ভাষা নিয়ে ভাসা জ্ঞান!
ভাষা নিয়ে ভাসা জ্ঞান! (রম্যগদ্য)
সোহেলী জান্নাত, সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
(ভাষা বহতা নদীর মতো। নদীর যেমন দুকূল ছাপিয়ে নানান কিছু গ্রহণ বর্জনের মাধ্যমে সমুদ্রপানে ধেয়ে যাওয়াই উদ্দেশ্য, তেমনি ভাষার উদ্দেশ্য মনোভাব প্রকাশ। ভাষার টিকে থাকার প্রয়োজনেই তাই লেনা দেনা আবশ্যক।
বাংলা ভাষাও নানান রূপ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বর্তমান যুগের প্রেক্ষাপটে এগুলো নিয়ে কিঞ্চিৎ মজার আলাপ জুড়ে দেয়াই আমার এ লেখার উদ্দেশ্য। )
১. ভাষার সরলীকরণঃ ভাষাকে ব্যক্তি বিশেষের বোধগম্য করে তোলার জন্য অনেকেই সরল করে ফেলেন, অনেক ক্ষেত্রে তা কাজে দিলেও কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই বিপত্তি বাঁধে। একবার এক কোষ্ঠকাঠিন্য রুগিকে ডাক্তার দিয়েছেন ব্যথানাশক মলম। লাগানোর নিয়ম সহজ করে বলতে গিয়ে বলেছেন পুরো ফাইল পায়খানার রাস্তায় লাগিয়ে রাখবেন। আশা করি ব্যথা সেরে যাবে। রুগি পুরোটা মলম টিপেটুপে সাবাড় করে টয়লেট যাবার পথে বিছিয়ে দিয়েছেন। মলম ফুরিয়েছে ব্যথা ফুরায় নি!
২. ভাষার ছলাকলাঃ এই কাজটি পত্রিকাওয়ালারা বেশি করে থাকেন। শব্দ নিয়ে রহস্য খেলা পত্রিকার কাটতি বাড়াতে প্রভুত সাহায্য করে। ছেলেবেলায় দেখা পত্রিকার দুটি হেডলাইন এখনো চোখে গেঁথে আছেঃ
১. “প্রধানমন্ত্রী বন থেকে হেগে এলেন!”
২. ” খালেদা জিয়া মা হতে চলেছেন!”
শিরোনাম দেখে যে কারও পিলে চমকে যাবার কথা! একজন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কে নিয়ে এমন ইতর শিরোনাম! বিশেষত, আশির দশকে স্বামীহারাজন কীভাবে নব্বই দশকে মা হয়! কিন্তু ভেতরের খবর হল, বিদেশ সফররত প্রধানমন্ত্রী সুইজারল্যান্ডের বন শহর থেকে নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে এসেছেন! আর দ্বিতীয় ঘটনা সম্ভব হয়েছে এতিমখানার দায়িত্ব নেয়াসূত্রে!
৩. ভাষার কাটছাটঃ এই বিষয়টি শুরু হয়েছে আজকালকার ডিভাইসফ্রেক ইয়াং জেনারেশানের হাতে। কী ফেসবুকের পাতায়, কী পরীক্ষার খাতায় কোথাও এদের ডিটেইলসে যাবার আগ্রহ নেই! রবী ঠাকুর এদের হাতে হয়েছেন ‘রঠা’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হয়েছেন ‘ব চ’ প্যারীচাঁদ হয়েছেন ‘প্যাঁচা’!
হাসব্যান্ড ‘হাব্বি’ হয়ে হাবা হয়েছেন।
প্রেমিক প্রেমিকা ‘বাবু’ নাম ধারণ করে বালখিল্যে মেতেছেন।
কাউকে প্রচুর অনুসরণ করা হল এফ( f:following) কাউকে প্রচুর ভালবাসা হল লোল!( lol: lot of love)
তবে কথা হল গিয়ে “বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ” যেমন সংক্ষেপ করা সম্ভব নয়, করলেও শ্রুতি কটু তেমন প্রচুর ভালবাসার সাথে লোল টোল বড্ডো বে মানান!
৪. ভাষার স্মার্টনেসঃ দিন যাচ্ছে আর মানুষ সাবেক প্রয়োগকৃত শব্দের স্থলে নতুন নতুন শব্দ বসিয়ে বেশি বেশি আধুনিক আর স্টাইলিশ হবার পরিচয় দিচ্ছে।
আশির দশকে মানুষ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ‘পায়খানায়’ যেতো।
নব্বই দশকে একই কাজে ‘বাথরুমে’ গিয়েছে। আর একবিংশ শতকে পায়খানা, বাথরুম এগুলো বড্ডো খ্যাত শব্দ! মানুষ এখন ‘ওয়াশ রুমে’ যায়!
শব্দ বদলেছে, যদিও, কাজ কিন্তু সেই একই রয়ে গেছে…. বিসর্জনের আনন্দ!
আগে মেয়ের জীবনসঙ্গীকে জামাই বলা হতো। এখন নিজের জীবন সঙ্গীকেও কেউ কেউ জামাই বলে থাকেন।
আবার, জীবনসঙ্গীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের শালীন শোভন নাম দিতে গিয়েও নিত্য নতুন শব্দ প্রয়োগ করা হচ্ছে। কেউ বলছেন রিলেশন, কেউ ‘ঘুমানো’ কেউ আবার ভিন ভাষায় ইন্টারকোর্স, কেউবা নিছক ‘থাকা’ শব্দ দিয়ে ঘটনার গুরুত্ব বোঝাচ্ছেন। সমবয়সী সমমনারা এসব দ্বিচারী শব্দের প্রকৃত অর্থ অনুধাবনে সক্ষম হলেও বিপত্তি বাধছে অপেক্ষাকৃত মুরুব্বীদের নিয়ে।
একবার এক অনুশোচনায় দগ্ধ প্রেমিকা প্রাজ্ঞ ঋষীর কাছে গিয়ে বলছেনঃ বাবা! সত্যি করে বলেন তো বিয়ের আগে প্রেমিক প্রেমিকা একসঙ্গে ঘুমানো কী পাপ?
ঋষীঃ একসাথে প্রেমিক প্রেমিকা ঘুমানো পাপ হতে যাবে কেন! মুশকিল হচ্ছে তোমরাতো একসাথে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকো না!
৫. শব্দহীনতার শব্দঃ নেটের দুনিয়ায় ব্যস্ত মানুষের এখন অনুভূতি প্রকাশে শব্দটুকুও লিখতে হচ্ছে না! ইমোজি স্টিকার কমেন্ট বিভিন্ন প্রকার রিয়াকশনের নমুনা সে স্থল দখল করে নিয়েছে। সঠিক অনুভূতি প্রকাশে সঠিক ইমোজি প্রয়োগ তাও ঠিক আছে। কিন্তু মানুষ এখন ইতিবাচক ইমোজি দিয়ে নেতিবাচক অনুভূতি বোঝাচ্ছে। যেমন স্মাইলি একটি পজেটিভ ইমোজি! কিন্তু কাউকে উত্তক্ত করতে তার সিরিয়াস পোস্টে একটি স্মাইলি রিয়াকশনই যথেষ্ঠ!
নেতিবাচক শব্দের পজেটিভ প্রয়োগের উদাহরণও রয়েছে। যেমন ক্রিকেট খেলার সময় দর্শক আনন্দে উত্তেজিত হয়ে বলছে ” কোপা! মামু! হালারে কোপা!”
তার মানে হলো ভাই খুব ভাল করে ব্যাট কর।
৬. সেলিব্রেটি শব্দের ভাষাঃ ফেসবুক,ইউটিউব কিংবা ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার কারণে হঠাৎ হঠাৎ কিছু শব্দ বিখ্যাত হয়ে উঠছে। এবং লোকজন তখন ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে সেই শব্দগুলো প্রয়োগ করে অখ্যাত শব্দ বা ভাষাগুলিকে সেলিব্রেটি শব্দের মর্যাদা দিচ্ছে। সেফাত উল্লাহর “বেশি করে মদ খা”, “কী হিংসে হচ্ছে? হতে চাও আমার মতো” ভোটার লাইনে দাঁড়ানো গ্রাম্য সরলা নারীর ” ঘোরতে,খুশিতে ঠেলায়” কিংবা তাহেরি হুজুরের” ঢেলে দেই?” পরিবেশটা সুন্দর না?” এরকমই সেলিব্রেটি শব্দ ও ভাষা!
৭. নামই যখন ভাষাঃ কিছু কিছু ব্যক্তি নিজেই শব্দের সাথে মিশে উপযুক্ত বাক্য গঠন করছেন। এক্ষেত্রে নেতিবাচক চরিত্রগুলোই বেশি ব্যবহৃত হয়। একালের রুবেল- হ্যাপি, ডিসি-সাধনা এরকম কিছু নাম। এই প্রবণতা আসলে আগেও ছিলো। তুই বেইমানি করিশ না, না বলে বলা হয় মীরজাফরি করিস না, কূটকৌশল না করা বলতে গিয়ে বলা হয় বেশি হিটলারি করিস না!
ভাষার জন্য একটা সময় যে জাতি রক্ত দিয়েছে রাজপথে, তারাই আজ ভাষাটাকে হেসে খেলে গলাটিপে হত্যা করতে উদ্যত।ফলে একটি শুদ্ধ সুন্দর মধুর ভাষা দিন দিন পরিণত হচ্ছে রূচিহীন আনাড়ি ভাষায়।বস্তুত জাতিগত হীনমন্যতা ঢুকে গেছে আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মা কে তাই মা বলে শান্তি নেই! মাম্মি, মমস এ মিলছে অপার আনন্দ!
যাবার আগে বরিশাল অঞ্চলের মানুষের একটি নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে পুরোজাতিকে অবহিত করতে চাই!
সমগ্র বাংলায় কালকে মোটামুটি তিন প্রকারে ভাগ করা হয়ঃ
১. সকাল
২. বিকাল
৩. রাত্রিকাল
কিন্তু বরিশালবাসী তাদের ভাষায় আরেকটি কাল আবিষ্কার করেছেনঃ হেকাল!
এই হে কালের অনেক মাহত্ম! এই একটি কাল দিয়ে আপনি সবকাল বোঝাতে পারবেন!
এসেছেন কখন?
: হেকালে।
: যাবেন কখন?
: হেকালে।
এবার আপনিই বুঝে নেন হেকাল কোন কাল?