ভ্যাকসিন নেওয়া এবং না নেওয়া, মানুষ চিহ্নিত হবে দুই দলে
ভ্যাকসিন নেওয়া এবং না নেওয়া, মানুষ চিহ্নিত হবে দুই দলে
গোলাম মোর্তোজা
মানুষের চেয়ে পাঁচ হাজার কোটি গুণ ক্ষুদ্র করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন বাংলাদেশে পৌঁছে গেছে। মহামারিকালের সবচেয়ে ভালো সংবাদ এটাই। কার্যত এই ক্ষুদ্র ভাইরাস থেকে মুক্তির সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে নানা ওষুধের সমন্বয়ে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছেন। বিস্ময়করভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞান অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছে। ট্রায়ালে কার্যকারিতা প্রমাণের পর মানুষের শরীরে ভ্যাকসিন দেওয়াও শুরু হয়েছে। এসব তথ্য অজানা নয়।
আমরা এও জানছিলাম যে, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র অর্থনীতির দেশগুলো আদৌ ভ্যাকসিন পাবে কি না, প্রশ্ন-সন্দেহ ছিল। এদিক দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে ভাগ্যবানই বলতে হবে যে, তারা ইতোমধ্যেই ভ্যাকসিন পেয়ে গেছে। প্রথমে উপহার ২০ লাখ ডোজ, পরবর্তীতে কেনা ভ্যাকসিনের প্রথম চালান ৫০ লাখ ডোজ পৌঁছে গেছে দেশে। ভ্যাকসিন সংগ্রহের ক্ষেত্রে সরকারকে কৃতিত্ব দিতেই হবে। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় তা পর্যাপ্ত নয়।
এ সময় জনমানুষের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি হওয়ার কথা, সরকার যেন আরও ভ্যাকসিন জোগাড়ে তৎপর হয়। সব মানুষের ভ্যাকসিন যেন নিশ্চিত করা হয়। অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো, এমন দাবি দৃশ্যমান নয়। ভ্যাকসিন নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নানাবিধ নেতিবাচক প্রোপাগান্ডা দৃশ্যমান। ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে এমন মনোভাব অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও, একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়। এদেশে টিকা দেওয়ার সঙ্গে নেতিবাচক প্রচারণা ও জোর-জবরদস্তির একটা সম্পর্ক বহু পুরনো। যাদের হাতে দুটি টিকার দাগ রয়ে গেছে, সেসব টিকা জোর করেই দেওয়া হয়েছিল। ইতিহাস তাই বলে।
এখনকার পৃথিবী বহু এগিয়ে গেছে। টিকা নেওয়ার সেই শারীরিক যন্ত্রণা এখন নেই। প্রায় সব ওষুধের যেমন কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে, টিকারও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সাধারণত দৃশ্যমান হয়। শরীর ব্যথা, একটু জ্বর ইত্যাদি। কিন্তু, করোনাভাইরাসের টিকার বিরুদ্ধে এমন সব প্রোপাগান্ডা হাজির করা হলো, যার প্রায় কোনো অস্তিত্ব নেই। ‘ভ্যাকসিনের মাধ্যমে শরীরে চিপস ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। যা দিয়ে আপনি কখন-কী করছেন, সব জানা-দেখা যাবে’, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন শতভাগ অসত্য প্রোপাগান্ডা চলছে। একজনের ছবি দিয়ে বলা হচ্ছে টিকা নিয়ে ‘ভারতে শত শত মানুষ মারা গেছে, চিকিৎসাকর্মীরা টিকা নেওয়ার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন’, সামাজিক মাধ্যম থেকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে এমন প্রচারণা। অথচ যার ছবি ব্যবহার করে মারা যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তিনি মারা গেছেন হৃদরোগে, টিকার কারণে নয়। ভারতের কিছু চিকিৎসাকর্মী ‘কোভ্যাক্সিন’ নিতে প্রথমাবস্থায় অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তারপর থেকে ভারতে নিয়মিতভাবে চিকিৎসাকর্মীরা টিকা নিচ্ছেন। গত ছয় দিনে ভারতে ১০ লাখ মানুষ টিকা নিয়েছেন।
অথচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই সংবাদগুলো তেমন চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে টিকা নিয়ে কে মারা গেল, কার মুখ বাঁকা হলো, কার জেন্ডার পরিবর্তন হলো— এসব অসত্য-উদ্ভট সংবাদ। এসব সংবাদ মানুষের আলোচনায় স্থান পাচ্ছে। অনেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছেন যে, বাংলাদেশের মানুষ টিকা নিতে চান না।
প্রশ্ন হলো, এই প্রচারণা কারা চালাচ্ছেন? কত সংখ্যক মানুষ এই প্রচারণায় সম্পৃক্ত? কত মানুষ এই প্রচারণায় বিশ্বাস করছেন?
এই প্রশ্নগুলোর সঠিক বা সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অন্য কারও কাছে নেই। অথচ থাকা অত্যন্ত জরুরি ছিল। টিকা নিয়ে অনীহা অন্যান্য দেশেও আছে, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ নয়। তাদের জানা আছে কত মানুষ টিকা নিতে চান, কত মানুষ নিতে চান না। তারা জরিপ করেছে। কিন্তু, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় আরও অনেক কিছু যেমন করেনি, তেমনি কোনো জরিপও করেনি। কত মানুষ টিকা নিতে চান, গত নভেম্বরে প্রথম জরিপ করেছিল ব্রিটেন। তাতে দেখা যায় ৬১ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন নিতে চান। তারপর প্রচারণা চালায় ব্রিটেন। এই জানুয়ারির জরিপে দেখা যায় ৮১ শতাংশ মানুষ টিকা নিতে চান।
জরিপে দেখা যায় লন্ডনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের ৪০-৪৫ শতাংশ টিকা নেওয়ার পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রে নভেম্বরে টিকা নেওয়ার পক্ষে ছিল ৩৭ শতাংশ মানুষ, জানুয়ারিতে বেড়ে হয়েছে ৫০ শতাংশ। ডিসেম্বরে ফ্রান্সে টিকা নেওয়ার পক্ষে ছিল ৩০ শতাংশ মানুষ, জানুয়ারিতে ৪৬ শতাংশ। ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের ডিসেম্বরের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জরিপে দেখা গেছে টিকা নিতে চান না ভারতে এমন মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ। যা এখন অনেক বেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর বহু দেশ জরিপ করে প্রকৃত চিত্র জেনেছে। কেন মানুষের অনীহা, তা চিহ্নিত করে প্রচারণা চালিয়েছে। বাংলাদেশে আমরা জানি না কত শতাংশ মানুষ টিকা নেওয়ার পক্ষে, কত শতাংশ বিপক্ষে বা দ্বিধায় আছেন। ঠিক কী কারণে টিকা নিতে অনীহা, তাও জানি না।
মজার ব্যাপার হলো, কারণ জানা না থাকায় সুনির্দিষ্ট করে তো নয়ই, প্রোপাগান্ডার জবাবেও কোনো পরিকল্পিত প্রচারণা নেই বাংলাদেশ সরকারের। সবই ধারণাগত, সবই অনুমান-নির্ভর। আরেকটি অনুমান-নির্ভর ধারণা, যেহেতু টিকা ভারত থেকে আসছে, সেহেতু মানুষের ভেতরে অনীহা। এক্ষেত্রে ভারত-বিরোধী রাজনীতির প্রসঙ্গও সামনে আনা হচ্ছে। বাস্তবতা কিন্তু এ কথা বলে না যে, ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি বাংলাদেশের মানুষ আস্থাহীন। প্রতি বছর কয়েক লাখ মানুষ ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নেন। যাদের অধিকাংশই ভারতে চিকিৎসা নিয়ে খুশি।
আরেকটি সংবাদ বাংলাদেশের মানুষকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলেছে বা একটির সঙ্গে আরেকটি গুলিয়ে ফেলেছে। যে সময় ভারত ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন বাংলাদেশকে উপহার দিলো, সেই সময়ই আরেকটি সংবাদ সামনে এলো যে, ভারত ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করতে চায় বাংলাদেশে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যায়, অনেকে ধরে নিয়েছেন উপহার দেওয়া ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন বাংলাদেশে ট্রায়াল করতে চায় ভারত। ‘উপহার’ আর ‘ট্রায়াল’ যে দুটি ভিন্ন ভ্যাকসিন, তা অনেকে বুঝতে পারেননি। অনেকে হয়তো বুঝেও উদ্দেশমূলক প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টির পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিতে সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে উপহার পেয়েছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ওষুধ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা যৌথভাবে যে ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছে, সেই ভ্যাকসিন। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার যে ভ্যাকসিন ব্রিটেন, ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলো ব্যবহার করছে, সেই ভ্যাকসিনই ভারতে উৎপাদন করছে সেরাম ইনস্টিটিউট। সম্পূর্ণ এক ভ্যাকসিন, দুটির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ভারতে উৎপাদন হচ্ছে বলে বাংলাদেশসহ অনেক দেশ সহজে এই ভ্যাকসিন পাচ্ছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হয়েছে ব্রিটেন, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং সীমিত পরিসরে ভারতে।
এর বাইরে ভারতের প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেক ‘কোভ্যাক্সিন’ নামে একটি ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছে। যার ট্রায়াল হয়েছে ভারতে। ট্রায়াল পর্যাপ্ত হয়নি, এমন বিতর্ক ভারতের ভেতরে আছে। যদিও তামিলনাড়ুর স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ অনেকেই কোভ্যাক্সিন নিয়েছেন। ভারত কোভ্যাক্সিনের ট্রায়াল করতে চায় বাংলাদেশে। বাংলাদেশ কোভ্যাক্সিন উপহার পায়নি, কেনেনি বা কেনার আলোচনাও হয়নি। বাংলাদেশ উপহার পেয়েছে, কিনেছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন।
এই তথ্যগুলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মানুষের সামনে উপস্থাপনের প্রয়োজন মনে করেনি। শুধু বলেছে ‘গুজব’ ছড়াবেন না, এমপি-মন্ত্রীরা আগে টিকা নিবেন না, রাজি থাকলে বিএনপিকে আগে টিকা দেওয়া হবে। এসব বক্তব্যে যে আরও ‘গুজব’ ছড়ায়, তা অনুধাবন করছে না সরকারের কর্তারা। জনমানুষের ভেতরে আস্থা অর্জনের জন্যে তাদের কোনো উদ্যোগই দৃশ্যমান নয়।
মনে রাখতে হবে কোভিড-১৯ থেকে মুক্তির উপায় নেই, ভ্যাকসিন ছাড়া। প্রথম ডোজের পরে ২৮ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ নিলে কার্যকারিতা ৬২ শতাংশ। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার সর্বশেষ গবেষণার তথ্য, দুই মাস পর দ্বিতীয় ডোজ নিলে কার্যকারিতা ৭০ শতাংশ এবং তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ নিলে কার্যকারিতা ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিলে হয়তো আট মাস থেকে এক বছর নিরাপদ থাকা যাবে। তারপর আবারও ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। আগামীর পৃথিবীতে ভ্যাকসিন নেওয়া একটি অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হবে। ভ্যাকসিন নেওয়া এবং ভ্যাকসিন না নেওয়া, মানুষ চিহ্নিত হবে এই দুই দলে। ভ্যাকসিন নেওয়াওয়ালারা উড়োজাহাজ, ট্রেন, লঞ্চ এমনকি গণপরিবহনে সুবিধা পাবেন। অফিসিয়াল কার্যক্রমে অগ্রাধিকার পাবেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীর পরিপ্রেক্ষিতেই বিষয়টি এমন হতে পারে। যারা ভ্যাকসিন নেবে এবং যাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে, তারা প্রমাণ সঙ্গে রাখলে বারবার কোভিড-১৯ পরীক্ষা করতে হবে না। সুতরাং ভ্যাকসিন না নেওয়ার বা ভ্যাকসিন-বিরোধী প্রোপাগান্ডা যারা চালাচ্ছেন, তারা দেশ ও দেশের মানুষের বড় রকমের ক্ষতি করছেন। রাজনীতি আর ভ্যাকসিনকে এক করে ফেলা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
নেতাদের আগে ভ্যাকসিন নিতে বলাও কোনো অপরাধ নয়। কঠিন সময়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করেই নেতৃত্ব দিতে হয়। পৃথিবীর বহু নেতা ইতোমধ্যে নজির তৈরি করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা ভ্যাকসিনের ব্যবস্থাপনাটা আরও একটু গোছানো হওয়া দরকার। ভ্যাকসিন চলে এসেছে, কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখনো যথেষ্ট পরিমাণ অগোছালো। চূড়ান্তভাবে তারা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তারা যা বলে, মানুষ তা বিশ্বাস করে না। ভ্যাকসিনের প্রতি মানুষের অনাস্থার এটা একটা বড় কারণ। আস্থা-বিশ্বাস অর্জনের জন্যে দরকার প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত প্রচারণা।
যার ইচ্ছে হবে ভ্যাকসিন নেবেন, ইচ্ছে না হলে ভ্যাকসিন নেবেন না, স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন এ কথা। বিষয়টি মোটেই এমন হওয়া উচিত নয়। দেশের কমপক্ষে ৭০-৮০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে না পারলে নিরাপদ থাকা যাবে না। প্রবাসী ও পোশাকশ্রমিকদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনতেই হবে। সুতরাং, পর্যাপ্ত পরিমাণ টিকা জোগাড় করতে হবে। মানুষকে বুঝিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে তা দিতে হবে। তা না হলে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। সরকার, জনগণ— সবার উপলব্ধিতেই বিষয়টি আসা দরকার।
গোলাম মোর্তোজা : সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
s.mortoza@gmail. com