মেজর সিনহা ও গুম-খুনের বাংলাদেশ

মেজর সিনহা ও গুম-খুনের বাংলাদেশ
রণেশ মৈত্র
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ

বিচার বহির্ভূত হত্যা, খুন, গুম সংক্রান্ত অজস্র ঘটনার লোমহর্ষক কাহিনী শুনতে শুনতে বাংলাদেশের মানুষ ক্লান্ত ও বিপর্য্যস্ত। এই জাতীয় সকল হত্যাকান্ডে লিপ্ত সরকারি পলিশ বাহিনী-যাদের থাকার কথা জনগণের পক্ষে, কাজ করার কথা জনগণের স্বার্থে, নিরাপাত্তা দেওয়ার কথা দেশের নাগরিকদেরকে। কিন্তু প্রায় এক দশক ধরে ঐ জাতীয় যত ঘটনা ঘটেছে তার বিশদ এবং বিস্তারিত বিবরণ বহু ক্ষেত্রেই জানা যায় নি। গুম যাঁরা হয়ে ছিলেন, তাঁদের একাংশ অনেকদিন পরে হলেও, নিজ বাড়ীতে ফিরেও এসেছিলেন। ফিরে এসেছিলেন মারাত্মকভাবে বিপর্য্যস্ত মন নিয়ে। তাঁরা কেউই মুখ খোলেন নি কোথায় ছিলেন-কী বৃত্তান্ত তা জানা যায় নি।

কিন্তু গত ৩১ জুলাই অকস্মাৎ খবর এলো মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নামক সমরিক বাহিনী থেকে অবসর প্রাপ্ত এক তরুণ কর্মকর্তার ঠান্ডা মাথায় সুপরিকল্পিত হত্যাকান্ডের। ঘটনাটা এমনি ভয়াবহ এবং অমানুষিক যে, বিস্তারিত জানলে তা যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। প্রশ্ন জাগে, এ-ও কি সম্ভব? এতটাও কি সম্ভব?
হ্যাঁ, সম্ভব। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে এটা সম্ভব। এবং পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা, সদস্যরা ও তাদের ইনফরমার দালালেরা সকলে মিলে সুপরিকল্পিতভাবে অত্যন্ত ঠা-া মাথায় এই হত্যালীলা দিব্যি চালিয়ে গেলেন।
এ ব্যাপারে একটি জাতীয় দৈনিকে ১১ জুলাই তারিখে প্রকশিত খবরটি পড়ে বহুক্ষণ কোন কথা বলতে পারি নি। “ইয়াবা তদন্তে প্রদীপের সাথে কথা বলাই কাল হলো প্রদীপের” শীর্ষক ঐ খবরে বলা হয়েছেঃ
“জাষ্ট গো” ইউ টিউব চ্যানেলে কক্সবাজার এলাকার ইয়াবার আদ্যোপাস্ত তুলে ধরতে চেয়েছিলেন মেজর (অব:) সিনহা। টানা কয়েকদিন ইয়াবা বাণিজ্যের নেপথ্য কাহিনী নিয়ে ডকুমেন্টারী তৈরী করছিলেন মেজর সিনহা। কোন ধরণের বাধা ছাড়াই সময় পার করছিলেন। তবে শেষ মুহুর্তে টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমারের সাক্ষাতকার রেকর্ড করাটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় মেজর সিনহার জন্য।

প্রত্যক্ষদর্শী ও একাধিক সূত্র অনুযায়ী, ক্রসফায়ারের নামে নৃশংসভাবে খুন করা অসংখ্য মানুষের রক্তে রঞ্জিত প্রদীপ কুমারও ভিডিও সাক্ষাতকার দেওয়ার সময় বার বার কেঁপে ওঠেন। মেজর সিনহার তথ্য বহুল প্রশ্নের পর প্রশ্নে চরম অস্বস্তিতে পড়েন প্রদীপ। নানা অজুহাতে ভিডিও সাক্ষাতকার এড়ানোর সব কৌশল খাটিয়েও ব্যর্থ ওসি প্রদীপ বাধ্য হয়েই প্রশ্নবারে জর্জরিত থাকেন, ভিডিও চিত্রে মেজরের উদঘাটন করা নানা তথ্যের সামনে সীমাহীন নাস্তানাবুদ হন তিনি।
ক্রসফায়ারে অতিমাত্রায় উৎসাহী প্রদীপ ও তার সহযোগিরা ইয়াবা বাজারজাত এবং পাচারের ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকার কথা স্বীকার করতে বাধ্য হন। সফল ঐ সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেই মেজর সিনহা আর একদন্ড দেরী করেন নি। ঝড়ের বেগে থানা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের গাড়িতে উঠে বসেন। তার সঙ্গে ভিডিও রেকর্ডিং এ ব্যস্ত থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতও ক্যামেরা, ট্রাইপড, ব্যাগ গোছাতে গোছাতে ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠতেই টেকনাফ সদর ছেড়ে গাড়ীটি ছুটতে থাকে উত্তরদিকে, বাহারছড়ার পথে।

বাহাড়ছড়া সংলগ্ন মারিসঘোনা এলাকাতেই বসবাস করেন চলচিত্রের ফাইটিং গ্রুপ পরিচালনাকরী ইলিয়াস কোবরা। হঠাৎ তার টেলিফোন করা আমন্ত্রণ পূরোপূরি এড়িয়ে যেতে পারেন নি মেজর সিনহা। মরিসঘোনায় নিজের বাগান বাড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানোর নামে ইলিয়াস কোবরা সেদিন বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্য্যন্ত নির্জন পাহাড়েই নিজ হেফাজতে রেখেছিলেন মেজর সিনহাকে। এ সময়ের মধ্যে মেজরের অবস্থান, কতক্ষণপর কোন রাস্তায় কোথায় যাবেন সে সব তথ্য জানিয়ে কোবরা নয়টি এস এম এস পাঠান ওসিকে।
পরিকল্পনা মাফিক সন্ধ্যা ৭ টার দিকে ওসি প্রদীপ কুমার দাস তার পছন্দের দুই এস আই ও দুই কনষ্ট্রেবল নিয়ে নিজের সাদা নোহায় এবং আরও পাঁচ সাতজন পুলিশ সদস্য অপর একটি মাইক্রোবাসে হন্তদন্ত অবস্থায় থানা থেকে মেরিন ড্রাইভওয়ে ধরে উত্তর দিকে ছুটতে থাকেন। ওসি বাহিনী বাহাড়ছড়া কক্সবাজারের পথে শামলাপুর পুলিশ ক্যাম্পে যাওয়ার পথেই ইলিয়াস কোবরার নতুন খবর আসে। ওসি প্রদীপকে ফোন করে তিনি জানান, এ মুহুর্তে মেজর সিনহা ও তার ভিডিওম্যান সিফাত মারিস ঘোনার পাহাড় চূড়ায় উঠছেন। পাহাড়ের উপর থেকে মেরিন ড্রাইভওয়ে, টেকনাফ সদর, নাফ, নদী-মিয়ানমার সীমান্ত এবং দক্ষিণ দিকে সমুদ্রের বিস্তীর্ণ অংশ দেখা যায়। গভীর সমুদ্রের দিক থেকে ছোট বড় ইঞ্জিন বোটগুলো সার্চলাইটের আলো ফেলে সমুদ্র সৈকতের দিকে আসতে থাকে। পূরা দৃশ্যপটের ভিডিও চিত্র ধারণ করাটাই ডকুমেন্টারীর শেষ দৃশ্য করার পরিকল্পনা সিনহার।

কোবরা ফোনে প্রদীপকে জানান, মেজর সাহেব পাহাড় থেকে নেমে কিছু সময়ের জন্য মেরনি ড্রাইভওয়ে ব্যবহার করে টেকনাফের দিকে যেতে পারেন ও তারপর সেখান থেকে ফিরে যাবেন হিমছড়ির রিসোর্টে। এটুকু শুনেই ওসি প্রদীপ তার গাড়ী থামিয়ে দেন বাহাড়ছড়া পৌঁছানোর আগেই। মারিসঘোনা থেকে টেকনাফ যাওয়ার পথে তিন কিলোমিটার দূরের বড়ডিল নামক স্থানে ওসি ও তার সঙ্গীদের সবাই দুটি মাইক্রো থামিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতিতে অপেক্ষমান থাকেন।
এর মধ্যেই ওসি প্রদীপ কুমার মারিসঘোনা এলাকার দুজন সোর্স ছাড়াও ক্রস ফায়ার বাণিজ্যের টাকা সংগ্রহকারী এজেন্ট বলে কথিত আবদুল গফুর মেম্বর, হাজী ইসলাম, মুফতি কেফায়েতুল্লাহ্ ও হায়দার আলীকে ফোন করে জানান, মারিসঘোনা পাহাড়ের চূড়ায় বেশ কয়েকজন ভয়ংকর সন্ত্রাসী বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে জমা হয়েছে। তারা কেউ পাহাড় থেকে নামার চেষ্টা করতেই যেন এলাকার লোকজনকে সঙ্গে নিযে ‘ডাকাত’, ‘ডাকাত’ বলে চিৎকার জুড়ে দেওয়া হয় এবং যাদের হাতে নাতে পাওয়া যাবে তাদেরই যেন গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হয়। বাকী সব কিছু ওসি দেখবেন এবং এজন্য তিনি মারিসঘোনার দিকে রওনা দিয়েছেন বলেও জানান হয় তাদের।
সঙ্গে সঙ্গে এজেন্টরা পাহাড় সংলগ্ন চারিপাশের বেশ কয়েকটি বাড়ীঘর ছড়িয়ে লাঠিসোটায় সজ্জিত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন।

এমন আরও অনেক লোমহর্ষক কাহিনী নানা মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েই চলেছে। হয়তো বা উল্লেখিত কোন ব্যক্তি জড়িত ছিলেন না-ভুলবশত: তাঁর নাম সাংবাদিকের রিপোর্টে এসে গেছে। কিন্তু তা সত্বেও নিঃসন্দেহে দাবী করা যায় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলি যথেষ্ট পরিমাণে সত্য এবং শান্তিকামী মানুষের জন্যে মারাত্মকভাবে আশংকাজনক।

জানা গেছে, পাহাড়ের ঐ এলোকা ওসি প্রদীপ কুমারের কারণে রাতের বেলায় হয়ে উঠতো ভীতিকর। সাধারণ মানুষ ঐ পাহাড়ী পথে চলাফেরা করার সাহস পেতেন না। পূরো এলাকা হয়ে উঠতো সস্ত্রাসী তৎপরতায় ভয়াল রোজই প্রায় ক্রসফারে মানুষ হত্যা করা হতো ওসি’র দাবীকৃত টাকা না দিতে পারা অপরাধে। ঘটনাগুলি দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত হয়েছিল।
র‌্যাব এই ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর অনেককে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে যার মধ্যে পুলিশের দায়ের করা মামলার কতিপয় সাক্ষীও রয়েছে। তাদের মুখ থেকে র‌্যাব অনেক তথ্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে হয়তো এই তথাকথিত সাক্ষীরা শেষ পর্য্যন্ত হত্যা মামলার সহযোগি হিসেবে আসামী তালিকাভূক্ত হতে পারে।

মেজর সিনহার পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করতে গেলে তা পুলিশ নিতে অস্বীকার করেছিল। পরে আদলতের হস্তক্ষেপে সেই মোকর্দমা রেকর্ড করা হয় এবং তার তদন্ত কাজ র‌্যাব পরিচালনা করছেন।

বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়, সংশ্লিষ্ট খুনী ওসি প্রদীপ কুমার ও একই থানার পুলিশ কর্মী ও কর্মকর্তা-যারা ঐ হত্যালীলায় ওসি’র সহযোগি হিসেবে ভূমিকা পালন করেন-তারা গ্রেফতার ও নিজ নিজ পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত হলেও ওসির পেছনে অনেক বড় বড় রাঘব বোয়াল সক্রিয় ছিলেন তার তাবৎ প্রমাণ র‌্যাবের কাছে।

বাংলাদেশে আজও পুলিশ জনগণের বন্ধু হয়ে উঠতে পারলো না কতিপয় ব্যতিক্রম বাদে। ব্যতিক্রমী হলেও যে সকল পুলিশ কর্মকর্তা ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য শত প্রলোভনের ও সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে সৎভাবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন-তাঁদের সককে হজারো স্যালিউট জানাই যদিও সৎভাবে দায়িত্ব পালন সবার জন্যই আইনগত দায়িত্ব।
কিন্তু অপরাধীরা? যাঁরা মানুষ গুম করেন বিনিময়ে টাকা আদায় করেন, যাঁরা চোরাকারবারীদের সাথে হাত মিলিয়ে ও মাদক ব্যবসায়ী ও পাচারকারী, অস্ত্র পাচারকারী এবং এ জাতীয় মারাত্মক অপরাধে সরাসরি বা অপ্রত্যক্ষভাবেই জড়িত তাঁদের প্রতি কোন করুণা নয় বরং কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন-যদিও এ যাবত কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার গায়ে কেউ স্পর্শ করেন নি। বিভাগীয় শাস্তি নামক আদরের ব্যবস্থা নিয়ে মানুষকে পাগল বুঝ দেওয়ার অপচেষ্টা করা হচ্ছে বহুকাল যাবত।
এবারে তার অবসান হোক। গুম, ক্রসফায়ার প্রভৃতির এখানেই সমাপ্তি সূচীত হোক।
আইন শৃংখলার এহেন করুণ পরিস্থিতিরও এখানেই সমাপ্তি ঘটুক।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!