হজে যাওয়া হলো না মোজাফফরের
একবুক হতাশা নিয়ে হজক্যাম্প ছাড়লেন পঁচাত্তরোর্ধ্ব মোজাফফর। হজ পালনে আর কখনও সৌদি আরব যেতে পারবেন কিনা সন্দিহান তিনি। গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে যখন আশকোনা হজক্যাম্প ছেড়ে যাচ্ছিলেন তখন বৃদ্ধ এই মানুষটির চোখে পানি টলমল করছিলো। জীবনে একবার অন্তত পবিত্র হজ পালনে মক্কা গমন করবেন- এ স্বপ্ন দেখতেন অনেক আগে থেকেই। সেই জন্য তিলে তিলে জমিয়েছিলেন বেশ কিছু টাকা। একটি এজেন্সিকে গত ৩ মাস আগেই আড়াই লাখ টাকা দিয়েছিলেন। এজেন্সি তাকে নিশ্চয়তাও দিয়েছিলো। তাদের গ্রিন সিগন্যাল পেয়েই আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গত ৫ দিন ধরে আশকোনা হজক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে এজেন্সির দালাল তার কাছে দাবি করে বসে আরও এক লাখ টাকা। হঠাৎ করে এতো টাকা কোথায় পাবেন তিনি? তাই আর হজে যাওয়া হলো না তার। মোজাফফরের বাড়ি পাবনা জেলার আতাইকুলা থানার ধর্মগ্রামে। শুধু তিনিই নন, তার মতো চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আশকোনা হজক্যাম্প ছেড়ে যাচ্ছিলেন একই উপজেলার সোনাপুর গ্রামের আবদুল মজিদ, পীরপুর গ্রামের ইউনূস আলী ও মাহমুদা খাতুন দম্পতি। তারা সবাই ছারসিন নামে একটি এজেন্সির মাধ্যমে আড়াই লাখ করে টাকা জমা দিয়েছিলেন। এছাড়া, গতকাল হজে যেতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে ক্যাম্প ছেড়েছেন শতাধিক বৃদ্ধ নারী-পুরুষ। তাদের কেউ ৫ দিন, কেউ ১০ দিন আবার কেউ তারও বেশি সময় ধরে আশকোনা ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। ক্যাম্পের মেঝেতে গড়াগড়ি করে, নির্ঘুম রাত কাটিয়ে মক্কা নগরীতে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু অবশেষে সে সুযোগ না পেয়ে হতাশ হয়ে ক্যাম্প ছাড়লেন। এজেন্সির লোকজন তাদের দিনের পর দিন আশা দিয়ে বসিয়ে রেখেছিল। আবার হাব নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকার কারণেও অনেক এজেন্সি তাদের বৈধ হজযাত্রীদের ভিসা পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
এবারের হজ মওসুমের শুরু থেকেই হজ ব্যবস্থাপনায় নজিরবিহীন অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ডাটাবেজে ভুয়া ১০ হাজার নাম এন্ট্রি হয়। এমনকি মোবাইল, সিম, জয়ধর এ ধরনের অদ্ভুত (!) নাম এন্ট্রি করা হয় নির্ধারিত ওই ডাটাবেজে। ফলে অনেক বৈধ হজযাত্রীর হজে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। যাচাই-বাছাই কমিটি ওই ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত ১০ হাজার নাম ভুয়া বলে চিহ্নিত করে। আবার বাদ পড়া বৈধ হজযাত্রীদের অনেকেই রিপ্লেসমেন্টের সুযোগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট এজেন্সিকে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে হজে যাওয়া নিশ্চিত করেন। সর্বশেষ প্রায় ৩ হাজারের মতো হজ গমনেচ্ছু ব্যক্তি বাকি ছিলেন। এক পর্যায়ে আন্দোলনে নামেন হজ গমনেচ্ছু ও কোটাবঞ্চিত এজেন্সির মালিকরা। আন্দোলনকারী এজেন্সির দাবি ছিল, সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে ইতিমধ্যে অনেকেই হজে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তাই বাংলাদেশের জন্য সৌদি সরকার অতিরিক্ত ৩ হাজার কোটা বরাদ্দ করলে সবাই যেতে পারবেন। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে ধর্ম মন্ত্রণালয় ৩ হাজার কোটার আবেদন করলে সৌদি সরকার ৫ হাজার অতিরিক্ত কোটা বরাদ্দ করে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে এ কোটা বরাদ্দের পরও শতাধিক বৈধ ব্যক্তি হজে গমন করতে পারেননি।
জানা যায়, শুরু থেকেই অনিশ্চয়তার কারণে এ বছর অনেকেই হজে যাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ৫ হাজার অতিরিক্ত কোটা বরাদ্দ পাওয়ার পর থেকেই সংশ্লিষ্ট হজ এজেন্সি তাদের অধীনে থাকা হজযাত্রীদের ক্যাম্পে আসতে বলে। শুরু হয় বিড়ম্বনা। দিনের পর দিন বসে থাকতে হয় হজক্যাম্পে। কিন্তু ৫ হাজারের মধ্যে ২৭শ’ লজমেন্ট হওয়ার পরই হঠাৎ করে সংশ্লিষ্ট সৌদির সার্ভার বন্ধ হয়ে যায়। কারণ হিসেবে হজক্যাম্পের আইটি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ৫ হাজার কোটার জায়গায় সাড়ে ৫ হাজার পাসপোর্ট জমা পড়েছে। ফলে তারা তাদের সার্ভার বন্ধ করে দিয়েছে। পরে আলোচনাসাপেক্ষে তারা সার্ভার খুলে দেয়। লজমেন্ট থেকে শুরু করে ভিসা এবং বিমান টিকিটের পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে হজ এজেন্সিদের সংগঠন হাব। তাদের অনুমোদন পেলেই কোন এজেন্সি ভিসা পাবেন। সেই হিসেবে দিনের পর দিন এজেন্সির মালিকদের ‘হাব’ অফিসে ধরনা দিতে দেখা যায়। লজমেন্ট হওয়ার পরও প্রায় শতাধিক বৈধ হজ গমনেচ্ছু হজে যাওয়া আটকে দেয়। গত শনিবার হাব-এর সাধারণ সম্পাদক আশকোনা হজক্যাম্পে একটি তালিকা টানিয়ে দেয়। সেখানে দেখা যায় অনেকেই ভিসা পাননি। তবে ভিসা না পাওয়ার কারণও উল্লেখ করা হয়নি তাতে। শুধু ফারুক ট্রাভেলসই ৭০ জনের মধ্যে ৩৭ জনের ভিসা পায়নি। এব্যাপারে ওই ট্রাভেলস-এর মালিক হুমায়ূন কবির বলেন, তিনি কেন ভিসা পাননি তার কারণ নিজেও জানেন না। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ওই এজেন্সির সঙ্গে হাব নেতাদের সুসম্পর্ক না থাকায় তারা ভিসা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এব্যাপারে হাব-এর সাধারণ সম্পাদক শেখ মো. আবদুল্লাহ জানান, ভিসা দেয়া দূতাবাসের কাজ। সৌদি দূতাবাস তাদের কেন ভিসা দেয়নি তা আমরা বলতে পারবো না।
এদিকে গতকাল শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে ভিসা না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে অনেকেই হজক্যাম্প ছেড়ে গেছেন। ভুক্তভোগীরা জানান, এ বছরে শুরু থেকে সমস্যার কারণে তারা হজে যাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। ৫ হাজার কোটা বরাদ্দ হওয়ার পর এজেন্সির মালিকরা আমাদের ফোন করে বলেছে, যেকোন সময় ফ্লাইট। তাই এলাকার আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীর কাছ থেকে দোয়া নিয়ে এসেছি। হজ না করেই ফিরে যাচ্ছি। এখন সবাই অন্যভাবে দেখবে আমাদের। তাছাড়া, জীবনে আর সুযোগ পাবো কিনা তাও জানি না। অন্যদিকে ৫ হাজার কোটা পাওয়ার পরও কিভাবে বৈধরা ভিসা পেল না বা তাদের পরিবর্তে কারা গেল এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। হিসাব মতে মাত্র তিন হাজার লোক বাকি ছিল তাহলে এতজন কোথা থেকে এলো- এ প্রশ্ন এখন খোদ হাব নেতাদের বিরুদ্ধে।
গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে বৃদ্ধ মোজাফফর, আবদুল মজিদ, ইউনূস আলী ও মাহমুদা খাতুন দম্পতি আশকোনা হজক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার সময় এই প্রতিবেদককে বলেন, আমাদেরকে গত বুধবার এজেন্সির লোক তাদের এলাকার পীরপুর গ্রামের আসলাম হোসেন গত বুধবার ক্যাম্পে আসতে বলে। তিনি তাদের বলেছিলেন, যে কোন সময় ফ্লাইট। সেই আশায় রোববার সকাল পর্যন্ত বসে ছিলেন। কিন্তু তারা এখানে আসার পর এজেন্সির কোন লোক তাদের সঙ্গে দেখা করেনি। তারা শুধু ফোনে বলেছেন, আজ-কাল করে করে সময় পার করছেন। তাই রোববার সকাল বেলা বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাড়িতে পৌঁছানোর পরপরই আসলাম ফোন করে আবার বলে সোমবার সকালে ফ্লাইট। তাই রাতেই চলে এসেছি। কিন্তু আসার পর সে আমাদের সঙ্গে দেখা করেনি। ফোনে বলেছে, ভিসা রেডি। তবে টিকিটের জন্য এক লাখ টাকা জামানত লাগবে। হজ থেকে ফেরার পর তা ফেরত দেয়া হবে। কিন্তু আমরা তো আগেই সব খরচ বাবদ আড়াই লাখ টাকা দিয়েছি। বৃদ্ধ মোজাফফর বলেন, অনেক কষ্টে হজে যাওয়ার টাকা যোগাড় করেছিলাম। এখন হঠাৎ করে এই টাকা কিভাবে দেব? তিনি কেঁদে ফেলে বলেন, আল্লাহ হয়তো চাননি, তাই হজ করতে পারলাম না। তিনি আরও বলেন, আগামীবার বেঁচে থাকবো কিনা জানি না। আল্লাহর ঘরে যেতে পারলাম না! এই বলে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। এব্যাপারে ছারসিন এজেন্সির প্রতিনিধি পাবনা জেলার আতাইকুলা উপজেলার পীরপুর গ্রামের আসলাম হোসেনকে ফোন করলে বন্ধ পাওয়া যায় তার ফোন। এদিকে হজ করতে সৌদি আরবে পৌঁছানোর পর অনেকে জানিয়েছেন, সেখানে এজেন্সি তাদের কোন খোঁজখবর নিচ্ছে না। এমনকি খাবারও দিচ্ছে না।