হাইকোর্টের রায় এবং এনটিআরসি এ’র লাগামহীন কার্যক্রম
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কতৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠার পর সংস্থাটি ১৪টি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা সম্পন্ন করে। চলতি ডিসেম্বরের ২৬ তারিখ পঞ্চদশ শিক্ষক নিবন্ধনের আবেদন ডেডলাইন শেষ হয়।
হা্কইর্টের নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠানটি কিছুদিন আগে জাতীয় সম্মিলিত মেধাতালিকা করে।
মেধা তালিকা অনুসারে প্রায় ছয় লক্ষ শিক্ষক নিবন্ধিত শিক্ষক রয়েছে। এরপর ২০১৬ সালে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ ক্ষমতা এনটিআরসিএ’র উপর ন্যস্ত হলে মেধাবী, মানসম্মত শিক্ষকের চাহিদা পূরণের দ্বার উন্মোচিত হয়।কিন্তু এনটিআরসিএ’র সাম্প্রতিক লাগামহীন কার্যক্রমে সনদ প্রাপ্তরা সেই প্রত্যাশার প্রাপ্তির বিন্দু পরিমাণ দেখছে না। এক থেকে দ্বাদশ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা একই প্রকারের হলেও ত্রয়োদশ এবং চর্তুদশ পরীক্ষা বিসিএস এর আদলে নেয়া হয়। উল্লেখ্য দ্বাদশ নিবন্ধন ফলাফলের পর নিয়োগের উদ্দেশ্যে উপজেলা ভিত্তিক একটি মেধা তালিকা করা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা হারিয়ে যায় সময়ের অন্তরালে। বরং সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি সম্মিলিত জাতীয় মেধা তালিকায় জগা-খিচুড়ি পাকিয়ে ফেলার অবস্থা করেছে। মহামান্য হাইকোর্ট গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর ১৬৬টি রিটের চূড়ান্ত রায়ে ১- ১২তম শিক্ষক নিবন্ধতদের জাতীয় মেধাতালিকা করার নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া ত্রয়োদশ ও চর্তুদশ শিক্ষক নিবন্ধিতদের ঐ মেধাতালিকায় যুক্ত করে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করতে যাচ্ছেন। অন্যদিকে ১-১৪তম নিবন্ধিতদের গণবিজ্ঞপ্তি কিংবা নিয়োগ সুপারিশ সম্পন্ন না করেই পঞ্চদশ শিক্ষক নিবন্ধনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন যা কতটুকু আইন সম্মত তা খতিয়ে দেখা দরকার। এছাড়া ঐ বিজ্ঞপ্তিতে বয়স নিয়ে একটি বিভ্রান্তকর তথ্য দিয়েছেন। অর্থাৎ, বিজ্ঞপ্তি অনুসারে পয়ত্রিশোর্ধ প্রার্থীরা শিক্ষক নিবন্ধনে আবেদনসহ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে সনদ অর্জন করবেন কিন্তু এমপিও নীতিমালা অনুসারে গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন কিংবা পরবর্তিতে এমপিও ভুক্ত হতে পারবেন না। বিজ্ঞপ্তিতে পয়ত্রিশোর্ধ বয়সীদের সাথে প্রহসন যে করা হচ্ছে এতে কোন সন্দেহ নাই। একজন পয়ত্রিশোর্ধ প্রার্থী যদি সনদ অর্জন করে গনবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করার সুযোগ না পায় কিংবা নিয়োগ পেয়েও এমপিওভুক্ত না হয় তাহলে তার এই সনদের কিমূল্য থাকলো? শিক্ষক নিবন্ধনের সনদটি মূলত শিক্ষক হওয়ার একটি পেশাগত সনদ? সরকারি প্রতিষ্ঠান, দেশি-বিদেশি কোন কোম্পানি, ফ্যাক্টরি, ফার্মহাউজ এবং এনজিওতে এই সনদের মূল্যায়ন কতটুকু তার নির্দেশনা নাই। এই সনদ শুধু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক তা করার একটি সনদ। যদি এই সনদ অর্জন করে বাতিল হয়ে যায়, তাহলে এনটিআরসিএ’র শিক্ষক নিবন্ধন বিজ্ঞপ্তিতে আবেদন না করতে উল্লেখ থাকার অতি আবশ্যক ছিল। কিন্তু তা না করে প্রতিষ্ঠানটি বয়স নিয়ে লুকোচুরি খেলছে যা সচেতন মহলে প্রশ্নের ঝড় তোলে।
এদিকে শিক্ষক নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তিতে প্রতিষ্ঠান প্রতি ১৮০ টাকা ফি নেয়া হচ্ছে। উল্লেখিত ফি একবারই প্রযোজ্য হলে কোন প্রসঙ্গ ওঠার কথা নয়। কিন্তু একজনপ্রার্থীকে লটারির টিকিট কাটার মতো একাধিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে বেকার প্রার্থীদের গুনতে হচ্ছে হাজার হাজার টাকা। এরপরও তারা চাকরির প্রত্যাশা নিশ্চিত করতে পারছেন না। এ বিষয়ে এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান একটি বিশেষ নোটিশে উল্লেখ করেন যে, বিসিএস পরীক্ষায় একজন প্রার্থীকে ৮০০-১০০০ টাকা ফি দিয়ে আবেদন করতে হয়। আপনি যথার্থই বলেছেন। তাহলে এনটিআরসিএ ১০০০ টাকা ফি করতে পারে এতে বেকারদের কোন অভিযোগ থাকবেনা যদি তা মেধা তালিকার ভিত্তিতে নিয়োগ হয়। সম্মিলিত জাতীয় মেধা তালিকা থাকা সত্বেও কেন নিবন্ধন সনদ প্রাপ্তদের একাধিক আবেদন করতে হবে? কেন তারা একশো-দুইশো প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে বিশ থেকে চল্লিশ হাজার কষ্টের টাকা খরচ করবেন? বিষয়টি স্বভাবতই অমানবিক এবং বেকার যুবকদের সাথে জুয়া খেলার মতো মনে হচ্ছে। এই জুয়া খেলে বেকার প্রার্থীরা আদালতে জয়ের হাসি হাসবে নাকি হেরে যাবে তা নিয়ে তারা সত্যিকার অর্থে সন্দিহান। এছাড়া নির্বাচন কালিন সময়ে ইন্টারনেট সার্ভার ডাউন থাকায় অনেকে ঠিকমতো আবেদন এবং ফি প্রদান করতে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। আবার অনেক এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শূন্যপদগুলোকে নন এমপিও দেখাচ্ছে।
এ সমস্যা নিরসন না করে এনটিআরসিএ বেকার যুবকদের সাথে প্রহসন করছে বলে অভিযোগ তুলেছেন আবেদন প্রার্থীরা।
মহামান্য হাইকোর্ট নিয়োগ বঞ্চিত নিবন্ধিত শিক্ষকদের ১৬৬ রিটের চূড়ান্ত শুনানিতে সরকার এবং এনটিআরসিএ’কে সাতটি নির্দেশনা দেন।চূড়ান্ত রায়ের এক নম্বর পয়েন্টে শিক্ষক নিবন্ধিতদের নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত সনদের মেয়াদ বহাল থাকার কথা বলেছেন। দুই নম্বর পয়েন্টে রায়ের নব্বই দিনের মধ্যে একটি মেধা তালিকা করার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে আবেদন কারিরা তাদের মেধা তালিকা এবং পজিশন দেখা পায়। তিন নম্বর পয়েন্টে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশের উদ্দেশ্যে একটি সম্মিলিত জাতীয় মেধা তালিকা করতে বলা হয়েছে যা উপজেলা, জেলা, কিংবা বিভাগ ভিত্তিক হবে না। রায়ের চার নম্বর পয়েন্টে সর্বশেষ একটি নিয়োগ সম্পন্ন করে বছরে একবার সম্মিলিত মেধা তালিকা আপডেট করতে এনটিআরসিএকে নির্দেশ দিয়েছে। পাঁচ নম্বর পয়েন্টে জাতীয় মেধা তালিকা অনুসারে রিট পিটিশনার এবং প্রত্যাশিত আবেদন কারিদের নাম যাদের সনদ ইস্যু করা হয়েছে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়ার জন্য প্রস্তাব/সুপারিশ করতে নিদেশ দিয়েছে এবং নিয়োগের পর শিক্ষা মন্ত্রনালয় কিংবা শিক্ষা বোর্ড নিয়োগকৃত শিক্ষকদের আবেদনে নিজ এলাকার প্রতিষ্ঠানে বদলি করার অনুমতি দিতে পারেন। ছয় নম্বর পয়েন্টে শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশ পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ব্যবস্থাপনা কমিটি বা পরিচালনা পর্ষদ কার্যকর না করে তাহলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবোর্ড ঐ কমিটিকে ভেঙ্গে দেবে এবং ঐ প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নিবে। সর্বশেষ সাত নম্বর পয়েন্টে বলা হয়, চাকরির এন্ট্রি প্রসেসে যেহেতু কোন বয়স নির্ধারণ নেই সেহেতু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের উদ্দেশ্যে প্রার্থীদের বয়স সীমা করতে সরকারের একটি জরুরী পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ।
প্রকৃত অর্থে এনটিআরসিএ মেধা তালিকা এবং বয়স নির্ধারণ ছাড়া আর বাকি নির্দেশনাগুলো পালন করার আদৌ কোন প্রয়োজন বোধ করছেনা।শুধু ৭নং পয়েন্ট অনুসরণ করে পয়ত্রিশোর্ধ সনদধারীদের অন্যায়ভাবে বাদ দেয়ার জোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। মহামান্য হাইকোর্ট চাকরির এন্ট্রি প্রসেসে বয়স নির্ধারণ করার জন্য বলেন। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রনালয় এবং প্রতিষ্ঠানটি রায়ের ব্যাখ্যা বিকৃত করে অন্যায়ভাবে পয়ত্রিশোর্ধ প্রার্থীদের গণবিজ্ঞপ্তিতে বাদ দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে ভুক্তভোগিরা অভিযোগ করেছেন। যদি পূর্ণাঙ্গ রায় মেনে চলা হয় তাহলে পয়ত্রিশোর্ধ প্রার্থীদের গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করার সুযোগ থাকার কথা।
শিক্ষামন্ত্রনালয় এন্ট্রি প্রসেসকে এন্ট্রি লেভেলে পরিণত করে। ফলে এনটিআরসিএ এমপিও নীতিমালা/১৮ এর দোহাই দিয়ে পয়ত্রিশোর্ধ প্রার্থীদের বাদ দেয়ার সাফাই গাইছেন। মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশ না মানতে হলে সাতটি নির্দেশনাই পুরোপুরি মানা দরকার। সাতটি নির্দেশনার মধ্যে কোন বিচারপ্রার্থী বঞ্চিত হলে তা আসলেই আদালত অবমাননার পর্যায়ে পরে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির খামখেয়ালিপনা সামগ্রিক কার্যক্রমে হাজার হাজার নিবন্ধিত শিক্ষক হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তারা সামাজিক গণমাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন। কিন্তু নির্বাচন কালিন সময়ে গণমাধ্যমগুলো ব্যস্ত থাকায় তাদের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রনালয় এবং এনটিআরসিএ চেয়ারম্যানের সময় থাকতেই উপলব্ধি করা এবং আশু পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
লেখক- ভূপেন্দ্র নাথ রায়, খানসামা, দিনাজপুর।