স্মৃতিতে একাত্তরের দিনগুলি (সাত)
স্মৃতিতে একাত্তরের দিনগুলি (সাত)
সিডনীর কথকতা-৩৩
রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত
সভাপতিমন্ডলীর সদস, ঐক্য ন্যাপ
একাত্তরের নয় মাস, যার শুরু ২৫ মার্চের গভীর রাত থেকে ও সমাপ্তি ১৬ ডিসেম্বরে, অর্থাৎ গনহত্যা দিয়ে শুরু এবং শত্রুদের আত্মসমর্পন ও বাঙালির বিজয়ের মধে ̈ দিয়ে সমাপ্তি। সেই সমগ্র সময়টাই আমার কেটেছে প্রধানত: পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলার করিমপুরে স্থাপিত পাবনা জেলার ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধ রিক্রুটিং এর জন্য ̈ করিমপুর যুব শিবিরে। ১৯৭১ থেকে আজ ২০১৮ অর্থাৎ দীর্ঘ ৪৭ টি বছর। এর মধে ̈ বহু ঘটন অঘটন ঘটেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। বয়স বেড়েছে ঐ ৪৭ বছর। তাই স্মৃতিতে সময় সময় বিভ্রম ও ঘটছে এতদিন পরে এই ধারাবাহিক ̄স্মৃতি কথাটি লিখতে বসে।।
এই স্মৃতিবিভ্রমের কথা ফেসবুক মেসেঞ্জার এর মাধ্যমে অবহিত করলেন স্নেহভাজন কমরেড শামছুজ্জামান সেলিম। পরে একটি দিন তাকে ফোন করে বেশ কিছু সময় কথাবার্তা বলার সময় সেলিম জানালেন যে কমরেড অমূল ̈ লাহিড়ী ̄ স্মরণে যে বইটি ছাপা হয়েছে তাতে তার লেখা নিবন্ধটি এবং কামাল আহমেদের একটি বইতে এ প্রসঙ্গে যা লেখা আছে তাতে ঐ সময়কার কথা গুলি ঠিকমত লেখা হয়েছে। বললাম আমি তো সিডনীতে এখানে তো এগুলি পাওয়ার কোন সুযোগ নেই যদি কোনভাবে পাঠাতে পার-ভাল হয়। কিন্তু সেলিম তাতে তাঁর অপারগতা প্রকাশ করলে ঐ সময়ের অপর সহযোদ্ধা কামাল আহমেদকে ফেসবুকে পেয়ে তাকে জানালে তিনি দুটোই পাঠালেন ই-মেইল করে। বারবার লেখাগুলি পড়ে বুঝলাম-আমার যেমন কিছুটা স্মৃতিবিভ্রম ঘটেছে তেমনি বেশ কিছু কম বয়েসী হওয়া সত্বেও তাঁদের দু’জনও ঐ রোগে খানিকটা হলেও আক্রান্ত। তাদের লেখাতেই তা স্পষ্ট।
তা সত্বেও নৈতিক সততাবোধ থেকেই ঐ দুই দায়িত্বশীল ও কর্মী মুক্তিযোদ্ধার লেখা দুটি ও সে সম্পর্কে আমার বক্তবে ̈ তুলে ধরে পৃথক একটি চ্যাপ্টার লেখার আকাংখা প্রকাশ করছি। স্মৃতিকথা হলেও যেহেতু এই লেখাটি মুক্তিযুদ্ধে পাবনার বামপন্থীদের প্রারম্ভিক সময়ের কথা গুলো স্থান পাচ্ছে এই ধারাবাহিক রচনাটিকে সাধ্যমত নির্ভূল করে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই তিনজনই আমরা ঐ সময়ের করিমপুর ক্যাম্পের মূল সংগঠক। তিনজন, যদি একত্রে বসে লিখতে পারতাম এবং সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকজনের সাথে আলাপ করে নিতে
পারতাম তাহলে পরিপূর্ণ তৃপ্তি পাওয়া যেন। সে চেষ্টা দেশে থাকাকালে কয়েকবার করেছি বটে কিন্তু সেলিম ও কামালকে কখনওই একসাথে পাবনাতে না পাওয়াতেই যা কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। দেশে ফিরে যাবার পর পুনরায় চেষ্টা করবো সকলে একত্রিত হয়ে ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে। তবে একথা অবশ্যই সত্য যে ঐ দুই সহযোদ্ধার লেখা দুটি স্মৃতির দুয়ার কিছুটা খুলতে আংশিক হলেও সহায়ক হয়েছে।
করিমপুর যুব শিবিরের জন্য সবচাইতে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো একাত্তরের বর্ষাকালে। সেবার যেন বন্যা-বরর্ষারও বৃষ্টি বাদল পূর্ব ও পশ্চিম-উভয় বাংলার জন্যই প্লাবন সংকটের উদ্ভব ঘটিয়েছিল। অবশ্য অবরুদ্ধ বাংলাদেশে বানভাসি এলাকা গুলিতে যাঁরা বাস করছিলেন তাঁরা পাক-বাহিনীর আক্রমণের হাত থেকে অনেকটা মুক্ত থাকতে পেরেছিলেন এক-দেড় মাসের জন ̈ যদিও। পাক-সেনারা জল দেখে ভয় পেতো, বৃষ্টি নামলে এলাকা ছেড়ে ট্রাকে চড়ে দৌড়ে পালাতো আর বন্যা দেখলে ভয়ে নিজেদের ক্যাম্পে শুয়ে বসে অবসরে
দিন কাঠাতো। ফলে আক্রমণ করে বাঙালি নিধন যজ্ঞে সাময়িক হলেও ছেদ পড়তো। এর ফলে স্বভাবত:ই দেশের অভ্যন্তরের মানুষেরা সাময়িক নিরাপত্তা রোধে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতেন-যদিও রাজাকার, আলবদর, আল শামস্, জামায়াতে ইসলামীর তৎপরতা কিছুটা পরিমানে সর্বদাই অব্যাহত থাকতো।
কিন্তু পশ্চিম বাংলায়? বাংলাদেশ থেকে একটি কোটি মানুষ সহায় সম্বলহীন হয়ে ভিটে মাটি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ভারতে এসে জীবনের যে নিরাপত্তা পেয়েছিলেন শরণার্থী শিবির গুলিতে আশ্রয়, খাদ্য , চিকিৎসার সুযোগ পেয়ে তাতেই তৃপ্তি পেতে সুরু করেছিলেন বর্ষা-বৃষ্টি-বন্যার গ্রাসে তাঁদের কষ্টের সীমা রইলো না।
বৃষ্টি-বাদল-বন্যার কারণে সৃষ্ট দুর্দশার ফলে করিমপুর আমাদের ক্যাম্পটিও জলমগ্ন হলো। কোথাও শুকনা ছিল না। কিভাবে রাত্তিরে শুয়ে ঘুমানো যাবে-সে এক মহা দুশ্চিন্তার ব্যাপার। তার সাথে গরমও যেন পাল্লা দিয়ে হানা দিয়ে ছিল। সমগ্র পশ্চিম বাংলা জুড়ে কলেরার ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। ফলে মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হলো অনেককে ঐ কলেরার মহামারীতে। সাথে অনেককে ঐ কলেরার মহামারীতে। সাথে দেখা দিল চোখ ওঠার মহামারী। এ নিয়ে বাসে-ট্রাকে চলাচলও দুরূহ হয়ে পড়েছিল। পশ্চিম বাংলার বাসিন্দারা নাম দিয়েছিলে
“জয়বাংলা রোগ”। কারণ প্রধানত শরনার্থীরাই এই দুটি রোগে আক্রান্ত হচ্ছিলেন। নামটি তখন পশ্চিমবাংলার মানুষের মধ্যেই নয়, সেখানে আশ্রয় নেওয়ার এক কোটির অধিক বাংলাদেশীও ঐ নামেই রোগটির উল্লেখ করতেন।
এই সব রোগ-পীড়ার যে মহামারী লেগেছিল তার মোকাবিলা করাটা তখন সহজ ছিল না। ভারত সরকার সচেষ্ট থাকলেও মাঠ পর্য্যায়ে চিকিৎসক, সেবিকা এবং ওষুধ পত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব প্রভৃতি কারণে বহু সংখ ̈ক কলেরারোগ আক্রান্ত শরণার্থীকে প্রাণ হারাতে হয় দীর্ঘদিন ধরে ভুগতে হয় চক্ষু রোগাক্রান্তদেরকে। নানাবিধ সতর্কতার কারণে অবশ ̈ মু৩িযোদ্ধা রিক্রুটিং কেন্দ্র বা যুব শিবির গুলিতে রোগ দুটি তেমন কোন ক্ষতি করতে পারে নি।
তেমন কোন শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি বা রোগ পীড়ায় আক্রান্ত না হলেও বন্যার জল আমাদের যুব শিবিরের দৈনন্দিন জীবন যাত্রা অত্যন্ত দুরূহ করে তুলেছিল। মেঝে ছিল ছিল কাঁচামাটির ওতে মাদুর পেতে আমরা রাতে শুয়ে ঘুমাতাম। সেই মেঝে হয়ে গেল কর্দমাক্ত খাট চৌকি নেই তা কিনবারও সাধ ̈ ছিল না। তাই অগত্য ওয়াটারপ্রুফ কিনে এনে তার ওপর মাদুর পেতে শুতে হতো আমাদের। বন্যার জল এসেছিল পদ্মার একটি শাখা নদী থেকে যেটা আমাদের করিমপুর যুব শিবিরের কাছাকাছি দিয়ে প্রবাহিত ছিল।
এবাবেই শুধুমাত্র রাত্রি যাপন নয় দিনও কাটতো ঐ কদর্মাক্ত মেঝেতেই। সেখানে বসেই আমরা
রাজনৈতিক ক্লাস বা প্রশিক্ষণ দিতাম। বাজার করে নানাবিধ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনে এনেও মেঝেতেই রাখতে হতো। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল একাত্তরের ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের পাবনা জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের করিমপুর যুব শিবিরে থাকাকালীন দিনগুলি।
এমনই এক বৃষ্টিরূপ সন্ধ্যায় রাজনৈতিক ক্লাস নিচ্ছিলাম হারিকেন জ্বালিয়ে। হঠাৎ দেখা গেল, ছাতা নিয়ে একজন এসে কারও নাম না ধরে জিজ্ঞেস করলেন এটা কি বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবির? ছেলেদের মধ্য ̈থেকে কেউ কেউ উত্তর দিয়ে বলল- হ্যা, আর প্রশ্ন করলো আপনি কে? কোথা থেকে এসেছেন? লোকটি বললেন, কোলকাতা থেকে এসেছি। এখানে কি রণেশ মৈত্র আছেন? তখন একটু খটকা লাগায় ছেলেরা রেরিয়ে গিয়ে তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো, কেন চান ওনাকে? ভেতরে আসুন। উত্তরে তিনি জানালেন তিনি একজন ট্যাক্সি চালক। রাস্তায় ট্যাক্সিতে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। তিনি লন্ডন থেকে রণেশ বাবুর সাথে দেখা করতে এসেছেন আরও অনেকের সাথে নানা জায়গায় দেখা করবেন তিনি। ছেলেরা এসে
আমাকে বলাতে বললাম, আমি রণেশ মৈত্র ওনাকে গাড়ী থেকে নামিয়ে এখানে আনুন। ড্রাইভার ফিরে গিয়ে ওনাকে জানালে উনি নেমে বললেন, কথা প্রাইভেট। তাই রণেশ বাবুকেই সাথে করে আন। অগত্যা যেতেই হলো ভদ্রলোক অতদূর থেকে এসেছেন একথা জেনে। গেলেই উনি হ্যান্ডশেক করে বললেন, “কমরেড, বেশ কিছু আলাপ ছিল কিন্তু তা করতে হলে তো রাস্তায় বৃষ্টির মধ্যে ̈ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করা সম্ভব নয়। সব চেয়ে ভাল হয়ে আপনি যদি আমার সাথে আজকের রাত্রি ও কাল কিছুক্ষণের জন ̈ কোলকাতা আসেন। ওখানে এক হোস্টেলে আছি-আপনিও থাকবেন। কোন অসুবিধা হবে না। বললাম, দেখুন, আমি এই ক্যাম্পের পরিচালক। আমার পক্ষে এই দুর্যোগের মধ্যে ̈ সকলকে রেখে যাওয়া সম্ভব না। বরং আপনে ভেতরে চলুন কথা বার্তা বলে এক পেয়ালা চা খেয়ে চলে যাবেন। আমার ঐ কথায় রাজী না হয়ে তিনি ড্রাইভারকে বললেন জিনিষটা গাড়ী থেকে বের করে আমাকে দিতে। ড্রাইভার বের করলেন একটি চাইনিজ রাইফেল এবং আমাকে দিতে চাইলে বললাম, দেখুন, আমি নিতে পারি না – আমার এখতিয়ার নেই। প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ওটা দিতে হয় কিন্তু প্রশিক্ষণ শেষে তাদের আর্মস দিতে হয় অন্য ̈ বিভাগের নেতৃত্বের মাধ্যমে। তাই ওটা দিতে হলে কোলকাতায় পার্টি নেতৃত্বকে দেবেন। ইতোমধ্যে ̈ তিনি টাকার বান্ডিল ভর্তি ব্যাগ বের করে বললেন, এতে ৫
লক্ষ ভারতীয় টাকা আছে। রাখুন, আপনার ক্যাম্পের কাজে লাগবে। আরও আছে অপরাপর ক্যাম্পগুলিতে বৃটিশ কমিউনিষ্ট পার্টির পক্ষ থেকে দেওয়ার জন ̈।
এবারেও আমার একই উত্তর। বললাম, দুঃখিত, আমার টাকা পয়সাও নেওয়ার এখতিয়ার নেই। এব্যাপারেও আপনাকে কলকাতায় পার্টি অফিসেই গিয়ে ব্যাবস্থা করতে হবে। এবারে বললেন, কমরেড, আমি ফতেহ লোহানী। এগুলি রাখলে কিন্তু ভাল করতেন। নামে আপনাকে চিনি কিন্তু পরিচয় হয়নি কোনদিন। তা ন্যাপের কথা বললেন, কোন ন্যাপে আছেন আপনি কোন অবস্থানে ? উত্তরে বললাম, ওয়ালি মোজাফফর ন্যাপের আমি পাবনা জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক। তবে বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও পাবনা জেলা ন্যাপ কমিউনিষ্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের করিমপুর যুব শিবিরের পরিচালক।
জবাবে লোহানী সাহেব বলে উঠলেন, ওয়ালি ন্যাপ? অর্থাৎ রুশ সংশোধনবাদের প্রিষ্ঠপোষক? আমি তো আপনাকে কমরেড মাও এর অনুসারী মনে করেছিলাম। কারণ মতিন ভাই এর কাছে আপনার অনেক প্রশংসা শুনেছিলাম রুশ-চীন দ্বন্দ্বের আগে। আপনাকে ধন্যবাদ। আমাদের টাকা ও অস্র ভুল ̄স্থানে দিতে হলো না আপনি না নেওয়াতে। ইচ্ছে ছিল পরের দফায় এসে আরও বেশী করে দেব। ইতিমধ্যে ̈লন্ডনে আরও অনেক বেশী টাকা সংগ্রহ হবে তা থেকে। কারণ আমিও তো পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার সন্তান। এই বলে হাত মিলিয়ে গাড়ীতে উঠে বিদেয় হলেন।
পরদিনই একজন কর্মীকে এই ঘটনার রিপোর্ট জানিয়ে পার্টি অফিসে কমরেড সালাম ভাইকে (বারিন দত্ত) একটি চিঠি দিয়ে কলকাতা পাঠালাম। কর্মীটি রাতেই ফিরে এলো আমার ঐ চিঠির উত্তরসহ।
উত্তরে আমাকে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে অভিসন্ধান জানান হয়েছিল এই রাজনৈতিক, নৈতিক ও সামরিক সততার জন্য ̈। চিঠিখানা আজ আর নেই, হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।