অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারীর চাষ পদ্ধতি!!
অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারীর চাষ পদ্ধতি!!
সেলিনা জাহান প্রিয়া ।।
অ্যালোভেরার সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। এটি একটি অতীব পরিচিত উদ্ভিদ। এর আরও এক নাম আছে যা হল কুমারী। ঘুত কুমারী বা অ্যালোভেরা সর্বজন বিদিত এবং বহুল ব্যহহৃত ঔষধি উদ্ভিদ যা স্বাস্থ্য এবং সৌন্দর্য চর্চায় প্রসাধনী এবং সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। মিশরীয় লোককাহিনী থেকে জানা যায় সৌন্দর্য বর্ধন করে যে প্রকৃত কণ্যা তার ল্যাটিন নাম অ্যালোভেরা ওরফে ঘৃতকুমারী। প্রাচীনকালেও রানী ক্লিওপেট্রা, সম্রাট আলেকজান্ডার, বাদশাহ সোলায়মান, নেপোলিয়ন এবং ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মত বিখ্যাত মানুষেরা অ্যালোভেরা ব্যবহার করতেন। ইদানিংকালের বড় উদাহরণ মহাত্মা গান্ধী। ইউনানী শাস্ত্রে চূর্ণ ঘৃতকুমারীর নাম হয় মুসাউয়া। প্রায় প্রতিটি দামীয় রুপীয় অঙ্গরাগের কৌটায়, শিশিতে অথবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ধাধানো বিজ্ঞাপনে রয়েছে অ্যালোভেরার জয়গান। ঘৃতকুমারী গাছটি দেখতে অনেকটা কাটাওয়ালা ফণী মনষা বা ক্যাকটাসের মত। অ্যালোভেরা দেখতে ক্যাকটাসের মত হলেও এটা ক্যাকটাস নয়। এটা একটা লিলি পরিবারের উদ্ভিদ যেমন: পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি। অ্যালোভেরা গাছের গোড়া থেকেই সবুজ রঙের পাতা হয় এবং পাতাগুলো পুরু ধরনের হয় যার দুই পাশেই করাতের মতো ছোট ছোট কাঁটা থাকে। এর পাতা দেখতে বর্ষা আকৃতির মতো হয় এবং যা পুরু ও মাংসাল হয়। পাতার ভেতরে স্বচ্ছ পিচ্ছিল ধরনের শাঁস থাকে যাকে অ্যালোভেরা জেল বলা হয়। এই গাছের পাতা থেকেই নতুন গাছ জন্মায়। পৃথিবীতে প্রায় ২৫০ রকমের অ্যালোভেরা জন্মে। তবে মাত্র ২ রকমের অ্যালোভেরা বানিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়।
অ্যালোভেরা অথবা ঘৃতকুমারীর খাদ্য গুণাগুণ:
অ্যালোভেরা অথবা ঘৃতকুমারীতে অনেক ধরণের খাদ্যগুনে গুনান্বিত। মানবদেহের জন্য যে ২২টা এমিনো অ্যাসিড প্রয়োজন তার ৮টি এতে বিদ্যমান। এটি প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন A, B1, B2, B6, B12, C, E এবং বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ। এছাড়াও এতে বিভিন্ন ধরণের খনিজ লবণ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, কপার, এবং আয়রন বিদ্যমান। এছাড়াও এতে অনেক ধরণের খাদ্যগুন বিদ্যমান।
অ্যালোভেরা অথবা ঘৃতকুমারীর ঔষধি গুনাগুন:
অনেক রকমের ঔষধি গুনে সমৃদ্ধ এই অ্যালোভেরা অথবা ঘৃতকুমারী। অ্যালোভেরা অথবা ঘৃতকুমারী খেলে শরীরে হজম শক্তি বাড়ে ও দেহের ওজন কমে। এছাড়াও ডায়েরিয়া সারাতেও ঘৃতকুমারীর রস দারুণ কাজ করে। ত্বকের যত্নে, ব্রণের সমস্যায়, এর রস দারুণ উপকারী। পরিপাকতন্ত্র সতেজ রাখতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে এর তুলনা অপরিসীম। অ্যালোভেরা অথবা ঘৃতকুমারীর রস খেলে শরীরের অনেক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। এটি আমাদের হৃদপিণ্ড ভালো রাখে এবং দেহকে বিষমুক্ত রাখে।
মাটি ও জলবায়ু:
সবরকম জমিতেই ঘৃতকুমারী চাষ সম্ভব; তবে দোঁ-আশ ও অল্প বালু মিশ্রিত মাটিতে গাছের বৃদ্ধি ভালো হয়। সুনিষ্কাশিত জমি যেসব জমিতে পানি জমে না এরূপ উঁচু জমিতে ঘৃতকুমারীর চাষ করা যায়। তবে লবণাক্ত ও চরম অম্লীয় মাটিতে ভালো হয় না। নিচু ও পানি জমা জমিতে গাছ পচে যায়। যেকোনো দোআঁশ মাটিতে চাষ ভালো হয় তবে বেলে দোআঁশ মাটি উত্তম। এঁটেল মাটিতে চাষ না করা ভালো। ছায়া জায়গায় হবে না, ঘৃতকুমারীর জন্য দরকার সারা দিন রোদ।
জমি তৈরি:
ঘৃতকুমারী চাষ করতে হলে জমি প্রথমে ভালোভাবে পরিষ্কার করে চাষ দিতে হবে। চাষের সময় হেক্টর প্রতি ১০ থেকে ১২ টন গোবর মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া এ সময় বিঘা প্রতি ২৫ থেকে ৩০ কেজি টিএসপি এবং ১০ কেজি এমওপি সার দিতে হবে। অ্যালোভেরা চাষিরা সাধারণত বেশি করে গোবর সার দিয়ে এর চাষ করেন, খুব কম চাষিই রাসায়নিক সার দেন। অনেক চাষি প্রচুর ছাই ব্যবহার করে থাকেন।সার মেশানোর পর জমিতে চারা লাগানোর জন্য বেড তৈরি করতে হবে।
বেড তৈরি:
বেড হবে ১.৫ থেকে ২.২৫ মিটার চওড়া। প্রতি দুই বেডের মাঝে ৪০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার নালা রাখতে হবে।
চারা রোপণ:
অ্যালোভেরা অথবা ঘৃতকুমারী মূলত শেকড়ের মাধ্যেমেই বংশবিস্তার করে থাকে। এর শেকড় থেকে বেরোনো ডাল সংগ্রহ করে অন্যত্র রোপন করলে গাছ হয়। ঘৃতকুমারীর তিন রকম চারা লাগানো হয়। রুট সাকার বা মোথা,গাছের গোড়া থেকে গজানো চারা ও গাছের গোড়ার অংশ কেটে ফেলে পুরো গাছ। বাণিজ্যিকভাবে রুট সাকার লাগানো লাভজনক নয় বিধায় এটি লাগানো হয় না। পুরনো গাছের গোড়া থেকে গজানো চারা মাতৃগাছ থেকে আলাদা করে প্রথমে একখণ্ড জমিতে বা বেডে লাগানো হয়। সেখানে এসব চারা দুই থেকে তিন মাস লালন পালন করে বড় করা হয়। পরে মূল জমি চাষ দিয়ে এসব চারা তুলে সেখানে লাগানো হয়। এতে চারার প্রতিষ্ঠা ভালো হয়। তবে এরূপ চারা লাগিয়ে পাতা তোলার জন্য ছয় মাস অপেক্ষা করতে হয়। তাই বাণিজ্যিক চাষের জন্য এরূপ চারা লাগানোর চেয়ে মোথা কেটে বাদ দিয়ে সরাসরি পুরনো গাছ লাগাতে বেশি পছন্দ করে থাকেন। এতে দ্রুত পাতা তোলা যায়। এ রকম গাছ লাগানোর তিন মাসের মাথায় পাতা তোলা যায়। অনেক দিন জমিতে থাকার পর একই গাছ থেকে উপর্যপুরি পাতা তোলার পর গাছের গোড়া যখন লম্বা হয়ে যায় এবং গাছ যখন খাড়া থাকতে পারে না, তখন গাছ কেটে ২-৩টি পাতা বাদ দিয়ে সেসব গাছ লাগাতে হবে। লাগানো গাছ যেন সুস্থ সবল হয় সে দিক লক্ষ রাখতে হবে।
রোপণ সময়:
বছরের যেকোন সময়েই আপনি ইচ্ছা করলে এই অ্যালোভেরা অথবা ঘৃতকুমারী চাষ করতে পারেন। তবে জুন মাস অথবা আষাঢ় মাসে গাছ লাগালে তা বাড়ে অনেক তাড়াতাড়ি। তবে শীত ও বর্ষাকালে চারা না লাগানো ভালো। সাধারণত কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে চারা বেশি লাগানো হয়। কেননা এ সময় চারা লাগালে শীতের মধ্যে গাছ মাটিতে লেগে যাওয়ার চেষ্টা করে। শীতের সময় বাজারে অ্যালোভেরার পাতার চাহিদা থাকে না। তাই চাষিরা এ সময় পাতা সংগ্রহ থেকে বিরত থাকেন। পক্ষান্তরে এই ২-৩ মাসের মধ্যে চারা জমিতে ভালোভাবে লেগে যায়।শীত শেষে বসন্তে নতুন পাতা ছাড়তে শুরু করলে পাতা সংগ্রহ করা শুরু হয়। এ পদ্ধতিতে চাড়া রোপণ করলে বেশি পাতা পাওয়া যায়।
রোপণ দূরত্ব:
চারা সারি করে লাগানো হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব সাত ইঞ্চি ও প্রতি সারিতে ছয় ইঞ্চি পর পর চারা লাগানো হয়। ১.৫ মিটার চওড়া বেডে দুই সারিতে ও ২.২৫ মিটার চওড়া বেডে তিন সারিতে চারা রোপণ করা হয়। এক বিঘা জমিতে প্রায় তিন হাজার ছয়শোটি গাছ লাগানো যায়।
পরিচর্যা:
অ্যালোভেরা অথবা ঘৃতকুমারী চাষে সঠিক নিয়মে বাগানের যত্ন করতে হবে। গাছের গোড়ায় যেন আগাছা না জন্মে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। আগাছা জন্মালে সেটা নিড়ানি দিয়ে উপড়ে ফেলতে হবে। গাছে নিয়মিত পানি দিতে হবে।
সার ও সেচ প্রয়োগ:
সাধারণত কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ব্যবহার করতে হবে খৈল বা নিম খৈলের মত জৈব সার। জমি প্রস্তুত করে নিয়ম অনুযায়ী ঘৃত কুমারি চাষ করতে হয়। সাধারনত ভেজা জমিতে ঘৃত কুমারি ভালো বাড়ে। নিয়মিত সেচের দরকার হলেও গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যদি ইউরিয়া সার দিতে হয় তাহলে বছরে একবার সবটুকু ইউরিয়া সার জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে জমিতে ছিটিয়ে দিলেই চলে। সার ছিটানোর পর আগাছা নিড়িয়ে মাটির সাথে সার মিশিয়ে দিতে হয়। বেশি ইউরিয়া সার দিলে রোগের আক্রমণ ও প্রকোপ বেড়ে যায়। শুষ্ক মওসুমে জমিতে প্রয়োজন মাফিক সেচ দিতে হবে। মাঝে মাঝে জমির আগাছা নিড়িয়ে দিতে হবে। ঘৃতকুমারী গাছ জমিতে প্রায় দুই বছর থাকে। তাই দ্বিতীয় বছরেও প্রথম বছরের মতো একই হারে জমিতে সার ও সেচ দিতে হবে।
বালাই ব্যবস্থাপনা:
পাতার দাগ রোগঃ- ঘৃতকুমারী গাছে পাতায় দাগ পড়া এক প্রধান সমস্যা। শীতকালে এ রোগ কম থাকে। কিন্তু শীত শেষে ফাল্গুন মাসে এ রোগের প্রকোপ বেড়ে যায় এবং পাতার ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ রোগের আক্রমণে পাতার অগ্রভাগে আলপিনের মাথার মতো ক্ষুদ্র এক বিন্দুর মতো দাগ পড়ে, সেখান থেকে আঠার মতো কষ বের হয়। ওই আঠা শুকিয়ে বাদামি দাগের সৃষ্টি করে। এভাবে আক্রান্ত গাছের পাতায় ধীরে ধীরে দাগ বড় হতে থাকে ও দাগের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এটি ধারণা করা হয় ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, তাই ছত্রাকনাশক প্রয়োগে তেমন ফল পাওয়া যায় না। এ রোগের কারণে পাতার চেহারা নষ্ট হয়ে যায়। বাজারমূল্যও কমে যায়। তবে যারা বাণিজ্যিকভাবে ঘৃতকুমারী চাষ করেন তারা ১৫ দিন পরপর চুন পানিতে গুলে স্প্রে করে থাকেন।
গোড়া পচা রোগ:
গোড়া পচা রোগে গাছের গোড়া পচে যায়। পরে গাছ মারা যায়। বর্ষাকালে ও গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলেও বা ভেজা থাকলে গোড়া পচা রোগ হয়। ছত্রাকনাশক স্প্রে করলে এ রোগের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যায়।
পোকামাকড়:
ঘৃতকুমারী গাছে সাধারণত কোনো পোকামাকড় দেখা যায় না। তবে মাঝে মাঝে ছাতরা পোকা, জাব পোকা, স্কেল পোকা, লাল মাকড় ইত্যাদির আক্রমণ হতে পারে।
ফসল সংগ্রহ ও ফলন:
ঘৃতকুমারী চারা লাগানোর দুই তিন মাস পর থেকেই গাছের পাতা তোলা শুরু করা যায়। একটি গাছে থেকে ৬০- ৭০টি পাতা বিক্রি করা যায় এবং সারা বছর জুড়ে এর থেকে নতুন নতুন পাতা জন্মে । বছরে ৯-১০ মাস পাতা তোলা যায়। শীতকালে পাতা তোলা বন্ধ থাকে। সাধারণত প্রতি ১৫ দিনে একটি পাতা বের হয়। তবে চাষিরা মাসে একটি গাছ থেকে ১-২টি পাতা সংগ্রহ করে। গাছের বৃদ্ধি ও পাতা বড় হলে প্রতি মাসে দু’টি পাতা তোলা যায়। পাতা তোলার পর পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে ছায়ায় শুকিয়ে আঁটি বেঁধে বাজারে বিক্রি করা যায়।
চাষাবাদের খরচ:
এক বিঘা জমিতে বছরে খরচ প্রায় ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা।
বাজারজাত:
প্রচুর চাহিদার থাকার কারনে বাজারজাত করতে সমস্যা হচ্ছে না।। ৫০ থেকে ৫৫ কেজি পাতার একটি আটিকে গাইট বলে। প্রতি ৬ গাইট ঘৃতকুমারীর বাজার দর ১৮০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা। এ হিসেবে ১ বিঘা হতে ১.৫ থেকে ২ লাখ টাকার পাতা বিক্রি হয়।
তথ্য সূত্র- কৃষি তথ্য , ও ইন্টার নেট ।।
ছবি- ইন্টার নেট ।।