নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী বিধিব্যবস্থা

 

 

নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী বিধিব্যবস্থা

রণেশ মৈত্র (সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ)

কিছুদিন আগের এক সকালে অভ্যেস বশত: টেলিভিনে খবর দেখতে বসে চ্যানেল আই-তে দেখলাম, নতুন নির্বাচন কমিশন আগামী সেপ্টেম্বর থেকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মত বিনিময় শুরু করবেন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলির সাথে। পরে জানা গেল: সংলাপ জুলাইতেই শুরু করা হবে।
খবরটি দেখে স্পষ্টত:ই বুঝা গেল, নির্বাচনটি আসন্ন। হয়তো বা ২০১৮ সালের মার্চের দিকেই নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। তা যদি নাও হয় তবে ২০১৮ সালের শেষ দিকে নতুন সংসদ নির্বাচন যে অবশ্যই অনুষ্ঠিত হবে তাতে কোন দ্বিধা বা সংশয়ের কারণ নেই। ২০১৮ সালের শেষ দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাকে “আগাম নির্বাচন” ও বলা যাবে না কারণ তখন নির্বাচন অনেকটা বাধ্যতামূলকও হয়ে পড়বে সংবিধানের বিধান অনুযায়ী।
নির্বাচন যে সংসদের বিধান মোতাবেক নির্দিষ্ট সময়কালে অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে আমার মনে সামান্যতম সংশয়ও নেই। তবে নির্বাচনের বাদ্যি-বাজনা শুনে এবং বড় দলগুলির ছুটাছুটি দেখে মনে হয় নির্বাচন নির্দিষ্ট মেয়াদের শেষ প্রান্তে অনুষ্ঠিত না করে হয়তো মাস কয়েক আগে আগামী বছরের শুরুর দিকেও অনুষ্ঠিত হতে পারে।
বস্তুত: নির্বাচন যত সত্বর অনুষ্ঠিত হয় ততই মঙ্গল। তবে সে নির্বাচন কোনক্রমে ২০১৪ সালের মত নির্বাচন হওয়া চলবে না। তাতে অবশ্যই সকল দলের অংশ গ্রহণ থাকতে হবে। এবং এখানেই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতা অনেক।
আমি আনন্দিত যে নির্বাচন কমিশন প্রত্যাশিত ঐ নির্বাচনটি যাতে সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত করা যায় সে ব্যাপারে সেপ্টেম্বর থেকেই বা তারও আগে নিবন্ধিত দলগুলির সাথে আলোচনা সুরু করবেন।
তার আগে নির্বাচন কমিশনকে কিছু কথা বলতে চাই।
রাজনৈতিক দলগুলির নিবন্ধনের পালা শেষ হয়েছে বহু আগে। ঐ পালা শেষ হওয়ার পরে নতুন করে গঠিত দলগুলির নিবন্ধনের সুযোগ দেননি সাবেক নির্বাচন কমিশন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, সংসদ নির্বাচনের আগে ঐ পালা শুরু করা হবে। এটা নাকি নির্বাচন কমিশনের নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন সংক্রান্ত তাঁদের আইনেই উল্লেখ করা আছে।
যদি আইনটি তেমন হয়ে থাকে তখন তার যৌক্তিকতাও হয়তো ছিল-কারণ তখন সংসদ নির্বাচন ব্যতিরেকে অন্য কোন নির্বাচনে যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন প্রভৃতির নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দল আনুষ্ঠানিকভাবে কোন প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে পারতো না এবং কোন প্রার্থীর ঐ সকল স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলির নির্বাচনে কোন দলীয় প্রতীক ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। কিন্তু ইতোমধ্যে সংসদে সে আইন পরিবর্তন করে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলিতেও দলীয় প্রতীক ব্যবহারের বিধান করা হয়েছে এবং ঐ বিধান অনুযায়ী বিদায়ী ও বর্তমান নির্বাচন কমিশন অনেকগুলি নির্বাচনও পরিচালনা করেছেন। শীঘ্রই আরও কয়েকটি নির্বাচন পরিচালনা করতে যাচ্ছেন।
কিন্তু এই সকল নির্বাচন করার আগে কোন নবগঠিত রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেওয়া না হওয়াতে ঐদলগুলি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন নি। তাই নতুন দলগুলির প্রতি উভয় নির্বাচন কমিশনই বৈষম্যূলক আচরণ করেছেন যা তাঁরা করতে পারেন না।
শুধুই কি স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলির নির্বাচনে সংসদে প্রণীত নতুন আইনের জন্যেই আমার যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য? না, আমি তা ছাড়াও মনে করি, যেহেতু বছরের যে কোন সময় সংসদের যে কোন শূন্য (তা যে কারণেই হোক না কেন) আসনে উপনির্বাচনের বিধান আছে এবং উপনির্বাচনগুলিও নির্বাচন কশিনই পরিচালনা করেন তাই নতুন নতুন দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সারা বছরই উন্মুক্ত রাখা প্রয়োজন গণতন্ত্রের বিধান অনুসারেই। সে কারণে অবিলম্বে নবগঠিত দলগুলির নিবন্ধনের দরখাস্ত জমা দেওয়ার আবেদন জানান হোক কালবিলম্ব না করে। এ দাবী গণতন্ত্রের স্বার্থেই উত্থাপন করলাম।
নিবন্ধন সংক্রান্ত যে সকল বিধি বিধান আছে তাও অনেকাংশে বাস্তবতা বর্জিত। তাতে বর্ণিত আছে কতগুলি উপজেলায় কতগুলি জেলায় কত সদস্য ও কতগুলি সক্রিয় অফিস থাকলে এবং কতভাগ মহিলা সদস্য বিভিন্নস্তরের কমিটিতে থাকলে নিবন্ধন দেওয়া যাবে। এই বিধান অবিলম্বে বাতিল করা উচিত। দলগুলির যদি সর্বত্র বা অধিকাংশ জেলায় নানা কমিটি বা অফিস বা মহিলা সদস্য না থাকে তবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দলটি। সরকারের বা নির্বাচন কমিশনের এতে কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হওয়ার সামান্যতম কারণ নেই। কাজেই দলটির যে কটি শাখাই থাকুক না কেন তা নির্বাচন কশিনের বিবেচ্য হওয়ার বিষয় নয়। তবে বলা যেতে পারে ঢাকাতে একটি কেন্দ্রীয় কমিটিও তার কেন্দ্রীয় অফিস থাকলে এবং সারা দেশে কমপক্ষে ৫,০০০ (পাঁচ হাজার) সদস্য থাকলেই দলটি নিবন্ধন পেতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে, আমি ভারতের বর্তমান দিল−ীর সরকারের উদাহরণ টানতে পারি (কেন্দ্রীয় সরকার নয়)। দিল−ীতে ক্ষমতাসীন দলটির নাম “আম আদমী পার্টি”। সারা ভারতবর্ষে ঐ দলের কয়টি শাখা-প্রশাখা আছে, কতগুলি অফিস, কত নারী সদস্য আছে খোঁজ নিলে তা জানা যাবে। বস্তুত তেমন কোন কিছুর অস্তিত্বই নেই তবু দলটি নিবন্ধিত। বাংলাদেশে অর্থ, অস্ত্র প্রভৃতি রাজনীতির অনুষঙ্গে পরিণত হওয়ায় নতুন দল গড়ে ওঠা কত কঠিন তা তেমন দল যাঁরা গড়েন বা করেন তাঁরাই তা অনুধাবন করতে পারেন। নির্বাচন কমিশন যদি সুস্থ ধারার রাজনীতির বিকাশ কামনা করেন তবে অবশ্যই তাঁদেরকে ঐ রাজনীতি সহায়ক বিধি-বিধান করতে হবে। মনে রাখতে হবে ৪০ টির মত নিবন্ধিত দলের অস্তিত্ব যদিও রয়ে গেছে তবু ক্ষমতা দখল করার মত শক্তি এবং সামর্থ্য দুটির অধিক দলের নেই কেন সেই কারণটা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। ক্ষমতা দখল তো দূরের কথা-ঐ দুটি দলের বা তার কোন না কোনটার সাথে জোট বেঁধে না দাঁড়ালে কেন কোন দলই সংসদে ৫/১০ টি আসনেও জিতে আসতে পারে না সে বিষয়টিও ভাবতে হবে। নইলে দেশ বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বাদ থেকে বঞ্চিত থেকেই যাবে।
কেন তৃতীয় কোন রাজনৈতিক দল নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে একক শক্তিতে নির্বাচনে বিজয়ী হতে বা উলে−খযোগ্য সংখ্যক ভোট পেতে পারেন না তা গভীরভাবে ভাবা প্রয়োজন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও তো দুটি বৃহৎ দলের অস্তিত্ব আছে কিন্তু তবুও তার নানা প্রদেশে নানা দল ক্ষমতাসীন। সেখানে ক্ষমতায় যেতে বা ক্ষমতা ধরে রাখতে বৃহৎ দল দুটিকেই ছোট ছোট দল নিয়ে জোঁট বাঁধতে উদ্যোগী হতে দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে ভিন্ন পরিস্থিতি কেন?
কেন বড় দলগুলির পক্ষ থেকে যদি কোন ধর্ষক বা অপরাপর ঘৃণ্য অপরাধে অপরাধী, অসৎ ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক অঙ্গনে পুরোদস্তর অপরিচিত মুখ মনোনিত হলেও দিব্যি জিতে যেতে সক্ষম হচ্ছে তাও আসন্ন নির্বাচনের প্রক্রিয়া সুরু হওয়ার আগেই ভেবে একটি সমাধানে আসতে হবে।
কে না জানে, নির্বাচনে টাকা ও পেশী শক্তির অপ্রতিহত দাপটের কথা? ঐ দুটি থাকলে আর তার সাথে বৃহৎ দলের বিশেষ “মার্কা” থাকলে যে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যে কারও পক্ষেই সম্ভব তা সবাই স্বীকার করেন। এ কথাও স্বীকার করেন নির্বাচনী প্রচারণাও ক্রমান্বয়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করার বে-আইনী সুযোগ দিব্যি ঐ দুটি বৃহৎ দল সহ ছোট ছোট কিছু দলও গ্রহণ করে চলেছে। এই অপপ্রক্রিয়া ক্রমাগত বেড়েই চলেছে “ধর্ম নিরপেক্ষ” বলে প্রচারিত বা দাবীকৃত এই দেশে।
এ ক্ষেত্রে নির্চাচন কমিশনের ভূমিকা দৃশ্যমান হওয়া প্রয়োজন। এগুলি শুধুমাত্র নির্বাচনী আইনে নিষিদ্ধ থাকলেই চলবে না-সেই নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে দলগুলিকে মানতে বাধ্য করতে পারে একমাত্র নির্বাচন কমিশন। তাই তাকে আজ আইনগুলির প্রয়োগ কঠোরতার সাথেই করতে হবে।
ভাবতে হবে একটি দল যদি শতকরা ৫১ ভাগ ভোট পায় তবে তার বিজয় ৫১ ভাগ আসনে হবে না কেন? যে দল ৪০ ভাগ পেল, ৩০ ভাগ পেল, ১০ বা ৫ ভাগ ভোট পেলো সে দলগুলি সমানুপাতিক হারে আসন পারেন না কেন? এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বহু দলীয় গণতন্ত্রকে এ দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিকে বিকাশ লাভ ঘটাতে হলে এ বিষয়টি নিয়ে সকল রাজনৈতিক দলকেও ভাবতে হবে বিশেষ কর যারা বঞ্চিত হয়ে চলেছে নির্বাচন সমূহে আসন লাভ থেকে এ পদ্ধতি গ্রহণে নির্বাচন কমিশিনকেও দৃঢ় ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।
প্রয়োজন আরও এ কারণে যে সংসদ অধিবেশনগুলির নিষ্প্রাণতা – নিষ্প্রভতাকে কাটিয়ে উঠতে “শত ফুল ফোটার” সুযোগ অবারিত করার লক্ষ্যে। সংসদে অবশ্যই যেমন মৌলিক প্রশ্নগুলিতে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিফলিত হতে হবে-তেমনই আবার নানা প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন মতেরও প্রতিফলন ও তার সক্রিয় পদচারণাও থাকতে হবে। বলা বাহুল্য সংসদকে হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও আদর্শে নিষ্ঠাবান এবং তার জন্যে ক্ষমতাসীন দলসহ সকল রাজনৈতিক দলকে সেই প্রশ্নগুলিতে দৃঢ়মত হতে হবে যাতে কদাপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ থেকে দেশটা বিচ্যুত না হয়। আর তা করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে ধর্মাশ্রয়ী দলগুলি ও তাদের রাজনীতিকে সংবিধানের মৌলিক প্রশ্নের সাথে সাংঘর্ষিক বিবেচনায় নির্বাচনী ময়দান থেকে তাদেরকে নির্বাসনে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতকে অভিমত প্রদানের জন্য নির্বাচন কমিশন উক্ত আদালতের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করতে পারেন।
নিবন্ধটির আকৃতি আর না বাড়িয়ে এখন সমাপ্তি টানার আগে নিন্মোক্ত দাবীগুলি পুনরুত্থাপন করি।
এক: রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া হিসাবে চালু করা হোক;
দুই: নির্বাচনী ব্যয় প্রার্থী পর্যায়ে ব্যাপকভাবে কমিয়ে তা সৎ প্রার্থীদের সাধ্যানুগ করা হোক;
তিন: নির্বাচনে টাকা ও অস্ত্রের খেলা গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাই ওগুলি পূরোপূরি বন্ধ করার কার্য্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক;
চার: নির্বাচনী প্রচারণায় ও নির্বাচণী ইশতেহারে ধর্মের ব্যবহারকে শাস্তিযোগ্য অপারাধ হিসেবে ঘোষণা করে তা অক্ষরে অক্ষরে কার্য্যকর করা হোক;
পাঁচ: নির্বাচনী ব্যয়ের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন গ্রহণ করলে সর্বোত্তম হতে পারে;
ছয়: নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার করে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হোক;
সাত: নির্বাচন-পূর্বের ও পরের তিন মাস যাতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আদৌ না ঘটে অথবা ঘটলে তার বিচারের নিশ্চিত ব্যবস্থা করা হোক;
আট: যে সকল দল রাষ্ট্রের মৌলনীতি সমূহের অন্যতম “ধর্মনিরপেক্ষতা” স্পষ্টভাবে মেনে তা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের, নির্বাচনী প্রচারণায় ও দলীয় মেনিফেষ্টোতে নি:শর্তভাবে রাখবে না তাদের নিবন্ধন বাতিল করা হোক;
নয়: সকল নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের সকল ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন নিরপেক্ষভাবে এবং এ ব্যাপারে সকল দলের সম্মতি নিশ্চিত করা হোক।

 

  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!