অপরাধী শাস্তিহীন-নিরপরাধ কারাগারে
অপরাধী শাস্তিহীন-নিরপরাধ কারাগারে
রণেশ মৈত্র
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
জানি, প্রিয় পাঠাক-পাঠিকাদের কাছে বর্তমান নিবন্ধটির শিরোনাম বিভ্রান্তিকর বলে মনে হবে। নিবন্ধটি না পড়া পর্য্যন্ত অবশ্য তেমনটি মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদী এই বিষয়টি, প্রায় ৮০ বছর ধরে অধ্যাহত ভাবে চললেও তার সমাধানের ন্যূনতম লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এই সময় কালের মধ্যে যে পড়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের (বিভক্ত করো আর শাসন করো) অধীনস্থ অবিভক্ত ভারতবর্ষ, তেমনি আবার একদিনও কোন নেতা-কর্মীকে জেলে যেতে হয় নি এমন একটি আন্দোলন জাত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসনামল, তেমনই আবার বিপুল রক্তক্ষয়, আত্মাহুতি, কারা নির্য্যাতন, ২৩ বছর যাবত নিরন্তর গণ-সংগ্রাম ও নয় মাস ব্যাপী পরিচালিত সশন্ত্র মুক্তিযুদ্ধেরমাধ্যমে কষ্টার্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছর।
আগেই বলেছি, ইংরেজ শাসকেরা যেহেতু বিদেশী তাই তাদের শাসনের মেয়াদ যতটা সম্ভব দীর্ঘ করে তোলার তাগিদে বিভক্ত করা শাসন করো নীতি গ্রহণ করে ঐ একই স্বার্থে কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক দক্ষিণপন্থী অংশ ও মুসলিম লীগকে দিয়ে অসংখ্য বার ঘটানো হয়েছিল ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ঐ দাঙ্গা থামানো এবং ‘সাম্প্রদায়িকতার অবসান’ ঘটানোর লক্ষ্যে পাকিস্তান নামে একটি ঘোষিত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ভারত বিভাগের মাধ্যমে গঠন ও তার ২৩ বছর ব্যাপী শাসনকাল জুড়ে সাম্প্রদায়িকতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক হানাহানি বজায় থাকলেও তা অস্বাভাবিক ছিলনা।
কিন্তু ২৩ বছর ব্যাপী পাকিস্তানী শাসনামল জুড়েই গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতার দাবীতে অকুতোভয় লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে এবং সর্বশেষ নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী সশন্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে সাত কোটি বাঙালি ১৯৭১ যে স্বাধীন রাষ্ট্রটি গঠন করলেন তার চরিত্র বৃটিশ ও পাকিস্তানী শাসনামলের চাইতে ভিন্ন প্রকৃতির হতেই হবে। কারণ বছর ব্যাপী পরিচালিত ঐ গণসংগ্রামের এবং নয় মাস ব্যাপী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত লক্ষ্য গুলি বাহাত্তরের সংবিধানে চার মূলনীতি আকারে সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের নয় মাসের মধ্যে। রাষ্ট্রীয় সেই চার মূলনীতিতে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ (বাঙালিজাতীয়তাবাদ) স্পষ্টাক্ষরে লিখিত হয়েছিল।
তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি ঘটানো হবে আমাদের পবিত্র সংবিধানের সুষ্পষ্ট লংঘন। তদুপরি এ কথাও স্পষ্টভাবেই বলা যায়, যেহেতু বাংলাদেশের পাকিস্তান এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গণ-আন্দোলন এবং সশস্ত্র লড়াই এর মাধ্যমে তাই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক সংঘাত তো দুরের কথা সাম্প্রদায়িক প্রচার-প্রচারণা ও সংবিধানের লঙ্ঘন বলে বিরেচিত হওয়া কথা।
কিন্তু বাস্তব চিত্রটি হলো তার সম্পূর্ণ বিপরীত। সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পুনরাবির্ভাব বাংলাদেশের মাটিতে ঘটতে সময় লাগেনি। বিশেষ করে মন্দিরে অগ্নিসংযোগ, প্রতি মাভাংচুর প্রভৃতি ঘটেছিল ১৯৭২-৭৩ সালেই তখন তারতীব্র প্রতিবাদও হয়েছিল।
কিন্তু এই অনাকাঙখিত ঘটনার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের অল্পকাল পর থেকেই একটি গোষ্ঠী ঐ জঘন্য ঘটনা ঘটানোর পর থেকে দলে দলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সম্প্রদায়ের অসংখ্য নর-নারী দেশ ত্যাগ করতে শুরু করেন নতুন করে। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির ঘোষণার পর থেকেই এবং আজ প্রায় ৮০ বছর যাবত তা নির্বিবাদে অব্যাহত আছে।
অপরদিকে দেশের প্রায় সকল জেলা ও উপজেলায় ধর্মীয় সংখ্যাঘুদের উপর বিনা কারণে আক্রমণ, হত্যা, নারী অপহরণ, সম্পত্তি ও বসত ভূমি গ্রাস জাতীয় নানা ঘটনা অব্যাহত ভাবে চালু আছে।
সত্য বটে, জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে বন্দুকের আঘাতে বাহাত্তরের সংবিধানে “বিসমিল্লাহ্” সংযোজন এবং জামায়াতে ইসলামীকে বৈধ করণের মাধ্যমে পাকিস্তানীকরণের এক প্রক্রিয়া শুরু করেন এবং অপর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এসে একই পদ্ধতিতে সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রটির ইসলামীকরণের শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন। এই দুটি সংশোধনীর বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগসহ সকল ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী দল কখনও ঐক্যবদ্ধভাবে আবার কখনও পৃথকভাবে আন্দোলন পরিচালনা করে নির্বাচনের মাধ্যমে ঐসব প্রক্রিয়াশীল সরকারকে পরাজিত করে আওয়ামীলীগ ১৯৯৬ তে প্রথম এবং পরবর্তীতে ২০০৮ সালে বিপুল সংখ্যক আসনে নির্বাচিত হয়ে আজ পর্য্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায়আসীন থাকায় সকলের প্রত্রাশাজিয়া ও এরশাদের সংশোধনী বাতিল করে বাহাত্তরের সংবিধান অবিকল পুনরুজ্জীবন করা হবে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-দাঙ্গামা কঠোরভাবে দমন করা হবে-এমন ঘটনা যারাই ঘটাবে তাদেরকে আইনের আওয়তায় এনে কঠোর শাস্তির বিধান করা হবে। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো-এর কোনটিই আজতক ঘটলো না। ফলে সংখ্যালঘুদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা অব্যাহত আছে এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির দৃশ্যমান উত্থান ঘটে চলেছে।
এর সর্বশেষ ঘটনাহলো সম্প্রতি খুলনায় হিন্দু গ্রামে হামলা। খুলনার রূপসা উপজেলার শিয়ালী গ্রামের চারটি মন্দির এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশকিছু সংখ্যক দোকান ও কয়েকটি বাড়ীতে ভাঙচুর চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গত ৯ জুলাই শনিবার শতাধিক দুর্বৃত্ত একযোগে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ওই গ্রামে হামলা চালায়। এ ঘটনা দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক।
গ্রামবাসীদের অভিযোগ, শুক্রবার রাত নয়টার দিকে পূর্বপাড়া মন্দির থেকে কিছু সংখ্যক ভক্ত নারী কীর্তন গাইতে গাইতে শিয়ালী মহাশ্মশানের দিকে যাচ্ছিলেন। পথের মাঝে একটি মসজিদ ছিল। মসজিদটির ইমাম নারীদের কীর্তন গোষ্ঠী মাঝে মাঝেই ধর্মপ্রাণ নিরীহ মানুষকে উত্তেজিত এবং উন্মত্ত করে তুলে এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে। সত্যি সত্যি ধর্মের অবমাননা ঘটছে কিনা তা খতিয়ে না দেখে অবলীলায় অপরাধীরা টার্গেট না হয়ে টার্গেট হচ্ছেন নিরপরাধ সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়।
আক্রান্তরা বলছেন, ঘটনার উৎপত্তি এবং এ জাতীয় ঘটনার আশংকার কথা জানানো সত্বেও পুলিশ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও প্রশাসনের ও রাজনৈতিক মহল পক্ষ থেকে করা হয় নি।
পুলিশ এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এহেন নিষ্ক্রিয় থেকে পরোক্ষে দুস্কৃতিকারীদের সহায়তা করায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ তাঁরাও করেছেন এবং এমন ঘটনা বারংবা ঘটছে।
অপর এক খবরে জানা যায় রাজধানী ঢাকা সংলগ্ন কেরানীগঞ্জ এক সংখ্যালঘু পরিবারকে বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদের হুমকি দিচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের কয়েকজন। বাড়িঘর ছেড়ে চলে না গেলে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়ার হুমকি দেয় ওই প্রভাবশালীরা। ঘটনাটি ঘটেছে কেরানীগঞ্জ উপজেলার কালিন্দী ইউনিয়নের ব্রাহ্মণবিত্তা মালোপাড়া এলাকায়। এ ব্যাপারে ওই বাড়ীতে বসবাস কারী মনি রাজবংশী কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন।
জানা যায় মনি রাজবংশী পেশায় একজন পিঠা বিক্রেতা। থাকেন কেরানীগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণবিত্তা মালোপাড়া এলাকায় তাঁর নিজস্ব পৈত্রিক বিটায়। বাড়ীর সামনেই একটি টং দোকান করে তিনি পিঠা বিক্রী করে জীবিকা নির্বাহ করেন।এই বাড়ীতেই থাকেন তাঁর আর এক বোন বনলতা ভৌমিক। কিছুদিন ধরে প্রভাবশালী কিছু লোক তাঁদেরকে উৎখাতের হুমকি দিচ্ছে। মনি রাজবংশী জানান এই বাড়ীটির মালিক তাঁর বাবা শচীন্দ্র রাজবংশী। বাবা মারা যাওয়ার পর ৩০ বছর ধরে তাঁরা তিন বোন এই বাড়ীতেই থাকেন। বিয়ের পর ছোট বোন অঞ্জনা পোদ্দার শ্বশুর বাড়ী রামপুরাতে থাকেন।
থানা কর্তৃপক্ষ স্পীকার করেছেন-তাঁরা এ ব্যাপারে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন কিন্তু কোন ব্যবস্থাই এই নিবন্ধ লেখা পর্য্যন্ত (১০ জুলাই দুপুর) গৃহীত হয় নি।
সুনামগঞ্জের শাল্লার ঘটনা দেশে-বিদেশে আলোচিত। এই গ্রামে মাসকয়েক আগে প্রকাশ্য দিবালোকে মসজিদের মাইক থেকে প্রচার করে লোকজন ডেকে শতাধিক লোক অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে গ্রামবাসী প্রায় একশত পরিবারকে আহত করে, বাড়ীঘরে অগ্নিসয়যোগ ও লুটপাট করে।
ঘটনার কারণ হলো দুদিন আগে হেফাজত নেতা মমিনুল হক ওয়াজের নামে সাম্প্রদায়িক প্রচার চালালে যুবক ঝুমন দাশ তার বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোষ্ট দেয়। তার প্রেক্ষিতে ইসলাম অবমাননার অবিযোগ তুলে ঐ হামলার ঘটনা ঘটে। ঝুমন দাশকে আটক করা হয়। গ্রামবাসীরা অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে জনা কয়েক অপরাধীকে গ্রেফতার করা এবং কিছুদিনের মধ্যে জামিনে মুক্তি পায়। কিন্তু ঝুমন দাস আজও কারাগারে।
সে কারণেই শিরোনাম দিলাম অপরাধীরা শাস্তিহীন-নিরপরাধ কারাগারে।