সেলিনা জাহান প্রিয়ার ধারাবাহিক গল্প: ‘অ-মানব’-(২৭তম পর্ব)
‘অ-মানব’-(২৭তম পর্ব)
————————- সেলিনা জাহান প্রিয়া
সোফায় বসে আছে আমজাদ সাহেব বয়স ৬০ বছর হবে। খুবোই চিন্তাশীল মননের মানুষ। এই পরিবারে সবাই জ্ঞানী। দুই মেয়ে বড় আর ছেলে ছোট।
দুই মেয়ে কে বিয়ে দিয়েছে দুজনেই বাবার সাথে থাকে। বড় মেয়ে লায়লা তার স্বামী মিঃ মোহন আর দ্বিতীয় মেয়ে পারু তার স্বামী দুলাল। এক মাত্র ছেলে রাজ। আমজাদ সাহেবের স্ত্রী রেবেকা। বাসায় কাজের মেয়ে আছে একজন মিতা আর দারোয়ান মালি মিলে দুজন। বাগানের মালির বাড়ি ময়মনসিংহ নান্দাইল। মালির নাম ভিমরুল খাঁ।
আমজাদ সাব দারোয়ান জাফর কে খুব পছন্দ করে কারন সে যে কোন কাজ বললে না করে না। বাগানের মালি কে খুব পছন্দ করে কারন সে গাছের খুব যত্ন নেয়। নিয়মিত পানি দেয়। রেবেকা বেগম দু’জন কে একেবারে পছন্দ করে না। জাফর যেমন বলে সব পারি কিন্তু কাজের কাজ কিছুই পারে না। সব কাজ শেষ পর্যন্ত অন্য কে দিয়ে করাতে হয়। মালি গাছ ছাড়া অন্য কিছুই বুঝে না। অন্য কাজের কথা বললে, বলে আমি তো মালি মানুষ অন্য কাজ আমাকে শুভা পায় না।
কাজের মেয়ে মিতা কি কাজ করে সারা দিন ঘর মুছামুছি করতেই সময় চলে যায়। রেবেকা স্বামীর জন্য একটু চা বানাতেই হাপিয়ে উঠে। দুই মেয়ে সারা দিন বিউটি পার্লার আর স্বামীদের সাথে ঝগড়া লেগেই থাকে। তাদের মেয়েদের সব আবদার আমজাদ সাহেব আদরের সহিত পালন করে। ছেলে রাজ সারা দিন ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত। আমজাত সাহেবর হাতে চা তুলে দিয়ে রেবেকা বেগম বলল-
—- তোমার দারোয়ান জাফর আজ সাত দিন হল উধাও। তোমার
ড্রাইভার আলি কত দিন দারোয়ানি করবে। সে নাকি এই কাজ করতে লজ্জা পায়। তার নাকি সম্মান নষ্ট হচ্ছে।
—- আমজাদ সাহেব বলল, ওতো আগে দারোয়ান ছিল। পরে তো আমি ওকে টাকা দিয়ে ড্রাইভারী শিখালাম। তখন তো বলল দারোয়ানি ড্রাইভারী সব করবে। এখন আবার নতুন সুর। মানুষ আসলেই অতীত ভুলে যায়।
—– তা তুমি জাফর কে মালি থেকে দারোয়ান বানালে কেন?
—– আরে ও তো গাছের গ বুঝে না।
—- চাকুরি নেয়ার সময় তো বলেছে সে গাছের সব কাজ পারে।
—- ও ঠিক বলেছে। সব কাজ বলতে ও কৃষি কাজ বলেছে কিন্তু বাগান না।
—- তা এখন তোমার জাফর যে বাবুর্চি আনতে গেল ৭ দিন। এই সাত দিন কি আমরা হাওয়া খেয়ে থাকব।
—- কেন হোটেল থেকে তো তিন বেলা আলি খাবার কিনে আনছে।
—- তোমার সাথে খাবার নিয়ে কথা না বলে একটা হোটেল দিয়ে দাও বাসার সামনে। ব্যবসাও হবে খাবারও হবে। হোটেলের নাম দিবে আমজাদ হোটেল।
—- আমজাদ সাহেব বলল তোমার চিন্তা ভাল। জানো হোটেল দিলে এই এলাকার সব হোটেলের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। কারন আমি জনগণ কে বিশুদ্ধ খাবার খেতে দিব।
— রেবেকা একটু রাগ হয়ে বলল তাই কর। বই পড়া ছাড়া তো আর কোন কাজ নাই।
কাজের মেয়ে মিতা দাড়িয়ে শুনছিল আমজাদ সাহেব আর রেবেকা বেগমের কথা। হোটেলের কথা শুনে সে সোজা চলে গেল লায়লা আপুর ঘরে। লায়লা কে বলল – আপু একটা মজার খবর।
—- কি খবর মিতা। পারুর জামাই আজ কিছু বলেছে।
—- আরে না। চাচাজান বাসার সামনে একটা খাবার হোটেল দিবে।
—– বলিস কি? মানুষ কি বলবে। আমার স্বামী কি অফিসে চেহারা দেখাতে পারবে। ইস আমার স্বামীর সম্মান কি হবে। লায়লা তাড়াতাড়ি পারুর ঘরে গিয়ে বলল, পারু খুব খারাপ খবর আব্বু নাকি বাসার সামনে একটা খাবার হোটেল দিবে। দেখ মানুষ আমাদের কি বলবে। তোর দুলা ভাই কত বড় চাকুরি করে। অফিসের মানুষ শুনলে কি বলবে। পারু বলে কি আর বলবে। আমার জন্য ভাল হবে আমি একটু পর পর আমার স্বামী কে এটা সেটা খেতে দিতে পারব। নিজেদের হোটেল মানে। সারা দিন শুধু এটা সেটা খেতে দিতে পারব। সারা দিন শুধু খাব আর খাব। লায়লা বলল আমি যাচ্ছি আব্বুর পাগলামি বন্ধ করতে। পারু বলল না তুমি বন্ধ করার কে। আমি চাই হোটেল হউক।
দুই বোন মিলে এক সাথে আমজাদ সাহেবের সামনে। পিছনে মিতা, রেবেকা আমজাদ সাহেবের হাতের নক নেইল ক্যাটার দিয়ে ঠিক করে দিচ্ছিল। লায়লা এসে বলল – আব্বু তুমি নাকি হোটেল দিচ্ছ। পারু আব্বু খুব ভাল হবে। আমজাদ কাজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল কিরে মিতা তোকে না বলেছি। তোর মুখে তালা দিতে।
মিতা বলল – চাচা জান আপনি যত বার তালা দেন এই দুই আপা ধমক দিয়ে তালা খুলে দেয়। যদি কোন কোন কিছু না বলি তাহলে বলে লায়লা আপু আমাকে বাড়িতে যাওয়ার ছুটি দিবে না। আমাকে কান দড়িয়ে দাড়িয়ে রাখে।
পারু আপু বলে একটা কাচের গ্লাস নিয়ে হাতের তালুতে রেখে দাড়িয়ে থাকতে। আমি এই বিপদ থেকে বাচার জন্য এই তথ্য পাচার করেছি।
এমন সময় জাফর এসে হাসি দিয়ে লম্বা একটা সালাম দিল। রেবেকা বেগম জাফরের দিকে চেয়ে বলল – লংকা জয় করে ৭ দিন পর এসেছ।
—- জি আম্মা জান। এটা লঙ্কা জয় না বলেন আফগান জয়। আমি সেই রকম একজন বাবুর্চি এনেছি। কথা কম বলে। রান্না খুব ভাল করে।
—- তুমি তার রান্না খেয়েছ।
—- না আম্মা জান এখনো খাই নাই। তবে তার কথা শুনেই আমার খাওয়া হয়ে গেছে। একবার তার কথা শুনলে ৭ দিন না খেয়ে থাকা যায়।
— রেবেকা বলল এই মাত্র বললি কথা কম বলে আবার বলছিল একবার কথা
শুনলে সাত দিন না খেয়ে থাকা যাবে।
—– জি আম্মা জান আমার অনেক চেনা। অনেক বছর এক সাথে। আগে নাকি চাইনিজ হোটেল, ইটালি হোটেল, কুরিয়া হোটেল আর ইন্ডিয়া হোটেল এ কাজ করত। অনেক আশা ভরসা দিয়ে নিয়ে এসেছি। বলেছি আম্মা জান যদি খাবার খেয়ে পছন্দ করে তবে চাকুরি কোন দিন যাবে না।
—- আমজাদ সাহেব বলল। কই তোমার সেই সেফ মানে বাবুর্চি।
—- লায়লা বলল- তাহলে কি হোটেল বানাবে বাবা।
—- আমজাদ সাহেব বলল দেখি তোমাদের খাবার দাবার খুব কষ্ট।
—- পারু বলল যাই হক আব্বু ঠিক সময় ঠিক কাজ করছে।
আমজাদ সাহেব আর রেবেকা এক সাথে মেয়েদের ঝগড়া শুনে হাসে। জাফর বাবুর্চি নিয়ে আমজাদ সাহেব এর সামনে আসলো। রেবেকা বেগম বাবুর্চির দিকে তাকিয়ে দেখে গরমের মধ্যে একটা সোয়েটার গলায় একটা কাপড় ঝুলানো। মুখে দাড়ি মাথায় এলো মেলো লম্বা চুল। কিন্তু চেহারাটা খুবোই শান্ত ও মায়াবি। আমজাদ সাহেব বলল –
—— কি নাম তোমার।
—— জাফর বলতে চাইলে। রেবেকা একটা ধমক দিয়ে বলল কম কথা বল যাকে জিজ্ঞাসা করছি সে বলুক।
—– রেবেকা বলল – এই ছেলে কি নাম।
—– আমার নাম অ-মানব।
—- আমজাদ সাহেব একটু হেসে বলল কি নাম?
—– জি আমার নাম অ-মানব।
—– এটা কোন নাম হল।
—– স্যার এই বিষয় নিয়ে কোন দিন চিন্তা করি নাই।
—— কেন চিন্তা কর নাই।
—— মানুষের জন্ম স্যার অন্যের ইচ্ছায়। যার ইচ্ছায় জন্ম নিয়েছি নামটা স্যার সেই রেখেছে। তাই নামের বিষয়টা একান্ত জন্ম দাতার। তাই তার সম্মানে এটা আর বদলাতে চাই না।
—– বাহ ! জন্ম দাতাকে যে ভালবাসে তাকে আমি অনেক সম্মান করি। তুমি তাকে সম্মান কর জেনে ভাল লাগলো।
—– স্যার আমি কোন জন্ম দাতাকে সম্মান করি না। দুনিয়ায় যে কেউ যে কাউকে জন্ম দিতে পারে। কিন্তু যে লালন পালন করে একজন মানুষ কে মানুষ বানায় তাকে সম্মান করি। স্যার দুনিয়াতে অনেক খারাপ জন্ম দাতা আছে। কিন্তু দুনিয়ায় একটাও খারাপ পিতা নাই। আমি সকল পিতাকে সম্মান করি। আমার নামটা আমার জান্ম দাতা পিতা রেখেছে।
—- আমজাদ সাহেব বলল চমৎকার কথা। আমি এভাবে কোন দিন চিন্তা করি নাই। তোমার কথা যথেষ্ট যুক্তি আছে।। থ্যাংকস।
—- রেবেকা বেগম বলল – তা বাবা অ-মানব। কি কি রান্না করতে পার? আর কি কি কাজ পার। আর গরমের মধ্যে এটা কি পরে আছ?
—– পাগল বলল আমি আপনাকে কি বলে ডাকব এটা আগে জানা দরকার। আর আপনার পরিচয়। তাহলে আমি ঠিক ভাবে আপনার সামনে নিজেকে তুলে ধরতে পারব।
—– রেবেকা বেগম একটু হেসে বলল – বাবা অ-মানব। আমি এই বাড়ির মালিকের এক মাত্র বউ। আমি যেহেতু তোমাকে বাবা বলেছি তাই তুমি আমাকে কি ডাকবে চিন্তা করে নাও।
——– পাগল এবার রেবেকা বেগম কে পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল- আম্মাজান। আমি যে কোন কিছু রান্না করতে পারি। বিশেষ করে ৪২ রকমের ভর্তা। দেশের সকল অঞ্চলের রান্না। আর দুনিয়ার সকল দেশের রান্না। যা আপনি খেতে চাইবেন। তবে একদিন আগে সব
খাবারের কথা বলতে হবে। রান্না একটা শিল্প। আর যে শিল্পমনা তার রান্না হবে সুন্দর। রান্নার বিষয় টা হল- লবণ আর মসলার বিষয় আর কতটা তাপমাত্রায় রান্না করতে হবে তা নিজের মধ্যে ধারন করা। আর তা ছাড়া আমি কাপড় পরিষ্কার জুতা পালিশ, কাপড় আইরন করা, ঘর মুছা। ড্রাইভারি। গাছ ও মাছ পালন, রঙ করা, বিদ্যুৎ মেরামত ও বাজার করতে পারি।
লায়লা বলল বাহ বহু গুন তোমার। এত গুনের লোক আমি আজ জিবনে প্রথম দেখলাম। তা তুমি ফ্রাস দেশের খাবার রান্না করতে পার।
—- অ- মানব বলল। জি আমি পারি। কিন্তু?
—- কিন্তু কি?
—- ইন্টার নেট লাইন আর একটা কম্পিউটার লাগবে।
—– কেন?
—– কারন আপনি ফ্রান্স দেশের কোন খাবার খাবেন তার রেসিপি টা দেখাতে হবে না।
—– রেবেকা বেগম বলল- অ-মানব এই গরমে তুমি সোয়েটার পরে আছ কেন?
—– অ-মানব বলল- আমর কাপড় রাখার ব্যাগ নাই। গত শীতে মিলি খালা কিনে দিয়েছিল। যদি হাড়িয়ে যায়। এই ভয়ে পরে রেখেছি।
রেবেকা বেগম বুঝল যে এটা খুব বোকা একটা মানুষ। হয়ত গ্রামে ছোট থেকে কষ্ট করে বড় হয়েছে। পারু বলল এই অ-মানব তুমি কি লেখা পড়া জান।
—- অ-মানব বলল এই পর্যন্ত আপু স্কুল খুজে পাই নাই ভর্তি হবার জন্য। একটা স্কুল খুজতেছি যে স্কুল এ মানুষ বানায়। আমাদের দেশের সব স্কুল গুলো মানুষ কে গোলাম বানায়। পাশ করেই চাকুরি চায়।
—– আমজাদ সাহেব শুধু অ-মানবের দিকে চেয়ে আছে, এই ছেলেটা কি বলছে।।
চলমান——–