প্রিয়াঙ্কার প্রবেশ
অনলাইন ডেক্স । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
রাহুল দুবাইয়ে। উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌয়ে ‘বুয়া-ভাতিজা’ জুটি মায়াবতী ও অখিলেশ সংবাদ সম্মেলন করে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে রাজ্যের ছিয়াত্তরটা আসন নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। কংগ্রেসের জন্য ছেড়ে দিলেন আমেথি ও রায়বেরিলিসহ আরও দুটি আসন। সেই দুই আসন তাঁরা ছাড়ছেন পশ্চিম-উত্তর প্রদেশের জোট নেতা অজিত সিংয়ের রাষ্ট্রীয় লোকদলের জন্য। নিজেদের জন্য রাখলেন ৩৮টি করে আসন।
দুবাইয়ের সাংবাদিকদেরকে রাহুল বললেন, মায়াবতী ও অখিলেশের প্রতি তিনি গভীর শ্রদ্ধাশীল। নিজস্ব ভাবনা অনুযায়ী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ অধিকার তাঁদের রয়েছে। তাঁদের মতো রাহুলও চান বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। তবে একই সঙ্গে তিনি চান কংগ্রেসও শক্তিশালী হয়ে উঠুক। রাহুল আরও বলেন, ‘উত্তর প্রদেশে আমরাও দু-একটা চমক দেখাব।
প্রিয়াঙ্কা ভোটের সময় এবং অন্য সময়েও নানা রকম সামাজিক কাজকর্মে এই দুই কেন্দ্রে থাকেন। তবে এই প্রথম রাহুল তাঁর বোনকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের পদাধিকারী করলেন। দায়িত্ব দিলেন উত্তর প্রদেশের অর্ধেক আসনের।
কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা এই ঘোষণায় উৎফুল্ল। চনমনে হয়ে উঠেছে উত্তর প্রদেশের রাজনীতিও। প্রিয়াঙ্কা কি উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতে তিন দশক ধরে প্রায়ই নির্জীব থাকা কংগ্রেসকে নতুন জীবন দিতে পারবে?
বিজেপির মুখপাত্র থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এর্বং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত মুখ খুলেছেন। নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘আবার প্রমাণ হলো কংগ্রেসের কাছে পরিবারই দল, আমাদের কাছে দলই পরিবার।’ তবে বুধবার রাত ও বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি ‘বুয়া-ভাতিজা’ জুটির কাছ থেকে।
বিজেপির চিন্তিত হওয়ার প্রধান কারণ তাদের ও কংগ্রেসের ভোটব্যাংক অভিন্ন। জাতপাতভিত্তিক উত্তর প্রদেশে কংগ্রেসের সমর্থন যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, তা প্রধানত উচ্চবর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ২০১৪ সালের লোকসভায় সাড়ে ৭ শতাংশ এবং ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে ৬ শতাংশের সামান্য বেশি যে ভোট কংগ্রেস পেয়েছে তা প্রধানত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যর মতো উচ্চবর্ণের। তিন দশক ক্ষমতার বাইরে থাকায় উচ্চবর্ণের বিপুল সমর্থন ক্রমেই চলে গেছে বিজেপিতে। রাজ্যের যাদবপ্রধান অনগ্রসর শ্রেণি বেছে নিয়েছে সমাজবাদী পার্টিকে, জাটভপ্রধান দলিত সম্প্রদায় কোল পেতে দিয়েছে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টিকে। মুসলমানেরা প্রধানত ভিড় করেছে এসপিতে। কিছুটা বিএসপিতেও। প্রতি ভোটে মুসলমান দেখেছে বিজেপিকে হারাতে এসপি, বিএসপি ও কংগ্রেসের মধ্যে কার সম্ভাবনা বেশি। সেই দেখে কেন্দ্র হিসেবে তারা ট্যাকটিক্যাল ভোট করেছে। প্রিয়াঙ্কার প্রবেশের ফলে উচ্চবর্ণ বেশি উদ্বেলিত হলে বিজেপির সর্বনাশ অবধারিত। বিশেষ করে উচ্চবর্ণের যুবসম্প্রদায়, চাকরিহীন প্রবৃদ্ধি যাদের অখুশি রেখেছে। মনে রাখা দরকার, ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে আলাদা লড়াই করে কংগ্রেস এই রাজ্যে ২১টা আসন জিতেছিল। সেগুলোর মধ্যে ১৩টাই ছিল এই পূর্বাঞ্চলে।
এসপি-বিএসপি কি তাহলে চিন্তিত নয়। অবশ্যই তাদের কপালের ভাঁজও গভীরতর হয়েছে। তারাও বুঝতে চাইছে, প্রিয়াঙ্কার প্রবেশ তাদের মূল সমর্থকদের মধ্যে কোপ ফেলবে কি না; বিশেষ করে মুসলমান সমর্থনে। সহজ অঙ্ক, প্রিয়াঙ্কা-রাহুল জুটি উচ্চবর্ণকে উৎসাহিত করলে বিজেপির সর্বনাশ। মুসলমানদের মন জয় করতে পারলে ক্ষয়াটে হবে বুয়া-ভাতিজা দুজনেই। কংগ্রেসের হারানো জমি পুনরুদ্ধারে যুবমানসে আশা জোগালে লোকসান তিন প্রধানেরই। ফলে কেউই দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছে না।
এমনিতে উত্তর প্রদেশ চার অংশে বিভক্ত। পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমাঞ্চল, বুন্দেলখন্ড-রোহিলখন্ড ও মধ্যাঞ্চল। এবার রাজ্যটাকে লম্বালম্বি দুভাগে ভাগ করে পূর্বাঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রিয়াঙ্কাকে। এই অঞ্চলের মধ্যেই চলে আসছে আমেথি, রায়বেরিলি, লক্ষ্ণৌ, ফৈজাবাদ। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন ক্ষেত্র বারানসি ও মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্র গোরক্ষপুরও এখানে। রায়বেরিলিতে মায়ের বদলে প্রিয়াঙ্কা ভোটে দাঁড়াবেন কি না, এখনো নিশ্চিত নয়। কিন্তু দাঁড়ালেও গোটা পূর্বাঞ্চলের ভার যেহেতু তাঁর ওপর, মোদি ও আদিত্যনাথকে তিনি নিশ্চিন্তে থাকতে দেবেন না। ২০১৪ সালের প্রবল মোদি-হাওয়া সত্ত্বেও রাজ্যের যে কেন্দ্রগুলোতে কংগ্রেস লক্ষাধিক ভোট পেয়েছিল, সেগুলো এই পূর্বাঞ্চলেই। বিজেপি অবশ্যই চিন্তিত, কারণ, পাঁচ বছরে হাওয়ায় অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে।
বুধবারেও রাহুল ‘বুয়া-ভাতিজা’ জুটিকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে কথা বলেছেন। বলেছেন, বিজেপি তাঁদের সবার শত্রু। বিজেপিকে সরাতে তিনি মায়াবতী-অখিলেশকে সাহায্যের হাত সব রকমভাবে বাড়াতে প্রস্তুত। এই মন্তব্য রাজ্যে আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে নতুন ভাবনার উদয় ঘটাবে কি না, বলা কঠিন। মায়াবতী-অখিলেশ দুদিন আগে পর্যন্তও রাহুলের কংগ্রেসকে তেমন গুরুত্ব দেননি। কংগ্রেসের ঐতিহ্যগত উচ্চবর্ণ ভোট কখনো যাদবপ্রধান এসপি ও দলিতপ্রধান বিএসপিতে ‘ট্রান্সফার’ হয় না। ফলে তাঁদের ধারণায়, কংগ্রেস আলাদা লড়লে এসপি-বিএসপির লাভ ও বিজেপির ক্ষতির আশঙ্কা বেশি।