তুরাগ পরিবহন: মধ্যরাত হলেই ভয়ংকর রুপ
অনলাইন প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
রাজধানীতে যারা বাসে চলাচল করেন তাদের কাছে ‘তুরাগ পরিবহন’ অতি পরিচিত একটি নাম। রাজধানীর সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী থেকে গাজীপুরা পর্যন্ত চলাচল করে এই বাস সার্ভিস। তবে মধ্যরাতে এর রূপ পাল্টে যায়, হয়ে ওঠে ভয়ংকর, পরিণত হয় ‘ছিনতাই পরিবহনে’। বাসের হেলপার, কন্ডাক্টর ও চালক সবাই হয়ে ওঠেন ছিনতাই চক্রের সদস্য।
দামি মোবাইল, ঘড়ি আছে এমন যাত্রী দেখে ‘আদর করে’ বাসে তুলে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে মুহূর্তেই সবকিছু কেড়ে নেয়া হয়। একপর্যায়ে মাঝপথে ধাক্কা দিয়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যায় বাস। যাত্রীদের জিম্মি করে এভাবেই চলতে থাকে ভোররাত পর্যন্ত তাদের হিংস্রতা। মূলত মধ্যরাতে এ অভিযান শুরু হয়। পুলিশের হাতে গ্রেফতার তুরাগ পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো জ-১১-১৩৮১) গাড়ির চালক আবু বকর সিদ্দিকের (২৬) জবানবন্দি এবং পুলিশসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এই ভয়ংকর তথ্য পাওয়া যায়।
সিদ্দিক সোমবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলামের আদালতে দেয়া জবানবন্দির অনুলিপি যুগান্তরের হাতে এসেছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যাত্রাবাড়ী থানার এসআই মো. শহিদুল্লার নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল অভিনব কৌশলে রোববার তাকে ময়মনসিংহ থেকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতারের পর আদালতে জবানবন্দি দেয়ার আগেই সিদ্দিক সবকিছু খুলে বলেন পুলিশের কাছে। তিনি বলেন, তুরাগ পরিবহনের চালক, হেলপার এবং কন্ডাক্টরদের মধ্যে অন্তত ১৫ জন পেশাধার ছিনতাইকারী আছেন। এরা সব সময় সক্রিয়। তাদের নেতৃত্বে আছেন মো. রিয়াজ নামের যুবলীগ নামধারী এক ‘নেতা’। ১০ ফেব্রুয়ারির একটি ছিনতাই মামলায় তাকে আটকও করা হয়েছিল। পরে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তার কাছে প্রতিশ্রুতি আদায় করা হলেও ছাড়া পাওয়ার পরই সে পাল্টে যায়, ভঙ্গ করে প্রতিশ্রুতি।
মো. রিয়াজ নিজেকে যাত্রাবাড়ী থানা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক বলে পরিচয় দেন। কথা হয় যুবলীগ নামধারী এ ‘নেতার’ সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভেতরে ভেতরে একটি কমিটি হয়েছে। সেখানে আমার পদ যুগ্ম সম্পাদক। তবে ওই কমিটি প্রকাশ করা হয়নি।’ ছিনতাইকারী চক্রের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্তা অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো ছিনতাইকারীকে প্রশ্রয় দেই না। আমি তাদেরকে আইনের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে রিয়াজ বলেন, ‘আমাকে থানায় নেয়ার পর আমি পুলিশকে কথা দিয়েছিলাম সিদ্দিককে পুলিশের হাতে তুলে দেব। কিন্তু পলাতক থাকায় আমি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারিনি।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইউনুছ নামে আমার এক ফুফাতো ভাই আছে। সেও তুরাগ পরিবহনের চালক। তার বিরুদ্ধেও ছিনতাইয়ের অভিযোগ আছে। এ বিষয়টি পুলিশ আমাকে আগে জানায়নি। যখন আমাকে জানিয়েছে তখন সে পালিয়ে গেছে। এখনও পলাতক। তাই এ বিষয়ে পুলিশকে সহায়তা করতে পারছি না।’ হেলপার কামাল এবং রুবেলকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে এ বিষয়ে আপনি কিছু জানেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাদেরও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। এ কারণে বিষয়টি নিয়ে পুলিশকে সহায়তা করতে পারছি না।’
এদিকে মঙ্গলবার রাতে নীরব নামে এক ব্যক্তি নিজেকে নবগঠিত যাত্রাবাড়ী থানার যুবলীগের দফতর সম্পাদক পরিচয় দিয়ে মোবাইল ফোনে এ প্রতিবেদকের কাছে জানতে চান কেন রিয়াজকে ফোন করা হয়েছিল? এরপর তিনি জানান, নবগঠিত কমিটিতে রিয়াজের স্থান হয়নি। তাকে কোনো একটি ইউনিট কমিটিতে ভালো পদ দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছিল। যদি ছিনতাই সিন্ডিকেটের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায় তবে তাকে কোনো পদ দেয়া হবে না।
ভোররাতে এ চক্রের খপ্পরে পড়া রাজধানীর কাপ্তানবাজারের মাছ ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম (৩০) বলেন, ‘আমি এবং আরেক মাছ ব্যবসায়ী আলম (৪৫) গত ১০ ফেব্রুয়ারি যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তে মাছ কিনতে টিকাটুলি মোড় থেকে তুরাগ পরিবহনের একটি বাসে উঠি। ওই বাসে চালকসহ চারজন লোক ছিল। গাড়িটি কিছুক্ষণ চলার পর চালকের নির্দেশে তিনজন লোক ছুরি ও চাপাতিসহ আমাদের দু’জনের সামনে আসে। ভয় দেখিয়ে আমাদের বলে, তোদের কাছে যা আছে সব দিয়ে দে। আমরা দেরি করায় একজন ছুরি দিয়ে আলমের পিঠের বাম পাশে আঘাত করে এবং তার সঙ্গে থাকা ৩২ হাজার টাকা এবং একটি সিম্ফোনি মোবাইল সেট ছিনিয়ে নেয়। এ সময় আমি চিৎকার করার চেষ্টা করলে গাড়ির হেলপার ও কন্ডাক্টররা আমার মুখে অস্ত্র ঠেকায়। তারা আমার মুখে আঙুল ঢুকিয়ে দেয় এবং জখম করে। পরে ছুরি ও চাপাতি দিয়ে দুই হাতে আঘাত করে আমার কাছ থাকা ২৬ হাজার টাকাও ছিনিয়ে নেয়। গাড়িটি সায়েদাবাদ সেতুর কাছে এসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আইল্যান্ডের ওপর উঠে গেলে বাসের চালক ও হেলপার গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে আমাদের উদ্ধার করে। পাশাপাশি বাসটি জব্দ করে। পরে চিকিৎসা শেষে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা করি।’
তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশের ওয়ারী বিভাগে উপকমিশনার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন জানান, ১০ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় সিদ্দিক, কামাল ও ইউনুছ নামের তিন ব্যক্তির সরাসরি সম্পৃক্তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এদের মধ্য থেকে সিদ্দিক ও কামালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হওয়া কামাল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না দিলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্দিককে গ্রেফতারে করা হয়েছে। ওয়ারী বিভাগের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনায় রুবেল নামে এক হেলপারের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু তিনি প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন। এ কারণে তাকে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। প্রভাবশালী মহলের চাপের কারণে এ ছিনতাই সিন্ডিকেট চক্রের অন্যতম গডফাদার রিয়াজকে আটকের পরও ছেড়ে দিতে হয়েছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ কর্মকর্তা জানান।
সূত্র জানায়, ১০ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা করা হয়। এরপরই ওই ছিনতাইকারীরা পালিয়ে যায়। পুলিশ জানতে পারে, এ ঘটনার মূল নায়ক সিদ্দিকের সঙ্গে যুবলীগ নেতা রিয়াজের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। তখন চাঞ্চল্যকর এ ছিনতাইয়ের ঘটনায় যুবলীগ নেতা রিয়াজকে আটক করে থানায় আনা হয়। রিয়াজ পুলিশকে জানান, তিনি সিদ্দিককে পাঁচ দিনের মধ্যে থানায় হাজির করবেন। এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে থানা থেকে বের হওয়ার পর রিয়াজ অধিকতর সতর্ক হয়ে পড়ে। সিদ্দিককে নির্দেশ দেন তার ব্যবহৃত মোবাইলটি বন্ধ করে ফেলতে। পুলিশ জানতে পারে, মোবাইলটি বন্ধ হওয়ার আগে সিদ্দিক প্রথম তিন দিন ছিল মুন্সীগঞ্জে। পরের তিন দিন ছিল বরিশালে। এরপর মোবাইল বন্ধ করে ময়মনসিংহে চলে যান। সেখানে একটি মেলায় সেলসম্যান হিসেবে কাজ শুরু করেন। গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে তাকে ময়মনসিংহ থেকে গ্রেফতার করে রোববার ঢাকায় আনা হয়। এর পরদিন তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
উৎস-যুগান্তর।