বাবাকে বড্ড বেশী মনে পড়েছে
বাবাকে বড্ড বেশী মনে পড়েছে
রণেশ মৈত্র (সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত)
সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
আমার বাবাকে আসলেই প্রতিদি;নই একবার হলেও মনে পড়ে। তাঁকে হারিয়েছি আজ থেকে ৬৮ বছর আগে-৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৪। তাঁকে শেষ দেখা দেখতে পারি নি-শেষ বিদায় জানাতে পারি নি-এমন কি তাঁর জীবনের শেষ কটি দিন তাঁর সান্নিধ্যে থাকতেও পারিনি। এ বেদনা আমাকে আমৃত্যু বয়ে বেড়াতে হবে।
আমার বাবা প্রয়াত রমেশ চন্দ্র মৈত্র, যতটুকু শুনেছিলাম, জন্মেছিলেন ১৯০০ সালে। ১৯২০ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়াকালে আমার পিতামহ (ঠাকুরদা) মৃত্যু বরণ করেন। বাবা তখন সংসারের হাল ধরতে আমাদের পৈত্রিক গ্রাম পাবনা জেলার সাঁথিয়া থানার ভুলবাড়িয়া গ্রামে চলে আসতে বাধ্য হন।
গ্রামে এসে ভুলবাড়িয়া প্রাইমারী স্কুলে সহকারী শিক্ষকের পদে চাকুরী গ্রহণ করেন। তখন ম্যাট্রিকুলেট হলেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকও হওয়া যেত-তবে অবশ্যই তাঁকে জিটি পাস হতে হতো। জি.টি মানে গুরু ট্রেইনিং যাকে এখন পি.টি.আই পাশ বলা হয়। বাবা জিটি না পড়ায় আজীবন সহকারী শিক্ষক পদেই থেকে যান।
এই স্কুলটির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। ই ংরেজ আমলের সমগ্র বঙ্গদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এটি। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮২৭ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ আজ থেকে ১৯৫ বছর আগে। আর পাঁচ বছর পরে স্কুলটির দ্বিশতদ বার্ষিকী উদযাপিত হওয়ার কথা। তবে সরকারি স্কুল হওয়ায় সরকারি উদ্যোগ-আয়োজন পেলে স্থানীয় শিক্ষক, বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী এবং অভিভাবকেরা মিলে যথাযথভাবে তা পালন করা সম্ভব হবে। বেঁচে যদি থাকি তবে তো নিশ্চয়ই সে উদ্যোগের অত্যন্ত উৎসাহী একজন হিসেবে সাধ্যে যা কুলো তা করবো।
স্কুলটির প্রধান শিক্ষক ছিলেন প্রয়াত নায়েব আলী মন্ডল। স্কুলটিতে তখন এই দুজনই মাত্র শিক্ষক ছিলেন। আমিও ঐ স্কুল থেকেই প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করি। তখন প্রাথমিকে চতুর্থ শ্রেণী পর্য্যন্ত পড়ানো হতো। পঞ্চম শ্রেণী থেকে উচ্চ মাধ্যমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হতো।
তখন জনসংখ্যা ছিল অনেক কম। তদুপরি ঐ এলাকাটি প্রধানত: মুসলিম অধ্যুষিত। সে কালে মুসলিম সমাজ লেখাপড়ার দিকে মনোযোগী ছিল না-ফলে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ছিল বেশ কম। ছেলে-মেয়ে উভয়েই পড়তো তবে মেয়েদের মধ্যে মুসলিম পরিবারের মেয়ে দেখাই যেত না প্রায়-ছেলেদের অবশ্য বেশ উল্লেখযোগ্য অংশই ছিল মুসলিম।
যতদূর মনে পড়ে বাবাই বেশী সংখ্যক ক্লাস নিতেন। তখন প্রাইমারি স্কুলগুলিতে কোন ব্লাক বা কেরানী বা পিওনের পদ ছিল না। লেখাপড়ার কাজগুলি শিক্ষকরাই করতেন-আর ঘর ঝাড়– দেওয়া, প্রতি প্রিরিয়ডে এবং ক্লাস শেষে ছুটির ঘন্টা বাজানোর দায়িত্ব পড়তো এক এক দিন এক এক ছাত্রের উপর। কখনও কোন শিক্ষক ক্লাস ফাঁকি দিতে বা কোচিং ক্লাস করতে দেখে নি। ক্লাসের পড়াই ছিল প্রধান। আর এমন করে শিক্ষকরা পড়াতেন তা বার্ষিক পরীক্ষা পর্য্যন্ত মনে রাখা বেশীর ভাগ ছাত্র-ছাত্রীর পক্ষেই কঠিন হতো না।
বাবা পড়াতেন, কবিতা মুখস্থ করাতেন এবং সবচেয়ে নজর দিতেন বানান, উচ্চারণ এবং হাতের লেখার পদ্ধতি। হাতের লেখা ভাল করার জন্য “আদর্শ হস্তাক্ষর” “আদর্শ হস্তলিপি” জাতীয় বই নিজে থেকে কিনে দিতেন ছাত্র-ছাত্রীদেরকে-যদি তাদের অবিভাবকেরা তা করতে সমর্থ না হতেন। আমি তো হাতের লেখার জন্য অনেকবার বাবার হাতে বেত্রাঘাত খেয়েছি।
ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা কিন্তু কম হওয়ার কথা ছিল না কারণ তখনকার সময়ে ভুলবাড়িয়া ছাড়া আর কোন প্রাইমারি স্কুল বা অন্য কোন বিদ্যালয় ছিল না। সামাজিক পশ্চাতপদতাই ছিল শিক্ষার্থী কম হওয়ার প্রথম বা প্রধান কারণ। আর ছিল দারিদ্র্য। গ্রামে তো ছিলেন ৯৮ ভাগই কৃষক। তাঁরা তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদেরকেও কৃষিকাজের অংশীদার করে ফেলতেন।
বাবা কলকাতা থেকে প্রকাশিত অর্ধ-সাপ্তাহিক আনন্দ বাজার পত্রিকা আনাতেন ডাকযোগে। এর জন্যে বছর বছর বাৎসরিক টাকা নির্দিষ্ট পরিমাণে ডাকযোগে। এর জন্যে বছর বছর বাৎসরিক টাকা নির্দিষ্ট পরিমানে ডাকযোগে পাঠাতেন। আমাদের গ্রামে কোন ডাকঘর বা পোষ্ট অফিস ছিল না। ভুলবাড়িয়া ছিল আতাইকুলা পোষ্ট অফিসের আওতাধীনে। ডাক পিওন ছিলেন অজিত কাকা। তিনি বাবাকে দাদা বলে ডাকতেন-তাই। সেই অজিত কাকা সপ্তাহে তিনদিন আসতেন ভুলবাড়িয়া এবং পার্শবর্তী গ্রামগুলোতে চিঠি, পার্শেল ও মানি অর্ডারে আসা টাকা বিলি করতেন। শিক্ষিতের অডারের কারণে চিঠিপত্রের বা অন্যান্য জিনিষ কারও বেশী একটা আসতো না। যদি আসতো তবে অজিত কাকা বাবারগুলি বাবাকে দিয়ে অন্যান্যদেরগুলি ইউনিয়ন পরিষদের সচিবের কাছে রেখে যেতেন। তিনি সন্ধ্যায় বাজারের আসা লোকজনের মাধ্যমে তা প্রাপকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন।
অজিত কাকা তাঁর পৌঁটনা নিয়ে শুকনাকালে সাইকেল যোগে-বর্ষাকালে নৌকাযোগে ভুাবাড়িয়া যাতায়াত করতেন। ভুলবাড়িয়া আসতেন সপ্তাহে তিন দিন। সোম, বুধ ও শুক্রবারে। তখন শুক্রবারে ছুটি থাকতো না। প্রতি সপ্তাহে ঐ তিনদিন ভুলবাড়ীয়া এসে স্কুলে বাবার পাশে বসতেন। বসে গল্পসল্প ও চিঠিপত্র যা থাকে তা বাবাকে দিতেন। বাবার বিস্তর চিঠিপত্র আসতো কলকাতা-মেদিনীপুর, কুচবিহারের মাথাভাঙ্গা প্রভৃতি দূর দূর অঞ্চল থেকে আমাদের আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে। বাবাও চিঠি লিখতেন খুব। খাম-পোষ্টকার্ড বেশ অনেকগুলি করে কিনে রাখতেন। চিঠিপত্র ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে দুই দিন আসতো অর্ধ-সাপ্তাহিক আনন্দবাজার-বাবা যার বার্ষিক গ্রাহক ছিলেন।
একদিন অজিত কাকা এসে পত্রিকার প্যাকেট বাবার হাতে দিতেই বাবা সেটা খুলে প্রথম পৃষ্ঠায় আটকলামব্যাপী বড় হরফেছাপা খবরটি দেখেই পত্রিকাটি হাতে নিয়ে প্রধান শিক্ষক নায়ের আলী মন্ডলের পাশে বসলেন। তাকিয়ে দেখি, দুজনের চোখেই জল। উভয়ে দু’চার মিনিট কথা বলার পর প্রধান শিক্ষক বলেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন। তাই আজকের অবশিষ্ট সময় এবং আগামীকাল স্কুল বন্ধ থাকবে। পরশুদিন থেকে আবার নিয়মিত স্কুল চলবে। রবীন্দ্রনাথের নামতো তখনও শুনি নি বা তাঁর লেখা কবিতাও পড়িনি। আমি তখন দ্বিতীয় কি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৪১ সাল। শ্রাবণ মাস।
প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমাদের সংক্ষিপ্ত ধারণা দিলেন।
তৃতীয় দিনে স্কুল খুললে আমরা ছাত্র ছাত্রীরা বললাম রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে এক শোক সভা এবং তাঁর কবিতা আবৃত্তির আয়োজন করেছি। সে কারণে প্রধান শিক্ষকের অনুমতি চাইতেই তিনি তৎক্ষণাৎ সম্মতি দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে টেবিল চেয়ার বেঞ্চ সাজিয়ে আলোচনা সভার ব্যবস্থা করা হলো। আলোচনা করলেন বাবা আর আমরা জনাকয়েক কয়েকটি কবিতা পাঠ করলাম। সেই যে রবীন্দ্র নাথের সাথে পরিচয় হলো সে পরিচয় দিন দিন নিবিড়ই হয়েছে। বড় হয়ে অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নানা মঞ্চে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেছি। তাঁর “পৃথিবী” “ওরা কাজ করে” “আফ্রিকা” ছিল আমার অত্যন্ত প্রিয় কবিতা আর নজরুলের “বিদ্রোহী”।
রবীন্দ্র চর্চার জন্য ‘শিখা সংঘ’ নামে, পরবর্তীতে উদীচী, জাহেদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ এবং তার পরে “জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ” প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান পাবনাতে গড়ে তুলে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আলোচনা, তাঁর কবিতা আবৃত্তি ও রবীন্দ্র সঙ্গীতের অসংখ্য অনুষ্ঠান করেছি পাবনার অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরীতে এব অন্যান্য স্থানে।
এর পর আসে ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ পঞ্চাশের মন্বন্তর বলে যা ইতিহাসে পরিচিত। তখনকার বাংলার মানুষের করুণ চেহারা আমি দেখেছি তাঁদের আর্তস্বরও শুনেছি। ঐ সময় প্রথম দফায় একদিন সন্ধ্যায় খেলার মাঠ থেকে ফিরে বাড়ীতে এসে দেখি, বাবা গালে হাত দিয়ে আমাদের শোবার ঘরের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছেন। নির্বাক। ছুটে গেলাম রান্নাঘরে মায়ের কাছে। জিজ্ঞেস করলাম বাবা গালে হাত দিয়ে বসে আছেন কেন? মা বললেন, হঠাৎ চালের দাম বেড়ে ১০ টাকা মন হওয়ায় কি করে পরিবারের সকলকে বাঁচাবেন সেই দুশ্চিন্তায় তিনি ঐভাবে বসে আছেন। বস্তুত: বাবা তো ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, বেতন মাসে পাঁচ টাকা মাত্র। আর কোন বাড়তি উপার্জন নেই। তাই এমন উদ্বেগ। বাজারে অন্যান্য পণ্যেরও মূল্য বাড়ছে হু হু করে।
জামালপুরে মামার কোন খবর বেশ অনেকদিন পাওয়া যাচ্ছিল না। বাবা হঠাৎ বললেন, সবাই চলো, নীরোদ দাকে দেখে আসি। নীরোদ মজুমদার আমার মামার নাম। যে কথা-সেই কাজ। গরুর গাড়ী, বাস, ট্রেন, স্টীমার আবার ট্রেনযোগে দীর্ঘ সময় ধরে চলতে চলতে গিয়ে পৌঁছালাম ময়মনসিংহের জামালপুরে। দিন কয়েক ওখানে থাকার পর আবার ফিরে আসা। কেউ কিছু মুখে না বললেও, এই মন্বন্তরে মামার পরিবারও যে বিধ্বস্ত-তা বুঝে নিতেই কষ্ট অনুভব করলাম। ফেরত যাত্রা ভিন্নপথে। গাইবান্ধার বোনারপাড়া জংসনে রেলযোগে এসে কয়েক ঘন্টা ঐ জংশনের ওয়েটিং রুমে বসে থাকা ঈশ্বরদী মুখী ট্রেনের অপেক্ষায়। তখন রাত ভোর হয় হয়। হঠাৎ ভোরে বাইরে তাকিয়ে দেখি প্লাট ফর্মের এক কোনে মানুষের জটলা। ছুটে গেলাম সেখানে। অত:পর ঈশ্বরদী হয়ে শিয়ালদহ। সেখান থেকে বজবজ হয়ে বিড়লাপুর। গঙ্গানদীর তীরে ছোট্ট একটা শহর। খুঁজে শশধর কাকার বাসা পাওয়া গেল। বাবাকে দেখেই শশধর কাকা বললেন, দাদা, বিড়লা জুট মিলসের অফিসে আপনার জন্য একটা ভালো চাকুরী জোগাড় করে নিয়োগপত্র পাঠিয়ে দিয়ে ছিলাম। কিন্তু সে পদ তো খালি নেই। যথাসময়ে না আসায় বা কোন খবর না পাওয়ায় সেখানে অন্য একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবু এখানেই থাকেন, চেষ্টা করি, সম লাগলেও কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই। আমরা থেকে গেলাম।
শশধর কাকার বাড়ী আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামে। অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন বাবাকে। ১০/১৫ দিনের মধ্যেই তিনি বিড়লা জুট মিলসের দু’তিন জন বড় অফিসারের বাসায় গিয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের টিউটার হিসেবে বাবাকে ঠিক করে দিয়ে বললেন, দাদা দেশের যা অবস্থা তাতে ফিরে না গিয়ে আমার বাসায় ছেলে মেয়ে সহ থেকে টিউশনি করুন। আরও কি ব্যবস্থা করা যায় তা দেখছি। বাবা অনিচ্ছা সত্বেও রাজী হলেন।
কিছু দিনের মধ্যে শ্রমিক কলোনীতে বাবার নামে একটি ছোট্ট বাসা এবং রেশন কার্ডের ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা সেখানে গিয়ে উঠলাম। আমাকে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেওয়া হলো বিড়লাপুর হাইস্কুলে। বিড়লা জুট মিলসের কারণে বিড়লাপুর একটি ছোট্ট দৃষ্টিনন্দন শহরে পরিণত হয়েছিল। রেশন কার্ডের বদৌলতে আমাদের খাদ্য সংকট মিটলো। বাসা পেয়ে বিনা ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থা হলো। বাবার টিউশনির আয়ে আমাদের ভালই চলছিল।
আমি বাসা থেকে পায়ে হেঁটে স্কুলে যাতায়াত শুরু করলাম। গঙ্গানদীর ধারে ইটের বাধানো মজবুত রাস্তা। মাইল খানেক দূরে ছিল স্কুলটি। যাতায়াতে রোজ চোখে পড়তো অসংখ্য লাশ রাস্তার দু’ধারে পড়ে আছে। সব অনাহারে মৃত্যু। তাদের দাহ বা সৎসারের কোন ব্যবস্থা দেখি নি। সম্ভবত: লাশগুলিকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হতো-ভাসতে ভাসতে সেগুলি চলে যেতো বঙ্গোপসাগরের অথৈ জলে। মন্বন্তরের ভয়াবহ রূপটি তাই আমি অসহায়ভাবে দেখেছি মমত্ত্ববোধ জেগেছে-কিন্তু কিছুই করার শক্তি ছিল না।
হঠাৎ একটিদন ভুলবাড়িয়া স্কুল থেকে হেড মাষ্টার বাবাকে একটি চিঠি দিয়ে জানালেন, তাঁর সবেতন ও বিনাবেতনে পাওনা সকল ছুটি শেষ। তাই চিঠি পাওয়ামাত্র এসে জয়েন না করলে চাকুরী রক্ষা করা সম্ভব হবে না বলে থানা শিক্ষক কমকর্তা তাঁকে জানিয়েছেন।
আর কি? দে ছুট। এবার ফিরতি যাত্রা ভুলবাড়ীয়া গ্রামে। এসেই বাবা স্কুলের চাকুরীতে যোগ দিলেন। কষ্টের যাতনা বাবার পথ ছাড়লো না।
ইতোমধ্যে অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক কৃষক দরদী হিসেবে কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়। পঞ্চাশের মন্বন্তরে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে যে কৃষকেরা পেটের দায়ে জলের দামে জমি বিক্রী করে দিয়ে সর্বশান্ত হয়েছেন, তাদের জমি উদ্ধার করে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ঋণ শালিশী বোর্ড নামক এক সংস্থা সরকারীভাবে গঠন করেন। বিধি অনুযায়ী প্রতি ইউনিয়নে বোর্ড গঠন হবে ইউনিয়ননের অধিবাসীদের মধ্য থেকে তাদের ভোটে।
দিব্যি মনে পড়ে, এই খবরে উল্লাসিত হলেও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক সমাজ দুর্নীতির আশংকায় সৎ লোকদের চেয়ার ম্যান মেম্বর হিসেবে নির্বাচন করতে আগ্রহী হন। আশ পাশের গ্রাম থেকে লোকজন এলেন বাবার কাছে বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে দাঁড়ানোর জন্য। বাবা অসম্মতি জানিয়ে বলেন, “আমি তো রাজনীতি করি না-ভোটেও কোনদিন দাঁড় করাও-আমি প্রকাশ্যে সমর্থন দেব। আমিও ঐ দুর্ভিক্ষের একজন ভূক্তভোগী। কৃষকেরা এতে রাজী না হয়ে বাবাকে দাঁড়াতে বাধ্য করলেন-জানতাম না সৎ মানুষ হিসেবে স্কুলের বাইরেও তাঁর এত জনপ্রিয়তা।
যা হোক, শেষতক বাবা দাঁড়ালেন এটা দেখে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইচ্ছুক অন্য সবাই সরে দাঁড়ালেন। বাবা হলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত। চেয়ালেন মর্মে দরখাস্ত পেলেন তদন্তে সত্য প্রমাণিত হওয়ায় তাঁদের সমস্ত জমি ফেরত পাবার ব্যবস্থা করেন। বাবার এই কৃষক-দরদী রূপটি এতদিন আমাদের অজানা ছিল-অজানা ছিল এলাকায় তাঁর আকশচুম্বি জনপ্রিয়তা কথাও।
এরপর এলো পাকিস্তানের জোয়ার নানাস্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়ংকর সব খবর। গ্রামে থাকা নিরাপদ মনে না করে অজানা উদ্দেশ্যে সপরিবারে চলে এলেন পাবনা শহরে এক ভাড়া নেওয়া কাঁচা বাসায়। ইতোমধ্যে আমি ম্যাট্রিক পাশ করে এডওয়ার্ড কলেজে পড়াশুনা শুরু করেছি-ছাত্র ইউনিয়ন গঠন করেছি পাবনায়। এলো ১৯৫৪ এর নির্বাচন। মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষ্যে হক ভাসানী-সোহ্রাওয়ার্দী নেতৃত্বে গঠিত হলো যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্ট গঠনের দাবী ছাত্র ইউনিয়নও উত্থাপন করেছিল। যুক্ত ফ্রন্টের প্রার্থীদের সপক্ষে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কাজ করার জন্য গঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তালিকা ঘোষণার পর পরই প্রার্থীদের এলাকায় নির্বাচনী অভিযান পরিচলনায় ৮/১০ জন করে ছাত্র নিয়ে টিম আমি গেলাম সুজানগর এলাকায়। সুজানগর থানা হেডকোয়ার্টারে ৪ ফেব্রুয়ারি জনসভা। আমি প্রধান বক্তা। মাগরিবের নামাযের পর আমি বলতে শুরু করি দুই প্রার্থীর পক্ষে। একজন যুক্তফ্রন্ট মনোনীত অপর জন সাধারণ (হিন্দু) আসন থেকে মনোনীত কমিউনিষ্ট পার্টির কৃষক নেতা কমরেড অমূল্য লাহিড়ী। স্বভাবত:ই লম্বা হয়ে যায়, বক্তৃতা। ঘন্টাখানেক ধরে বক্তৃতা করে যেই মঞ্চ থেকে নামছি-সভাপতি একটি শ্লিপ হাতে ধরিয়ে দিলে তা খুলে দেখি, ছাত্র ইউনিয়নের এক নেতা নূরুদ্দিন চিঠিটি পাওয়া মাত্র পাবনা ফিরে আসতে লিখেছে। শেষে বাসে পাবনা আসতে আসতে রাত প্রায় ১০টা বেজে গেল। দেখা হলো নূরুদ্দিন ভাই ও সাজাহান মাহমুদের সাথে। উভয় নির্বাক। কিছুই বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার ডেকেছেন কেন? বেশ কিছুক্ষণ চুপ শেষে উভয়েই বললেন, বাবা নেই। আকাশ ভেঙ্গে পড়লো যেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম, বাবা সকালে মারা গেছেন-আমাকে খবর পাঠিয়ে সারাদিন অপেক্ষা করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শেষ দেখা হলো না।