর সম্পত্তির সামান্যতম অংশও পাবেন না।অর্থাৎ স্বামী বা বাবার মৃত্যু হলে তাঁর সম্পত্তির সামান্যতম অংশও পাবেন না। অর্থাৎ স্বামী বা বাবার মৃত্যু ঘটলে স্ত্রী ও কন্যারা সহায় সম্পত্তিহীন ও চারম অসহায় জীবে পরিণত হবেন। এর কোন নড়চড় বাংলাদেশের হিন্দু আইনে আজও করা হয় নি। যদি দয়া করে, কোন মহিলার সন্তান বা ভাইয়েরা তাঁকে আশ্রয় তবেই দেন তবেই তিনি খেয়ে পরে বাঁচতে পারবেন-দ্বিতীয় কোন পথ খোলা নেই তাঁর সামনে। স্বামীর মৃত্যু পর তাঁদের সম্পত্তির মালিক পুত্রেরা যদি নাবালক থাকে তবে সেক্ষেত্রে স্বামীর সম্পত্তি “দেখাশুনা” ও “রক্ষণাবেক্ষণের” দায়িত্বটুকুই বিধবা স্ত্রী ভোগ বা পালন করবেন। তবে স্বামীর ঋণ, পরিশোধ মেয়ের বিয়ে, সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষা ও ভারণ-পোষণ প্রভৃতির ব্যাপারে প্রয়োজন হলে তিনি কিছু সম্পত্তি ঐ নাবালক পুত্রদের (যারা হলো হিন্দু আইনে উত্তরাধিকার) পক্ষ থেকে বিক্রয় বা হস্তান্তর করতে পারেন। এক্ষেত্রে তাঁর পক্ষে আদালতের মাধ্যমে নিযুক্ত অভিভাবকত্ব নিলে অনেকটা নিরাপদ। নতুবা নাবালক ছেলোর বড় মায়ের ঐ হস্তান্তর বে-আইনী বলে দাবী করতে পারবে-পারবে বলতে যে মিথ্যা ও ভ্রান্ত তথ্য দিয়ে তার মা ঐ সম্পত্তি হস্তান্তর বাবদ প্রাপ্ত টাকা আত্মশাত করেছেন।
আবার হিন্দু মেয়েরা উত্তরাধিকারী হওয়ার দাবী তুললে মুরুব্বীদের একটি অংশ মৌলবাদী ভাষায় বলেন যে, এমনিতেই বহু হিন্দু মেয়ে ধর্মান্তরিত, অপহৃত ও ধর্ষিত হচ্ছে-তাই তাদের হাতে যদি সম্পদের মালিকানা যায় তবে ঐ জাতীয় দুর্ঘটনা হু হু করে বেড়ে যাবে। তাই সনাতন ব্যবস্থাকেই বজায় রাখা হোক। ভারতে কিন্তু হিন্দু আইন সংশোধন করে (সম্ভবত: ১৯৫৫ সালে) পিতা স্বামীর মৃত্যু ঘটলে তাঁদের সম্পত্তিতে সমান অংশে অংশীদার হবেন মর্মে বিধান যুক্ত করা হয়েছে মুসলিম আইনেও তাই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মুসলিম পারিবারিক আইনের (যাতে এক সন্তান দুই মেয়ের সমান অংশীদার হয়) কোন প্রকার সংশোধন আনার কথা উচ্চারনই করেন না সে দাবীও খুব একটা জোরদার করতে মুসলিম মেয়েরা আজও সক্ষম হন নি।
হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের ক্ষেত্রে অবশ্য মাস তিনেক আগে প্রধানমন্ত্রী নেতাদেরকে নিজ উদ্যোগেই বলেছিলেন, “আপনাদের ধর্মে তো মেয়েরা কিছুই পায় না। আমি আইন পরিবর্তন করতে রাজী আছি। সেক্ষেতে আপনারা একমত হয়েছে একটা আইনের খসড়া আমাকে দিন – আমি ঠিক সেভাবেই আনের সংস্কার করে হিন্দু মেয়েদের পৈত্রিক। স্বামীর সম্পত্তির অংশীদারিত্ব মেনে আইন পাশ করে দেব”। এতে হিন্দু মুরুব্বীরা সম্ভবত: মহা খুশী কারণ কদাপি তাঁরা একমত হবেন না ফলে সরকারও ঐ আইন বদলাবে না।
কিন্তু নীতি-নৈতিকতার বালাই তো ঐ ধারণার মধ্যে খুঁজে পাওয়া দুস্কর। কারণ,সংবিধান মোতাবেক সরকার নারী পুরুষের মধ্যে বিরাজিত বৈষম্য দূরীকণে এবং সমতা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ক্ষমতা গ্রহণে পাক্কালে তাঁরা শপথ নিয়েও বলেরেছ তাঁরা অক্ষরে অক্ষরে সংবিধান মেনে চলবেন। তাই ঐ শপথ বাক্যও সরকারকে হিন্দু আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে কারও কাছে ঐক্য মত্যের ভিত্তিতে আইনের খসড়া তৈরী করার নির্দেশ দেওয়ার সুযোগ রাখে নি। এটা বাধ্যতামূলক।
তেমনই হিন্দু বিবাহ রেজিষ্ট্রেশনের আইন করলেও তা অজানা কারণে বাধ্যতামূলক করা হয় নি। অবলিম্বে নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বিবাহ রেজিষ্ট্রেশনের এবং যৌক্তিক কারণে ডিভোর্সের সুযোগ রেখে আইন প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরী।
তদুপরি হিন্দু সামাজিক ধর্মীয় বিধানে স্বামীর মৃত্যুর পর মৃত স্বামীর বাঁ পায়ের আঙ্গুল দিয়ে বিধবা স্ত্রীর সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেলার ও হাতের শাঁখা একইভাবে ভেঙে দেওয়ার রেওয়াজ বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার প্রতীক হওয়ায় তা ও অবিলম্বে নিষিদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।
নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণে বাদ বাকী ব্যবস্থাগুলি নিয়ে পরবর্তীতে আবারও লিখবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্থানাভাবে এই নিরপেক্ষতা দাবী উত্থাপন করতে পারি না।
- প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪–এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।