সেলিনা জাহান প্রিয়ার ধারাবাহিক গল্প-‘অ-মানব’-(২৮ তম পর্ব)
‘অ-মানব’-(২৮ তম পর্ব)
———————— সেলিনা জাহান প্রিয়া
আমজাদ সাহেবে আর রেবেকা বেগমের কাছে ঘরের কি কি কাজ সব বুঝে নিল অ-মানব। লায়লা আর তার স্বামী ঘরে বসা। দরজায় টোকা দিয়ে অ-মানব বলল- বড় আপা আমি অ-মানব আসব।
— হ্যা এসো। কি বিষয়।
— ভাইজানের জন্য লাল চা। আদা দিয়ে। আপনার জন্য দুধ চা। সাথে হালকা নাস্তা। আমি নিজেই বানিয়েছি। আলু দিয়ে। লায়লা আবাক। আমার স্বামী তো লাল চা পছন্দ করে। তুমি জানলে কি ভাবে। কাজ করার আগে কার কি পছন্দ তা একটা তালিকা করেছি। তালিকা মতে সব খাবার। আপনার তালিকা আর বড় দুলাভাইয়ের তালিকা বেশ জটিল। স্বামীর স্ত্রীর সব বিষয় একটা মিল আস্তে আস্তে করে নিতে হয়। খাবার থেকে পোশাক পর্যন্ত। তাতে তাদের মধ্যে মহব্বত বারে।
— লায়লার স্বামী বলল, একদম ঠিক বলেছে হে মানব।
— স্যার আমার নাম অ-মানব। মানব হতে পারি নাই। দয়া করে স্যার আমাকে আমার নামে ডাকবেন। আমার নাম অ-মানব। যেমন আপনার নাম মোহন। কেউ যদি পেয়ারে মোহন ডাকে তখন কিন্তু আপনি রাগ করবেন।।
— ওমা এ দেখি আমার নাম ও জানে।
— স্যার এটা আমার কাজের ধরন। কোথাও কাজ করলে সবার নাম পদবি আর তার আচরণ জানা থাকলে। কাজ করতে সুবিধা।
— সুন্দর কথা বলেছে হে অ-মানব। আমি কোন দিন এভাবে চিন্তা করি নাই। নাম পদবি জানা তো খুবেই সহজ। কিন্তু মানুষের আচরণ জানব কি ভাবে।
— স্যার আপনি চা শেষ করেন। মানুষ এই দুনিয়ায় একমাত্র বোকা প্রানি সে তার আচরন লুকাতে পারে না। কারো না কারো চোখে সে আসল আচরন প্রকাশ করে। একে একে সবাই তার আচরন জেনে যায়।
— বাহ! চমৎকার। তা লেখা পড়া কিছু করেছ অ-মানব।
— এই দেশে স্যার কি লেখা পড়া করব। স্কুল গুলো, পিতা মাতা সবাই লিখা পড়া করায় গোলাম বানানোর জন্য। লিখা পড়া শেষ আর চাকুরী খোঁজা শুরু। চাকুরী মানেই ইন্টার্ভিউ। কিছু জানা জিনিস আপনাকে জিজ্ঞাস করিবে। যা সে নিজে জানে। দেখবেন আপনি খুব ভাল গোলাম হওয়ার যোগ্যতা রাখেন কারন আপনাকে সেই ভাবেই মানুষ করা হয়েছে তার পর ও আপনার চাকুরী হবে না। কারন আপনার টাকা ও মামুর জোর থাকতে হবে। তা না হলে নো চাকুরী।
— তা একদম ঠিক হে অ-মানব। কিন্তু চাকুরী না করলে এত কাজ কে করবে।
—- চাকুরী মানুষ করবে তার দায়িত্ব মনে করে। স্বাধীন ভাবে। যে যার কাজের কাছে জবাবদিহিতা করবে। কিন্তু আমরা কাজের চেয়ে জী হুজুর জী হুজুর আর চামচামি করি, আসল কাজেই ঠিক মতে করিনা।
— লায়লা বলল এত জ্ঞান তো বাবুর্চি গিরি কেন কর?
— আপা আপনি কি জানেন সেফ হতে অনেক যোগ্যতা লাগে। তাকে পুষ্টি আর রুচির উপর দক্ষতা জানা লাগে। রান্না একটা শিল্প। যা মানুবজীবনে সব চেয়ে দরকার। আপনি কি আপু না খেয়ে থাকতে পারবেন– না। রান্না খারপ হলে খেতে পারবেন- না। দেখুন আজ কাল টেলিভিশনে রান্না বিষয় অনুষ্ঠান হয়। দামি দামি তারকারা তা উপস্থাপন করে।
— লায়লা একটু চুপ হয়ে গিয়ে বলল – হ্যা ঠিক।
— এই আপু আপনার স্বামীর যখন লন্ডন পড়েছে তখন সে কি করত?
— লায়লা তখন মোহন কে বলল এই তুমি কি করতে?
— মোহন একটু হেসে বলল তখন একটা ইন্ডিয়ান হোটেলে ওয়েটার ছিলাম।
— অ-মানব বলল কি বুঝলেন আপা। স্যার কিন্তু বাবুর্চির চেয়ে ছোট কাজ করত। এই কথা বলে অ-মানব। লায়লার ঘর থেকে বের হয়। লায়লা বলে দারুন চা বানিয়েছে। আসলেই খুব মজা। মোহন বলে মানুষটা আসলেই খুব চমৎকার যুক্তি দিয়ে কথা বলে। লায়লা বলল– একটা ব্যাপার দেখেছ সে এই গরমে একটা সোয়েটার পড়ে আছে।
— হ্যা তাই তো, কেন? দাড়াও আমি ওকে আবার ডাকছি। ওর কথা গুলো দারুন। এই অ-মানব আমার ঘরে একটু এসো তো। কাজের মেয়ে মিতা এসে বলল– বড় আপু সে এখন আসতে পাড়বে না। ছোট আপু কে নাস্তা দিয়ে চাচা জানের সামনে গেছে।
— তা মিতা আজ কি কি কাজ করলি।
— আপা কোন কাজ সারাদিনে করতে পারি নাই। সবার কাপড় অ-মানব ধুয়ে ফেলেছে। সিঁড়ি থেকে তিন ঘর বাদে সব ঘর মুছে ফেলেছে। ভাত তরকারি রান্না শেষ। সব কিছু ধুয়ে মুছে শেষ করেছে। আমি যে কাজেই হাত দেই দেখি শেষ। ছাদে গেলাম কাপড় আনতে যেয়ে দেখি সেটাও নিয়ে এসেছে। আবার সবার কাপড় আইরন করা শেষ। রাতে কি কি হবে রান্না তার জন্য সব ঠিক করে রেখেছে।
— বলিস কি বাসার সব কাজ সে একাই করেছে।
— হ্যা আপু হাতে একটা ডাইরি আর একটা কলম রাখে। সব কিছু রুটিন মতো করে। রান্না ঘরে একটা রুটিন রেখেছে। আর সে যেই ঘরে ঘুমাবে, সেই ঘরে একটা রুটিন রেখেছে। আমাকে বলে রান্না ঘরে আসলে যেন মাথায় কাপড় দিয়ে ভাল করে চুল বেঁধে আসি।
— লায়লা তো অবাক হয়ে বলল এটা কি মানুষ না রোবট। রেবেকা বেগম সব ঘরে যায়। আজ সে সারা বাড়ি হাঁটছে। মালি এসে সালাম দিয়ে বলল – বেগম সাহেব নতুন যে বাবুর্চি নামে একটা বিচার আছে। সে ছাদের সব টব উল্টা পাল্টা করেছে। এটা আমার কাজ সে সব গাছে পানি দিয়েছে। একজনের কাজ অন্য জন করা কি ঠিক। মিতা এসে বলল আমার কাজ সে করেছে আমি কি কাজ করব। আম্মাজান। রেবেকা বলল অ-মানব কোথায়। ওরে একটু ডাক। অ-মানব এসে মাথা নিচু করে সালাম দিয়ে বলল আম্মাজান আমাকে ডাকছেন? হ্যা আজ সকালে তুমি কাজে লেগেছ। খুব ভাল কথা। তা রান্না রেখে অন্য কাজ করছ। তোমার রান্না কে করবে। আম্মাজান দুপুরে খাবার রান্না শেষ। আজ তো বাজার করা হয় নাই। তাই ফ্রিজ থেকে মাছ রান্না করেছি। ডাল রান্না। আলু ভর্তা। কালিজিরা ভর্তা করেছি। আমার রান্না ১১.৩০ মিনিটে শেষ। স্যার, আপু ও দুলাভাইকে চা দিয়েছি। আপনার জন্য চায়ের সাথে একটু মুড়ি দিয়েছি। ওদের কাজ তুমি করেছ কেন। আম্মাজান ওরা এক ঘণ্টার কাজ আঁট ঘণ্টায় করে। এভাবে কাজ করলে দেশ পিছিয়ে যাবে। এটার সাথে দেশের কি সম্পর্ক। আম্মাজান প্রতিটা কাজ দেশের জন্য। এই যে গাছে পানি দেয়া দরকার যেই সময়ে, সেই সময় না দিলে গাছের উপকারে আসবে না। যেমন আপনার নাস্তা খাওয়া দরকার সকাল আঁট টায়। আপনি যদি এগার টায় খান আপনার খতি হবে। এমন করে প্রতিটা কাজ সময়মতো না করলে পরিবারের খতি হবে। প্রতিটা পরিবার রাষ্ট্রের অংশ। কি জানি বাপু। তোমার কথা ঠিক বুঝি না। তা তোমার স্যার কে কি দিয়েছ? চিনি ছাড়া চা আর সাথে দিয়েছি বিস্কুট। সারা বাড়ি কি তুমি মুছেছ? জী আম্মা। ভাত হতে হতে সিঁড়ি মুছেছি। ডাল হতে হতে ঘর। সবার কাপড় আর আপনার বিছানার চাদর। রেবেকা বেগম বলল রাতে কি কি কাজ তোমার। হাতের ডাইরি টা বের করে বলতে লাগলো। রাতে খবার শেষ হলে থালাবাসুন পরিষ্কার করব। সবাই কে পানি দিব। স্যার আর আপনার মেডিসিন। সকালের নাস্তার জন্য কি কি লাগবে আপনার সাথে পরামর্শ করে ঠিক করে রাখা। তা এখনো সোয়েটার পড়ে আছ কেন। আমি কোন ঘরে থাকব। তা ঠিক হয় নাই। থাকার ঘর ঠিক হলে খুলে রাখব। মিতা কে বলল যা ওকে বাগানের ঐ ঘরটা তে থাকতে দে। আমজাদ সাহেব রেবেকা কে বলছে ছেলেটা জিনিয়াস। সুন্দর করে কথা বলে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। জাফর একটা কাজের মত কাজ করেছে। এমন একটা ছেলে এনে দিয়েছে, খাবার রান্না খুব মজা। আর সব কাজ সে করে। আমার বই গুলো সুন্দর মতে গুছিয়ে দিয়েছে। রেবেকা বলে একদিন যে কাজ করেছে দেখ কাল সকালে পালায় কি না। তোমার মেয়েদের যে ব্যবহার। লায়লা এসে বলল – আব্বু লোকটা সব কাজ রোবটের মত করে। কোন কিছু তাকে বলা লাগে না। এই মাত্র আমাকে সে একটা ফ্লাক্স গরম পানি দিয়ে বলল – বড় দুলা ভাই রাতে চা খায়, টি ব্যাগ ও চিনি রাখেন। একটু আদা আর দারুচিনি দিল। আমজাদ বলল তা অ-মানব কোথায় এখন। মিতা বলল। খালুজান এখন সে বাড়ির সামনের গেইট সাবান আর পানি দিয়ে পরিষ্কার করছে। মিতা ওকে ডাক। ভেজা হাতে এসে সালাম দিল। আমজাদ সাহেব বলল এই সন্ধ্যার সময় গেইট পরিষ্কার কেন করছ? স্যার সকালে বাসার সামনে দিয়ে অনেক গাড়ি যাবে। রাস্তা কাদা হবে। আর একজন মানুষ যদি বাহির থেকে দেখে গেইটা অপরিষ্কার তা হলে মনে মনে বাসার সবাই কে খারাপ মনে করবে। স্যার পড়েন নাই। শেখ শাদীর গল্প। আজ কাল মানুষ টাকা পয়সা দেখে না। দেখে কে কত গুছানো আর পরিষ্কার। তাই গেইট দেখে যেন বুঝে আমরা রুচি বান মানুষ।
দারুন কথা বলেছ। বাসার গেইট যে পরিষ্কার করতে হয় তা চিন্তা করি নাই। বাবা অ-মানব। তুমি যদি বাসার কাজ সব একা কর অন্য সবাই কি করবে? স্যার ওরা সবাই কাজ করতে চায় কিন্তু তাদের নিয়ম মতো কেউ কাজ শিখায় নাই। প্রতিটা কাজ নিয়ম মতো করলে কাজের সময় কম লাগে। ভুল কম হয়। সময় বাচে। মনের মধ্য সফলতার আনন্দ আসে। আমরা কেউ কাউকে কাজ শিখাই না। খালি বলি তুমি পারবে না। ভুল করলে শাস্তি দেই। কিন্তু কেন ভুল করল তা খুজি না। এবং ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেই না। আমরা কাউকে পারত পক্ষে কিছু ইচ্ছা করে শিখাই না। আর কেউ কেউ ভয়ে বা লজ্জায় শিখতে চায় না। যারা লজ্জা ও ভয় কে দূর করে কাজ শিখে তারাই সফল। যেমন আজ আপনাদের মেয়ে রান্না পারে না। এই না পারাটা কি স্যার ব্যর্থতা না?আমজাদ সাহেব একদম বোকা হয়ে গেল। অ-মানব চোখে আঙুল দিয়ে তাদের ব্যর্থতা দেখিয়ে দিল। রেবেকা বেগম একদম চুপ হয়ে গেল। পাগল সালাম দিয়ে আবার গেইট পরিষ্কার করতে লাগলো।
চলমান ———–