শত প্রদীপে আলোকজ্জ্বল হোক বাংলাদেশ
শত প্রদীপে আলোকজ্জ্বল হোক বাংলাদেশ
রণেশ মৈত্র (সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, পাবনা
১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতবর্ষের সুরুতে এই ক্ষণজন্মা দেশ নেতার শুভ জন্মলগ্নের ক্ষণগণনা শুরু হলো। ৭ মার্চ তাঁর জন্মদিন, শত প্রদীপে সমগ্র বাংলাদেশ আলোকিত হোক, এই কামনা নিয়েই সমগ্র বাঙালি জাতি, দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, নারী সমাজ, ছাত্র সমাজ, শ্রমিক শ্রেণী, কৃষককূল ধর্ম-বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে বছরটি নানা আয়োজনে উদযাপন করবে। দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট জনেরা আসবেন, বাঙালীর প্রাণের নেতাকে, বঙ্গবন্ধু তথা বিশ্ববন্ধুকে তাঁদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাতে।
বাঙালী জাতির জন্য বঙ্গবন্ধুর দানের সীমা-পরিসীমা নেই। ১৯২০ সালে অজ পাড়া গাঁয়ে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। একটি আজান পড়েছিল সেদিনকার সেই শত সম্ভাবনাপূর্ণ শিশুটিকে দেশের মাটিতে স্বাগত জানিয়ে।
সেই ১৯২০ সালে জন্ম আর তাঁর করুন বিদায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের কালরাতে। মাত্র ৫৫ বছর জীবিত থাকতে পেরেছিলেন ঐ হাজারো সম্ভাবনাপূর্ণ শিশুটি বিশ্বকে চোখের জলে ভাসিয়ে। বাঙালি বেদনার সাথে অনুভব করে বঙ্গবন্ধু আক্রান্ত হলে দেশবাসী, এমন কি তাঁর ঘনিষ্ঠ জনেরাও ঐ নির্মম আক্রমণ প্রতিরোধে এগিয়ে যেতে পারেন নি স্রেফ পরবর্তী নেতৃত্বের ভীতির কারণে।
অথচ, আজ মনে পড়ে ঐ একটি মানুষ দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে তাঁদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে কী অসীম সাহসের সাথেই না জীবনভর লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলন করেছিলেন অসীম বিচক্ষণতার সাথে তাঁর প্রিয় বাঙালি জাতিকে মুক্ত করতে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে। আজও মানুষ সে কথা ভেবে শ্রদ্ধায় তাঁর ছবিতে ফুল দেয়, কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করে এই দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে।
এক নজরে পেছন ফিরে দেখা যাক শেখ মুজিব নামক ১৯২০ এর ১৭ মার্চ ভূমিষ্ঠ হওয়া সেই শিশুটি তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে দেশের মানুষকে কি কি দিয়ে গিয়েছেন। মাত্র ৫৫ বছরের মধ্যে প্রথম ২০ বছর যদি তাঁর চেতনা বিকাশে লেগেছে বলে ধরে নেওয়া যায়, তবে তো তাঁর হাতে সচেতনভাবে দেশের কাজ করার জন্য সময় পেয়েছেন মাত্র ৩৫ বছর। অংকের হিসাব আমাদেরকে আরও জানায় যে তাঁর দীর্ঘ বার বছরের কারাজীবনকে হিসেবে নিলে প্রকৃত পক্ষে সক্রিয়ভাবে জনগণকে নিয়ে জনগণের সাথে মিলে পৃথিবীর আলো-বাতাসে সমৃদ্ধ হয়ে কাজ করার সময় পেয়েছিলেন মাত্র ২৩ বছর। মাত্রই ২৩ বছর। তবে জেলখানায় বসেও দিনগুলি তিনি ঘুমিয়ে কাটান নি-ভেবেছেন দেশের কথা-মানুষের কথা-বাঙালি জাতির কথা-আন্দোলনের কথা-সংগ্রামের কথা-লাড়াই এর কথা।
বঙ্গবন্দু একজন বিশালদেহী মানুষ তেমনই বিশাল ছিল তাঁর হৃদয়, তেমনই দৃঢ় ছিল তাঁর প্রত্যয়, তেমনই নিষ্ঠা ছিল তাঁর দেশ, জনগণ ও আদর্শের প্রতি।
এগুলি অতিকথন নয়-স্তাবকতাও নয়। যদিও কি বঙ্গবন্ধু কি তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা -উভয়ের কপালেই বিপুল সংখ্যক স্তাবক জুটেছে। স্তাবকেরা প্রায় সকলেই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ তাঁর বিশ্বস্তও। আর সর্বোচ্চ বিশ্বস্ত হিসেবে যিনি দলে ও সরকারে ছিলেন তাঁর নিকতটতম ঘনিষ্ঠতম সেই খোন্দকার মোশতাকই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মত নির্মম ঘটনা ঘটাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন নি।
আজও রাষ্ট্রক্ষমতাকে ঘিরে যে হারে স্তাবকের দল জুটেছে তাতেও শংকিত বোধ করার যথেষ্ট কারণ আছে। দুধ কলা দিয়ে যে সাপগুলিকে পুষতে দেখা যাচ্ছে তাদেরকে চেনা দুরূহ বটে কিন্তু তবু না চিনলে, তাদের বিরুদ্ধে সময়োচিত, দৃঢ় পদক্ষেপ না নিলে সর্বনাশের পুনরাবৃত্তি অসম্ভব কিছু নয়।
যা হোক, বঙ্গবন্ধুর লালিত আদর্শ, এদেশের মহান ভাষা আন্দোলনের আদর্শ, গণতান্ত্রিক আন্দোলন সমূহের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ যা তিনি ধারণ করতেন, লালন করতেন-সেগুলিকে সইতে বা মানতে রাজী না থাকার ফলেই দলের ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থেকে খুনীরা অত বড় একটি বিপর্য্যয় ঘটিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র পরোয়া করে নি ঘাতকের লোমশ হাত কাপে নি একটুও।
পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল ইসলামী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে। ঐ রাষ্ট্র গঠনেও শেখ মুজিবের বাল্যকালে খানিকটা অবদান ছিল মুসলিম লীগের কর্মী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। কিন্তু পাকিস্তান যখন বাস্তবে রূপ পেল, চাঁদ তারা পতাকা যখন ঘরে ঘরে উড়ানো হলো, ‘পাক সরজমিন’ নামক গানটি (অবাঙালির গানকে) যখন তার জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়ানো শুরু হলো, পোষ্ট্যাল স্ট্যাম্প, মনি অর্ডার ফর্ম, সরকারি দফতর সমূহের যাবতীয় নথিপত্র যখন ঊর্দু ও ইংওরেজীতে ছাপানো হলো, শেখ মুজিব তখনই পাকস্তিান গড়ার নেতাদের মতলব বুঝে ফেললেন। দেশের বাপন্থী তরুণ সমাজের সাথে হাত মিলিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখলেন।
ইতিমধ্যে যৌবনে উত্তীর্ণ শেখ মুজিব সংগঠন গড়া, দল গড়া (মুসলিম ছাত্রলীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ) শেষে তাবৎ আন্দোলণ গড়ে তুলতে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মূলত: পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে গড়ে তোলা ঐ আন্দোলন সমূহে দেশের বাপন্থী তরুণ-তরুণীরাই ছিলেন সাহসী সহযোদ্ধা। জাতীয়তাবাদী ও বামশক্তির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক একটি বাঙালি রাষ্ট্র গঠনের লৌহদৃঢ় প্রত্যয়।
সেই অবিনাশী প্রত্যয় নিয়ে আন্দোলনের মাঠ প্রকম্পিত করে তুলেছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং ভাসানী মনিসিংহের নেতৃত্বে বামপন্থী তরুণ শক্তি হাতে হাত ধরে। উভয় শক্তির মধ্যে সংহতিও গড়ে উঠেছিল বিপুলভাবে।
যেদিন বিদেশের মাটিতে অন্যতম আওয়ামী লীগ নেতা পাশ্চাত্যে ঘেঁষা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পরোলক গমন করেন শেখ মুজিবের একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের উপর। ১৯৫৫ তে আওয়ামী মুসলিম লীগ “মুসলিম” শব্দ দলের নাম থেকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত করা, ১৯৭২ সালের সংবিধানে চারটি ঐতিহাসিক মৌলনীতি ঘোষণা (গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ) বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনার সর্বোচ্চ প্রতিফলন হিসেবে সর্বত্র স্বীকৃত সর্বত্র নন্দিত।
তাই শেষ বিবেচনায়, আজ বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিনের প্রাক্কালে স্মৃতিতে ভেসে উঠছে তাঁর ঐতিহাসিক অবদান ও আদর্শের অবিনশ্বর চেতনাগুলিকে এবং তাঁর জীবনের অমূল্য শিক্ষাগুলিকে।
সেগুলিকে সংক্ষেপে এভাবে চিত্রিক করা যায়:
এক. সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে যোগ দিয়ে অবশেষে তাকে ঘৃণার সাথে পরিত্যাগ করে অসাম্প্রদায়িক চরিত্রে সংগঠনকে রূপান্তরিত করা;
দুই. ভিক্ষা নয়, আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমেই জনতার ন্যায্য দাবী দাওয়া আদায় করতে হয়;
চার. শত্রুকে কদাপি বন্ধু বলে গ্রহণ না করা এবং বন্ধুর সাথে মিত্রতা ক্রমান্বয়ে দৃঢ় করা এবং
পাঁচ. জাতিকে কদাপি বিভক্ত নয় বরং সর্বদা সকল কাজে ব্যাপকভাবে ঐক্যবদ্ধ করা।
এই শিক্ষাগুলিকে পূরোপূরি গ্রহণ করে অগ্রসর হতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ পুন: প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতির সকল বাস্তবায়নই হতে পারে বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের প্রধানতম প্রত্যয়।
তাই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ যত জৌলুমের সাথেই পালন করা হোক-তার সাথে অবশ্যই পরিপূর্ণ সংযোগ ঘটানো প্রয়োজন তাঁর আজীবন লালিত আদর্শ সমূহকে যে আদর্শ নিয়ে তিনি সংগ্রাম করেছেন সারাটি জীবনভর যে মহান আদর্শগুলি তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর রচিত বাহাত্তরের সংবিধানে সেগুলির অবিকল পুন:স্থাপন।
সুতরাং আমরা যদি এই বর্ষটি যথার্থই উদযাপন করতে চাই তাহলে তার প্রতিটি মুহুর্তকে যেমন আনন্দঘন করে তুলতে হবে-তেমনই তাঁর সূমহান আদর্শগুলিকে সংবিধান পুন:স্থাপন করে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে।
এই লক্ষে আগামী ১৬ মার্চ (১৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর জন্মের পূর্ব দিনে) সংবিধানের বিশেষ অধিবেশন ডেকে বাহাত্তরের সংবিধান অবিকল পুনরুজ্জীবিত করা হোক।
# বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লক্ষ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক;
# ১৯৭৫ পরবর্তীকালে সংঘটিত তাবৎ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচার ও অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হোক;
# ধর্মীয় ও জাতীয় সংখ্যালঘু (আদিবাসীদের সকল ক্ষেত্রে সম অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হোক এবং
# শান্তিপূর্ণভাবে সকলের মত প্রকাশের এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্বকারী সকল আইন প্রতিষ্ঠা করা হোক।
এগুলিই হোক শতবকর্ষের আলোকোজ্জ্বল শত প্রদীপ যা থেকে দীপ্ত ও উজ্জ্বল হোক আমাদের বাংলাদেশ।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।