সাংবাদিকতায় পাবনায় ভূমিকা
সাংবাদিকতায় পাবনায় ভূমিকা
রণেশ মৈত্র
গত ১৩ অক্টোবর রাতে পাবনা প্রেসক্লাবে একজন তরুণ সহকর্মী হঠাৎ জানালো, রাজশাহীর বিভাগীয় সাংবাদিক সমিতির পক্ষ থেকে একটি স্যুভেনার প্রকাশিত হবে। তাঁরা পাবনার একটি লেখা চান। এই বলে আমার ফোন নং নিয়ে সংশ্লিষ্টদেরকে জানালেন। ১৪ অক্টোবর সকালে যোগাযোগ হলে ঐ একই অনুরোধ পেলম রাজশাহী বন্ধুদের কাছ থেকে। বস্তুত : রাজশাহী বিভাগীয় সাংবাদিক সমিতি নামকরণ আমার কাছে কিছুটা বিভান্তিকর বলে মনে হলো আমারই অজ্ঞতাবশত: এই সমিতি কি রাজশাহী বিভাগের সকল জেলা-উপজেলার সাংবাদিকেরা মিলে গঠন করেছেন? এই সমিতি কি নিয়মিত বার্ষিক বা দ্বি-বার্ষিক বা ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন করে কার্য্যকরী কমিটি নির্বাচিত করে থাকে? হতেও পারে। কিন্তু আমার জানা নেই। তাই কর্মকর্তারা অপরিচিত। অপরিচিত বয়সের ব্যবধানের কারণেও। কিন্তু সাংবাদিক যখন তাঁরা পরীক্ষা থাকা না থাকার প্রশ্নটি অবান্তর। আমরা কি কেউ মার্কটালি কে দেখেছি? না, দেখিনি। কিন্তু পারিচিতের চাইতেও অনেক বেশী পরিচিত তিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকের কাছে যদিও তিনি সুদর ইংল্যান্ডের অধিবাসী এবং বিবিসির বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি কুড়িয়েছিল। এই তুলনা টা যদিও ঠিক হলো না কারণ মার্কটালির খ্যাতির সাথে আমাদের কারও খ্যাতির তুলনা করা যায় না। যা হোক, প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ১৯৫১ সালে প্রথম সাংবাদিকতা শুরু করি আজও তা অব্যাহত। তখন সাংবাদিকতা শুরু করি এবং আরও যাঁরা কোন মফঃস্বল শহরে বা এলাকায় সে যুগে সাংবাদিকতা করতেন তাঁরা কেউই বিন্দুমাত্র পরিশ্রমিক পেতেন না। পত্রিকা মালিকেরা দিতেন না। এমন কি ডাক খরচ, টেলিগ্রাম বা ফ্যাক্স পাঠানোর খরচ বা খবর সংগ্রহের খরচ, কাগজ কলমের দাম কিছু দিতেন না। তবুও কেউ কেউ কাজ করতাম রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, ক্ষমতার লোভ থেকে নয়, দুঃখ দুর্দশার আন্দোলন সংগ্রামের খবর প্রকাশের লক্ষ্যে। কেউ বা সমানে পরিচিতি অর্জনের লক্ষ্যে, কেউ বা সাংবাদিকতা শিখবার জন্যে। এমন পরিস্তিতি চলতে থাকলো ১৯৪৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত। যাঁরা পত্রিকা অফিসে ঢাকায় সাংবাদিক কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন তাঁরাই শুধু নির্দিষ্ট পরিমাণে বেতন পেতেন তাও অত্যন্ত কম। তবে তাঁরা পর্বূ পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নে যা ছিল তা সংগঠিত হয়ে উপযুক্ত বেতন ভাতার দাবীতে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারকে সাংবাদিকদের জন্য বেতন বোর্ড গঠনে বাধ্য করেন। সেই বেতন বোর্ডের পক্ষ থেকে প্রথম রোয়েদাদ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালের ডিসেম্বরে। তাতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্যাটোগরীতে সংবাদদাতা গুলিতে বিভক্ত করে প্রতিটি ক্যাটোগরীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন বেতনের স্কেল ও ভাতাদি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু মফঃস্বল সাংবাদিককেরা কোনভাবেই সংগঠিত ছিলেন না। ফলে তাঁরা ঐ বেতন স্কেল থেকে বাতিল হন। বাঁ হলা মফঃস্বল সাংবাদিককেরা ‘সার্বক্ষণিক’ সাংবাদিক নন। তাই তাঁরা ‘কর্মরত সাংবাদিক হিসেবে বিবেচিত নন’। সুতরাং তাঁরা ঐ বেতন ভাতাদি থেকে রক্ষিত হলেন। তৎকালীন সকল দৈনিক পত্রিকাতেই ঐ রোয়েদাদ পূরোপূরি প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা গেল “…………………………………………….” অর্থাৎ “জেলা সংবাদদাতা” নামে এক ধরনের সাংবাদিকের উল্লেখ আছে এবং তাঁদের জন্য লাইনেজ ও বিটোইনার হিসেবে সামান্য কিছু পারিশ্রমিক দেওনার বিধানের ব্যবস্থা আছে। যেদিন ঢাকার পত্রিকাগুলিতে রোয়েদাদাটি প্রকাশিত হয় সেদিন পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকার রংপুর প্রতিনিধি আবু সাদেক ঢাকায়। সকালে হোটেল হতে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে তিনি প্রেসক্লাবে গেলেন চা-নাস্তা খেতে। সেখানেই পত্রিকাগুলিতে প্রকাশিত ঐ রোয়েদাদ তাঁর নজরে পড়ে। ই. পি. ই. জে. কর্মকর্তারা এলে তিনি তাঁদের সাথে আলাপ করেন এবং জানতে চান মফঃস্বল সাংবাদিকদের জন্যে ঐ রোয়েদাদ প্রচেষ্টা হবে কি না। তাঁরা বলেন “না”। তবে তাঁরা বলেন, “আমাদেরকে সংগঠিত হয়ে দাবী তুলতে হবে আদায় করতে হবে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার ও মালিকদের কাছ থেকে। এটা যদি করতে চান পাবনা গিয়ে রণেশ মৈত্রের সাথে যোগাযোগ করে সংগঠন তৈরীর ব্যবস্থা শুরু করুন। পাবনাতে আমরা তাকে ছাড়াই সংগঠিত হওয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করে রাজশাহী খুলনা বিভাগীয় সম্মেলন ডেকেছিলাম প্রাদেশিক সম্মেলন ডাকার সাহশ পাইনি। এই পরামর্শ আবু সিদ্দিককে দিলেন প্রয়াত কে. জি মুস্তফা ও সালাহ্ উদ্দিন মোহাম্মদ দিল কুয়েত পরেই ছুটে এলেন আবু সাদেক পাবনাতে। আমার পরিচয় ছিল না তার সাথে বা তার আমার সাথে। বেশী কথা না বলে সংক্ষেপে পরিচয় দিয়ে সরাসরি জানালেন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতাদের পরামর্শের কথা। অতঃপর আবু সাদেক বললেন দাদা, উদ্যোগ নেন প্রাদেশিক সম্মেলনের সার্বিক সহযোগিতা করবো। ‘না’ বললাম এই যুক্তিতে যে পাবনা ছোট্ট শহর সাংবাদিক নেই বললেই চলে মিল কারখানা বা অর্থ প্রাপ্তির উৎস নেই। ফলে সংগঠক কর্মী টাকা পয়সা কোন কিছু পাবনাতে পাওয়া যাবে না। বরং রংপুর বা রাজশাহীতে করুন। যতটুকু সম্ভব পাবনার সহযোগিতা পাবেন। আর তাছাড়া আমরা তো রাজশাহী, খুলনা বিভাগীয় সাংবাদিক সম্মেলন ইতোমধ্যেই ডেকেছি। যেখানে তো দেখা হবেই আপনাদের সাথে। আবু সাদেক বললেন, এ বিষয়ের কে. জি. ভাইদেরকে বলেছি তাঁরা এটাকেই প্রাদেশিক সম্মেলনে রূপান্তরিত করার পরামর্শ দিলেন। যা হোক শেষ পর্যন্ত সবাই আলাপ করে ঢাকার প্রস্তাব গ্রহণ করে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা হলো ৭/৮ মে, ১৯৬১ তারিখে পাবনাতে। বিভাগীয় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির বর্ধিত সভায় প্রাদেশিক সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠিত হলো। পাবনার প্রয়াত এ কে এম আজিজুল হককে সভাপতি ও আমাকে সম্পাদক করে। দু’দিন ব্যাপী ঐ সম্মেলনের মধ্যরহিত আগে কে. জি মুস্তফাসহ তিনজন সাংবাদিক কে গ্রেফতার করলো সরকার জন নিরাপত্তা আইনে। ফলে আমাদের প্রতিশ্রুতি বিশেষ অতিথি ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞা ও সংবাদ সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী তাঁদের আমার কর্মসূচী বাতিল করে শুভেচ্ছা বাণী পাঠালেন সালউদ্দিন মোহাম্মদ সভাপতি পর্বূ পাকিস্তান সাংবাদিক ইনিয়নের মাধ্যমে। সম্মেলনের অপর দুই বিশেষ অতিথি পাকিস্তান অবজার্ভার সম্পাদক আবদুস সালাম ও মর্নিং নিউজ সম্পাদক এম. জি. এম. বদরুদ্দিন এলেন। উদ্বোধন করলেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রী (বগুড়ার) হাবিবুর রহমান। সম্মেলনে সারা প্রদেশ থেকে ৬০/৭০ জন সাংবাদিক এলেন। উল্লেখ্য, ১৯৬১ সালে মফঃস্বল সাংবাদিকদের সংখ্যা এতই কম ছিল (পত্রিকা কম থাকার এই টিভি চ্যানেল না থাকার কারণে) যে ঐ সংখ্যাকে সবাই বিরাট উপস্তিতি বলে মনে করলেন। যা হোক, সম্মেলনটি বিস্মকর সাফল্য অর্জন করে এবং সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে “পূর্ব পাকিস্তান মফঃস্বল সাংবাদিক সমিতি” নামে দেশের মফঃস্বল সাংবাদিকদের ট্রেড ইউনিয় সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পাবনার আজাদ এ.পি.পি প্রতিনিধি এ.কে.এম. আজিজুল হককে সভাপতি, কুমিল্লার এম. রহমাতুল্লাকে সাধারণ সম্পাদক মুন্সীগঞ্জের শফি উদ্দিন ও পাবনার রণেশ যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। সম্মেলনের সকল কর্মসচূীই পত্র পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করায় দেশের সাংবাদিকদের মধ্যে অধিকতর উৎসাহের সৃষ্টি হয়। মুল দাবীগুলির মধ্যে ছিল (১) মফঃস্বল সাংবাদিকদেরকেও বেতন বোর্ডের রোয়েদাদের আওতায় আনতে হবে (২) তাঁদেরকে সার্বক্ষণিক সাংবাদিক অর্থাৎ “কর্মরত সাংবাদিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, (৩) বিনা বিচারে আটক সকল সাংবাদিক ও রাজবন্দীদেরকে মুক্তি দিতে হবে, (৪) সংবাদপত্রের কারারোধকারী সকল কালাকুন বাতিল করতে হবে এবং (পাঁচ) কাল ক্রমে পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাথে একীভূত হয়ে সারা দেশে একটি মাত্র সাংবাদিক সংগঠন গড়ে তোলা হবে সাংবাদিকদের বাধ্যতম ঐক্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। কিন্তু সমিতির সদস্য কর্মকর্তা সারা পূর্ব বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় নতুন কমিটির সভা অনুষ্ঠান ছিল কষ্ট সাধ্য। তবুও তা মাঝে মাঝে ঢাকা প্রেসক্লাবে করা হতো। পত্রিকা কর্তৃপক্ষের সাথে ডেপুটেশন নিয়ে গিয়ে আলাপ আলোচনা ও করা হতো। এর ফলে সর্বপ্রথম পাকিস্তান অবজার্ভার, মর্নিং নিউজ চালু করলো লাইনেজ প্রথা যেমনটি লেখা ছিল বেতন বোর্ড রোয়েদাদে জেলা সংবাদদাতাদের জন্য। বেতন স্কেল কেউই চালু করতে রাজী হননি মফঃস্বলের সবাই “পার্ট টাইমার সাংবাদিক এই অজু হাতে। ধীরে ধীরে ইত্তেফাক ও দৈনিক পাকিস্তানও সমিতির দাবীর ভিত্তিতে লাইনেজ প্রথা চালু করে। এভাবে সমিতি গঠনের ফল ইতিবাচক হতে শুরু করে। দৈনিক পাকিস্তান ষাষ্টের দশকের মাঝামাঝি সক্রিয় দাবীর চালালে তাদের পাঠান জেোর সাংবাদদাতাকে জুনিয়র স্টাফ রিফোর্টার পদে উন্নীত করে স্কেল অনুযায়ী বেতন ভাতাদি চালু করায় আরও অগ্রগতি হতে থাকলো। এভাবে মফঃস্বল সাংবাদিকেরা তাঁদের পেশা জীবনে নতুন উন্নীত হতে শুরু করেন। আজ সেদিনকার কথা ভাবাই যাবে না। এখন পরিস্থিতি অনেক পাল্টেছে অনেকেই কমবেশী বেতন বোর্ডের রোয়েদাদ অনুযায়ী পাচ্ছেন। তবে এখনও কর্মরত সাংবাদিক অর্থাৎ সার্বক্ষণিক সাংবাদিক হিসেবে স্বীকৃতি না চাওয়াতে বেতনভূক্ত নন। কোন কোন পত্রিকা বা চিভি চ্যানেল থেকে না ফিস্ট একটা অংক দিচ্ছেন বলে শুনেছি। কিন্তু উপ-সম্পাদকীয় বা কলাম লেখকদের জন্য এখনও কোন বিধান বেতন বোর্ডে নেই ফলে কলাম লেখকরা বিলীন। তাই সমিতির প্রয়োজনীয়তা এখনও প্রচুর। কিন্তু দুঃখ্যজনক ঘটনা হলো কতিপয় নেতৃত্ব লোভী স্বার্থান্বেষীর কারণে পূর্ব পাকিস্তান সমিতির আজ আর অস্তিত্বই নেই। যা ৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি নামে পরিচিত তাই এখন মফঃস্বলের সাংবাদিকদের স্বার্থে বৃহত্তর অর্থে না দেখার সাংবাদিকতা ও সাংবাদিক সমাজের স্বার্থে নতুন করে মফঃস্বল সাংবাদিকদের সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন ও অনিবার্য্য হয়ে উঠেছে। এই নিবন্ধের মাধ্যমে রাজশাহী বিভাগীয় সাংবাদিক সমিতির নেতৃত্বের কাছে আমার আবেদন তারা উদ্যোগী হন সারাদেশের সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ করুন, যোগাযোগ করুন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাথেও। বর্তমান পরিস্থিতিতে সকল সাংবাদিকদের স্বার্থে কি করণীয় তা নির্ধারণ করুন। নতুন বেতন বোর্ড গঠনের আগেই উপর্যুক্ত পদক্ষেপও গ্রহণ করুন।