সেলিনা জাহান প্রিয়ার ধারাবাহিক গল্প ‘অ-মানব’ (১২ তম পর্ব)
মিলির ঘর আলো করে মিলি পুত্র এলো। কিন্তু মিলির মায়া লাগছে পাগলটার জন্য। কোথায় গেল না বলে। আসলে ও কি পাগল। মিলি অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা। কিন্তু মিলিকে অল্প সময়ে দিয়ে গেছে অনেক না বলা কথা। আজ মিলির খুব মনে পড়ছে কেমন ছিল ওর মা। বাবা কোন দিন মিলি কে বলে যায়নি তার মায়ের কথা। বাবা সব কিছু আমার নামে করে দিল। এই মা হয়ত আমাকে সব দিয়ে সে তার ভুলের অনুশোচনা করছে। আমি কিন্তু আমার এই মায়ের মত ভুল করব না। পাগলটাই ঠিক বলেছে নিজের বলে কিছুই তার নেই। অনেক ভাবনায় মিলি ঘুমেয়ে পড়ে। জোছনা মিলির মায়ের কাছে বলে নানু আব্বুর গরুটা কি হবে। মিলির মা হেসে বলে হবে। জোছনা খাটে বসে পাগলের শিক্ষা দেয়া চোখ বন্ধ করে দেখতে চায় ও বাবার গরুটা। জোছনা কিছু ক্ষণ পড়ে দেখে ওর বাবা দুইটা গরুর বাচ্চা কিনেছে। জোছনা একটা হাসি দিয়ে ঘুমেয়ে পড়ে।
মিলি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ছাদে যায়। পাগল বোতল কেটে কি সুন্দর করে নাম না জানা পথের ধারের কিছু লতা পাতা লাগিয়েছে। যেন এক দিনেই মনে মত একটা বাগান। কিছু গাছ যে এত সুন্দর লাগে মিলি তো অবাক শিশির পড়ে জমে আছে তাতে। মিলি অনেক বছর পড় এই শহরে নিজের হাতে শিশির নিল।
জোছনার বাপ সকালে হোটেল থেকে নাস্তা নিয়ে আসার সময়, নাপিত ছেলেটা এক বিশাল হাসি দিয়ে বলল। ভাই ঐ মানুষটা কি বাসায় আছে। জোছনার বাপ বলল কেন? নাপিত বলল – ঐ লোক আমার পাঁচ বছরের কাজ, পাঁচ মিনিটে করে দিয়েছে। পাগল টা কমলাপুর থেকে একটা লোকাল ট্রেনে সারা রাতে চলে এসেছে সিলেটে। এখন কেউ দেখলে তাকে পাগল বলবে না। পড়নে দামী জুতা জামা কাপড়। ট্রেন থেকে নেমে সোজা হাটা দিল শহরের দিকে। শীতের দিন বলে হয়ত শহর একটু নিরব।
দুই জন মহিলা রিক্সা না পেয়ে খুব তাড়াতাড়ি হাঁটছে। রাস্তার চায়ের দোকানে খুব বেশী ভীর। সকালে সিলেটের মানুষ মনে হয় চা একটু বেশী খায়। পাগল টা চায়ের দোকানে সামনে এসে দাঁড়ালো। ঐ দুই জন মহিলা ঐ চায়ের দোকানের সামনে এসে একজন কে বলল – তোমার কোন আক্কল জ্ঞান নাই। রক্ত মিলে না। বাচ্চা বাচাইতে চাইলে রক্ত লাগব। বসে থাকা দু জন মানুষ বলল – ও নেগেটিভ রক্ত তো চাইলেও মিলে না। পাগল ওদের দিকে তাকিয়ে বলল – চিন্তা করবেন না। আমার রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। একজন মহিলা ফোন করে কাকে জানে বলছে – ও মা আল্লাহ্ মিলাইয়া দিছে। এর মধ্য পাগল কে চা দিতে বলছে। পাগল চা খেতে খেতে একটা গাড়ি চলে আসলো। মহিলা ও পুরুষ সবাই গাড়িতে উঠল পাগল কে নিয়ে।
একজন বলল – সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায়। ভাইসাব আপনের খুনের গ্রুপ নেগেটিভ কিল্লা? পাশের মহিলা বলল – আল্লাহ্ যারে জিমান দিছে। অগুতা অনেক দামী।
পাগল হেসে বলল- যখন স্রষ্টা মনে করে তার তাকে বাচাবে তখন তার ব্যবস্থা তিনি করেন। তবে চেষ্টা মানুষ কে করতে হবে।
একজন বলল- আপনার বাড়ী কোথায়? পাগল বলল আগমন জানি প্রস্তান হব জানি। তাই বাড়ী নিয়ে কোন চিন্তা নেই।
— আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না।
— এই যে বিশাল সাগর। এত মাছ পোকা জলজ প্রাণী এদের কোন বাড়ী আছে।
— না, নাই।
— তাহালে আমার ও বাড়ী নাই।
হাসপাতালের সামনে থেকে নেমেই। চলে গেল ল্যাবে। ডাক্তার রক্তের গ্রুপ করে দেখল ঠিক আছে। ইতিমধ্য অনেক মানুষ চলে এসেছে যে রক্ত পাওয়া গেছে শুনে। এই শীতের মধ্য একজন ডাব। একজন হাতে জুস নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
ডাক্তার বলল – আপনি এই কাগজে সাক্ষর করেন। পাগল বলল – আমার টিপসই নেন। আমি লিখতে জানি না। ডাক্তার বলল- আপনাকে দেখে মনে হয় না যে আপনি শিক্ষিত না। এই বার পাগল হেসে বলল – আপনি কি শিক্ষিত?
— হ্যা আমি শিক্ষিত না হলে কি ডাক্তার হতে পারতাম?
— পাগল বলল – আপনি কিছু বিষয় পড়েছেন যা অন্য লোকের আবিস্কার।
আপনি হলেন সেই সব অবিস্কারকের অনুসারী। যদি আপনি শিক্ষিত হতেন তাহালে সব জানতেন। চায়না পড়তে পারেন ডাক্তার?
— ডাক্তার বলল না।
— তাহালে আপনি বলবেন আমি বাংলা ইংলিশ জ্ঞান জ্ঞাত। কিন্তু আপনি শিক্ষিত না। মানুষ এখনো শিক্ষিত হতে পারে নাই। মানুষ যদি শিক্ষিতই হতো তাহালে দুনিয়ায় শিক্ষিত মানুষগুলো এত পাপ জুলুম অত্যচার করত না।
— ডাক্তার চুপ হয়ে গেল। আর কোন কথা বলল না। সামনে ফরম রেখে বলল আপনার নাম বলুন লেখি।
—- পাগল বলল আমি রক্ত দিতে এসেছে নাম দিতে না। যদি হয় একটা টিপ সই দিব। যা খুশি লিখে নেন।
—- ডাক্তার বলল টিপ নেয়ার মত কিছু নাই। মানে কালি নাই।
—- পাগল বলল ঠিক আছে আমি দেখছি বলে একটা মেয়ের ব্যাগ হাতে নিল। মেয়ের
ব্যাগ থেকে একটা আই লাইনার নিয়ে বুড়ো আঙ্গুলে লাগিয়ে কি সুন্দর টিপ
দিল। রক্ত দিতে দিতে বলল – ডাক্তার আপনার এই হাসপাতালে আপনি
সহ ১১ জন ও নেগেটিভ রক্তের লোক আছে। কিন্তু ডাক্তার আপনি শুধু রক্ত নিয়েই গেলেন। কিন্তু আপনি আজ পর্যন্ত কাউকে এক ব্যাগ রক্ত দেন নাই।
— ডাক্তার বলল আমার রক্ত ও নেগেটিভ আপনাকে কে বলল।
— ডাক্তার আমি তো আপনার মত না। আমি কিন্তু শিক্ষিত তবে আমি চলে যাবার পড়। আমার টিপ সই দেখে নিবেন।
পাশ থেকে একজন বলল এই ডাক্তারের রক্ত ও নেগেটিভ? পাগল বলল হ্যাঁ কিন্তু তোমার রক্তের গ্রুপ কি? জি আমার জানা নেই? আগে নিজের টা জানতে চেষ্টা কর, তার পর অন্যের টা জানিও।। পাগল তার রক্ত দেয়া শেষ করলো।
বাচ্চা বলতে একজন ১৪ বছরের মেয়ের অপারেশনে প্রচুর রক্ত ঝরেছে। ডাক্তার ভাবতেও পারে নাই। এত ছোট একটা টিউমার অপারেসানে রক্ত লাগবে। যে চার জন সাত সকালে পাগল কে নিয়ে এসেছে এদের একজনের মহিলার নাম নাজু। অন্য জনের নাম নাদিয়া। তাদের বোনের মেয়ে হল শিলা। শিলার মায়ের নাম নাজু। নাজু ডাক্তারের সাথে কথা শেষ করে। দুই বোন কে ডেকে বলল – রক্ত দেয়া মানুষ কোথায়। নাজু বলল – আপা লোকটা জানি কেমন। কারো দিকে তাকায় না। কিন্তু খুব চমৎকার কথা বলে। এই হাসপাতালে নাকি ১১ জন মানুষের ও নেগেটিভ রক্ত আছে কিন্তু তারা নাকি কেউ রক্ত দেয় না।
— ওরা ডাক্তার। আর ডাক্তার মানেই মমতা কম। তুই দেখ লোকটা কোথায়? আমার সাথে দেখা না করে যেন যায় না। শিলা রক্ত নেয়া শেষ হলে হয়ত আল্লাহর রহমতে ভাল হবে।। যা যেয়ে দেখ মানুষটা কোথায়।
পাগল শীতের মধ্য একটা ডাব খেল। ডাক্তার বলল – ভাই আপনার নামটা যদি বলতেন। পাগল এবার বলল আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে নাম দেয় নাই। যাযাবর আর পাগলদের নাম কেউ মনে রাখে বলে জানি না। পাশ থেকে একজন নার্স হাসছে। পাগলটাও নার্সের দিকে চেয়ে হেসে বলে – যারা কষ্ট পেতে জন্ম হয় তারা অল্পতে হাসতে পারে। নার্স বলল – আপনি কি মনে করেন আমি কারো ধারা কষ্ট পাব।
পাগল বলে কারো ধারা না। বিশ্বাস ধারা মানুষ কষ্ট পায়।
পাগল কে লক্ষ্য করে নাদিয়া বলল – আপনি আমার বোনের সাথে দেখা না করে কোথাও যাবেন না। পাগল বলল – কে আপনার বোন। ডাক্তার বলল – যেই রোগী কে রক্ত দিলেন, সেই রোগীর মা। পাগল বলল – আপনার বোনকে বলবেন – আমি দেখা না করে কোথাও যাব না। নাদিয়া বলে আসুন আমার সাথে । পাগল কে নিয়ে নাদিয়া হাসপাতালে হেটে শিলার রুমের দিকে যাচ্ছে। নাদিয়া বলল – আপনি নাকি খুব অদ্ভুত মানুষ। নাম বলেন না। আমার বোন বলল। আমার তিন বোন কোন ভাই নাই। বড় বোনের বিয়ের সাত দিন পর বাবা মারা যায়। আমাদের দুলাভাই মানে যাকে আপনি রক্ত দিলেন তার বাবা আমাদের ছোট বেলা থেকে লালন পালন করেছে। আমরা গত কাল বিকাল থেকে রক্ত পাগলের মত খোঁজতে ছিলাম। আমি এই সকালে গিয়েছিলাম একজনের কাছে তার রক্তের কথা শুনে। কিন্তু সে নাকি ঢাকা গিয়েছে। আমাদের একটা মাত্র বোনজি। ওর কিছু হয়ে গেলে আপা দুলাভাই কে মনে হয় বাচাতে পারতাম না। আপনি কোথায় থেকে আসলেন। এ যেন আল্লাহ্ আমার দুলাভাইরের জন্য নিজের হাতে আপনাকে পাঠাইছে। পাগল বলল- দেখুন সব ভাল কাজের একটা পুরষ্কার আছে। এটা হয়ত তাই। আমি কি মনে করে মিলি খালা কে না বলে হাঁটতে হাঁটতে কমলাপুর চলে আসি। আর কি মনে করে ট্রেনে উঠি আমি নিজেই জানি না। সব চেয়ে মজার কথা সারা ট্রেনে আমি ঘুমিয়ে আসি আমার কাছে কেউ টিকেট পর্যন্ত চায় নাই। আসল কথা কি জানেন। এদেশের মানুষ সুন্দর চেহারা আর ভাল পোশাক দেখলে মনে করে, না জানি কত বড় অফিসার। আর ভয় পাওয়ার কারন হল। যে টিকেট চাইবে সে তো সরকারকে প্রতিদিন দশ বিশ টাকায় কিনে।
এটাই আজব দেশ যেখানে সত্য দেখার পর চশমা পড়ে মানুষ বলে কিছুই দেখি নাই।
পাগলের কথায় নাদিয়া একটু হাসে। যেন অনেক দিন পর নাদিয়ার মুখে সূর্য উঠেছে……..।
চলমান ———–