চিরঞ্জীব শত্রু সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন
সিডনীর কথামালা -৫১
রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
E-mail:raneshmaitra@gmail.com
শিরোনামে বর্ণিত আইন দুটির কথা যখনই ভাবি, তখনই দৃষ্টি যতদূর যায় ততদূরই যেন দেখতে পাই একাত্তরের মত দৃশ্য। হাজারে হাজারে হিন্দুরা ভিটে মাটি ফেলে স্ত্রী-পুত্র-কণ্যা ও কাঁধে কাপড় চোপড়ের একটি পোঁটলা নিয়ে মাঠ-ঘাট নদীনালা পেরিয়ে ক্লান্তিহীন ভাবে হেঁটে চলেছেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত অভিমুখে।
সেখানে কে তাঁদের আশ্রয় দেবেন কে দু‘মুঠি ভাত দেবেন বা কার কাছে চাকুরী বাকুরী বা ব্যবসা বাণিজ্যের সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলবেন-তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। শ্রেফ হারা উদ্দেশ্যে দেশত্যাগী হওয়া।
না। একবোরে , একাত্তরের মত কিন্তু নয়। শত অত্যাচার তখন ছিল কিন্তু অত্যাচারীর চাইতে আশ্রয় দাতা-সাহায্যকারীর সংখ্যা ছিল বহুগুনে বেশী একাত্তর সালে। আর শত্রু সম্পত্তি আইন জারী এবং জরুরী আইন (Emergency laws) জারী যখন করলো ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ লাগার পর তখন কেমন করে কোন যাদুবলে “শত্রু সম্পত্তি আইন” নামে একটি নজির বিহীন বৈষম্য মূলক আইন যেই না জারী করা হলো- হিড়িক লেগে গেল হিন্দুদের বাড়ীঘরের তালিকা তৈরীর। কেন এমনটা করা শুরু হলো? তালিকা কেন? সরকার রেকর্ড বা খতিয়ানই তো আছে হিন্দুদের বাড়গঘরের যেমন আছে মুসলিমদেরও। জবাব দেয় উপরের হুকুম আর সরকার একটি আইনও করেছে যার কপি এবং গেজেটের কপি এলে সব জানা যাবে। তবে তালকা অতি দ্রুত প্রণয়ন করার হুকুম এসেছে “উপর” থেকে। এই “উপরটা কে- তা অবশ্য যিনি। যাঁরা তালিকা প্রণয়ন করছিলেন -তাঁরাও বলতে পারেন না যে হুকুম দাতাকে কে হুকুম দিয়েছেন এবং তার বিস্তারিত বর্ণনা কি। হিন্দুরা রাতারাতি পাকিস্তানের শত্রু হয়ে গেলেন। মানুষও যেন তাই ভাবলো।
বিষয়টা, আগেই সম্ভবত বলেছি, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট। ঐ যুদ্ধ তো স্থায়ী ছিল মাত্র ২৭ দিন। কিন্তু আজ তার পর ৫১ টি বছর চলে গেল যে পাকিস্তান সরকার এই আইন করেছিল সেই পাকিস্তান সরকারও আর নেই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিও নেই। বাঙালিরা পাকিস্তানকে তালাক দিয়েছে দেহের রক্তের আখরে লেখা তালাক নামার মাধ্যমে। আজ সেদিনকার পাকিন্তানী সেই লৌহ শাসক বলে তৎকালে অভিহিত শাসকটিও বেঁচে নেই। বাঙালি তাদেরকে পরিত্যাগ করে একাত্তরে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে এক স্বাধীন, স্বার্বভৌম, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ অর্থনীতি সহ তাবৎ ক্ষেত্রে সকল প্রকার শোষণ , বঞ্চনা ও বৈষম্য মুক্ত, আধুনিক নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছে।
এই রাষ্ট্রটির মৌল চরিত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৌল চারিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। পাকিস্তন ছিল “ইসলামী প্রজাতন্ত্রিক রাষ্ট্র” আর বাংলাদেশ হলো “ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র” যেখানে ধের্মের নামে সংগঠন গড়া তার মাধ্যমে রাজনীতি করাকে ঘোষণা করা হয়েছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মানুষে মানুষে , তার ধর্মবিশ্বাাসের কারণে, লিঙ্গ জনিত ভিন্নতার কারণে বিরাজমান যুগ-যুগান্তরের বৈষম্যকেও সংবিধানে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয় ১৯৭২ সালে। আইন সবার জন্য সমান, আইনরে চোখে সকলে সমসুযোগ পাবেন এমন কথাগুলিও ঘোষিত হলো। মোট কথা , একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সকল বৈশিষ্ট্য সম্বলিত সংবিধান প্রনয়ন ও অনুমোদন করে দেশে ব্যাপকতম ঐক্যের আবহ রচনা করা হলো।
কিন্তু শত্রু সম্পত্তি আইন? যা জারী করেছিল ১৯৬৫সালে পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল আইউব খান? সে আইন এবং তার বিস্ময়কর দ্রুততার সাথে প্রয়োগ অব্যাহত রাখা হলো। শুধুমাত্র একটি পরিবর্তন করা হলো আইনটির নামে। রাতারাতি ঐ আইনটির নাম “শত্রু সম্পত্তি আইন” এর পরিবর্তে রাখা হলো “অর্পিত সম্পত্তি আইন”। কিন্তু শত্রু সম্পত্তি আইনের প্রতিটি বাক্য, শব্দ, অক্ষর দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন এই “নতুন আইন” অর্পিত সম্পত্তি আইনে দিব্যি বহাল রাখা হলো। পাকিস্তান আমলে ‘শত্রু’ দের সম্পত্তি বলে বলা হলো-স্বাধীনতার পর হলো ‘অর্পিত’ সম্পত্তি। এ এক অদ্ভূত পরিবর্তন।
কিন্তু প্রশ্ন তো করা যেতেই পারে ঐ নতুন আইনভূক্ত সম্পত্তিকি আদৌ কেউ কাউকে অর্পণ করেছে? করে থাকলে তার একটি পূর্ণাঙ্গ গেজেট প্রকাশ করা হোক। আর না করে থাকলে কোন অধিকারে ঐ সম্পত্তিগুলিকে “অর্পিত সম্পত্তি” নামে অভিহিত করা হলো তাও স্পষ্ট করে জানান হোক দেশবাসীকে।
এতদিন পরে কেন এ কথা বলছি তার কারণ নীচে বর্ণনা করছি।
পাকিস্তান সরকারকে ও তার নীতিকে আমরা সবাই জানতাম-জানতাম তারা পরিপূর্ণ এবং সকল অর্থেই সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হতো। তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহকে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীদেরকে শত্রু হিসেবেই চিহ্নিত করেছিলো। তারা ঐ সম্প্রদায়ের মানুষগুলিকে “পাকিস্তান ও ইসরামের শত্রু” বলে প্রকাশ্যেই বলতো। তাই তাঁদের কাছে “শত্রু সম্পত্তি” আইন হিসেবে নামকরণকে অস্বাভাবিক বলে ভাবার কোন কারণ নেই।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর যখন স্বাধীন বাংলাদশে অর্জন করা হলো পাকিস্তান ও সতার বিভেদাত্মক ও ধর্মভিত্তিক চরিত্র, চেহারা, নীতিমালা ও আদর্শকে পরাজিত করে, তখন যে বাংলাদেশ অর্জিত হলো হিন্দু-মুসলিম ও অন্যান্য সকল ধর্মাবলম্বরি মিলিত রক্ত¯্রােতে তখন তো এদেশের কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকেই ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে শত্রু মনে করার কোন কারণ থাকল না।
শুধু তাই নয়,যেহেতু বাহাত্তরের সংবিধান দেশটাকে “ধর্মনিরপেক্ষ” বলে ঘোষনা করা হলো এবং বলা হলো এদেশের সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান বলে বিবেচিত হবেন-সুতরাং পাকিস্তানের ঐ বৈষম্যমূলক আইনটির অস্তিত্ব বজায় রাখার কোন অবকাশই আইনত থাকলো না-আইনটির শিরোনম অদলবদল করেও না।
যে সম্পত্তি কেউ অর্পন করলো না-সে সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি বলে নামান্তরিত হওয়াও বা করারও কোন সুযোগ বা অধিকার থাকলো না। কিন্তু তা সত্বেও দিব্যি তা আজও বহাল তবিয়েতে বহাল রাখা হয়েছে।
তবে ২০০১ সালে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ওই সম্পত্তিগুলি তার বৈধ মালিক বা তাঁদের বৈধ কোন উত্তরাধিকারী বাংলাদেশের স্থায়ী নাগরিক হলে এবং স্থায়ীভাবে এদেশে বসবাস করলে সরকার তাদেরকে ঐ সম্পত্তি প্রত্যর্পণ করবেন বলে আইন প্রণয়ন করলেন। বলা চলে, মাঝখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর এবং তার আগে খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর এই সাত বছর বাদে ১৬ বছরের মধ্যে নয় বছরই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে এবং স্বভাবত:ই তারা তাদের আইন বাস্তবায়ন করবেন এটাই তো ছিল প্রাসঙ্গিকও প্রত্যাশিত। সে প্রত্যাশা আজও রয়েছে। ওগুলি প্রত্যার্পণ করা হবে এ বিশ্বাসও রয়েছে।
কিন্তু বাস্তবের চিত্রটি সম্পূর্ণ বিপরীত।
তার নমুনা হিসেবে অন্যতম জাতীয় দৈনিক “কালের কণ্ঠে” সম্পত্তি “৮,২০০ একর অর্পিত সম্পত্তি গেজেটভুক্তই হয় নি”
শীর্ষক একটি প্রতিবেদনের উল্লেখ করছি।
তাতে বলা হয়, ভূমি মন্ত্রনালয়ে ৮,২০০ একর জমির তালিকা বাইরে রেখেই অর্পিত সম্পত্তির “ক” তফসিলের গেজেট জারী করেছে। এ ছাড়া একজনের জমি অন্যজনের নামে কিংবা এক দাগের ও খাতিয়ানের জমি অপর দাগে ও খতিয়ানে ছাপাপনো নানা ধরণের ভূল ৯,২০০ একর জমির ক্ষেত্রে হয়েছে। বাদপড়া জমির অপর একই গেজেট কি প্রকাশ করা হবে?
ইতোমধ্যে ২০০৮ সালের পর থেকে ছয় দফা সংমোধনী পাশ করা হয়েছে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইনের। আবারও আমলারা আরও এক দফা সংশোধনী পা কেটে পনিময় তৈরী হয়ে আছেন সম্ভত সংশোধনী পাশ করানোর লক্ষ্যে। তা হলে প্রত্যার্পণ পাশ করানোর লক্ষ্যে। তা হলে প্রত্যার্পণ হবে কবে? তার কি কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা আদৌ ধার্য্য করে কঠোরভাবে তারমধ্যেই প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার তাগিদ মূলক নির্দেশনা জারী করা হবে? না কি এই প্রত্যর্পণ আইনটি ডীপ ফ্রিজে চলে যাবে? যা ঐ আমলা-সাহেবরা মনে এবং কাজে কর্মে চাইছেন?
গেজেট যেটা প্রকাশ করা হয়েছে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন অনুযায়ী তাতে ৩,০০০ মৌজার ১০,০০০ খতিয়ানের ৯,২০২ একর সম্পর্কিত। এগুলি অত্যন্ত জরুরী ভিত্তিতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগী হয়ে সংশোধন করা উচিত। কাজটি ভূমি মন্ত্রনালয়ের এবং উপজেলা পর্য্যায়ের তাদের কর্মকর্তাতদের। অভিযোগ আছে বিস্তর, তাবৎ ভূলের মূলেই রয়েছেন চূড়ান্ত রকমের অসৎ জেলা উপজেলা পর্য্যায়ের বেশীর ভাগে ভূমি দফতরের কর্মকর্তারা। টাকা পেলে সঠিক গেজেট-না পেলেই ভূল গেজেট। এই ভূল গেজেট হয় ও লোকচক্ষুর অন্তরালে কারণ অর্পিত সম্পত্তির তত্ত্বাবধানের সরকারী দায়িত্ব তো জেলা পর্য্যায়ের রেভিনিউ কর্মকর্তাদের আর কাজের দায়িত্ব মাঠ পর্য্যায়ের কর্মকর্তাতদের। এই মাঠ পর্য্যয়ের কর্মকর্তারা যার উপর খুশী হবেন তার কাজ নির্ভূল হবে।
আইনে আছে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের (ক) তফশীল বর্ণিত সম্পত্তি যদি কাউকে লিজ দেওয়া হয়ে থাকে এবং সেই সম্পত্তির মালিকের যদি কোন বৈধ ওয়ারিশ নাগরিকত্ব সহ এদেশের স্থায়ী বাসিন্দা না হন-তবে লিজ গ্রহীতা প্রত্যর্পনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অগ্রাধিকার পাবেন-যদি তাঁরা দাবী করেন। এই জাতীয় ‘ক’ তফশীলভূক্ত সম্পত্তি বিস্তর আছে যা এই মুহুর্তেই নিস্পত্তি করা সম্ভব। কিন্তুআইনকে বৃদ্ধাঙ্গলিক দেখানোর জন্য সরকারের উপর তলার আমলারাই যথেষ্ট। অভিযোগ অসংখ্য রয়েছে যে “আইন এখনও ষ্পষ্ট হয় নি-তাই প্রত্যর্পনেরর নির্দেশ সম্বলিত সার্কুলার জেলাগুলিতে পাঠনো যাচ্ছে না। এমন কথা গত ৬/৭ বছর ধরেই শুনা যাচ্ছে-তার শেষ হবে কতদিনে তা অনুমান করাও সম্ভব নয়। দফায় দফায় অর্থাৎ তাঁরা অনবরত আইনে সংশোধনী আনতেই আগ্রহী প্রত্যর্পণে আদৌ নয়।
তবে আবারও বলি, বর্তমানে আইনটি যেভাবে আছে সেটাই যথেষ্ট কোন সংশোধনী আনা “ক” তফশীলের ক্ষেত্রে আদৌ প্রয়োজন নেই। একটি সুষ্পষ্ট এবং কড়া নির্দেশ উপর থেকে দিলে আগামী তিন মাসের (ফেব্রুয়ারী ২০১৭) মধ্যেই “ক” তফশীলভূক্ত সম্পত্তি মালিকদের উত্তরাধিকারী লীজ দেওয়া সম্পত্তি লিজ গ্রহীতাদের মধ্যে প্রত্যার্পন করা সম্ভব। মহ ধূরান্ধর আমলাদের অতিক্রম করে মন্ত্রীপর্য্যায়ে এই সার্কুলার প্রদানই একমাত্র সমাধান।
কিন্তু তার কোন লক্ষণ নেই। আইন দুটি কি চিরঞ্জীব?
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।