৫১ বছর পরও দেশে দেশে বিপ্লবীদের আজও প্রেরণার উৎস চে গুয়েভারা
৫১ বছর পরও দেশে দেশে বিপ্লবীদের আজও প্রেরণার উৎস চে গুয়েভারা
-মাহবুব এইচ শাহীন
বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারা (১৪ জুন, ১৯২৮ – ৯ অক্টোবর, ১৯৬৭)
১৯২৮ সালের ১৪জুন চে গুয়েভারা আর্জেন্টিনায় জন্ম গ্রহণ করেন। পরিবারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন জৈষ্ঠতম। ছোটবেলা থেকেই তার চরিত্রে অস্থির চপলতা দেখে তার বাবা বুঝতে পেরেছিলেন যে আইরিস বিদ্রোহের রক্ত তার এই ছেলের ধমনীতে বহমান। খুব শৈশব থেকেই সমাজের বঞ্চিত, অসহায়, দরিদ্রদের প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ তাঁর ভিতর তৈরি হতে থাকে। একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার পরিবারে বেড়ে ওঠার করনে খুব অল্প বয়সেই তিনি রাজনীতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভ করেন। তার বাবা ছিলেন স্পেনের গৃহযুদ্ধে রিপাবলিকানদের একজন গোড়া সমর্থক, সেই সংঘর্ষের সৈনিকদের তিনি প্রায়ই বাড়িতে থাকতে দিতেন।
চে হাপানিতে সারা জীবন ভোগা সত্ত্বেও তিনি দারুন মল্যবিদ ছিলেন। তার খেলধুলার পছন্দ তালিকায় ছিল সাঁতার, ফুটবল, গলফ, শুটিং। চে সাইক্লিংয়ের একজন অক্লান্ত খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি রাগবি ইউনিয়নের একজন অতি আগ্রহী সদস্য ছিলেন এবং বুয়েনস এয়ারস বিশ্ববিদ্যালয় রাগবি দলের হয়ে খেলেছেনও। রাগবি খেলার ক্ষিপ্রতার জন্য তাকে “ফিউজার” (fuser) নামে ডাকা হত। তার বিদ্যালয়ের সহপাঠীরা তাকে ডাকত চানচো (pig) বলে, কারণ তিনি অনিয়মিত স্নান করতেন এবং সপ্তাহে একবার মাত্র পোশাক পাল্টাতেন।
১২ বছর বয়সে দাবা খেলা শেখেন তার বাবার কাছে এবং স্থানীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেন। ১৯৫১ সালে ২২ বছর বয়সী চে বয়সন্ধি থেকে শুরু করে সারাটা জীবন তিনি কবিতার প্রতি আসক্ত ছিলেন বিশেষ করে পাবলো নেরুদা, জন কিটস, এন্টনিও মারকাদো, ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল এবং ওয়াল্ট হুইটম্যান, তিনি ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন। তিঁনি স্মৃতি থেকে আবৃতি করতে পারতেন রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর “if” কবিতা এবং জোসে হার্নান্দেজ-এর “Martin Fierro” কবিতা। চে পরিবারে ছিল ৩০০০ এরও বেশি বই যা চে কে করে তোলে একজন জ্ঞান পিপাসু্। যার মধ্যে কার্ল মার্ক্স, উইলিয়াম ফক্নার, এমিলিও সলগারির বই। পাশাপাশি জওহরলাল নেহেরু, আলবেয়ার কামু, লেলিন, রবার্ট ফ্রস্ট এর বইও তিনি পড়তেন।
১৯৫৩ সালে পেশায় চিকিৎসক চে গুয়েভারা দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণে বের হন। এর দুই বছর পর তিনি মেক্সিকোয় পৌঁছান। এখানে তার সঙ্গে দেখা হয় ফিদেল কাস্ত্রোর ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোর। এই সূত্র ধরে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় আইনজীবী ফিদেল কাস্ত্রোর। মেক্সিকো থেকে দুই বিপ্লবী নেতার পথচলা শুরু হয়।
ফিদেল ও চে পরিকল্পনা করেন মেক্সিকো থেকে কিউবায় আক্রমণ করবেন। ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর তারা কিউবার উদ্দেশে রওনা দেন। কিউবায় পৌঁছামাত্র তারা বাতিস্তার সেনাবাহিনীর হামলার মুখে পড়েন। এ যুদ্ধে ফিদেলের ৮২ সহযোগী মারা যান অথবা কারাবন্দি হন। মাত্র ২২ জন সহযোদ্ধা প্রাণে বেঁচে ছিলেন। চের ভাষায়, এই যুদ্ধ তাকে চিকিৎসক থেকে বিপ্লবীতে পরিণত করে।
কিউবান বিপ্লবীদের অবিচ্ছেদ অংশ হয়ে উঠেছিলেন চে। সমাজতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে তিনি ফিদেল কাস্ত্রোকে নানা দিক থেকে পরামর্শ দিতেন। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা, কূটনীতি ও বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিয়ে ফিদেলের সঙ্গে আলোচনা করতেন।
বিপ্লবের সময় ফিদেল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন চেকে। বোমা তৈরির কারখানা, রুটি সেঁকার চুল্লি তৈরি ও নিরক্ষর সহযোদ্ধাদের জন্য পাঠশালা পরিচালনার দায়িত্ব পান তিনি। এ ছাড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সামরিক প্রশিক্ষণ ও পত্রিকায় বিপ্লবীদের খবর প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন চে। সবদিক থেকে ফিদেল কাস্ত্রোকে সহযোগিতা করায় টাইম ম্যাগাজিন তাকে ‘কাস্ত্রোর মস্তিষ্ক’ বলে অভিহিত করেন।
ফিদেলের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবীকে সংগঠিত করে রাখতে চে ছিলেন অবিকল্প নেতা। তিনি কিউবার বিদ্রোহী বাহিনীর কমান্ডার হন এবং কঠোর হাতে শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করেন। ফিদেল ও চের যৌথ নেতৃত্বে ১৯৫৯ সালে পতন হয় যুক্তরাষ্ট্রপন্থি কিউবার একনায়ক বাতিস্তার। ১৯৬১ সালে ফিদেল কিউবার শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন চেকে। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানের দায়িত্বও পালন করেন চে।
চে গুয়েভারা ‘ফিদেলের জন্য কবিতা’ শিরোনামে একটি কবিতা লেখেন। ফিদেল ও চের চেতনার ঘনিষ্ঠতা বুঝতে এ কবিতাই যথেষ্ট।
ফিদেলের জন্য কবিতা-
চলো যাই
অগ্নিময় প্রত্যুষে
বালুকাময় আঁকাবাঁকা নির্জন পথ পেরিয়ে
তোমার ভালোবাসার সবুজ স্বপ্নময়
দেশের মুক্তির জন্য।
চলো যাই
জমাট বাঁধা অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে
আমাদের ললাটে অসংখ্য বিদ্রোহের তারা জ্বলছে
শপথের বহ্নিতে না হয় আমরা মরব
অথবা জিতব
যখন প্রথম বুলেটের শব্দে দেশ জেগে ওঠে
কারুময় ঘুম থেকে আচমকা কোনো এক বালিকার মতো
তখনো অবিচলিত থেকো, হে যোদ্ধা
আমরা তোমার পাশেই আছি…
থাকব।…
যখন তুমি জোর প্রচার করো :
জমি-সংস্কার, ন্যায়, রুটি-রুজি আর
স্বাধীনতার
তখন আমরাও তোমার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করি:
আমরাও আছি;
আমাদের মুক্তির লক্ষ্যবানে
যখন বিপক্ষের বন্যপশুরা হতাহত হয়:
তখনো আমরা তোমার সাথে থাকি,
আমাদের হৃদয় গর্বে স্ফীত হয়:
আমরা সেখানে আছি।
বিপক্ষের সজ্জিত সৈন্যের নেকড়ে আক্রমণে
আমাদের প্রস্তাবিত সংকল্পের ভিত কখনো
টলবে না। আমরা চাই:
একটি রাইফেল, কিছু বুলেট
আর
লাঠিসোঁটা।
তবু যদি
বিপক্ষের রাইফেলগুলো ভীষণ গর্জে ওঠে
এবং ইতিহাসের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গে যদি
আমরা লীন হয়ে যাই
তখন কেবল আমাদের এইটুকুই চাওয়া:
কিউবার অশ্রু যেন
যুদ্ধে মৃত সৈনিকের এক একটি কাফন হয়।
মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে চে গুয়েভারা সৈনিকদের বলেছিলেন, “আমাকে গুলি করো না, আমি চে গুয়েভারা, আমাকে মেরে ফেলার পরিবর্তে বাঁচিয়ে রাখলে তোমাদের বেশি লাভ হবে।“ কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়নি। ১৯৬৭ সালের ৯ই অক্টোবর সারারাত বলিভিয়ার লা হিগুয়েরা গ্রামের একটি স্কুল ঘরে আটকে রেখে তাকে হত্যা করা হয়। তার হত্যাকারী ছিলেন বলিভিয়া সেনাবাহিনীর মদ্যপ সার্জেন্ট মারিও তেরান। চে-কে ধরা ও হত্যা করার পেছনে কাজ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। মৃত্যুর পরপরই তিনি বিশ্বজুড়ে বিপ্লবীদের কাছে নায়ক হয়ে ওঠেন। তাকে হত্যার পেছনে লাতিন আমেরিকার একনায়ক শাসক আলফ্রেদো ট্রয়েসনারের হাত ছিল বলে তথ্য দিয়েছেন প্যারাগুয়ের গবেষক মার্টিন আলমাদা। কারণ ‘চে’ তার বিরুদ্ধেও গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে পারেন বলে তার ভয় ছিল।
১৯৬৭ সালের অক্টোবরে চের মৃত্যুসংবাদ পৃথিবী জানতে পারে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তখন লিখেছিল, ‘একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপকথাও চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল।’ কথাটা সত্য হয়নি। কমরেডের মৃত্যুর পর কিউবায় লাখো জনতার সামনে আবেগঘন কণ্ঠে ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, যারা মনে করছে, চে গুয়েভারার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁর আদর্শ বা তাঁর রণকৌশলের পরাজয় ঘটেছে, তারা ভুল করছে।
চে’র কিছু উক্তি-
১। বিপ্লব তো আর গাছে ধরা আপেল নয় যে পাকবে আর পড়বে, বিপ্লব অর্জন করতে হয়।
২। নিষ্ঠুর নেতাদের পতন এবং প্রতিস্থাপন চাইলে নতুন নেতৃত্বকেই নিষ্ঠুর হতে হবে।
৩। নীরবতা একধরনের যুক্তি যা গভীর তথ্য বহন করে।
৪। শিক্ষা ব্যবস্থা তৃনমূল পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যেখানে গরীব থেকে ধনী একই শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, এমন নয় যাদের টাকা আছে শুধু তারাই শিক্ষিত হবে।
৫। আমরা কিসের জন্য বাঁচব সেটা আমরা নিশ্চিত হতে পারি না যতক্ষণ না আমরা তার জন্য মরতে প্রস্তুত থাকি।
৬। সবাই প্রত্যেকদিন চুলে চিরুনি চালায় যাতে চুল সুন্দর পরিপাটি থাকে, কেউ কেনো হৃদয় সুন্দর পরিপাটি রাখে না?
৭। বাস্তববাদী হও,’অসম্ভব’কে দাবী কর।
৮। আমি কোনো মুক্তিযোদ্ধা নই, মুক্তিযোদ্ধা বাস্তবে কখনো হয় না যতক্ষণ মানুষ নিজে মুক্তিকামী হয়।
৯। কিছু ব্যাপার পরিষ্কার, আমরা চমৎকারভাবে শিখেছি একজন সাধারণ মানুষের জীবন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির সম্পদের চেয়েও লক্ষগুণ বেশি দামী।
১০। নতজানু হয়ে সারা জীবন বাঁচার চেয়ে আমি এখনই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত।
১১। বিপ্লবী হতে চাও? বিল্পবের প্রথম শর্ত, শিক্ষিত হও।
তথ্যঃ (১) https://bn.wikipedia.org/wiki/চে_গেভারা, (২) বই – বলিভিয়ার ডায়েরী ।
সম্পাদনায়/মাহবুব এইচ শাহীন/ সম্পাদক ও প্রকাশক/কাগজ২৪