সেলিনা জাহান প্রিয়ার গল্প: ‘অ-মানব’-(৩৯ তম পর্ব)

 

অ-মানব-৩৯-তম-পর্ব

———————-  সেলিনা জাহান প্রিয়া

 

আজগর আলি বয়স ৭০ বছর । থাকে তার নিজ গ্রামে । বাংলা ঘরের ভিতরে বসে জানালা দিয়ে বাহিরে দিকে চেয়ে আছে । কিন্তু তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে । মাঝে মাঝে আবার একটু হাসে । বয়স হয়েছে বুঝা যায় কিন্তু মনে অনেক সাহস । তার তিন ছেলে দুই মেয়ে । আজগর আলির সম্পদ অনেক । ধানের জমি আর বাড়ি নিয়ে একশত পাখি জমি । গ্রামের মানুষ তাকে আজগর আলি বললে এক নামে চিনে । গত ৩ বছর যাবত আস্তে আস্তে তার চোখের সমস্যায় এখন আর চোখে দেখে না।
কথায় বলে চোখ নাই যার কিছু নাই তার । বাংলা ঘরের সাথে বড় একটা জানালা । জালানার পাশ দিয়ে একটা রাস্তা বাজার হয়ে শহরের রাস্তার সাথে মিশেছে । আজগর আলি বেশির ভাগ সময় আই জানালর পাশে বসে থাকে । যেই যাই একটা জানলার পাশ দিয়ে একটা সালাম দেয় আজগর আলি কে । আজগর আলি সেই সালামের উত্তর দেয় । কণ্ঠ দিয়ে সে মানুষ চিনে। মাঝে মাঝে বিকালে একটু হাটতে বের হয় হাতে একটা লাঠি নিয়ে । একদিন পড়ে গিয়ে খুব ব্যথা পায় । তার পড় বেশি বাহিরে যায় না। চোখের ডাক্তার দুই বার দেখাইছে ছেলে কে নিয়ে । খালি চোখের ড্রপ দেয় । ডাক্তার বলছে আর ভাল নাকি হবে না। আসলে ছেলেরা একটু চালাকি করে ভাল ডাক্তার দেখায় নাই । কারন জতদিন চোখ ভাল ছিল আজগর আলি ছেলেদের জমির আয় থেকে কিছুই দিত না।তাই ছেলেরা বাপের প্রতি একটু বেশ রাগ হয়ে আছে । ছেলেরা ভয় পায় চোখ ভাল হলে যদি তাদের বাবা আবার বিয়ে করে । আজগর আলি জানলার পাশে বসে একা একা কাঁদছে আবার হাসছে । অ-মানব আই রাস্তা দিয়ে যাছে । একবার তাকালো আজগর আলির দিকে । আরে এমন করে লোকটা হাসছে আবার কাঁদছে কেন । জানার জন্য অ-মানব জানলার পাশে যায় । অ-মানব বলে সালাম চাচা । এত হাসি এত
কান্না এই বয়সে ভাল না। আজগর আলি বলল বাবা তুমি কে ?
——- আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি এক জন অ -মানব ।
——- অ-মানব তুমি ?
——- জি আমি অ-মানব ।
—— তা মানুষের নাম কোন দিন অ-মানব হয় নাকি ?
—— চাচা আমি মানুষ হতে পারি নাই । আবার অমানুষ হতে পাড়ি নাই । তাই আমি অ-মানব ।।
—— তা তুমি যে মানবই হও । আমার মনে হয় তু,ই । তুমি একজন ভাল মানুষ । তা বাবা কার বাড়িতে এসেছ এই গ্রামে ।
——- না কারো বাড়িতে না। মনের ইচ্ছায় হাটা দিলাম । যে দিকে চোখ যাই সে দিকে যাব ।
—– আরে সময় সময় আমি তোমার মত ছিলাম । তখন আমি যুবক । মনে কি সাহস ? এখন মনে সাহস আছে কিন্তু আমার চোখের জন্য কোথাও যেতে পারি না ।
—— কেন চোখে দেখেন না।
——- চোখে দেখলে কি আর এখন এই ঘরে বসে থাকি । বাজারে গিয়ে দেশের খবর নিতাম ।
—— দেশকে খুব ভালবাসেন তাই না।
—— আরে ভাতিজা দেশ ভালবাসা ইমানের একটা অংশ ।
—— তা চোখ ভাল করান না কেন ।
——- ডাক্তার দেখাইছি ? কিন্তু আমাদের গ্রামের ডাক্তার বলেছে ভাল হবার সম্ভাবনা খুবই কম ।
——- অ-মানব একটু হেসে বলল গ্রামের ডাক্তার যদি এত বড় বিশেষজ্ঞ হত তাহলে তো সে শহরে চলে যেত ।
—— অ-মানব তোমার কি মনে হয় শহরে গেলে চোখ ভাল হবে ।
—— আমি মনে হয় বিশ্বাসী না। আমি কাজে বিশ্বাসী । আগে যাব ডাক্তার দেখাব । ভাল মন্দের মালিক জগত প্রভুর হাতে ।
—– এই জগত প্রভু কি আল্লাহ্‌।
—– হ্যাঁ তাকে যে যেই নামে ডেকে শান্তি পায় । তা চাচা আপনার বৃদ্ধা আঙুলে কাপড় বাঁধা কেন ?
—– আরে আর বল না । ছেলেরা যে কোন সময় টিপ সই দিয়ে আমার সম্পদ তাদের নামে লিখে নিতে পাড়ে । তাই আমি দুই আঙুলে শক্ত করে কাপড় বেঁধে রাখি । জাতে তারা কেউ কোন কাগজে টিপ সই নিতে না পাড়ে ।
—— অ-মানব এই কথা শুনে হাসতে থাকে । বলে আপনি বোকা মানুষ চাচা । খাবারের সাথে আপানকে ঘুমের মেডিসিন দিয়ে দিলেই হয় । বেহুশ ঘুমাবেন । কাপড় খুলে টিপ সহি নিয়ে আবার কাপড় বেঁধে দিবে ।।
——- আরে ভাতিজা তোমার কথা তো একদম ঠিক, আমি তো এভাবে চিন্তা করি নাই । শুধু শুধু গত একবছর বৃদ্ধা আঙুল গুলো বেঁধে কি না কষ্টে আচ্ছি । আসলে এখন কাউকে বিশ্বাস করি না। তাই মনের ভয়ে এই ব্যবস্তা ।
—— তা কান্না করছিলেন কেন ?
—— শুন অ-মানব ভাতিজা । আমার চোখ নষ্ট হবার পড় ছেলের বউরা খুব আদর করত । কিন্তু সব ছেলের বউ খালি যে যার স্বামীর নামে জমি চায় । জমি লিখে দেই না বলে এখন আমি আজগর আলি ওদের কাছে খুব খারাপ ।

cpa add
—— এখন তাদের ইচ্ছা মত যে যা দেয় তাই খাই । কানা মানুষ চোখে দেখি না । আমাকে দেখার মত কেউ নাই । এক মেয়ের কাছে গেলে অন্য মেয়ে ভাবে বাপের জমি নেয়ার জন্য হয়ত আমাকে নিতে চায় । বাপ কে কারো দরকার নাই । তাদের দরকার জমি । আমি খুব কষ্ট করে ১০০ পাখি জমি করেছি বেঁচে থাকতে কাউকে জমি দিব না। এখনি ছেলেরা দেখে না। জমি দিলে কি আর দেখবে ।
—— অ-মানব বলে চাচা এত জমি আপনার কিছু দান করে দেন ।
—— আরে দান করতে মন লাগে । আমি খুব গরীব মানুষের ছেলে ছিলাম । লিখা পড়া জানি না। নিজের নাম লিখতে শিখছিলাম । ১৪ বছর বয়সে ঘর থেকে বের হই । ঢাকা সদর ঘাটে কুলির কাজ করতাম । জাহাজে
খালাসী কাজ করে কোন ভাবে গরীব মানুষ চলতাম । একদিন এক পাকিস্তানীর সাথে জাহাজে করে পাকিস্তান চলে যাই । সেই পাকিস্তান থেকে সেই সাহেবের ভাই সাথে পূর্ব বাংলা আবার আসি । আমি তখন তাদের বাসার কাজ করতাম । দেশে যুদ্ধ লাগে । সেই পাকিস্তানী তাদের টাকার বস্তা স্বর্ণ সব রেখে চলে যায় ঐ বাড়িটা অন্য মানুষ দখল করে । আমি তাদের সেই টাকা আর স্বর্ণ নিয়ে দেশে আসি । তাদের স্বর্ণ গুলো আমি আমাদের জঙ্গলে গাছের নিচে মাটি খুঁড়ে লুকিয়ে রাখি । তার পড় আমি তাদের জন্য আবার ঢাকা যাই । তাদের আমি আর খুজে পাই না। পড়ে শুধু জমি কিনতে থাকি । এমন করে আমি ১০০ পাখি জমি কিনি।
——- চাচা আর গাছের নীচের স্বর্ণ গুলো ।
——- সেই গুলো তুলে তুলে বিক্রি করে দেই । আর বাজারে একটা জমি কিনে মসজিদ করে দেই । কিন্তু কাউকে বলি নাই পাকিস্তানীর টাকা যেন তারা এই মসজিদের নামজিদের দোয়া পায়, তবে আমি কাউকে বলি নাই । গ্রামের মানুষ জানে আমি যুদ্ধ থেকে অনেক টাকার মালিক ।
—— তা এত টাকার মালিক এখন তো মনে হয় খুব কষ্টে আছেন ।
—— কষ্ট কপালে থাকলে আর কি করা । কিন্তু যত কষ্টেই করি তবে জমি কাউকে দিব না।
—– ভাল আপনার জমি গুলি গলায় তাবিজ করে রাখেন ।
—– এটা কোন কথা হল ।
—– যদি এটা কোন কথা না হয় তবে ছেলেদের বলুন তারা কি চায় । বাবা চায় জমি চায় ।যদি জমি চায় তাহলে বলুন তোমরা সিদান্ত নাও কে কোন জমি নিবা । আর যদি আপনাকে চায় তাহলে বলুন আমি তোমাদের নিজের পছন্দ মত জমি দেব । কেউ কোন কথা বলবে না। আমি আজ যাই কাল যাওয়ার পথে দেখে হবে আমজাত আলি চাচা । ভাল থাকুন ।
অ-মানব আবার হাটতে লাগলো । সামনেই জামতলা বাজার । বাজারের সব মানুষ একটা কল থেকে পানি নেয় । অ-মানব সেই কলের কাছে গিয়ে দেখে এক লোক গোসল করে । অ-মানব আকাশের দিকে চেয়ে বলল যেখানেই আমি গোসল করতে আসি তখনেই দেখি বৃষ্টি হবে। কলের সামনে বাজারের অনেক লোক জন তার দিকে চেয়ে একটু হাসল । আকাশ পরিষ্কার যে গরম এর মধ্যে বৃষ্টি হয় কিভাবে ? লোক জন বলল আপনি কি গণক ঠাকুর যে আসমান দেখে বৃষ্টির কথা বলতে পারেন ।
অ-মানব একটু হেসে বলল আপনি যা পারেন আমি তা পারি না। আবার আমি যা পরি আপনি তা পারেন না।যদি বৃষ্টি হয় তাহলে কি আমারে খিচুড়ি খাওবেন । লোকটা বলল যদি না হয় তবে আপনি কি খাওয়াবেন । অ-মানব বলল যদি না হয় তাহলে আমি আপনাকে তাজা মাছ নদী থেকে ধরে এনে দিব । বাজারের সাথেই নদী
তো । আমি নদী থেকে ভাল মাছ ধরতে পারি ।
—– তা ভাল মাছ ধরতে পার তা তোমার পোশাক দেখে বুঝা যায় ।
—– আপনি ঠিক বলেছেন সমাজের ভাল পোশাক যারা পড়ে তারা তারই সমাজে যত রকমের খারাপ কাজ করে । আমি খারাপ পোশাক ওয়ালা কোন মানুষকে খারাপ কাজ করতে দেখি নাই । বরং কোট টাই ওয়ালা মানুষ গুলো সব দুর্নীতি করে । ঠিক কি না ।
বাজারের সব লোক একসাথে হেসে উঠল । একজন বলল ভাই যদি বৃষ্টি হয় তাহলে এই গেদু মাহাজন আপনাকে খিচুরি খাওয়াতে হইবে ? অ-মানব বলল ভাই কেউ কাউকে খাওয়াতে পাড়ে না। যে যার তগদিরের খাবার খায় । বাজারে মধ্যে মহসিন মিয়ার ঔষধের দোকানের সামনে একটা বেঞ্চ আছে সেখানে গিয়ে বসল । সবাই অ-মানব কে দেখছে । একজন বয়স্ক মানুষ এই রোদের মধ্যে খালি পায়ে বাজারে এসেছে । গরম মাটিতে পা ফেলতে খুব কষ্ট হচ্ছে । অ-মানব তার পায়ের জুতা গুলো হাতে নিয়ে সেই বয়স্ক মানুষের পায়ের কাছে গিয়ে তাকে জুতা পড়তে দিল । বয়স্ক মানুষ বলল
—– কে তুমি বাবা । আমাকে তোমার পায়ে জুতা গুলো আমাকে পড়িয়ে দিলে ।
—– আমি একজন পাগল মানুষ । দেশে দেশে মানুষের সুখ দুঃখ দেখে বেড়াই । আপনার পা গরমে খুব কষ্ট পাচ্ছে । তাই দিলাম আপনাকে ।
—– বাবা তুমি কি পায়ে দিবে ।
—– আমার জুতা লাগবে না। একটু পড়ে বৃষ্টি হবে । আপনি এই গুলো নেন । অ-মানবের বৃষ্টির কথা শুনে ঔষধের দোকান দার বলল – আজ পাগলের খবর আছে । বৃষ্টি না হলে গেদু মিয়া নদীতে নামাবে কিন্ত মাছ ধরতে!
অ-মানব বলল অনেক দিন খিচুড়ি খাই না। যদি গেদু মিয়া না খাওয়ায় তবে আমি কি আশা করি ডাক্তার সাহেব আপনি খাওয়াবেন ।
—– ঠিক আছে তাই হবে । এই বাজারের কেউ না কেউ খাওয়াবে । বেঞ্চে অ-মানব বসে পা নারাচ্ছে । যে যাই সে অ-মানব চেয়ে দেখে । গ্রাম বলে কথা । গেদু মিয়া দূর থেকে বসে অ-মানব কে দেখে আর তার ধানের আড়তে এক লেবার কে বলে ঐ পাগল কে নদীতে নামিয়ে মাছ ধরাব । এক দিন নদীর পানিতে চুবাইলে পাগলামি ভাল হয়ে যাবে ।
কিছু সময়ের মধ্যে আকাশ অন্ধকার হয়ে বাতাসের সাথে মেঘ আর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল বাজারর সব লোক বৃষ্টির হাত থেকে বাচার জন্য বিভিন্ন দোকানে আশ্রয় নিল ।
অ-মানব হাসতে লাগলো ডাক্তার মহসিন বলে কি কাণ্ড সত্যি ই তো বৃষ্টি । আবার পাগলে খাইছে গেদু মিয়ারে । বৃষ্টি ঝুম ঝুম পড়ছে । অ-মানব খালি পায়ে বৃষ্টির মধ্যে নেমে পড়ে হাত আবার উপরে দিকে তুলে বলে হে প্রভু আমাকে শান্তি দিলে । বৃষ্টির মধ্যে একটা ছোট ছেলে এসে অ-মানব কে দুইটা পেয়ারা দিয়ে বলল – তুমি সত্য বলেছ কলের পাড়ে এই নাও এই পেয়ারা গুলো খাও । পেয়ারা হাতে অ-মানব গেদু মিয়ার ধানের গদির সামনে যায় । একটা পেয়ারা গেদু মিয়ার হাতে দিয়ে বলে আপনার জন্য মাছ নিয়ে আসি । বৃষ্টির মধ্যে অ-মানব নদীতে নামে । একটা ছোট নদী । অ-মানব ডুব দেয় আর উঠে । বাজারের মানুষ অ-মানব কে দেখছে
আর সবাই বলছে বেটা একটা পাগল । এই ভাবে ডুব দিয়ে মাছ পাওয়া যায় ।
কিন্তু অ-মানব একটা বেশ বড় বয়ালের ঘার ধরে উপরে উঠে আসছে । সবাই এত বড় মাছ দেখে অবাক । গেদু মিয়াকে বলল মাছটা আপনার ………।।কিন্তু খিছুরি আমার চাই ………………………

চলমান———-

অ-মানব-প্রথম পর্ব    অ-মানব-দ্বিতীয় পর্ব    অ-মানব-তৃতীয় পর্ব    অ-মানব-চতুর্থ পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!