সেলিনা জাহান প্রিয়ার ধারাবাহিক গল্প: ‘অ-মানব’-(৩৩ তম পর্ব)
‘অ-মানব’-(৩৩ তম পর্ব)
———————- সেলিনা জাহান প্রিয়া
রেবেকা বেগম তার স্বামীর জন্য চা নিয়ে আসছে । আমজাদ সাহেব চা হাতে নিয়ে একি তুমি তো সারাদিন রান্না ঘর এর রান্না ঘর । কি হল আজ কাল ।।
—- কি আর হবে বল ? এটা আমার আগেই শুরু করা দরকার ছিল । তাহলে ছেলে
মেয়েদের উপকারে আসতাম । আজ আমাদের টাকা পয়সা সব আছে কিন্তু আমারা কি সুখী ? এই যে তুমি আমি আমাদের মেয়ে ছেলে ভাল করে দেখ কেউ কারো সাথে কথা বলে না। মেয়েরা তাদের ভাল মন্দ শেয়ার করে না। তারা নিজেরাও নিজেদের সাথে কোন কিছু নিয়ে আলোচনা করে না।
—- দেখ আমি এদের জন্য যা দরকার সব করেছি । আমি আর কি করব । এখন তারা বড় হয়েছে তাদের ভাল মন্দ তারা নিজেরাই বুঝবে ।অ-মানব আসার পর থেকে কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয়।
—- হয়েছে উন্নতি আমি বাজারে যাই , রান্না করি । মেয়েরা রান্না শিখেছে । যে যার কাজ এখন ভাল করে বুঝে নিয়েছে । এটা ঠিক আছে মনের শান্তি ?
—- দেখ আমার মনে অনেক শান্তি আছে । এখন আমি এই বাড়ির প্রতিটা গাছ কে
চিনি । গাছ গুলো আমার সাথে তাদের দুঃখ সুখ শেয়ার করে । এই অ-মানব
গাছে হাছে কিছু পাখির জন্য বাসা করে দিয়েছে । এখন অনেক পাখি আসে ।।
—- মিঃ আমজাদ নিজেকে কেন সব কিছু থেকে দূরে রাখ । এই যে তোমার ছেলে
আসতেছে টাকা নেবার জন্য ।
—- শুন ছেলেরা মায়ের টাকা নেয় ।
—- আমার ছেলে তো কমেই নেয় । তুমি তো মেয়েদের যা দাও তার তুলনায় অনেক
কম ।\
মা আমি একটা কথা বলতে এখানে এসেছি । তা কি বলবি বল ? টাকা লাগবে বাবা ?
—- আচ্ছা মা সন্তানের টাকা টাকা ছাড়া কি আর কিছু লাগে না। আমজাদ সাহেব একটু হেসে বলল তুমি বাপ টাকা ছাড়া কোন সময় আসো না। তাই আর কি তোমার মা বলল ।।
—- আব্বু তোমারা তো কোন দিন কোন বিষয় নিয়ে ডাক না। ভাব ছোট মানুষ কি আর বুদ্ধি ।। রেবেকা বেগম বলল তাহলে বলতে চাও তুমি বড় হয়েছ ?
— না , মা , আমি বড় হই নাই । অ-মানবের মত বলতে হয় । আমি বড় হতে চেষ্টা করছি মাত্র কাকে বড় হওয়া বলে একটু সন্ধান করছি ।
— আরে বাবা রাখ তো ওর কথা ও তো মানুষ না। একটা রোবট । আমজাদ সাহেব
একটু হেসে বলল আরে রোবট না। ও একটা পাগল ।
—- আব্বু আমার কিন্তু পাগল মনে হয় না। মনে হয় ও একটা রহস্য ।। রেবেকা বলল
রহস্য হউক আর যাই হউক আমার খুব ভাল লাগে ।। আর সত্য কথা বলে ।
—- হ্যাঁ মা আমি এমন একটা সত্য বিষয় নিয়ে আসছি আজ । টাকার জন্য না।
—- তা কি বিষয় বল ।
—- প্রশ্নটা মা তোমাকে না। বাবাকে । তবে তুমি শুনবে কিছু বলবে না। আমি আমার
বাবার সিদান্ত চাই ।।
—- আচ্ছা বল আমাকে আমি শুনছি । তোমার মা আজ কিছুই বলবে না। আজ বাবা
ছেলের মধ্য কথা হউক ।।
—- তাহলে তো আমি অনেক লাকি ।
—- বাপ লাকি হলে ছেলে লাকি হয় ।
—- তাই আব্বু
—- হ্যাঁ ।
—- তাহলে আব্বু তোমার বাবা তো এত টাকা ছিল না। তুমি লাকি কি ভাবে ?
—– আমার বাবার ছিল না। আমার আছে । তাই তুমি লাকি আমি না।
—– মনে রেখ যার বাবার আছে সেই ছেলে লাকি ?
—– আচ্ছা একটা কথা আজ ১৫ বছর আগে একটা মেয়ে বাসায় নিয়ে আসলে
বললে কাজ করবে । কিছু দিন লিখা পড়া করালে । এই মেয়ে টার বয়স এখন
২১ বছর । আমি কোন দিন এই মেয়েটার কেউ খবর নিতে দেখি নাই । মেয়েটার
বাবা কে মা কে ? কোথায় বাড়ি ? এমন কি মা পর্যন্ত না। রেবেকা বেগম বলল
সেটা তোমার জানা দরকার নাই ।
—– মা আমি আগেই বলেছি তুমি কোন কথা বলবে না।
—– রেবেকা দেখলে আজ তোমার ছেলে কথা বলা শিখেছে । তা ওর পরিচয় তো
তোমার জানা দরকার নাই ।
—- না বাবা আছে ! আমি এই মেয়েটাকে বিয়ে দিতে চাই ।
—- কার সাথে বিয়ে দিবে
—- আমাদের গাড়ি চালক আলি সাথে ।
—- না এটা সম্ভব না ।
—- কেন না ।
—- আমি সব কেনর উত্তর দিতে বাধ্য নই ।
—- তাহলে কি কোন সত্য গোপন হচ্ছে ।
—- দেখ তুমি আমাদের সন্তান । ও কারো না কারো সন্তান । তাই তোমার
জানার ইচ্ছা যেন তোমার সম্মান নষ্ট না করে ।
—- আচ্ছা থাক জানতে চাই না। কিন্তু বিয়ে দিতে চাই ।
—- না ওর সাথে না। এটা নিয়ে পড়ে কথা বলব ।
—- যখনি বল । কিন্তু তাড়াতাড়ি বল । আমি জানতে চাই কে এই মিতা ?
রাজ রুম থেকে চলে যায় । আমজাদ সাহেব বলল রাজ তো এ বিষয়ে কোন কথা বলার না। তুমি কি বল ?
—– আনি আগেই বলেছিলাম । কিন্তু তুমি মেয়েটা কে নিয়ে চলে আসবে কে জানত ।
—– হ্যাঁ না আনলে কোন উপায় ছিল না।
—- আমি আগেই বলেছিলাম মেয়েটা কে লিখা পড়া শিখাই । তুমি বললে না । এখন
কি করবে মিঃ আমজাদ সাহেব । আমার বিজ্ঞ স্বামী ।
—- বিষয় তা একটু চিন্তার ।। তবে রাজ কেন আজ এই প্রশ্ন করলো ।
—- দেখ কেঁচো খুরতে যেও না। পড়ে সাপ আসবে । আমার ছলে আমি জানি তো।
তোমার মত খুব জেদি হয়েছে । একটা কিছু বের করতে হবে । আমি দেখচি
কি করা যায় ।।
অ-মানবের কাছে মিতা এসে বলল – এই অ-মানব । এই বাড়িতে আজ কি হয়েছে ।
—– কেন রে মিতা ।
—- সবাই চুপ চাপ যে । এর সব কেমন জানি থেমে গেছে ।
—– মিতা ঝড় হওয়ার আগে অনেক কিছু হয় । মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে এখানেই
বড় মিল । একটা ঝড় আসবে এই ঝড়ে যে টিকে থাকবে সেই মানুষ ।
—- তোমার কথা অ-মানব আমি কিছুই বুঝি না।
—- তাহলে কি বুঝ ।
—- কাজ করব খাব । জীবন যাবে জীবনের মত করে ।
—- আলি কে কি পছন্দ হয় ।
—- অ-মানব তুমি আসলেই একটা পাগল । আমি ওরে খুব ভয় পাই । আমার দিকে
কেমন করে জানি চায় । তবে দুই দুলা ভাই অপেক্ষা ভাল ।
অ-মানব একটু হেসে বলল মিতা যাও তোমার সেই গানটা বারান্দায় যেয়ে গাও ।
—- না আজ গাইব না। অনেক গরম । এত গরমে জ্ঞান ভাল লাগে না।
—– তুমি জ্ঞান গাইলেই বৃষ্টি হবে ।
—- কি যে বল তুমি । আমি জ্ঞান গাইলেই বৃষ্টি হবে । ঐ যে রাজ ভাই কোথায় থেকে
জানি আসছে । আজ চেহারায় খুব মেঘ । আমি যাই পড়ে একটা ধমক দিবে ।।
মিতা চলে যায় । অ-মানব তার দিকে চেয়ে থাকে ।
রাজ অ-মানব কে দেখে একটা হাসি দেয় । অ-মানব বলে কি করে হাসলেন ছোট সাহেব । আপনার মুখে তো হাসি আসার কথা না। আমি জানি আপনি খুব খারাপ
অবস্তায় আছেন ।
—- তুমি একটা মানুষ বলত হে
— আমি তো আগেই বলেছি । আমি মানুষ হতে পাড়ি নাই । মানুষ হাবার মত একটা
স্কুল পাই নাই ।
—- আর কোন দিন পাবেও না। এই আমি একটা মানুষ কারো সাথে মিশতাম না।
একটা প্রেম করতাম সেটাও তোমার দুষ্ট চালে শেষ । ছবি তুলতাম সেটাও
তোমার জন্য আজ অফ । এখন বল আমি কি করি ।।
—- মিতার বিয়ে নাকি দিতে পারবেন ।।
—– অ-মানব কবি এখানে নীরব । আর আমি কিন্তু বলতে পাড়ি নাই । যে আমি
মিতার পরিচয় জানি । যদি আব্বু বলে কি জান । আমি তখন কি বলব ।
—– বাহ দারুন ছোট সাহেব । মাথায় বুদ্ধি হয়েছে । এই যে আপনিরা গরীব মানুষের
ছবি তুলে কত মানুষ এনে ছবি মেলা করেন । প্রাইজ পান । আপনি কি বলতে
পারেন এই প্রাইজ ঐ সব গরীব মানুষের কি উপকারে আসে । একদিন দেখলাম
পল্টন মোড়ে একটা বাসে আগুন দিল । একটা মানুষ পুড়ে যাচ্ছে । আর কিছু
মানুষ মডেল দেখার মত পুড়ে যাওয়া মানুষের বিভিন্ন এঙ্গেলর ছবি তুলছে ।
আচ্ছা বলুন ছবি তুলা দরকার না তাঁকে বাঁচানো দরকার ।
—– অ-মানব এই জন্যই তুমি মানব হতে পার নাই । যারা ছবি তুলছে তারা মানুষ
সমাজে তাদের অনেক দাম । তোমার কোন দাম নাই । তুমি হলে কাজের ছেলে
আব্দুল্লা ।
—- ছোট সাহেব এই আব্দুল্লা রা আছে বলেই । এই দেশ কত ডলার পায় , যা চিন্তা
করা যায় না।
—- আচ্চা থাক সে কথা । এখন বল অ-মানব । মিতা নিয়ে খুব ঝামেলা আছি ।
মিতা আসলে কি আমি জানতে চাই ?
——আপনার মা কি বলে ?
—– সবাই এক রকম । মা তো আব্বুর কথা বলবে না।
—- আচ্ছা কেউ না বললে আমি বলে দিব ।
—- মানে তুমি কি করে বলবে ?
—– ছোট সাহেব আপনি যদি বলেন চাঁদ তোমার আলো কে দেয় । চাঁদ বলবে সূর্য ।
কিন্তু সূর্য কে যদি বলেন আলো কোথায় পাও । সূর্য কি বলবে ?
—– সূর্য বলবে এটা তার নিজের আলো ।
—– না । সূর্য এত আলো কেউ না কেউ দিয়েছে । সব কিছুর শেষ আছে । এক দিন
এই সূর্যের আলো শেষ হবে । তাই বলি সব কিছুর শেষ আছে । জীবন মানে
কিন্তু শুরু মরণ মানে অনন্ত কাল শুরু ।
—– সুন্দর কথা । আমি আলোকিত হতে চাই অ-মানব । আমি জানতে চাই
অ-মানব ।
—– হা জানা আপনার দরকার । আপনার বাবা অনেক আগে ডাইরি লিখত ।
যদি একটা খুজে পান । সেই খানে দেখুন ।
রাজ বলল আচ্ছা বাবা তো আজ কাল পড়ার রুমে যায় না। বাবার সব কিছু ঐ খানে
থাকে । অ-মানব মানুষ এমন কেন বলত । সব কিছুতেই কেমন জানি একটা রহস্য ।
অ-মানব বলল আমার কাজ আছে । মানুষ তখনেই রহস্য করে যখন মজা পায় বা স্বার্থ থাকে । আর একটা কথা যদি কোথাও না পান তবে আপনাদের গ্রামে চলে যাবেন । আপনার গ্রাম চিনে বাড়ি চিনে ভীমরুল খাঁ । ওর বাড়ি নান্দাইল আর আপনার গ্রামের বাড়ি তার খুব কাছেই । জাম তলা । আরে অ-মানব আমি যেখানেই যাই তুমি
সাথে যাবে ।
রাজ বসে বসে বই পড়ছে । রেবেকা বেগম মিতা কে ডেকে বলল । আচ্ছা মিতা তকে
তোর খালুজি ডাকছে । মিতা খালুর কাছে আসতেই বলল তোমার খালা কে ডেকে নিয়ে আসো । রেবেকা বেগম বলল ডাকতে হবে না। আমি এসেছি । আমজাদ বলল
মা তোমার কি এই খানে খুব কষ্ট হচ্ছে ।
—- না খালুজান । তা কেন ।
—- তোমার কি বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে ।
— না । কিভাবে মনে পড়বে । আমার তো তাদের কথা মনে নাই । আর আজ হটাত
এই কথা বলছেন ।
—- না মা তুমি বড় হয়েছ । তোমাকে বিয়ে দিতে হবে না।
— মিতা চুপ করে থাকে । রেবেকা বলল রাজ কি তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেছে ।
—- না ।
—- রাজ যদি তোমাকে জিজ্ঞাসা করে মিতা তোমার বাড়ি কোথায় । তখন বলবে
তোমাকে সিলেট রেল স্টেশন থেকে পেয়ে এনেছি । মনে থাকবে তো ।
—- জি মনে থাকবে ।
—- তোমার বিয়ে আমাদের পছন্দ মত পাত্রের কাছে দিব । আর গাজি পুড়ে আমার একটা বাড়ি আছে ঐ খানে ১০ কাঁটা জায়গা আছে ঐ টা তুমি পাবে । আমি আমজাদ
সাহেব যা বলি তাই করি । আর কিছুই তুমি বলবে না। বিকেলে তোমার খালা তোমাকে নিয়ে মার্কেটে যাবে । আর আজ থেকে তুমি রান্না ঘরের সাথে রুমে থাকবে না। আমাদের ঐ পাশের রুমে থাকবে । যাও এখন আমাদের জন্য চা নিয়ে আসো ।
লায়লা আর পারু আমজাদ সাহেবের কাছে এসে বলল আব্বু মিতা নাকি তোমাদের
পাশের রুমে থাকবে । তাহলে খুব ভাল হয় আমাদের জন্য ।
রেবেকা বলে তোমরা তোমাদের রুমে যাও । সব কিছু নিয়ে আমাদের মেয়েরা খুব বাড়াবাড়ি করে ।
রাত ১০ টা রাজ তার বাবার লাইব্রিতে প্রবেশ করে খুজতে লাগলো বাবার ডাইরি ।
চলমান———-
অ-মানব-প্রথম পর্ব অ-মানব-দ্বিতীয় পর্ব অ-মানব-তৃতীয় পর্ব অ-মানব-চতুর্থ পর্ব