সেলিনা জাহান প্রিয়ার ধারাবাহিক গল্প: ‘অ-মানব’-(৩২ তম পর্ব)
‘অ-মানব’-(৩২ তম পর্ব)
———————– সেলিনা জাহান প্রিয়া
আমজাদ সাহেব সকালে ঘুম থেকে উঠে বাগানে আজ অনেক খুশি কারন বাগানের প্রতিটা গাছের চরিত্র আস্তে আস্তে জানতে পারছে। গাছ যে মানুষের চেয়ে রহস্যময় তা বুঝতে পারছে। কোন গাছ কি কাজের। কখন ফুল ফল দেয়। আর মানুষের জিবনে গাছের ভুমিকার কোন শেষ নাই। মানুষ কে সব চেয়ে বেশি সাহায্য করে গাছ। খুব সকালে আজ মিতা আমজাদের জন্য সাহেব জন্য চা নিয়ে এলো।
— খালুজান আপনার চা।
— আরে মিতা এত সকালে চা। তুমি চা বানাতে পার। বাহ ভাল।
— খালু জান এখন সব পাড়ি। চা নাস্তা রান্না। আর সব কিছু ঘড়ি ধরে করি।
— আচ্ছা বাড়ির আর লোকজন কোথায়।
— দারোয়ান। মালি। চালক এদের দেখছি না। আপনার অ-মানব। আপনার দুই মেয়ের জামাই কে ধ্যান শিখায়। আপনার মেয়েরা যে যার স্বামীর জন্য নাস্তা বানায়। আম্মাজান শুয়ে আছে। রাজ সাহেব ব্যায়াম করছে।
— বাহ! বাসার সাবাই তো মানুষ হয়ে গেল।
— অ-মানবের পাল্লায় পড়লে যে কেউ মানব হবে।
— হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। আমি দেখছস না। কি থেকে কি হয়ে গেলাম।
পাশের ঘর থেকে সব দেখছে দারোয়ান কিন্তু ঘর থেকে বের হতে পারছে না। গেইট এ তালা। আমজাদ সাহেব তো অবাক কি হল। রাজ নিজ ঘর থেকে বের হয়ে আসে। দারোয়ানের ঘরের তালা খুলে দেয়। সবাই কে এক লাইনে দাড় করিয়ে কান ধরে উঠ বস করাই। রাজ বলে একজন মানুষ সারা বাড়ির সব কাজ করতে পারে আর তোমরা কিছুই করতে পার না। যদি সব কাজ পার তাহলে থাক না হয় বিদায় হউ।। আমজাদ সাহেব আজ ছেলের মুখে এত দায়িত্ব বান কথা শুনে মহা খুশি।
রাজ সবাই কে বলল যে যার কাজ আজ বিকালে আমার কাছ থেকে বুঝে নিবে।।
অ-মানব ছাদ থেকে চেয়ে একটু একটু হাসে।
রেবেকা বেগম অ-মানব কে বলল তুমি একটু পারলে রাজকে সময় দিও। আমি আমার দুই মেয়ে নিয়ে বাজারে গেলাম।
জাফর। অ-মানবের কাছে এসে বলল, আমার এত বড় ক্ষতি তুমি কেন করলে। আগে আমি সারা দিন গেইট এ বসিয়ে কাটিয়ে দিলাম। কোন কাজ করা লাগত না। আজ যদি রাজ স্যার কাজ দেয় তবে আমার কি হবে তুমি বল। এটা কি আমার বিশ্বাসের ফল।
— দেখ জাফর তুমি অনেক অলস মানুষ। তোমার জীবন এভাবে নষ্ট করা ঠিক না। এই বাড়িতে তো কোন অফিস নাই। দিন রাত মিলে ছয় সাত জন মানুষ তাদের জন্য একটা কলিং বেইল হলেই চলে। আর তুমি ভাল কিছু শিখ। আলি’র সাথে মিলে গাড়ি চালানো। আমি আলি কে বললেই হবে। কি ভাবে শিখাবে এটা আমার উপর ছেড়ে দাও।
— আলি অনেক পাজি। মুখে মিষ্টি অন্তরে বিষ।
— দেখ জাফর দুনিয়ার সকল প্রানির মধ্যে বিষ আছে। কারো ব্যবহারে বিষ, কারো ভালবাসায় বিষ। কারো আদরে বিষ। কেউ আপন স্বার্থে বিষ দেয় আপন জানের হৃদয়ে। আমি আজ পর্যন্ত কোন প্রানি পাই নাই যার একমাত্র কেঁচো ছাড়া। আর সব প্রানির মধ্য কেন জানি বিষ দেখি।
— অই-মানব তুমি যে সুন্দর করে বল। আচ্ছা গাছের কি বিষ আছে?
— হ্যাঁ। আছে। গাছের যেমন গন্ধ আছে মিষ্টি আছে বিষ ও আছে।
— আমার চাকুরী গেলে আমি শেষ। অ-মানব।
— এই দুনিয়ায় শেষ বলে কোন শব্দ নেই। আজ তোমার শেষ কাল অন্য কারো শুরু। আমার কথা শুনো কাজে লাগবে।
— আমারে আলি গাড়ি চালন শিখাবে না।
— তোমার কাজ জাফর গাড়ি চালনা শিখা। আমার কাজ আমি করে দিব।
— খালাম্মা, স্যার, দুই আপা, রাজ স্যার সবাই কে ম্যানেজ করবেন কিভাবে।
— এটা ও আমার কাজ। তুমি এখন যাও আম্মাজন বাজারে যাবে।
— কেন তুমি বাজারে যাবে না।
— না,
রেবেকা বেগম বলল – বাবা অ-মানব তুমি কিন্তু রাজের সাথে যেও।
— জি আম্মাজান। তবে একটা কথা।
— হ্যাঁ বল। আপনি আলি কে একটু বলে দিবেন জাফর কে যেন গাড়িতে নিয়ে যায় আর গাড়ি চালনা শিখেয়ে দেয়। আমাদের একজন চালক অনেক সমস্যা।
— আচ্ছা তুমি বলে দিও আমার কথা বলে বাজার থেকে আশার পর। এই বাসায় দুই বোন মিলে কেউ কারো সাথে কোন বিষয় নিয়ে কথা বলত না। সারা দিন একজন অন্য জন কে ছোট করত। কিন্তু আজ একটা বিষয়ে দুই বোন মিলে কান্না করছে। কি করা যায় তাই ভাবছে। দুই বোন মিলে অ-মানব কে ডেকে আনলো।
— ছোট আপা বড় আপা আমাকে ডেকেছেন।
— পারু বলল অ-মানব ঐ বিষয়টা আপার সাথে আলাপ করেছি। আপা বলল দুলা ভাই নাকি একদিন মিতার শরীরে হাত দিয়েছিল। আসলে এটা কি? একটা কাজের মেয়ে যদি কিছু হয়। আমারা সমাজে মুখ দেখব কি ভাবে?
—- আপা আপনাদের স্বামীরা মনে করে আপনারা বোকা মেয়ে। আর তারা যা বলে তাই বিশ্বাস করেন। যখন টাকা চায় তখনেই আপনারা আপনার বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে দেন। আপা টাকা দিয়ে হাতি পোষা যায় স্বামী না। স্বামী কে স্বামীর মত মানুষ মানে পুরুষ মানুষ হতে দিন।
— আমারা কি করব একটা বুদ্ধি দাও।
— রাজ ভাইয়ের সাথে কথা বলুন। হাজার হলেও আপনাদের ভাই। ভাই বোন হল স্রষ্টার নিয়ামত। এমন এক সম্পর্ক যা কোন দিন ভাঙা যায় না। ভাই কে সব খুলে বলুন। ভাই কে বলে শুনন।।
— কিন্ত রাজ তো আমাদের সাথে কথা বলে না। ওর চোখ দেখলেই ভয় লাগে।
— ভাইয়ের জন্য কিছু রান্না করুন। দুই জন মিলে কাছে যান। মাথায় হাত দিয়ে ঠিক কান্না করে এভাবেই বলুন। বাকি তা আমি দেখছি।।
অ-মানবের কথায় অবাক হয় দুই বোন। তারা খুব খুশি হয়। জিবনে কেউ এভাবে কোন দিন বলে নাই।
কাজের মেয়ে মিতা আজ একা একা ছাদে বসে আছে। কোন কিছু কিছু কাজ নেই সময়ের কাজ সময় শেষ করে ফেললে এর কিছুই করার থাকে না।
রেবেকা বেগম বাজার থেকে চলে এসেছে মিতা কে ডেকে বাজার গুলো দেখতে বলল এর বলল মিতা আগামী মাস থেকে আমার সাথে বাজারে যাবি।
পারু দুলাল কেউ কারো সাথে কথা বলে না। দুলাল সেই ঘটনার পর থেকে খুব মানসিক ভাবে স্ত্রীর কাছে খুব ছোট হয়ে আছে। পারু স্বামীর কাছে বসে বলল যা হবার হয়েছে। মানুষের জিবনে অনেক ভুল হয়। অ-মানব বলেছে যারা ভুল করে তারা মানুষ এর যারা ভুল করে ক্ষমা চায় তারা মহামানুষ আর যারা ভুল করে ক্ষমা চায় না তারা শয়তান। দুলাল বলল আমাকে ক্ষমা কর। আমার ভুল হয়েছে। পারু কান্না করতে লাগলো।
দুলাল বলল। আমাদের মাঝে একটা কাজের মানুষ হল অ-মানব। এই মানুষটা আসলেই পাগল। আমাদের মাঝে সে কিন্তু আমাদের মাঝে কত ভিন্ন।
রাজ তার রুমে বসে আছে কিছু ছবি দেখছে দুই বোন এক সাথে আজ রাজের কাছে
আসলো। রাজ একটু অবাক হল গত কয়েক বছর তাদের বোন কোন দিন ভাল মন্দ কোন কিছুই কোন দিন বলে নাই। লায়লা বলল রাজ ভাই দেখত আমারা পায়েস রান্না করেছি কেমন হল। রাজ হাতে নিয়ে বলল আচ্ছা রেখে যাও পড়ে খাব। পারু বলল একটু খা না এখন।
— না এখন ভাল লাগছে না। পারুর চোখে লায়লার চোখে পানি চলে আসে। রাজ এবার বলল আপু খাচ্চি কান্না করো না। সরি। আমি দুঃখ দিয়েছি তোমাদের।
— লায়লা বলল রাজের মাথায় হাত দিয়ে বলল রাজ তুই ছাড়া বাবা মা ছাড়া আমাদের আপন কে আছে বল। জিবনে ভাই বোন হল আল্লাহর রহমত। আমারা দুই বোন মনে করতাম তুই আমাদের জন্য সমস্যা কিন্তু এই গুলো আমাদের স্বামী, আমাদের স্বামী আমাদের শিক্ষা দিয়েছে। তারা বলে বাবার কাছ থেকে এখন যা নিবে তাই লাভ। কিন্তু আমার বাবার সম্পদ তো আমাদের। এটা বাবার কাছে আর তোর কাছে বলে তো কোন কথা নাই। তোর মানেই তো আমদের। তুই আমার ভাই।
— রাজ বলল কান্না করো না আপু। আমাদের মাঝে কিছু শয়তান চলে এসেছে। মনে রেখ শয়তান সব সময় হেরে যায়। বল তোমাদের জন্য কি করতে পারি।
— এই যে আমাদের বাসার কাজের মেয়ের দিকে তোর দু দুলাভাই এর চোখ পরেছে।
কখন কি হয়। তখন কি মান সম্মান থাকবে।
— আচ্ছা আপু চিন্তা কর না। অ-মানব আসুক। ও আব্বুর বই গুলো গুছিয়ে দিচ্ছে ওর মাথায় অনেক বুদ্ধি ও ভাল চিন্তা। আমি ওর সাথে কথা বলে একটা ভাল কিছু করে দিব যাতে সাপ মরে লাঠি না ভাঙে। এটা মা বাবা শুনলে দুই দুলা ভাই কে খুব খারাপ জানবে। মানুষ মাত্র ভুল হতে পারে। আপু আজ অনেক ভাল লাগলো আমার মনে হয় জিবনে ভাই হিসাবে আমি আজ সত্যি আমার বোনদের ভাই হতে পেরেছি। রাজ ও একটু কান্না করে দেয়। তিন ভাই বোন মিলে চোখের পানি মুছে ঘর থেকে বের হয়।
অ-মানব গেইটের সামনে আসে গাড়ি চালক আলি কে ডাক দেয়।
— আলি এসে বলে অ-মানব ভাই বল কি করতে পারি তোমার জন্য।
— কিছু না। আমার জন্য কি করবে। আমি একটা কথা বলব।
— কি কথা?
— মিতা কে পছন্দ করো। হ্যাঁ বা না বল।
— হ্যাঁ করি।
— বিয়ে করতে চাও।
— হ্যাঁ।
— ওকে। আমার একটা কাজ করলে এই বিয়ে তুমি করতে পারবে।
— অ-মানব ভাই যে কোন কাজ করতে রাজি।
— সত্যি তো।
— হ্যাঁ তিন সত্যি।
— তাহলে আজ থেকে আমাদের জাফর কে গাড়ি চালনা শিখাও। এক সপ্তায় তোমার
বিয়ে ফাইনাল ওকে।।
— জি ওকে অ-মানব ভাই। আজ থেকেই শিখাব।
— যাও তোমার বিয়ে ঠিক করে দিচ্ছি।
গাড়ি চালক আলি দারোয়ান জাফর কে ডেকে বলে জাফর ভাই আজ রাতে আমার সাথে বের হবেন। রাজ স্যার কে নামিয়ে দিয়ে আপনাকে খোলা মাঠে গাড়ি চালানা শিখাব। জাফর আলির কথা শুনে একেবারে থ হয়ে যায়। অ-মানব যাই বলে তাই হয়। এটা মানুষ না কি ভুত।
গাড়ি চালক আলি জাফর কে বলে তোমাকে সাত দিনে পাকা চালক বানিয়ে দিব। আমি মিতা কে খুব পছন্দ করি। অ-মানব যা বলে তাই। আসলে যেমন নাম তেমন মানুষ। জিবনে মানুষ যে কত রকম। এই অ-মানব হল একটা সত্যি কারে মানুষ। জাফর বলে ঠিক বলেছেন কোন কিছুর প্রতি এই মানুষটার কোন লোভ নাই।
আমার সাথে রাস্তায় পরিচয়। একটা পাগলের মত দেখেছি আজ আমাদের সবার মনের কিছু কিছু আশা তার জন্য পুন্য হচ্ছে। এই যে আমি মনে মে গাড়ি চালাইতাম। আজ সত্যি সত্যি একজন চালক হব। এটাই কম কিসের। আলি বলল হা জাফর ভাই আমি তোমাকে দেখতে পারতাম না। আজ তোমার সাথে কথা বলে ভাল লাগলো তুমি গাড়ি চালনা শিখলে আমার কথা সারা জীবন তুমি মনে রাখবে। অ-মানব বলে তুমি যা জান তা অন্য কে জানাও। তোমার জ্ঞান অন্য মানুষ কোন দিন নিতে পারবে না। বরং তা প্রসারিত হবে।
রাজ অ-মানব কে ডেকে বলল কোথায় তুমি হে অ-মানব।
— অ-মানব বলল আকাশ দেখছি।
— তুমি সব সময় আকাশ দেখ কেন।
— এই যে আকাশ এর কোন শেষ নেই। একদিন মানুষ এই পারি দিয়ে আরেক আকাশে বসতি গড়ে তুলবে।
— অ-মানব। সেটা অন্য চিন্তা, কিন্তু একটা বিষয় খুব জটিল।
— কোন টা? দুলা ভাই রা
— আরে হা। তুমি দেখি সব জান।।
— আমি তো অ-মানব। আর অ-মানব যারা তারা সব জানে।
— আচ্ছা বল কি করি?
— মিতা কে আমাদের আলির সাথে বিয়ে দিয়ে দিন ছোট সাহেব।
— কি বলল। আব্বু তো রাজি হবে না।
— রাজি হবে।
— কি ভাবে।
— খালুজান কে বলেন যে মিতার জন্ম পরিচয় আমি জানি। তাই আমি মিতা কে
আমাদের বাড়ির পালিত ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে একটা ভাল কাজ করতে চাই।
— মিতার জন্ম পরিচয় মানে অ-মানব?
— এটা পড়ে বলছি? আপনি শুধু আপনার বাবা কে বলেন এতটুকু।।
— অ-মানব তোমার কথায় অনেক রহস্য।
— ছোট সাহেব মানুষ জীবনটাই একটা রহস্য। মিতা রহস্য টাও এমন কিছু যা। আপানকে মুগ্ধ করবে। তখন চিন্তা করবেন।।
— আচ্ছা আমি আজই বাবা কে বলব তোমার মত করে।।
— হ্যাঁ বলুন। একটা উত্তর তো আসবে ………………।
চলমান —–
অ-মানব-প্রথম পর্ব অ-মানব-দ্বিতীয় পর্ব অ-মানব-তৃতীয় পর্ব অ-মানব-চতুর্থ পর্ব