Organon-যে পড়ে নাই সে বুঝে নাই, যে বুঝে নাই সে পড়ে নাই, হোমিওপ্যাথির কি হবে!

Organon
যে পড়ে নাই সে বুঝে নাই
যে বুঝে নাই সে পড়ে নাই
হোমিওপ্যাথির কি হবে!
-আওলাদ হোসেন

১। সোরাঃ-সূত্র-৫ হতে শুরু
২। ডোজঃ-পরিমাপ
৩। অদৃশ্য শক্তিঃ-
৪। সদৃশঃ-
ভূমিকাঃ মানুষ সৃষ্টিতে মানুষের কোন হাত নেই কিভাবে দেহ সৃষ্টি হয়েছে তারও কোন সন্ধান পাাওয়া যায় না। এনাটমী পরড়লে ডাক্তারী বিদ্যা এবং পূর্ণাঙ্গ কি জন্যে ব্যবহৃত তা জানা যায় মাত্র। হোমিওপ্যাথিতে রোগ-সোরা, সিফিলিস, সাইকোসিস ইত্যাদি এলোপ্যাথিতে ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু এই বিষয়গুলি না যেনে হোমিওপ্যাথরাও প্র্যাকটিস করেন বটে। কিন্তু তাতে বাঞ্ছিত ফল লাভ হয় না। তবও আমরা ড. হ্যানিম্যানকে বাদ দিয়ে, অর্গানন না বুঝার কারণে অনেক কিছু করার চেষ্টা করি কিন্তু তা বাস্তব সম্মত নয়। সোরার বিস্তারিত বিবরণ নিুে দেয়া হলো-
১। সোরাঃ- কারণ সোরা অত্যন্ত প্রাচীনতম মায়াজম। পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ বছরে কোটি কোটি মানবদেহ অতিক্রম করে প্রাকৃতিক বিভিন্ন উত্তেজক কারণের সহায়তায় সোরা ব্যাপক রূপ লাভ করেছে। সোরায় সংক্রমিত হলে মানবদেহে এমন একটি রুগন পরিবর্তন সাধিত হয় যে, তা প্রায় সকল চিররোগের সূতিকাগারে পরিণত হয়। মানবদেহের এ- অবস্থাকে Psoric dyscrasia বা সোরাজনিত রুগন পরিবর্তন বলা হয়। এ-অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়েছে (যাদেরকে এন্টিসোরিক ঔষধ বলা হয়) এবং তাদের প্রস্তুত ও প্রয়োগ সম্পর্কে বিশেষ নির্দেশনা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকৃত চিকিৎসকগণ এ সকল ঔষধের মধ্য হতে চিররোগসমূহ আরোগ্য করার জন্য এখন প্রকৃত সদৃশ ঔষধটি নির্বাচন করতে পারেন। এ-মায়াজমের জন্য অধিক উপযুক্ত (এন্টিসোরিক) ঔষধের প্রয়োগ দ্বারা তারা এখন আরো বেশি যথার্থ সেবা দিতে পারেন এবং প্রায় অব্যর্থভাবে যথার্থ আরোগ্য দিতে পারেন। মানবদেহে যত প্রকার স্থায়ীব্যাধি জন্ম লাভ করে তাদের সকলের উৎস এক ও অভিন্ন সোরা মায়াজম। হ্যানিম্যান দি ক্রনিক্ ডিজীজ্ পুস্তকে ‘‘Nature of Chronic Disease’’ শিরোনামে ০৯ পৃষ্ঠায় বলেছেন যে, ” অর্থাৎ, ”হাজার হাজার বছর যাবৎ এটি মানবজাতিকে উৎপীড়ন করে আসছে,-তা সত্ত্বেও অতি প্রাচীন লোকদের প্রাচীন ইতিহাস এর মূলে পৌছতে পারে নি-এর নিদানগত লক্ষণের পরিমাণ খুব বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে-ধারণাতীত অসংখ্য বছরে লক্ষ লক্ষ মানবদেহ অতিক্রম করে অতিরিক্ত বৃদ্ধির দরুন এর পরিমাণ এত হয়েছে যে-এর গৌণ লক্ষণসমূহ কদাচিৎ গণনাযোগ্য। এবং, আমরা যদি ঐ ব্যাধিগুলোকে বাদ দেই যা বিকৃত চিকিৎসা দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে অথবা পারদ, সীসা, আর্সেনিক ইত্যাদি কারখানায় কাজ করার জন্য সৃষ্টি হয়েছে, যা সাধারণ নিদানশাস্ত্রে শত শত নামে পৃথক এবং সুসংজ্ঞায়ীত ব্যাধি হিসাবে উপস্থিত হয়েছে (এবং ঐ সকল ব্যাধি যা সিফিলিস এবং অল্পকিছু সাইকোসিস থেকে উৎপন্ন হয়েছে), বাকী সকল প্রাকৃতিক চিররোগগুলো নামে-বেনামে সোরার মধ্যে জন্মলাভ করেছে এবং সোরাই তাদের একমাত্র উৎস।”

হ্যানিম্যানের সময় সিফিলিস এবং গণরিয়া ব্যাধির ব্যাপকতা কম থাকার কারণ হয়তো এই ছিল যে, উক্ত মায়াজম দুটির বয়স কম ছিল। সাবেক সূত্রের ব্যাখ্যায় প্রদত্ত তথ্য মোতাবেক জানা যায় যে, সিফিসিল এবং গণরিয়া রোগ যথাক্রমে ১৪৯৩ এবং ১৮০৯ সাল থেকে বিকাশ লাভ করে। বর্তমানে এ-দুটি মায়াজম সোরা অপেক্ষা খুব পিছিয়ে নেই। বর্তমানে অধিকাংশ চিররোগগ্রস্ত ব্যক্তিদের দেহে প্রায়ই তিনটি স্থায়ী মায়াজমের সংমিশ্রণ দৃষ্ট হয়। তবে সোরার সমর্থন ছাড়া এ-দুটি মায়াজম মানুষের দেহে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে না। অতএব সোরা বহুরোগে উৎপাদনকারী শক্তিশালী সুনির্দিষ্ট একটি মায়াজম। এরূপ একক এবং অভিন্ন একটি মায়াজম থেকে উৎপন্ন সকল ব্যাধির মধ্যে একটি নিবিড় সাদৃশ্য থাকে। আবার সোরা স্বতন্ত্র দৈহিক ধাতগত বৈশিষ্ট্যভেদে এবং পৃথিবীর নানা প্রকার অপশক্তিসমূহের প্রভাবে অন্যান্য স্থায়ী ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয় বলে তাদের মধ্যে বৈসাদৃশ্যও সৃষ্টি হয়। দৃশ্যত এটুকু বৈসাদৃশ্যের কারণে তাদেরকে সম্পূর্ণ পৃথক ব্যাধি হিসাবে দেখা এবং তাদের অসংগত নাম অনুসারে চিকিৎসা করা যুক্তিযুক্ত নয়।

হ্যানিম্যানের মতে প্রত্যেক ব্যক্তির প্রত্যেক ব্যাধিকে স্ব স্ব বৈশিষ্ট অনুসারে স্বতন্ত্র না করে যথার্থ চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয়। তার মতের সমর্থনে তার দি লেসার রাইটিংস এ আমেরিকান মুখবন্ধে বলা হয়েছে যে, ”তার ঔষধ প্রয়োগ তত্ত্ব অনুসারে প্রয়োগকৃত ঔষধ রোগীদেহে সুস্থ অঙ্গসমূহ বাদ দিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে শুধুমাত্র পীড়িত অঙ্গসমূহে ক্রিয়া করে বলে, সকল জ্ঞানী লোকদের সুবিচারে এটিই স্বয়ং চির গ্রহণীয় আরোগ্যকলা।”

২। তিনটি মায়াজম-ব্যাখ্যাঃ- এ সূত্রে বলা হয়েছে যে, প্রকৃত চিররোগ বলতে ঐ সব স্থায়ী ব্যাধিকে বুঝায় যা স্থায়ী মায়াজম হতে উৎপন্ন হয় এবং রোগী যথার্থ স্বাস্থ্যবিধি পালন করে চলা সত্ত্বেও যে ব্যাধিগুলো উপযুক্ত সদৃশ ঔষধের প্রয়োগ দ্বারা আরোগ্য করা না হলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রোগীকে কষ্ট দেয়। খুব সবল ব্যক্তির পক্ষেও উৎকৃষ্ট পথ্যাদি, ও নিয়মতান্ত্রিক সুশৃঙ্খল জীবনযাপন, নিয়মিত ব্যায়াম, মুক্ত বাতাসে ভ্রমণ, স্বাস্থ্যকর স্থানে বসবাস ইত্যাদি ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বয়ং তার জীবনীশক্তির সোরা বা কোন মায়াজম সক্রিয় থাকে। অপচিকিৎসা কর্তৃক সৃষ্ট ব্যাধিগুলো ছাড়াও মায়াজম গঠিত এ সকল স্থায়ী ব্যাধির সংখ্যা কম নয়। বরং এরাই মানবজাতির স্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় শত্র“। তাই সদৃশ চিকিৎসায় মায়াজম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

হ্যানিম্যান মায়াজম বলতে সংক্রামক রোগের ভাইরাসকে বুঝিয়েছেন, যা যুগ যুগ ধরে অপরিবর্তিতরূপে বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন ব্যক্তিকে একইভাবে আক্রমণ করে এবং মানবদেহে প্রায় একইরূপ লক্ষণে আত্মপ্রকাশ করে। এ-সকল ভাইরাস মানবদেহে অসংখ্য রোগ উৎপাদন করে। তবে এদের মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাস অস্থায়ী স্বভাবের হয়ে থাকে। তারা যে ব্যাধি উৎপাদন করে সে ব্যাধির ভোগকাল সীমিত হয়।

হ্যানিম্যান সফল গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্থায়ী স্বভাবের তিনটি মায়াজম আবিস্কার করেছেন, যারা সকল প্রকার চিররোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। তারা একবার কোন ব্যক্তির দেহে সংক্রমিত হলে আজীবন দেহে অবস্থান করে এবং স্বকীয় ধারায় ক্রমাগত রোগ বিস্তার করে। এরা সকলেই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এবং একটার সাথে অন্যটার আদিরূপের কোন মিল নেই। এরা হচ্ছে ১. সোরা ; ২. সিফিলিস ও ৩. সাইকোসিসঃ-
হ্যানিম্যান দি ক্রনিক ডিজীজ পুস্তকে ‘Nature Chronic Disease’ শিরোনামে ৯ পৃষ্টায় লিখেছেন যে, “ইউরোপে এবং অন্যান্য মহাদেশে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যতটুকু জানা গেছে তাতে শুধুমাত্র তিনটি মায়াজম পাওয়া গেছে, যাদের দ্বারা সৃষ্ট ব্যাধি স্থানীয় লক্ষণের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে এবং যা থেকে সব না হলেও, অধিকাংশ চিররোগ জন্মলাভ করে, যেমন প্রথমত সিফিলিস (উপদংশ), আমি যাকে Venereal Chancre Disease বলেছি; তারপর সাইকোসিস (আচিঁল ব্যাধি) অথবা Fig-wart Disease; এবং সর্বশেষ চুলকানিযুক্ত উদ্ভেদভিত্তিক চিররোগ অর্থাৎ সোরা (চুলকানি)।”

এদের মধ্যে সোরাই সবচেয়ে বেশি রোগ উৎপাদন করে। তাই হ্যানিম্যান উক্ত পুস্তকের ১৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, ‘‘It was thus that PSORA became the most universal mother of chronic diseases.’’ অর্থাৎ, “সোরা এভাবে চিররোগের অধিকতর সর্বজনীন প্রসূতিতে পরিণত হয়েছে।”

যক্ষ্মা, ক্যান্সার, এইড্স ইত্যাদি ঘাতক ব্যাধিগুলো সোরারই সৃষ্টি। সুতরাং এরা কোন বিছিন্ন মায়াজম নয় এবং সোরার আদিরূপ থেকে এদেরকে পৃথক করা যায় না। তবে এইড্সের সংক্রমণ ধারাটি সিফিলিসের মতো।

মায়াজমের সংক্রমণ সম্পর্কে হ্যানিম্যান বলেছেন যে, সোরা ত্বকের উপর চুলকানিযুক্ত ফুস্কুড়ি আকারে প্রকাশ পায়। সাধারণত হাতের আঙ্গুলের ত্বকেই বেশি দেখা দেয়। চুলকানির ভাইরাস (Itch Virus) দেহে প্রবেশের সাধারণত নয় থেকে বার দিন অথবা চৌদ্দদিন পরে সামান্য জ্বরসহ সর্বপ্রথম চুলকানিযুক্ত ফুস্কুড়ি প্রকাশ পায়। এ-সময়ের মধ্যে সংক্রমণ পূর্ণতা লাভ করে। অর্থাৎ দেহাভ্যন্তরে চুলকানি রোগের বিকাশ সম্পন্ন হয় এবং দেহে সোরা মায়াজম স্থায়ীরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
অনুরূপভাবে দূষিত সঙ্গমের মাধ্যমে সিফিলিসের ভাইরাস যৌন অঙ্গে সংক্রমিত হয় এবং প্রাথমিক লক্ষণ হিসাবে যৌন অঙ্গের ত্বকে ক্ষুদ্র ফুস্কুড়ি এবং কুঁচকিতে বাগী উৎপাদন করে।

তদরূপভাবে সাইকোসিস ভাইরাস দূষিত সঙ্গমের মাধ্যমে যৌন অঙ্গের ভিতরে শ্লৈষ্কিম ঝিল্লিতে প্রথমে সংক্রমিত হয় এবং প্রাথমিক লক্ষণ হিসাবে যৌন অঙ্গের ভিতরে ক্ষত এবং উপরের ত্বকে আচিঁল উৎপাদন করে। (দ্রষ্টব্য দি লেসার রাইটিংস পৃঃ ৬৪৯ এবং দি ক্রনিক্ ডিজীজ্, হ্যানিম্যান।)

তবে শিশুদের ক্ষেত্রে যৌন সংক্রামক ব্যাধিগুলো ভিন্ন পথে সংক্রমিত হয়। হ্যানিম্যান দি লেসার রাইটিংস পুস্তকের ১৪৪ পৃষ্ঠায় ‘‘Venereal affections of  new-born infant’’ শিরোনামে এ-বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছেন। তিনি মনে করেন যে, শিশুরা ভূমিষ্টকালে এসব সংক্রামক ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে। এভাবে সংক্রমিত হলে তাদের চক্ষু প্রদাহিত হয়, চক্ষের পাতা ফোলে, চক্ষে পিঁচুটি জমে, মুখে ও জিহবায় ক্ষত হয়, চোয়ালের নিু গ্রন্থি স্ফীত হয়, নাক বন্ধ থাকে, মাথার ত্বকে চর্মরোগে, নাভি প্রদাহ, ক্ষত ও নাভি থেকে রক্তপাত হয়, দেহের নানা স্থানের গ্রন্থি ফোলে যায়, প্রদাহিত হয়। তিনি উক্ত পুস্তকের ১৪৬ পৃষ্ঠায় আরো বলেন যে, “সব শিশুরা সাধারণত দুর্বল এবং শীর্ণ হয়; তাদের ত্বক, বিশেষভাবে মুখের ত্বক, নীলাভ, কোঁচকানো, এবং বৃদ্ধ ব্যক্তির ন্যায় কুঞ্চিত হয়।”

এছাড়াও মাতৃগর্ভ থেকে অনেক শিশু নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে। শিশুর অঙ্গবিকৃতি, মাথায় টিউমার, মস্তিষ্কে শোথ, জন্ডিস, পুষ্টিহীনতা ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করে। এ-সকল ব্যাধির জন্য পিতামাতার দেহের সক্রিয় মায়াজম দায়ী। মাতৃগর্ভে শিশু কিভাবে স্থায়ী মায়াজম দ্বারা সংক্রমিত হয় তা মুশকিল। কিন্তু বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না। তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, মানুষ সংক্রমণের মাধ্যমে অথবা উত্তরাধিকার সূত্রে মায়াজম গ্রহণ করে। কিন্তু সকল প্রকার অর্জিত বা জন্মগত জটিল ব্যাধি, অঙ্গ বিকৃতি, এবং স্থায়ী স্বাস্থ্যহানি এবং সকল প্রকার স্থায়ী ব্যাধির জন্য ক্রনিক্ মায়াজম দায়ী, এতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে, রোগীর মায়াজমে সংক্রমিত হওয়ার ইতিহাস জানা না গেলেও লক্ষণ সাদৃশ্যে দীর্ঘ চিকিৎসার পর রোগী যখন আরোগ্য হয়েছে তখন তার অজ্ঞাত সংক্রমিত মায়াজম স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। অর্থাৎ, যেরূপে মায়াজমের Influx হয় ঠিক সেইরূপেই তার Outflux হয়। যেমন-সাইকোসিসে আক্রান্ত পিতামাতার শিশু সন্তান সদৃশ চিকিৎসায় আরোগ্যের পথে অগ্রসর হলে লিঙ্গপথে পুঁজ স্রাব দেখা দেয়, সোরাদোষযুক্ত শিশুদের গায়ে চর্মরোগ দেখা দেয় ইত্যাদি। যতক্ষণ পর্যন্ত চিকিৎসায় না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত হোমিও চালিয়ে যেতে হবে। এটাই নিশ্চিত স্থায়ী আরোগ্য। সিফিলিস সাইকোসিস মায়াজম সংক্রান্ত রোগ।

৩। Dose: তাই আমরা এ-বিষয়ে আলোচনা দীর্ঘ না করে ’মাত্রা’ বা ‘‘Dose’’ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করি। এ-সূত্রে বলা হয়েছে যে, ঔষধের ‘‘Dose’’ বা মাত্রা পর্যাপ্ত বৃহৎ হলে কৃত্রিম লক্ষণগুলো স্পষ্টভাবে বোধগম্য হয়। Large dose নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে এবং ভুল বুঝার সুযোগ আছে। কারণ ‘‘Dose’’ শব্দটি ঔষধের সেবন বিধিতে পরিমাণগত অর্থে ব্যবহৃত হয়। সাধারণতভাবে ঔষধের পরিমাণ বলতে মূল ঔষধের পরিমাণ বুঝায়। হ্যানিম্যান এক সময় Large dose, Moderate  dose, Small dose শব্দগুলো দিয়ে মূল ঔষধের বিভিন্ন পরিমাণ বুঝিয়েছেন। তার লেখা ”দি লেসার রাইটিংস” পুস্তকে এর অসংখ্য প্রমাণ মিলে। “The Curative Power of  drugs” প্রবন্ধে ২৭১ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন যে, “কফি বৃহৎ মাত্রায় মাথাব্যথা উৎপাদন করে, তাই তা মধ্যম মাত্রায় আরোগ্য করে যদি তা পাকস্থলীর গোলযোগ বা অম্লত্বজনিত না হয়। এ-টি বৃহৎ মাত্রায় অন্ত্রের অনৈচ্ছিক গতি বৃদ্ধি করে এবং তাই ক্ষুদ্রতম মাত্রায় উদরাময় আরোগ্য করে ।” ‘‘Dose’’ শব্দটি প্রাচীন এবং এখনো এ্যালোপ্যাথিতে ‘‘Dose’’ বা মাত্রা দ্বারা প্রতিবার সেবনের জন্য ঔষধের পরিমাণ বুঝানো হয়।”

হ্যানিম্যান দি লেসার রাইটিংস এ ৪৫১ পৃষ্ঠায় “যে ঔষধ পর্যন্ত পরিমাণে একক এবং অমিশ্রভাবে কোন সুস্থ ব্যক্তিকে দিলে সুনির্দিষ্ট ক্রিয়া করে এবং নিশ্চিত লক্ষণগুচ্ছ উৎপাদন করে, সে ঔষধটি খুব বেশি ক্ষুদ্রতম মাত্রায় দিলেও একইরূপ লক্ষণ উৎপাদন করে।” তিনি দি লেসার রাইটিংস এ ৩৮৭ পৃষ্ঠায় ‘‘On the power of small doses of madicine” প্রবন্ধে লিখেছেন যে, “ঔষধ পরমাণুভিত্তিক ক্রিয়া করে না কিন্তু শুধুমাত্র অদৃশ্য শক্তিভিত্তিক ক্রিয়া করে, তা আস্ত বড়ির চেয়ে আরো বেশি তীব্র লক্ষণ উৎপাদন করে, যদিও আস্ত বড়িতে লক্ষ লক্ষ গুণ বেশি ঔষধ থাকে (যা নিষ্ক্রিয় থাকে)।” এখানে হ্যানিম্যান ‘‘Dose’’ শব্দটিকে বস্তুগত অর্থে ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ ঔষধি বস্তুর পরিমাণ বুঝিয়েছেন। মুলত ”উড়ংব” শব্দটি বস্তুবাচক। কিন্তু আমাদের ঔষধে কোন বস্তু নেই। আমাদের ঔষধ সম্পূর্ণ বস্তুমুক্ত এবং গুণবাচক একটি অদৃশ্য শক্তি। অদৃশ্য শক্তির কোন পরিমাণ চিন্তা করা যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে সদৃশচিকিৎসাবিধানে শক্তিকৃত ঔষধে ১২ শততমিক ক্রম পর্যন্ত পরমাণুর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। তাই ১২ শততমিক ক্রম পর্যন্ত দ্রাবণের পরিমাণ দ্বারা মাত্রার বিশালতা বা ক্ষুদ্রতা ব্যক্ত করা যায়। এবং বলা যায় যে, ১২ক্রম অপেক্ষা ৬ ক্রমে পরমাণু বেশি আছে। তাই ১২ক্রমের তুলনায় ৬ ক্রম বৃহৎমাত্রা হয়। অথবা ৬ ক্রমের একটি ক্ষুদ্র বড়ির চেয়ে ৬টি ক্ষুদ্র বড়িতে বৃহৎ মাত্রা হয়। কারণ ছয়টি বড়িতে একটি বড়ির চেয়ে বেশি ঔষধ আছে।
কিন্তু আমরা যখন পরমাণুমুক্ত নিরঙ্কুশ অদৃশ্য ঔষধীয় শক্তি নিয়ে কাজ করি, যা কেবলমাত্র নিষ্ক্রিয় ক্ষুদ্র বড়িতে অথবা দ্রাবণে অদৃশ্য অবস্থায় থাকে, তখন শক্তির বাহকের সংখ্যা বা পরিমাণ এবং শক্তির ধাপ ব্যতীত আর কিছু চিন্তা করতে পারি না। ডা. কেন্ট তার লেসার রাইটিংস পুস্তকে “অনেকে মনে করেন যে, একটি অথবা দুটি ক্ষুদ্র বড়িতে নম্র ক্রিয়া হয়, কিন্তু এ-টি একটি প্রতারণা। একটি বড়ির ক্রিয়া বা শক্তি, যদি তা আদৌ ক্রিয়া করে, দশটি বড়ির মতোই বিশাল হয়। ডা. “কতগুলো বড়িতে এক-মাত্রা হয়? যথার্থভাবে ঔষধসিক্ত হলে একটিই কার্যতঃ একশত।” অতএব দেখা যায় যে, দুজন বিজ্ঞ হোমিওপ্যাথ মাত্রার পরিমাণ বিচারে বড়ির সংখ্যাকে গুরুত্ব দেন নি। তাদের মতে বড়ির সংখ্যা বড় কথা নয়, একবারে যা সেবন করা হয়, এবং তা যদি ক্রিয়া করে,তাতে একমাত্রাই হয়। তবে সুস্থদেহে ঔষধ পরীক্ষাকালে যদি একমাত্রায় ক্রিয়া না হয় সেক্ষেত্রে ডা. কেন্ট ঔষধ জলে মিশিয়ে দুই ঘন্টা পরপর ২৪ অথবা ৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত সেবন করতে বলেছেন। তিনি শিরোনামে তার ফিলসফিতে বলেছেন, ”পুনঃপুন সেবনে ঔষধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। রোগী উক্ত ঔষধের সূক্ষ্ম প্রভাবের অধীন হয়। তবে লক্ষণ প্রকাশ শুরু হলেই ঔষধ গ্রহণ বন্ধ করতে হবে।” মহাত্মা হ্যানিম্যান ১২৮ ও ১২৯ নম্বর সূত্রে বলেছেন যে, সুস্থ মানবদেহে ঔষধ পরীক্ষার জন্য ত্রিশ শক্তির ঔষধ ৪ থেকে ৬টি ক্ষুদ্র বড়ি জলে মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খালিপেটে একমাত্রা করে সেবন করতে হবে। এতে লক্ষণ স্পষ্ট না হলে উক্ত দ্রাবণের সাথে প্রতিমাত্রায় কয়েকটি করে ক্ষুদ্রবড়ি যোগ করতে হবে। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, ডা. কেন্ট বড়ির সংখ্যাকে গুরুত্ব দেন নি। কিন্তু পুনঃপুন প্রয়োগের গুরুত্ব স্বীকার করেন। হ্যানিম্যান বড়ির সংখ্যা এবং পুনঃপুন মাত্রা প্রদাণের উপর সমভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। বিষয়টি দুইভাবে বিচার করা যায়। প্রথমত হ্যানিম্যানের সময় যে শক্তিগুলোকে উচ্চ শক্তি বলা হয়েছে, ডা. কেন্টের সময় সেসব শক্তিকে নিু শক্তি হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। হ্যানিম্যানের সূত্র মোতাবেকই পরবর্তী সময়ে ত্রিশ থেকে এম এম শক্তি পর্যন্ত ঔষধের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ-সকল উচ্চতর শক্তির ঔষধে দৃশ্যত গুণ ব্যতীত কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। ক্ষুদ্র বড়িগুলো ঔষধসিক্ত হলে শুধুমাত্র শক্তির একেকটি ধাপের ক্রিয়া ক্ষমতা ধারণ করে রাখে। কিন্তু এ-ক্রিয়া ক্ষমতা একেবারে অদৃশ্য। এর কোন পরিমাণ দৃশ্যত চিন্তা করা যায় না। কিন্তু আমরা যদি একটু অন্যভাবে চিন্তা করি, অর্থাৎ সদৃশচিকিৎসাবিধান আমাদেরকে যেভাবে চিন্তা করতে শিখিয়েছে সেভাবে যদি চিন্তা করি তাহলে এ-ক্ষেত্রে একটি সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়। আমরা যে প্রক্রিয়ায় ঔষধের শক্তি বৃদ্ধি করি তাতে শক্তির প্রতি ধাপে ঔষধ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মতার দিকে এগিয়ে যায়। ত্রিশ শক্তির সূক্ষ্মতা যেমন দৃশ্যমান নয়, তেমনি দুইশত, হাজার, দশ হাজার ইত্যাদি শক্তির কোন ধাপেই শক্তি দৃশ্যমান নয়। তবে এ-কথা সত্য যে, ত্রিশ শক্তি অপেক্ষা দুইশত শক্তি বেশি সূক্ষ্ম, এক হাজার শক্তি আরো সূক্ষ্ম এবং এভাবে শক্তির প্রতিটি উচ্চতর ধাপে সূক্ষ্মতাই বৃদ্ধি পায়।
সূর্য রশ্মি যেমন কোটি কোটি মাইল দূর থেকে বায়ূমন্ডলের বিভিন্ন স্তরে অন্যান্য পদাধিক অণু-পরমাণুর সাথে মিশ্রণ ও ঘর্ষনের মাধ্যমে পরিস্রুত, বিশুদ্ধ ও সুক্ষ্ম হয়ে পৃথিবীতে পৌছে, তেমনি আমাদের ঔষধ আস্ত উপাদান থেকে অন্য নিষ্ক্রিয় বস্তুর অণু-পরমাণুর সাথে নিয়মিত মিশ্রণ ও ঘর্ষণের মাধ্যমে পরিস্রুত ও বিশুদ্ধ হয়ে সূক্ষ্মতার দিকে এগিয়ে যায়। এবং এভাবে তরলীকরণ ও ঝাঁকির মাধ্যমে আমরা আমাদের ঔষধের শক্তির বিভিন্ন ধাপ বা ক্রম তৈরী করি। তাহলে দেখা যায় যে, আমরা এ-কাজটি করার জন্য যে নিষ্ক্রিয় বস্তুকে মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করি সেই মাধ্যমটি শক্তির একেকটি ধাপের বাহক হিসাবে পরিগণিত হয়। আমরা যদি সূক্ষ্মতা ও ক্ষুদ্রত্বের ধারাবাহিকতায় চিন্তা করি তাহলে বলা যায়, এবং কার্যতঃ ত্রিশ শক্তি দুইশত শক্তি অপেক্ষা স্থুল বা কম তরলীকৃত, কম সূক্ষ্ম, কম ঝাঁকুনিপ্রাপ্ত, এবং কম শক্তিকৃত। এ-সত্য যদি মেনে নেই তাহলে ত্রিশ শক্তির একটি বড়ির চেয়ে দশটি বড়ি বৃহৎ মাত্রা হয়। তবে খুব সূক্ষ্ম চিন্তা ব্যতীত এর প্রভেদ নির্ণয় করা কঠিন।
হ্যানিম্যান সূক্ষ্ম চিন্তার অধিকারী ছিলেন। তিনি তার চিন্তা ও মনন শক্তি দ্বারা যা দেখেছেন তা দেখার মতো শক্তি আমাদের নেই। তবে যুক্তির খাতিরে আমরা বলতে পারি যে- একটি বড়ি যদি যথার্থ ক্রিয়া করে, তাহলে সদৃশচিকিৎসাবিধানে দশটি বড়ির স্থান নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা সূক্ষ্মতার জগতে আছি।

৪। ক্ষুদ্র মাত্রা কি-দেখা যায় না। কারণ ঔষধের ক্ষুদ্রতম মাত্রার মুখ্য ক্রিয়া খুব মৃদু হয় বলে গৌণ ক্রিয়াও খুব মৃদু হয়। অর্থাৎ ঔষধের মৃদু মুখ্য ক্রিয়ার বিরুদ্ধে জীবনীশক্তির ব্যাপক প্রতিক্রিয়া করতে হয় না বলে ক্ষুদ্র মাত্রায় স্পষ্ট গৌণ ক্রিয়া সংঘটিত হয় না। সদৃশ ঔষধের ক্ষুদ্রতম মাত্রার বিরুদ্ধে জীবনীশক্তি শুধুমাত্র আরোগ্য-সহায়ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। অর্থাৎ সদৃশ নিয়মে ক্ষুদ্রতম মাত্রায় রোগীকে ঔষধ দিলে জীবনীশক্তি এর বিরুদ্ধে শুধু আরোগ্য-সহায়ক প্রতিক্রিয়া দ্বারা রোগীর স্বাস্থ্য পুণরুদ্ধার করে। তাই তাদের দেহে অবাঞ্ছিত লক্ষণ প্রকাশ হয় না এবং ঔষধের মাত্রার এরূপ ক্ষুদ্রত্বের কারণে ঔষধীয় শক্তিও কখনো দুর্বল হয় না। তাই সদৃশ ঔষধের মাত্রা যতই ক্ষুদ্র করা হোকনা কেন যথার্থভাবে সদৃশ হলে তা অবশ্যই রোগ আরোগ্য করতে সক্ষম হয়।

৫। ডিনাইমাইজেশনঃ- প্রকৃতপক্ষে, সদৃশচিকিৎসাবিধানের ডিনাইমাইজেশন পদ্ধতি অনুসারে কিঞ্চিৎ ঔষধ (১গ্রেন বা ১ ফোটা) নিষ্ক্রিয় পদার্থের সাথে মিশিয়ে লঘুকরণপূর্বক ঘর্ষণ বা ঝাঁকির মাধ্যমে এর শক্তি বৃদ্ধি করাই মূল কথা। তাতে ঔষধের কার্যক্ষমতা কমে না বরং বৃদ্ধি পায় এবং এভাবে শক্তিকৃত ঔষধ সেবনে শরীর দুর্বল হয় না এবং ঔষধের ক্রিয়া দেহে তৎক্ষণাৎ সংঘটিত হয় এবং এর মুখ্যক্রিয়াও স্থায়ী হয় না। কিন্তু স্থুল মাত্রায় ঔষধের ক্রিয়া দেহে স্থায়ী কুফল সৃষ্টি করে। অতএব ঔষধ সদৃশচিকিৎসাবিধানে প্রচলিত যে কোন পদ্ধতি অনুসারে সূক্ষ্ম ও শক্তিকৃত হোকনা কেন তা সুস্থ মানবদেহে কৃত্রিম রোগলক্ষণ উৎপাদন করবে এবং তাদৃশ প্রাকৃতিক রোগলক্ষণ আরোগ্য করবে। কারণ ঔষধ কর্তৃক সুস্থ মানবদেহে কৃত্রিম রোগলক্ষণ উৎপাদন করা এবং সেই ঔষধ কর্তৃক তাদৃশ প্রাকৃতিক রোগলক্ষণ আরোগ্য করা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। তাই যুক্তিসঙ্গতভাবে নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, যে ঔষধ রোগীদেহে যেরূপ প্রাকৃতিক রোগলক্ষণ আরোগ্য করে, সে ঔষধ সুস্থ মানবদেহে তাদৃশ কৃত্রিম রোগলক্ষণ উৎপাদন করার যোগ্য এবং অবশ্যই তা উৎপাদন করবে, তবে ক্ষেত্রবিশেষে শক্তি ও মাত্রাভেদে। আমরা যদি সদৃশচিকিৎসাবিধানের এ-দর্শনটি বিশ্বাস করি তাহলে বিশ্বাস করতে হয় যে পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তিতে ঔষধ পরীক্ষা করা হলে তা একইভাবে সুস্থ মানবদেহে কৃত্রিম রোগলক্ষণ উৎপাদন করবে। কারণ আমরা বাস্তবে দেখেছি যে, পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তির ঔষধ আরোগ্য ক্ষেত্রে যথার্থ ক্রিয়া সম্পন্ন করে। তাই যদিও পঞ্চাশ সহস্রতমিক শক্তিতে ঔষধ পরীক্ষিত হয় নি তথাপি আমরা নিশ্চিত যে, এ-সব শক্তিতে ঔষধ অবশ্যই সুস্থ মানবদেহে কৃত্রিম রোগলক্ষণ উৎপাদন করবে। অর্থাৎ ঔষধ যে কোন রীতিতে সূক্ষ্ম এবং তার শক্তি বৃদ্ধি করা হোকনা কেন তা সুস্থ এবং অসুস্থ দেহে একইভাবে তার কার্যক্ষমতা প্রমাণ করতে সক্ষম হবে। তবে ঔষধের সূক্ষ্মতা ও শক্তি বৃদ্ধি করার বিভিন্ন পদ্ধতির ক্ষেত্রে এবং ঐসব ঔষধ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বাস্তব কিছু সুবিধা-অসুবিধা আছে। তা আমরা যথাস্থানে তুলনামুলকভাবে আলোচনা করব। যাহোক, প্রত্যেকটি ঔষধ বিভিন্ন শক্তিতে প্রস্তুত করা আবশ্যক। কারণ মানবদেহে ব্যক্তিগত সংবেদনশীলতা সকলের সমান নয়। এ-কারণে ব্যক্তিগত দৈহিক জীবনীশক্তির সংবেদনশীলতার বিভিন্ন ধাপের সাথে ঔষধ শক্তির সমন্বয় সাধন করার জন্য বিভিন্ন শক্তিতে ঔষধ প্রস্তুত করতে হয়। এ-বিষয়ে ডা. কেন্ট তার লেসার রাইটিংস পুস্তকে৩০৭ পৃষ্ঠায় বলেছেন যে, ”দুটি ক্রিয়ার মধ্যে গুণগতভাবে সাদৃশ্যের সর্বোচ্চ ধাপের বিন্দুটি পরিবর্তনশীল, তাই শক্তির বি¯তৃত পরিসরে কোন ধাপে নিু শক্তিতে অনেক ত্বরিত আরোগ্য দৃষ্টিগোচর হয়, তবে সচরাচর উচ্চ এবং উচ্চতর শক্তি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত পরিবেশন করে।”
৬। দুরবস্থা- সূত্র-৯৩-ব্যাখ্যাঃ- কোন ব্যাধি যদি সুস্পষ্ট কারণ দ্বারা অম্ল দিন আগে সংঘটিত হয়ে থাকে অথবা চিররোগের ক্ষেত্রে বেশ কিছুদিন আগেও যদি তা সংঘটিত হয়ে থাকে তাহলে রোগী সে কারণগুলো বলতে পারে। কারণ তখনও তার ঐ কারণগুলো মনে থাকে। অথবা রোগীর বন্ধুরা যদি কারণগুলো অবগত থাকে তাহলে তাদের কাছ থেকেও কারণগুলো জানা যায়। তবে এক্ষেত্রে চিকিৎসকের উচিত খুব গোপনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা। কারণ এ-সব কারণের মধ্যে অনেক কারণ থাকে যা খুব গোপনীয় এবং লজ্জাকর। তাই রোগী অথবা তার বন্ধুরা তা প্রকাশ্যে বলতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, তদ্রƒপ কিছু কারণ ৮৬ নম্বর পাদটীকায় উল্লেখ করা হয়েছে।

পাদটীকা-৮৬, লজ্জাকর কোন কারণ থাকলে , রোগী অথবা তার বন্ধুরা স্বীকার করতে চায় না, অন্তত স্বেচ্ছায়। চিকিৎসক দক্ষতার সাথে প্রশ্ন করে অথবা গোপনে তা জানার চেষ্টা করবেন। এ-জাতীয় কারণগুলো হচ্ছেঃ আত্মহত্যার চেষ্টা, হস্তমৈথুন, স্বাভাবিক অথবা অস্বাভাবিক অমিতাচার, মদ, উত্তেজক বস্তু, শরাব এবং অন্যান্য উত্তেজক পানীয় বা কফি পান,-অতিভোজন, অথবা ক্ষতিকর খাদ্যগ্রহণ, -যৌনরোগে অথবা চুলকানিতে সংক্রমণ, দুর্ভাগ্যজনক ভালবাসা, ঈর্ষা, পারিবারিক অশান্তি, বিরক্তি, পারিবারিক দুর্ভাগ্যজনিত দুঃখ, দুর্ব্যবহার, প্রতিশোধ নিতে নিরাশ, আহত গর্ব, আর্থিক দূরবস্থা, কুসংস্কারমূলক ভয়,-অনাহার, অথবা গুপ্ত অঙ্গের ত্র“টি, বিদারণ, স্থানচ্যুতি ইত্যাদি দূরবস্থা হবে, তাদের মধ্যে এমন কিছু আছে কিছু আছে কিনা যা রোগ উৎপাদন অথবা প্রতিপালন করতে পারে তা নির্ণয় করার জন্য, যাতে তাদের অপসারণ পূর্বক আরোগ্য ত্বরান্বিত হয়।

ব্যাখ্যাঃ- এ-সূত্রে বলা হয়েছে যে, চিররোগের অবস্থা অনুসন্ধানের সময় রোগীর পেশা , জীবনপ্রণালী, আহার, পারিবারিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয়গুলো অনুসন্ধান করতে হবে। এ-সব বিষয় রোগের প্রকৃত লক্ষণ না হলেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রোগীর পেশা, জীবনপ্রণালী, পথ্য, বাসস্থান ইত্যাদি বিষয়গুলোর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে রোগ সৃষ্টির কারণ নিহিত থাকে অথবা রোগীর আরোগ্যপথের কোন বাঁধা এ-সব বিষয়ের মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকতে পারে। চিকিৎসকের তা খুঁজে বের করতে হবে। অনেক সময় এসব কারণ দূর হলেও রোগী আরোগ্যলাভ করে। এছাড়াও মহিলাদের ক্ষেত্রে আরো কিছু অপরিহার্য বিষয় আছে যা সম্পর্কে বিশেষ অনুসন্ধান আবশ্যক। এ বিষয়গুলো ৮৭ নম্বর পাদটীকায় বর্ণনা করা হয়েছে।

৭। অদৃশ্য শক্তি কি-সূত্র-১১,ব্যাখ্যাঃ- আমরা জানি যে, পদার্থের বিষক্রিয়ায় মানুষ পীড়িত হয়। সে পীড়া কারণসর্বস্ব। এ-ছাড়া ব্যাধির অদৃশ্য শক্তির প্রভাবেও মানুষ পীড়িত হয়। সে-ক্ষেত্রে ব্যাধির অদৃশ্য ক্রিয়াশীল প্রভাব সর্বপ্রথম মানুষের অদৃশ্য জীবনীশক্তিতে সংক্রমিত হয়। তারপর দেহে রোগলক্ষণ প্রকাশ করে।

এখন প্রশ্ন জাগতে পারে কে এ-লক্ষণ প্রকাশ করে? নাকি অদৃশ্য ব্যাধিশক্তি? এ প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে হলে জড়বাদী জগত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সূক্ষ্ম উপলব্ধি অর্জন করতে হবে। দেহ নামক রাজ্যের শাসক জীবনীশক্তি। এ রাজ্যের রাজাকে প্রভাবিত না করে কার সাধ্য সেখানে দখল নেয়? রোগের অদৃশ্য ক্রিয়াশীল প্রভাব দেহের রাজার উপর সংক্রমিত হয়। তখন জীবনীশক্তি তার শত্র“র অনুরূপ ক্রিয়া করে। যেমন লৌহদন্ড যখন চুম্বক শক্তি দ্বারা সংক্রমিত হয় তখন চুম্বক দন্ডের অনুরূপ ক্রিয়া করে। তাই জীবনীশক্তি পীড়িত হলে রোগশক্তির ন্যায় ক্রিয়া করে। এ-স্বভাবটি জীবনীশক্তির সহজাত ও অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ কারণেই আমরা জীবনীশক্তির পীড়িত অবস্থার অবিকল চিত্রটিই প্রকাশিত রোগলক্ষণের মধ্যে খুঁজে পাই। এখন প্রশ্ন জাগে, অদৃশ্য শক্তি কী? এর ক্রিয়াশীল প্রভাব কী? এবং কার্য-কারণ সম্পর্ক কীরূপ?

এ-সূত্রের সুবিশাল পাদটীকায় তিনি এসব প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিয়েছেন। খুব সহজ, সরল এবং বাস্তব দৃষ্টান্তের মাধ্যমে তিনি বিষয়টি পরিস্কার করে তুলে ধরেছেন।

Dynamic Theory: Dynamic Theory গভীরভাবে মূল্যায়ন করতে পারে না। তারা কারণ জগতের গভীরে যেতে পারে না বলে শুধু ফলটাই দেখে। ফল বা কার্য যেহেতু দৃশ্যমান, তাই তাদের চর্মচক্ষু খুব ভালভাবে তা দেখতে পারে। মহাত্মা হ্যানিম্যান দেখিয়েছেন যে, সকল কার্যেরই কারণ আছে। তবে মৌলিক কারণটি অদৃশ্য। তাকে দেখা যায় না এবং কখনো দেখা যাবে না। কার্য দ্বারাই তাকে চিনতে হবে। তবে উত্তেজক কারণটি অবগত হওয়া যায়। মানবদেহে মূল চালিকাশক্তি তার প্রাণশক্তি বা জীবনীশক্তি। তাই মানবদেহের ব্যাধি মানেই তার জীবনীশক্তি ব্যাধি। জীবনীশক্তি অদৃশ্য; অপরদিকে ব্যাধিশক্তিও অদৃশ্য। ব্যাধিশক্তি অদৃশ্য তা অদৃশ্য জীবনীশক্তিতে সংক্রমিত হতে পারে। অদৃশ্য জীবনীশক্তি অদৃশ্য ব্যাধিশক্তি কর্তৃক সংক্রমিত হলে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাথ্যমে এর অস্বাভাবিক কার্য দ্বারা তা প্রকাশ করে। অর্থাৎ জীবনীশক্তি পীড়িত হলেই দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকলাপ ও অনুভূতিতে অস্বাভাবিকত্ব প্রকাশ পায়। অতএব চিকিৎসা দ্বারা জীবনীশক্তি পুনরায় স্বাভাবিক কার্যে নিয়োজিত হলেই দেহের অনুভূতি ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকলাপে স্বাভাবিকত্ব ফিরে আসে, তার মনে স্বস্তি ফিরে আসে। এরই নাম সুস্থতা। হ্যানিম্যানের এ-দর্শনটি অন্যান্য দার্শনিকদের চিন্তা-চেতনা থেকে আলাদা। ডা. টেস্টি তার সম্পর্কে মেটিরিয়া মেডিকার ৯ পৃষ্ঠায় বলেছেন যে, ”হ্যানিম্যান, যিনি চিন্তায় ছিলেন অদৃশ্যবাদী, ফিজিওলজীতে জীবনীশক্তিবাদী, এবং সেইহেতু চিকিৎসাবিজ্ঞানেও। অর্থাৎ ডেসকার্টিস এবং স্টাল, দার্শনিকদ্বয়ের মানবীয় দ্বৈতবাদের (দেহ এবং আত্মা) পরিবর্তে তিনি মানুষের মধ্যে তিনটি সুদৃঢ় মূলতত্ত্ব আলাদা করেছেন যথাঃ বস্তু, আত্মা, এবং অপর সূক্ষ্ম বস্তু, আত্মার মত অদৃশ্য, আত্মা এবং দেহের মাঝখানে এক ধরণের মধ্যবর্তী জীবনীশক্তি, যার প্রতি তিনি সকল ব্যাধি, এবং আমাদের সকল জৈবকার্যকলাপকে আরোপ করেছেন।”

৮। রোগীর ইচ্ছা রোগের ইচ্ছা- আমি এখানে রোগীর ইচ্ছার কথা বলছি এজন্য যে, কোন কোন ক্ষেত্রে আপাত দৃষ্টিতে রোগীর ইচ্ছা এবং রোগের ইচ্ছা পরস্পর বিপরীত হয়। যেমন-রোগী শীতে কাতর কিন্তু মাথা ব্যথায় ঠান্ডা চায় এবং মাথায় ঠান্ডা প্রয়োগে উপশম হয়। আমাদের আর্সেনিক অ্যাল্বাম ঔষধটি এরূপ দ্বৈত আকাক্সক্ষা উৎপাদন করে। লাইকোপোডিয়াম ঔষধটিও দ্বৈত লক্ষণ উৎপাদন করে। আবার কেলি আইওডের রোগী গরমে কাতর কিন্তু ঠান্ডা খাবারে তার পীড়ার বৃদ্ধি হয়। কেলি সাল্ফের রোগী গরমে কাতর কিন্তু øানে বৃদ্ধি। ফসফরাসের রোগী শীতে কাতর কিন্তু পেটে ভীষণ ঠান্ডা খাবার চায়। অতএব দেখা যায় যে, আমাদের অনেক ঔষধ সুস্থ শরীরে দ্বৈত আকাক্সক্ষা উৎপাদন করে এবং রোগে দ্বৈত আকাক্সক্ষার সাথে সদৃশ হয়ে তা আরোগ্য করে। সেইহেতু রোগের দ্বৈত আকাক্সক্ষা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মূলত রোগের আকাক্সক্ষা এবং রোগীর আকাক্সক্ষা একই। তা দ্বৈত প্রকৃতিবিশিষ্ট হতে পারে।

উপসংহারে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, ব্যাধির সহচর হ্রাস-বৃদ্ধিই ব্যাধিকে বৈশিষ্টমন্ডিত করে। অতএব সদৃশ ঔষধ নির্বাচনে এর গুরুত্ব অনেক বেশি।

৯। Surgical- সূত্র-২৯, বাংলাঃ- যেহেতু (পুরোপুরি অস্ত্রাঘাত জাতীয় নয় এমন) সকল ব্যাধিই শুধুমাত্র আমাদের জীবনীশক্তির (জীবনের মূলতত্ত্বের) বিশেষ রুগ্ণ, সূক্ষ্ম পরিবর্তনে সংঘটিত হয়ে অনুভূতি ও চলৎশক্তিতে প্রকাশিত হয়, সেইহেতু সদৃশচিকিৎসাবিধানসম্মত সকল আরোগ্য প্রাকৃতিক ব্যাধি কর্তৃক অদৃশ্যভাবে পরিবর্তিত এ-জীবনীশক্তি লক্ষণ সাদৃশ্য অনুসারে সঠিকভাবে নির্বাচিত ঔষধশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কিছু বেশি শক্তিশালী সদৃশ কৃত্রিম ব্যাধিলক্ষণ দ্বারা অধিকৃত হয়। এ-অনুভব দ্বারা সূক্ষ্মভাবে সৃষ্ট প্রাকৃতিক (দুর্বল) রোগলক্ষণের অনুভব শেষ হয় এবং রোগলক্ষণ দূর হয়। এ রোগলক্ষণ জীবনীশক্তিতে আর টিকে থাকে না। জীবনীশক্তি এখন শুধুমাত্র শক্তিশালী কৃত্রিম ব্যাধিলক্ষণ কর্তৃক অধিকৃত এবং পরিচালিত হয়। এ-কৃত্রিম রোগলক্ষণ শীঘ্রই এর ক্রিয়া নিঃশেষ করে দেয় এবং রোগীকে রোগমুক্ত, আরোগ্য অবস্থায় ত্যাগ করে। জীবনীশক্তি এভাবে রোগমুক্ত হয়ে সুস্থভাবে জীবন চালিয়ে নিতে পারে। সবচেয়ে বেশি সম্ভাব্য এ-আরোগ্য প্রক্রিয়াটি পরে বর্ণিত প্রমাণাদির উপর প্রতিষ্ঠিত।

ব্যাখ্যাঃ-দেহের কোন স্থানে কেঁটে যাওয়া, পুড়ে যাওয়া, আঘাত পাওয়া ইত্যাদি রোগ ছাড়া বাকী সকল ব্যাধিই অদৃশ্যভাবে প্রথমেই জীবনীশক্তিতে সংক্রমিত হয়। ফলে জীবনীশক্তি বিশৃঙ্খলিত হয়ে দেহের অনুভূতি ও ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে লক্ষণ প্রকাশ করে। একইভাবে, সদৃশচিকিৎসাবিধানমতে পূর্ণ লক্ষণ সাদৃশ্যে ঔষধ প্রয়োগ করা হলে ঔষধের অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী কৃত্রিম ব্যাধিলক্ষণ জীবনীশক্তিকে অধিগ্রহণ করে। ফলে সদৃশ প্রাকৃতিক রোগলক্ষণ পরাজিত ও নিবৃত্ত হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক রোগলক্ষণের উপর কর্তৃত্বশীল ঔষধের কৃত্রিম রোগলক্ষণ সবই তখন দেহে প্রকাশ পায় না। কারণ ঔষধ সুস্থ দেহে যে রোগলক্ষণ উৎপাদন করত রোগীদেহে তাদৃশ লক্ষণ বিদ্যমান থাকায়, ঔষধ এর সমস্ত শক্তি দিয়ে শুধুমাত্র সদৃশ রোগলক্ষণগুলোর সাথে যুদ্ধ করে। এবং শক্তিতে আরো সূক্ষ্ম বিধায় তা প্রাকৃতিক ব্যাধিকে খুব সহজে এবং দ্রুত পরাজিত ও ধ্বংস করে। এবং তদ্সঙ্গে উক্ত শক্তিকৃত ঔষধের সূক্ষ্ম ক্রিয়াও দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যায়। উল্লেখ্য সদৃশচিকিৎসাবিধানে ঔষধ খুব সূক্ষ্ম মাত্রায় প্রদাণ করা হয় বলেই জীবনীশক্তি একদিকে প্রাকৃতিক ব্যাধির প্রভাব মুক্ত হয়, অন্যদিকে ঔষধের কৃত্রিম রোগলক্ষণের প্রভাব মুক্ত হয়। তখন জীবনীশক্তি সম্পূর্ণ স্বাধীন হয় এবং পুনরায় সুস্থভাবে জৈবক্রিয়া পরিচালনা করতে থাকে।
দেহের অদৃশ্য অভ্যন্তরে কোন প্রক্রিয়ায় রোগ আরোগ্য হয় তার বিবরণ এ-সূত্রে দেয়া হয়েছে। তবে ধারণাটি প্রকৃতির কর্মপ্রণালী থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এটি কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না হলেও বিশ্বাসযোগ্য । কারণ প্রকৃতি সত্য এবং শ্বাশত।

১০। দৃশ্যত সদৃশ-যাহোক, সদৃশচিকিৎসাবিধানে ঔষধকে রোগ আরোগ্য করার উপযুক্ত করতে হলে তাকে সদৃশচিকিৎসাবিধানের নিজস্ব প্রণালীতে সূক্ষ্ম শক্তিতে উন্নীত করতে হবে। দুটি কারণে ঔষধকে সূক্ষ্ম এবং শক্তি বৃদ্ধি করতে হয়ঃ

প্রথমতঃ আমাদের জীবনীশক্তি একটি অদৃশ্য সত্তা এবং রোগশক্তি একটি অদৃশ্য সত্তা। তাই তাদের সাথে সমন্বয় করে অদৃশ্য সত্তায় পরিণত করতে হয়। অন্যথা ঔষধটি এ-সব অদৃশ্য সত্তার জন্য সদৃশভাবে উপযোগী হয় না।

দ্বিতীয়তঃ আমাদের জীবনীশক্তির সংবেদশীলতার ধাপ পরিবর্তনশীল। ঔষধের শক্তি ও মাত্রায় জীবনীশক্তির সংবেদনশীলতার সাথে সমন্বিত না হলে জীবনীশক্তি সে ঔষধের প্রতি ইতিবাচকভাবে সাড়া দেয় না। বাস্তবে দেখা যায় যে, কোন একটি ঔষধ একটি নির্দিষ্ট শক্তি ও মাত্রায় রোগীকে দেয়ার পর (বিশেষ করে চিররোগে) একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভাল কাজ করে, রোগের উপশম হয়। তারপর এর ক্রিয়া থেমে যায়, কিন্তু লক্ষণ দৃষ্টে একই ঔষধ আবশ্যক হয়। তখন আরো উচ্চতর শক্তিতে ঐ একই ঔষধ প্রয়োগ করা হলে পুনরায় আরোগ্যক্রিয়া শুরু হয়। এ-কারণে জীবনীশক্তির সংবেদনশীলতার পরিবর্তিত অবস্থা এবং রোগশক্তির সূক্ষ্মতা ও গভীরতার সাথে সমন্বয় করে আমাদের ঔষধের শক্তি পরিবর্তন করতে হয়। অন্যথা রোগীর পরিপূর্ণ আরোগ্য ও স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার সম্ভব হয় না। অতএব বলা যায় যে, যথার্থ সদৃশ ঔষধটি যথার্থ সদৃশ ঔশধটি যথার্থ শক্তি ও মাত্রায় রোগ আরোগ্যের জন্য উপযুক্ত হয়। অর্থাৎ পরিপূর্ণভাবে সদৃশ ঔষধটি সর্বদা সদৃশ প্রাকৃতিক ব্যাধি অপেক্ষা শক্তিশালী হয়।

ব্যাখ্যাঃ পৃথিবীতে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আমরা বসবাস করি। আমাদের স্বাস্থ্যের শত্র“ অসংখ্য। তারা সর্বক্ষণ আমাদের দেহ ও মনের সুস্থতা বিনষ্ট করার হন্য ওতপেতে থাকে। এ-শক্তিগুলোকে আমরা প্রতিকূল শক্তি বলি। এদের প্রভাবে আমাদের জীবনীশক্তি পীড়িত হয় এবং আমাদের দেহে নানারকম রোগ জটিলতা প্রকাশ পায়। তবে সুখের বিষয় এই যে, এ-রোগশক্তিগুলো ইচ্ছা করলেই আমাদের দেহে রোগ সংক্রমণ করতে পারে না। কারণ আমাদের দেহের চালক আত্মাসদৃশ জীবনীশক্তি। এ-অদৃশ্য জীবনীশক্তি স্বাধীন, সেচ্ছাচারী, সংবেদনশীল এবংঅভিযোজ্য। এ কারণে মানুষ প্রকৃতির সকল পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে, জীবনীশক্তি আমাদের স্বাস্থ্যকে রোগব্যাধি থেকে রক্ষা করতে পারে, রোগে আক্রান্ত করতে পারে। আবার পীড়িত অবস্থায় উপযুক্ত ঔষধের সাহায্য পেলে রোগ আরোগ্য করতে পারে। এ-কাজগুলো জীবনীশক্তির সংবেদনশীলতার উপর নির্ভর করে, ব্যাধিশক্তির ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। জীবনীশক্তির সংবেদনশীলতা স্বেচ্ছা-পরিবর্তনশীল। আমরা যদি জীবনমাত্রায় অনিয়ম করি, দেহের উপর বেশি জুলুম করি এবং জীবনীশক্তির উপর যদি প্রতিকূল শক্তিসমূহের চাপ বৃদ্ধি পায় তাহলে জীবনীশক্তি প্রকৃতির মতো রূপ বদলায় এবং ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। জীবনীশক্তি, বলতে গেলে, অনেকটা প্রাকৃতিক প্রতিশোধ গ্রহণে বাধ্য হয়। জীবনীশক্তির সংবেদনশীলতার স্তর তখন রোগশক্তির স্তরের সাথে সমন্বিত হয়। অর্থাৎ জীবনীশক্তি তখন ব্যাধিশক্তির প্রতি সাড়া দেয়। উল্লেখ্য জীবনীশক্তি যেরূপ প্রতিকূল শক্তি কর্তৃক খুব বেশি নিপীড়িত ও প্রভাবিত হয় ঠিক সেইরূপ ব্যাধিতেই আক্রান্ত হয়। এবং যে মূহুর্তে জীবনীশক্তি ব্যাধিশক্তির প্রতি সাড়া দেয় ঠিক সেই মূহুর্তে সে পীড়িত হয়।

কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের জীবনীশক্তি রোগউৎপাদক কারণের প্রতি সংবেদনশীল না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা পীড়িত হতে পারি না। তাই বলা হয়েছে যে, রোগ উৎপাদক শক্তিগুলো প্রত্যেকের মধ্যে রোগ উৎপাদন করে না কিংবা সব সময় করে না।

১১। প্রকারে পৃথক-সূত্র-৪৫, না, দুটি ব্যাধি, প্রকৃতই প্রকারে পৃথক কিন্তু খুবই সদৃশ তাদের বৈশিষ্ট্যে এবং কার্যফলে এবং রোগযন্ত্রণাসমূহে এবং লক্ষণসমূহে তারা স্বতন্ত্রভাবে যা উৎপাদন করে, ব্যতিক্রমহীনভাবে একটি অন্যটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে যখনই তারা দেহাভ্যন্তরে একত্রিত হয়; সবল ব্যাধি দুর্বল ব্যাধিকে সমূলে ধ্বংস করে, এবং যা এ-সরল কারণটির জন্যই হয়, কারণ সবল রোগ উৎপাদক শক্তি, যখন এটি দেহকে আক্রমণ করে, এর ক্রিয়াগত সাদৃশ্যের কারণে ঠিক দেহের একই অঙ্গসমূহ অধিকার করে যা পূর্বেই দূর্বল রোগজ উত্তেজনা দ্বারা আক্রান্ত ছিল, যা, ফলস্বরূপ, এই অঙ্গসমূহে এক মুহুর্তও ক্রিয়া করতে পারে না, কিন্তু ধ্বংস হয়; অথবা (অন্য কথায়), নতুন সদৃশ কিন্তু শক্তিশালী রোগ উৎপাদক শক্তি রোগীর অনুভূতিসমূহ নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং এখন থেকে জীবনীশক্তি এর বিশিষ্টতার কারণে, দুর্বল সদৃশ শক্তিকে মুহুর্তের জন্যও অনুভব করতে পারে না যা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়-মুহুর্তকালও টিকে থাকে না-কারণ এটি কখনোই বস্তুগত ছিল না, কিন্তু একটি অদৃশ্য-আত্মাসদৃশ -(ধারণাগত) পীড়া ছিল। জীবনীশক্তি অতঃপর পীড়িত হয় এবং তা কিন্তু অস্থায়ীভাবে নতুন সদৃশ কিন্তু শক্তিশালী রোগ উৎপাদক শক্তি দ্বারা।

ব্যাখ্যাঃ- এ-সূত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে সংক্ষেপে অনেক কথাই বলা হয়েছে। প্রথমেই বলা হয়েছে যে, হোমিওপ্যাথিতে আরোগ্যের জন্য দুটি ব্যাধি স্বভাব-চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য এক ও অভিন্ন হবে কিন্তু প্রকারে পৃথক হতে হবে। অন্যথা তা ইসোপ্যাথি হবে। ইসোপ্যাথি কখনো হোমিওপ্যাথি নয়। কুকুরের লালা সেবন করিয়ে কুকুরের বিষ ধ্বংস করার নাম ইসোপ্যাথি। আর কুকুরের লালা সূক্ষ্ম এবং শক্তিবৃদ্ধি করে লক্ষণ সাদৃশ্যে প্রয়োগ করার নাম হোমিওপ্যাথি। হ্যানিম্যান দি ক্রনিক ডিজীজ পুস্তকে দা মেডিসিন শিরোনামে ১৫২ পৃষ্ঠায় বলেছেন যে, ”এভাবে শক্তিকৃত এবং পরিশীলিত খোস বস্তু (সোরিনাম) যখন গ্রহণ করা হয় তখন তা মোটেও অশোধিত মূল চুলকানী বস্তু (একইবস্তু) নয়, কিন্তু শুধুমাত্র সদৃশতম (সর্বাধিক সদৃশ) হয়।” তিনি বিষয়টি সহজবোধগম্য করার জন্য অর্গাননের ভূমিকায় অনেক দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। তার একটি এখানে উল্লেখ করছি। তিনি বলেন-সুতরাং স্থুল ক্রিয়া থেকে আরেকটি দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে, শক্ত বস্তু দ্বারা কপালের উপর আঘাতের ফলে আহত হলে শীঘ্রই কিছু সময়ের বৃদ্ধাঙ্গুলের মাথা দিয়ে আহত স্থান প্রথমে জোড়ে চেপে রাখলে এবং তারপর ক্রমাগতভাবে চাপ কমাতে থাকলে কপালের আঘাতের ব্যথা এবং স্ফীতি দ্রুত সদৃশচিকিৎসাবিধানসম্মতভাবে কমে যায়, কিন্তু একইরূপ শক্ত বস্তুর একইরূপ শক্ত আঘাতের দ্বারা তা হবে না, এরূপ সমবিধান চিকিৎসা কুফল বৃদ্ধি করবে। অর্গানন, বোরিক কর্তৃক অনুবাদ।

অতএব সদৃশচিকিৎসাবিধানে দুটি ব্যাধিশক্তিকে প্রকারে পৃথক এবং বৈশিষ্টে ও কার্যফলে সদৃশ হতে হবে। তাহলে সবল নতুন ব্যাধি সাবেক দুর্বল ব্যাধিকে অপসারণ ও নির্মূল করবে। এরই নাম হোমিওপ্যাথি। এ-ভাবে আরোগ্যের প্রধান কারণ হলো, সাবেক ব্যাধি মানবদেহের যে সব অঙ্গ দখল করে আছে এবং যেরূপ লক্ষণে বিরাজ করছে পরের নতুন ব্যাধি ক্রিয়াগত সাদৃশ্যের কারণে একই অঙ্গ দখল করে এবং একইরূপ লক্ষণ উৎপাদন করে। ফলে আগের ব্যাধি নতুন সদৃশ ব্যাধি কর্তৃক অপসারিত হয়। খুব সহজ একটি উদাহরণের সাহায্যে বলা যায় যে, যেমন-একখন্ড ভূমি ক এবং খ উভয়ে পছন্দ করে এবং উভয়ে তা দখল করতে চায়। তখন উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্যভাবে সংঘটিত হবে। এক্ষেত্রে যে বেশি শক্তিশালী সে টিকে থাকবে। মানবদেহে ব্যাধির ক্রিয়াকলাপ জীবনীশক্তিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়। জীবনীশক্তি অদৃশ্য এবং ব্যাধিশক্তি অদৃশ্য। অপরদিকে সদৃশচিকিৎসাবিধানের ঔষধও একটি অদৃশ্য শক্তিমাত্র। তাই ব্যাধি অপসারণের জন্য জীবনীশক্তি কোন স্থুল বস্তু দেহ থেকে অপসারণ করে না। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে জীবনীশক্তির অনুভূতি সংক্রান্ত। জীবনীশক্তি যখন সদৃশ এবং শক্তিশালী নতুন অনুভূতি কর্তৃক পীড়িত ও অবিভূত হয় তখন সে সদৃশ সাবেক দুর্বল অনুভূতিকে ধারণ করে রাখতে পারে না। যেমন-আপনি মনের মধ্যে ছোট কোন আঘাতের পর যদি আরো বড় কোন আঘাত পান তাহলে আগের ছোট আঘাতের কথা আপনি অবশ্যই ভুলে যাবেন। এভাবে আগের ছোট আঘাত মুছে দেয়ার জন্য আপনার ভিতর থেকে কোন কিছু টেনে বের করতে হবে না। কারণ এটি একটি ভাবগত পরিবর্তন মাত্র। এ-ভাবেই সদৃশচিকিৎসায় আপনারা অসুস্থতা সুস্থতায় পরিণত হয়। এবং সুস্থ হওয়ার পর দেহে সদৃশ ঔষধের ক্রিয়া টিকে থাকে না। কারণ জীবনীশক্তি নিজেই তা থেকে খুব সহজে তৎক্ষণাৎ মুক্ত হতে পারে। অর্থাৎ জীবনীশক্তি তৎক্ষণাৎ ঔষধের ক্রিয়ার প্রভাব মুক্ত হতে পারে। আমরা জানি যে, ঔষধ এর শক্তি দিয়ে সদৃশ লক্ষণ উৎপাদনের মাধ্যমে সদৃশ প্রাকৃতিক ব্যাধির লক্ষণ দূর করে। যে মানবদেহে ঔষধের সদৃশ লক্ষণ বিদ্যমান আছে, সে দেহটি উক্ত ঔষধের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তার দৈহিক বিশেষত্ব খুব বেশি মাত্রায় ঔষধের অনুকূলে থাকায় ঔষধটি উক্ত দেহে তৎক্ষণাৎ লক্ষণ উৎপাদন করে। ঔষধটি এর মুখ্যক্রিয়া সংঘটিত করার পর তৎক্ষণাৎ তার গৌণ ক্রিয়া শুরু হয়। তাই ঔষধ এর সদৃশ লক্ষণ দ্বারা সাবেক রোগলক্ষণ দূর করার সঙ্গে সঙ্গে এর মুখ্য ক্রিয়া শেষ হয়ে যায়। রোগীদেহে তখনই সুস্থতা (আরোগ্যসহায়ক গৌণক্রিয়া) সংগঠিত হয়। তবে রোগের কারণে দেহে যে ফল সৃষ্টি হয় তা সংশোধন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!