সেলিনা জাহান প্রিয়ার গল্প: ‘অ-মানব’- (১৭তম পর্ব)
‘অ-মানব’- (১৭তম পর্ব)
————————সেলিনা জাহান প্রিয়া
রাত তিনটা বাজে । রেজিয়ার ফোনে বার বার ফোন আসতে থাকে । কিন্তু রেজিয়া আর ফোন রিসিভ করে না। নাজু রেজিয়ার ঘরে আসে । পাগল মানুষটা নাজুর সাথে আসে । ই-মেইল টা রেজিয়াকে দেখায় । চেয়ে দেখে রেজিয়া আসলেই ভুল করেছে। রেজিয়া দেখল তার চেয়ে বেশী কথা হয় অন্য একটা নাম্বারে ।
রেজিয়া সেই নাম্বারে কল করে । রাত তিনটায় মেয়েটার ফোন ব্যস্ত । রেজিয়া তার দেবর কে কল করে দেখে সেই ফোন ও ব্যস্ত ।
এক সময় রেজিয়া তার স্বামীর কাছে ফোন করে । স্বামী ফোন ধরে বলে কোথায় তুমি । গত দুই দিন তোমার কোন খোজ পাচ্ছি না। যে খানেই থাক বাসায় চলে এসো । আর আমি অফিস থেকে একটা ফ্ল্যাট পেয়েছি ।
আমর খুব ইচ্ছা এইটা তোমার নামে দিয়ে দিব । মা বলেছিল যে আমি তোমাকে যেন একটা ফ্ল্যাট কিনে দেই । আল্লাহ্ আমার মায়ের আশা পুন্য করেছে । আর একটা কথা তুমি বাসায় না থেকে ভালই করেছ । আমার ছোট ভাই তার বসের বউ কে নিয়ে নাকি পালিয়েছে । বাসায় পুলিশ এসেছিল । ভাগ্য ভাল আজ মা বেঁচে নেই ।
মা বেঁচে থাকলে হয়ত এত বড় কষ্ট সহ্য করতে পারত না। রেজিয়া বলে – তুমি কেমন আছ। রেজিয়ার স্বামী বলে আর কেমন থাকি বল । নীচ তলার আপা এসে কি সব বাজে কথা বলে গেল । আমরা নতুন ফ্ল্যাটে উঠে যাব । তুমি তাদের কোন কথা শুন না। এরা মানুষকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায় । রেজিয়ার চোখ দিয়ে টলটল করে পানি পড়ছে । নাদিয়া একটা লম্বা ঘুম দিয়ে এসে দেখে তাদের মেহেমান কাঁদছে । নাদিয়া নাজু কে ডেকে বলে যা তো আপুর জন্য ভাল করে চা বানিয়ে নিয়ে আয় ।
পাগল টাকে রেজিয়া বলে তুমি আসলেই কোন মানুষ না। কারন আমি তোমাকে যে অপমান করেছি তার পর ও তুমি আমার এত বড় উপকার করলে । কাল বাসায় যেতে যেতে বিকাল হয়ে যাবে । পাগল বলে তোমার কাছে টাকা আছে সকালে বিমানে চলে যাও । যদি ৬ টার কোন ফ্লাইট থাকে তাহলে ৭ টায় ঢাকার বাসায় ।
পাগল কে বলল তাহলে তাই কর আমার জন্য । পাগল বলল কিছু কিছু সময় মানুষকে স্বার্থ পর হতে হয় । তবে সব সময় না। আমাদের সমাজের মানুষ মনে করে যে স্বার্থপর মানুষরা সমাজে সুখের অভিনয় করে । আসলে কোন মানুষ স্বার্থহীন না। যারা স্বার্থহীন তারা পাগল না হয় শিশু । নাজ আদা দিয়ে দুধ চা নিয়ে আসে । ভোরে আসে ফজরের মিষ্টি আযান চার দিক থেকে ভেসে আসে ।
রেজিয়াকে নিয়ে সিলেট বিমান বন্দরে যায় পাগল মানুষটা । যাওয়ার পথে পাগল বলে আজ থেকে রেজিয়া আপু সব সময় মানুষের মাঝে কি ভাল আছে সেই ভাল গুলোর প্রশংসা করবে । তোমার স্বামী যদি জানতে চায় কোথায় ছিলে তাহলে বলবে যে নাজু আপার বাসায় ছিলাম । সে আমার পরিচিত ।
পাড়লে স্বামীর কাছে আবার সব বলে দিও না। আজ থেকে তুমি কিন্তু তোমার দেবর কে চিন না। সে তার পাপের পাপ্য পেয়ে যাবে । তুমি তোমার স্বামীর সেবা করে সেই পাপের ভার স্রষ্টার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবে। তবে কোন দিন বল না যে তার ভাই তোমার খতি করেছে । কারন মানুষ জন্মত রক্তের ভাই বোন তাদের রাগ দোষ তারা মনে রাখে না। পর সব সময় পর ।। রেজিয়া বলে তোমার জন্য আমি একটা খাম রেখে এসেছি নাজু আপার কাছ থেকে নিয়ে নিও । তোমার মত আমার একটা পাগল ভাই আছে এটাই আমার জিবনের সব চেয়ে বড় পাওয়া ।
পাগল মানুষটা আকাশের দিকে চেয়ে থাকে বিমান শব্দ করে উড়ে যায় । বিমানের দিকে চেয়ে থাকে ।।
সকাল ৭ টা ৩০ মিনিটে বাসায় আসে রেজিয়া । স্বামী দরজা খুলে দেয় । রেজিয়া সরি বলে । স্বামী বলে আজ দুই দিন অফিসে যায় নাই । রেজিয়া বলে তুমি রেডি হও আমি তোমার নাস্তা রেডি করছি । স্বামীর জন্য খুব তারা তাড়ি নাস্তা বানালো । সেই রাতে গত রাতের দুধ চায়ের আদা দিয়ে স্বামী কে দেয় । স্বামী চা মুখে দিয়ে বলে চা টা জানি কেমন ।। রেজিয়া বলে কি ভাল লাগে নাই ।
—–ভাল লেগেছে ।
—– শুন আশার সময় একটা নতুন সিম কিনে এনো । আর এই টাকা গুলো
ব্যাংকে জমা দিয়ে দিও । তবে আমার হিসাবে না। তোমার ব্যাংক হিসাবে ।
—– আরে এক জায়গায় রাখলেই হয় । তোমার যা আমার তা ।
—– রেজিয়া স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কেদে দেয় । স্বামী তার মাথায় হাত দিয়ে বলে
তোমরা নারীরা যে কখন কি কর আল্লাহ্ জানে । কান্না কর নাতো । রেজিয়ার স্বামী অফিসে চলে যায় । মিলি কে দেখে একটা বাচ্চা কে রোদে তেল মাখছে । রেজিয়া
মিলিকে বলে – আপু কেমন আছ । তোমার বাগান তো অনেক সুন্দর ।
—- শুন রেজিয়া মন সুন্দর হলে সব কিছু সুন্দর । তা গত কয়েক দিন দেখলাম না।
তোমার নীচ তলার আপা আমাকে বলল -তুমি নাকি তোমার দেবরের সাথে
পালাইছ । তোমার বাসায় পুলিশ আসাতে এলাকার মানুষের কাছে তোমার
মুখ রক্ষা হল । ঐ নীচ তলার আপার সাথে যেন তোমার স্বামী কথা না বলে ।
—- রেজিয়া হেসে বলে আপু মনে হয় আমার দেবর কে ওর খুব পছন্দ ছিল ।
—- তা তুমি কোথায় ছিলে ।
—- আপা সিলেট আপার বাসায় ।
—- বল কি ? তা আমাকে নিলেও তো পারতে ।
—- আপা আপনি যখন যাইতে চাইবেন নিয়ে যাব । কিন্তু একটা কথা পাগল টা
কোথায় ।
—- আরে পাগল হল আল্লাহর বান্দা আসে ভাল কাজ করতে । কাজ শেষ চলে যায় ।
—- আপা ঠিক বলেছেন । আপনার পাগলের একটা ছবি আমার মোবাইল এ আছে ।
চাইলেই আপনাকে দিয়ে দিব । মিলি জোছনার কুলে বাবু কে দিয়ে রেজিয়ার মোবাইল ফোনটা হাটে নেয় । পাগল ভাইয়ের ছবিটা দেখে কাঁদতে থাকে । মিলির কান্না দেখে রেজিয়াও কাদে । মিলি বলে খুব অল্প সময়ে ছেলেটা আমাদের মায়া লাগিয়ে কোথায় চলে গেল । রেজিয়া এখন জানে কোথায় আছে কিন্তু পাগল মানুষটা বলে দিয়েছে যেন তার কথা না বলে । মিলি তার বাচ্চা কুলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায় ।
নাজ নাদিয়া শিলা আর নাজু আপা চেয়ে দেখে পুকুরে মাছ আর মাছ । নাজুর স্বামী বল হে আল্লাহ্ এত মাছ বিশ্বাস হয় । মাছ দেখার জন্য মানুষ ভীর করেছে । রইছ মিয়া পাইকার নিয়ে এসেছে । শিলা বলে জিনিয়াস মামা আব্বু হেরে গেল । বিকেলের মধ্য মাছ বিক্রি শেষ । কাদা সরানো কাজ চলছে । নাদিয়া তাদের সব আত্মীয় স্বজনের বাসায় মাছ পাঠায় । রাত আঁটটা বাজে । বারান্দায় বসে আছে শিলার বাবা । পাশে পাগল মানুষটা । পাগল কে বলে শিলার বাবা আসলেই তোমার মাঝে শক্তি আছে। এই পুকুর নিয়ে আমাদের কোন চিন্তা ছিল না। পাগল হেসে বলে
—- দেখুন এই পুকুরে কি জানি একটা রহস্য আছে । আমি তাই এই পুকুর সেচে সেই
রহস্য বের করতে চাই ।
—– আসলে রহস্য কিছু না । ভয় । । ভয় পায় । এই পুকুর কাটার পর থেকে এই বাড়িতে কিছু না কিছু সমস্যা হতে থাকে । আমার বাবার ছোট ভাইয়ের তিন সন্তান পানিতে পড়ে মারা যায় । একেই দিনে । পুকুর কাটার দিন আমার বাবার দুইটা গরু মারা যায় । আমার ছোট চাচা এই পুকুরে ঐ শিমুল গাছে ফাসি দিয়ে মারা যায় । আমার মা প্রায় রাতে একা একা নেমে ডুব দিত । কতদিন যে বাবা তাকে পুকুর থেকে তুলেছে । যুদ্দের সময় পাক বাহিনী এই পুকুরে দুই জন কে ডুবিয়ে মারে । সাত বছর আগে কোথায় থেকে এক পাগল এসে নামে । সে আর উঠে না। তিন দিন পড়ে তার লাশ উঠে ।।
—- পাগল বলে দেখুন সব চেয়ে অবাক লাগে কি জানেন । আপনার মা কেন পুকুরে
নেমে সারা পুকুরে ডুব দিত । আচ্ছা দেখি সব রহস্য বের হবে ।
নাদিয়া আর নাজ তাদের রুমে শুয়ে আছে । বাড়ির পিছনে পুকুরে কুকুর পড়ে গেছে তাই গেউ গেউ করছে । সবাই লাইট নিয়ে পুকুর পারে গেছে । শীত আর কাদায় কুকুর আর উঠতে পারছে না। এত রাতে কে নামবে কাদায় । নাজুর স্বামী বলে এখন কি করি ? পাগল এসে বলল লম্বা দরি নেন । পুকুর থেকে উপরে উঠার কোন জায়গা নেই । সকালে জেলেরা বাঁশের মই দিয়ে নেমে ছিল । আর পানি থাকলে শিমুল গাছের শিকর ধরে উঠা যেত ।
পাগল তাই পাগল একটা দরি ধরে নামলো । কাদা থেকে কুকুর কে তুললো । কিন্তু পাগলের পায়ে কি যেন একটা শক্ত লাগলো । ইটা মনে করে তুলল । না ইটা না । কাদার অনেক গভীরে । যাই হউক হাতে শক্তিতে টান দিয়ে বের করল ।
দেখে একটা লম্বা বক্স । অনেক পুরানো দিনের কাটের বক্স । কাদা সহ হাতে নিয়ে আগে কুকুর তুলে দিল । তার পর সে বক্স নিয়ে পুকুর থেকে উপরে উঠে আসলো । নাজু আপু বলল এত বড় বক্স । তাই বক্সের কাদা পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগলো । নাদিয়া বলল – কি জানি আছে । নাজ বলল – মনে হয় জীন ভুত থাকতে পারে । শিলা বলল আমি কিন্তু খালা মনি ভুত ভয় পাই । নাজু বলল যাই আছে দেখা যাবে । আগে ভাল মতে পরিষ্কার করি তো …।
চলমান ——