সুচি কে লেখা এক শিশু রোহিঙ্গা জহিরের মর্মস্পর্শী গাঁ শিউরে উঠা চিঠি
আপনি কি ভাল আছেন? হয়তো ভাল। আবার না ও থাকতে পারেন। কারণ যতদূর জানি আপনার স্বভাব কিছুটা আমার মায়ের মতনই। আপনি দেখতেও আমার মায়ের মতনই কিছুটা। তাই আপনাকেই কিছু কথা বলতে চাই। যেহেতু মায়ের কথা খুব মনে পরছে এ মুহূর্তে। সে যেখানেই থাকুক, আল্লাহ ভাল রাখুন তাঁকে।
আচ্ছা, নিজের পরিচয় দেই একটু। আমার নাম জহির, বয়স ১২। বাবার নাম বসির উদ্দিন। মা তাহেরা। আমার আরও তিনটি ভাই বোন আছে। কিন্ত তারা আজ কে কোথায় আছে আমি তা জানিনা। আমাদের আপনারা রোহিঙ্গা বলে ডাকেন – মুসলিম রোহিঙ্গা, হিন্দু রোহিঙ্গা। আমাদের রাখাইন রাজ্যের গাঁয়ে আমরা ভালো ছিলাম কি মন্দ ছিলাম জানিনা, তবে আজকের চেয়ে অবশ্যই ভালো ছিলাম। আজ শুধু বেঁচে আছি, যদি একে বাঁচা বলে। এইটুকু বয়সে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। আজ সে কথাই আপনাকে বলতে চাই। আরও বলতে চাই একটি স্বপ্নের কথা। আমার এখন একটাই স্বপ্ন। আর তা হল আপনার সাথে দেখা করা। দেখা হলে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব। এবং অবশ্যই তার উত্তর নিয়েই আমাকে ফিরতে হবে।
আমার বাবা ছিলেন জেলে। মাছ ধরে খুব অল্প রোজগারে আমরা প্রতিদিন খেতে আর পরতে পারতাম। আমাদের গাঁয়ে একটা স্কুল ছিল। সেখানে আমি প্রতিদিন পড়তে যেতাম। বইয়ের পাতার জগৎটা আমার কাছে অদ্ভুত, অপরিচিত তবে রঙ্গিন আর স্বপ্নের মতই মনে হত। কল্পনায় দেখতাম আমিও একদিন দেশের নাম বলবো, পতাকা আঁকবো আর গাইবো জাতীয় সংগীত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গায়ের গণ্ডী ছাড়িয়ে যাবো রাজধানীতে। যদিও বইয়ের পাতায় যে দেশ, প্রকৃতি, গল্প, কবিতা, ইতিহাস লেখা ছিল তার সাথে আমাদের জীবনের কোন মিল ছিল না। আমি জানতাম না দেশ কী, পতাকা কী, সেনাবাহিনী কী। কিন্তু এ কদিনে এবং আজ জীবন আমাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে।
প্রথম কষ্টের দিন শুরু হল যেদিন আমার বাবা তার রক্তাক্ত আর ব্যান্ডেজ করা মাথা নিয়ে নদী থেকে ফিরে এলেন। কারণ আপনার সেনারা বলল নদীতে মাছ ধরা নাকি রোহিঙ্গাদের জন্য নিষেধ।তারা সব জেলেকে মেরে পিটিয়ে নদী থেকে তাড়িয়ে দিল। আল্লাহ’র দুনিয়ায় নিজের গাঁয়ের নদীতে মাছ ধরা কোন ধরণের অপরাধ ছিল একটু বুঝিয়ে বলবেন আমাকে?
তারপর বাবা আমাদের মুখে একটু অন্ন যোগানোর জন্য হেন কাজ নেই যা করেননি। কুলির কাজ করা, জুতা সেলাই করা থেকে শুরু করে আরও কত কাজ। এখানে যেকোন কাজ পাওয়াই কঠিন। আমার বাবা পরিশ্রমী একজন মানুষ ছিলেন। কখনও বসে থাকতেন না। সর্বশেষ আমি ও বাবা একজনের জমিতে কাজ নিয়েছিলাম। বর্গা চাষির কাজ। স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম আবার, দিন ফিরবে। আমরা খুবই সাধারণ শ্রমিক রোহিঙ্গা। রাজনীতি বুঝিনা। শুধু খেয়ে পরে বাঁচতে চাই। আমাদের তো খুব বেশি চাওয়া কোনকালেই ছিল না। তাই পরিশ্রম করে দিন ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখা কি অপরাধ ছিল?
কিন্তু হঠাৎ সে স্বপ্নেও ছেদ পরল। সেদিন সবে সন্ধ্যা হয় হয়। বেশ কিছু সেনাসদস্য কয়েকটা গাড়িতে করে এলো। কিছু লোক এলো সাধারণ পোষাকে। তারা চিৎকার করতে করতে ঘৃণিত দৃষ্টি নিয়ে আমাদের গায়ে ঢুকে পরল। কথা নেই বার্তা নেই গুলি করতে লাগল। আমার সামনেই আমার বাবাকে দেখলাম গুলি খেয়ে পরে যেতে। আমি তাকে ধরতে যেতেই হ্যাঁচকা টানে কে যেন আমাকে ঘরের পিছনে আড়ালে নিয়ে গেল। সেখানে আমার ভাইবোন আর মা ও ছিল। সারা গাঁয়ে শোরগোল পরে গেল। তার মাঝেই বুঝলাম কে বা কারা আমাদের ছোট্ট ঘরটিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আগুনের দাউ দাউ আভায় দেখলাম সন্ধ্যা নেমেছে পুরোপুরি। আর পুড়ে যাচ্ছে আমাদের ঘর, পুরে যাচ্ছে আমাদের সব স্বপ্ন। আমরা ঊর্ধ্ব শ্বাসে প্রাণ নিয়ে দৌড়াতে লাগলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলাম না। মস্ত ইউনিফরম পরা ভয়ংকর চেহারার এক লোক, আমার মাকে, যে আমার ছোট বোনটিকে নিয়ে দৌড়াতে পারছিল না, ধরে ফেলল। ছোট্ট বোনটিকে সে ছুড়ে দিল মাটিতে। ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগল মাকে। আমি চিৎকার করে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ধস্তাধস্তিতে সে আমাকে গুলি করতে না পেরে রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করল। আমি জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরে এলে দেখি কেউ কোথাও নেই। বাকি তিন ভাইবোনকে খুঁজে পেলাম না কোথাও। একটু দূরে ঝোপের আড়ালে খুঁজে পেলাম মায়ের গুলিবিদ্ধ উলঙ্গ দেহখানি। এমন দৃশ্য এর আগে কোনদিন দেখিনি আমি। দু:স্বপ্নের চেয়েও ভয়ংকর। পাগলের মত কাঁদতে লাগলাম আমি। এই ভয়ংকর দৃশ্য কেন কিভাবে এলো আমার সামনে?যে মায়ের দুধ আমি পান করেছি, তার নগ্ন দেহ কেন আজ আল্লাহ আমাকে এভাবে দেখাল?
সেই বিশাল প্রান্তর আর জঙ্গলের ধারে এই নগ্ন দেহকে আমি কিভাবে রক্ষা করবো শেয়াল-কুকুরের হাত থেকে? আল্লাহ সহায়। রাস্তা ধরে যাচ্ছিলো শত শত লোক তখন।আসলে পালাচ্ছিল রাতের আঁধারে। তাদের সাহায্য নিয়ে মায়ের দেহখানি মাটিতে পুতে দিলাম দোয়া পড়তে পড়তে। মানুষের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি আমার মা, শেয়াল-কুকুরের হাত থেকে অন্তত বাঁচুক।
হ্যাঁ, বলছিলাম আজ আমি অনেক শক্ত। শুধু কান্না পায় যখন মায়ের কথা মনে পরে। এই শরণার্থী ক্যাম্পের কাছের দোকানের টিভিতে আপনাকে দেখে মায়ের কথা আবার মনে পরল। আপনার হাসির সাথে আমার মায়ের হাসির অনেক মিল, যদিও সে কবে আপনার মত পোশাক পরে আর খোপায় ফুল পরে হেসেছিল তা প্রায় ভুলে গেছি। তবে হেসেছিল।
আমার এক চাচা ছিল। সে স্কুলের বড় ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিল। তার কাছ থেকে শুনেছি, মিয়ানমারের জনগণ এবং আপনি নাকি রোহিঙ্গাদের চান না। রোহিঙ্গারা নাকি মিয়ানমারের নয়। বৌদ্ধ,যারা আলখাল্লা পরে আর ধর্মের কথা বলে আমাদের ইমামদেরই মত, তারা কেন আমাদের উপর এত রেগে ছিল সেটাও একটা দুর্ভেদ্য রহস্য আমার কাছে। এখন আমি এখানে এরকম কাউকে দেখলে ভয় পাই। ঘৃণা করতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু কেন? আমি তো তা চাইনি। আমার এই চোখ, এই মন কি তবে তাদেরই মত হয়ে যাচ্ছে যারা আমাদের ঘৃণা করেছে, যারা আমার মাকে খুন করে উলঙ্গ অবস্থায় ফেলে গেছে?আমার বাবাকে গুলি করে হত্যা করেছে? যাদের জন্য আমার আদরের ছোট ছোট ভাইবোন গুলো হারিয়ে গেছে? প্রিয় সু চি, আমাকে আপনি এই ঘৃণা থেকে কী রক্ষা করতে পারবেন কোনদিন?
তিনদিন দুই রাত হেঁটেছি। জংগলে, নদীর ধার দিয়ে। সারি সারি মানুষের সাথে। নি:স্ব, শূন্য হাতে। আর খুঁজেছি ভাইবোন গুলোকে। কোথাও যদি ওদের পাই। ক্ষুধার্ত হয়েছি যখন, কারো কাছে কোন খাবার নেই, কোথায় পাবে। গাছের লতা-পাতা আর পানি খেয়ে জান বাঁচিয়েছি। শুধু জানটা নিয়ে আপনাদের কথিত আর আমার কল্পনার সেই দেশ মিয়ানমার ছেড়ে এসেছি এই বাংলাদেশে। এখানে এসেও দেখছি ইউনিফর্ম পরা লোকজন। কাঁধে তাদের রাইফেল। কিন্তু চোখগুলোই শুধু আলাদা। মুখের ভাষা না, চোখের ভাষায় বুঝেছি তারা আমাদের ক্ষতি করবেনা আপনার সেনাদের মত। প্রথমে তাদের দেখা পেয়ে ভয়ে আর অনিশ্চয়তায় কেঁদেছিলাম। কিন্তু এখন বুঝে গেছি আল্লাহ’র দুনিয়া থেকে মায়া-মমতা উঠে যায় নি।
জন্ম থেকে দেখেছি সব সন্তান তার বাবা মায়ের কাছে আদর পায়।
প্রিয় সু চি, আপনি কি আপনার সব সন্তানদের আদর করেন না? চাচা বলতো দেশ মানে নাকি মা। মিয়ানমার কি তার সব সন্তানদের সমান চোখে দেখে না? আমরাতো তারই সন্তান ছিলাম। জেনেছিলাম রাখাইন আমাদের রাজ্য, ভেবেছিলাম মিয়ানমার আমাদের দেশ। প্রিয় সু চি, দেশ মানে আপনার কাছে কি?
ইতি
হতভাগ্য একজন রোহিঙ্গা যে একটি দেশ চেয়েছিল আপনার কাছে।