সেলিনা জাহান প্রিয়ার গল্প: ‘অ-মানব’-(৪১ তম পর্ব)
অ-মানব-৪১-তম-পর্ব
————————সেলিনা জাহান প্রিয়া
অ-মানব ঘুমিয়ে আছে । অ-মানব বেশ কিছু দিন যাবত সময় পেলেই ঘুম দেয় । পাশের মসজিদ থেকে মাইকে আজান ভেসে আসছে । আজান শুনলে ও মানব আর ঘুমাতে পাড়ে না। তাই ঘুম থেকে উঠে বসেছে । একটু হাটতে বের হল । আজ অ-মানবের পায়ে জুতা নেই । পরনে একটা কালো গেঞ্জি আর লুঙি । হাটতে হাটতে চলে আসছে একদম বাজারের কাছেই । চেয়ে দেখে অনেক মানুষ এত সকালে বসা । অ-মানব বলল ভাই এত মানুষ এত সকালে এই খানে । একজন বলল ভাই আমরা কামলা মানুষ । যার যার জমির জন্য কামলা লাগে তারা সকালে এই খান থেকে কামলা নেয় । এখন তো ধান লাগানোর সময় তাই !! অ-মানব তাদের সাথে লাইনে বসল । দুই একজন বলল আপনি মিয়া কালকে না বৃষ্টির মধ্যে নদী থেকে মাছ ধরলেন ।
অ-মানব একটু হেসে বলল মানুষ মাত্র কাজে থাকলে ভাল থাকে । সবাই বসে আছে মানুষ আসছে কামলা যে যার মত দাম করে নিয়ে যাচ্ছে । মেম্বার এসে বলল ঐ মিয়া বাঁশ কাটতে পার ।
—– জি ভাই পাড়ি
—– সারা দিন কত নিবে ।
—– বাঁশ কাটার জন্য কি সারা দিন লাগবে । কতটা বাঁশ ।
—– প্রায় ৫০ টা ।
—– তাহলে তো দুই তিন ঘণ্টা লাগবো ।
—– মনে হয় তুমি খুব কাছের মানুষ ।
—– অ-মানব বলল ভাই কাজ দেখে পয়সা দিয়েন ।
ভোর ছয়টায় অ-মানব বাঁশ কাটতে লাগলো । তিন ঘণ্টায় সব বাঁশ কেটে সাইজ করে একদম পরিষ্কার করে ফেলেছে । ঠিক নয়টার সময় ৩৫০ টাকা মজুরি নিয়ে সে ডাক্তারের বাড়ির দিকে রওনা দিল । অ-মানবের কাজ দেখে যে তাকে নিয়েছিল সে কিছুটা অবাক হয়ে গেল । এটা কি মানুষ না দানব । কোন ডর ভয় নাই । সে আর কিছুই বলিল না। অ-মানবের কাজ দেখে সে খুবেই মুগ্ধ । ডাক্তারের বউ খুব কান্না করছে তার তার তিনটা সুখের মুরগী মারা গেছে । রাতের বেলায় ভাল মুরগী খাচায় রাখল সকাল বেলা মরা । কয়দিন আগে একটা দুধের গরু মারা গেল । ডাক্তার অ-মানব কে বলিল সকালে কোথায় গিয়েছিলে ।
—– ডাক্তার সাব কামলা দিতে । উত্তর পাড়ায় । সকাল বেলা ৩৫০ টাকা কাজের বিনিময় পেলাম । এক জুরা ভাল দেখে জুতা কিনব । তা আমার বোন এমন করে কানছে কেন ? ময়না মা তুমি আমাকে বলত কি হয়েছে । পাঁচ বছরের ময়না বলতে লাগলো – আম্মুর তিনটা সুন্দর মুরগী আজ মারা গেল ।
অ-মানব বলল আফা আপনে কান্না কইরেন না। আমি জুতা পরে কিনব । আজ আপনার জন্য এই টাকা দিয়ে মুরগী কিনে আনব । আপনি কাদলে ময়নার খুব কষ্ট হয় । ডাক্তার বলল – কি যে হইছে কিছুই বুঝতে পারছি না । গত কয় দিন আগে আমার একটা গরু ও মারা গেল । অ-মানব বলল আচ্ছা দেখছি এই ভাবে মরে যাওয়ার রহস্য কি ? মরা মুরগী গুলো হাতে নিয়ে দেখছে । আবার বলল অ-মানব খুবই চিন্তার বিষয় । কারন এই মুরগী গুলো কোন বিষ ধর সাপে মেরেছে । সাপ কিন্তু ডিম খেতে পছন্দ করে । ডাক্তার বলল দেখি । হ্যাঁ তাই তো মুরগীর সারা শরীর নীল হয়ে গেছে । অ-মানব বলল ভাই জান চিন্তা করবেন না। আমাকে একটা দা দেন আগে একটা বিশেষ কায়দায় লাঠি বানাই । কোদাল আর সাপল রেডি করুন । অ-মানব বলল সাপ আজ আমি বের করবই । ডাক্তার বলল পাগল নাকি তুমি । সাপ থাকলে কি একদিন ও চোখে পড়ত না? ডাক্তারের বউ বলল ভাই তুমি আর কষ্টের মধ্য মজা কর না। আমার বাড়িতে সাপ আসবে কেন ?
অ-মানব বলল আমাকে আমার কাজ করতে দেন । ডাক্তার বলল আমি বেদে ডেকে আনি তারা বাঁশি বাজিয়ে সাপ বের করতে পাড়ে ।
অ-মানব বলল আপনি ডাক্তার হয়ে এদের বিশ্বাস করেন ? বেদেরা সব সময় মানুষকে বোকা বানায় । বেদেরা যদি এত কিছুই পারত তাহলে মানুষের কাছে বেদেদের আসতে হত না। ডাক্তার ভাই আপনি চিন্তা করবেন না । আমি দেখছি । এর মধ্যে গেদু মিয়া এসে হাজির সাথে তার বউ । গেদু মিয়া বলল কি ডাক্তার কি হল ?
—– আরে কিছু না আর গেদু বল না ! সকালে তিনটা বড় মুরগী মারা গেল । কয়দিন আগে একটা গরু মারা গেল ।
—- বল কি ? কি ভাবে ?
—– আমি জানি না । তবে মেহমান বলছে সব কিছুই নাকি সাপে কাটছে ! গেদুর বউ বলল টা ঐ মানুষটা কোথায় ?
অ-মানব হাতে একটা লাঠি নিয়ে লঙ্গি কাছা দিয়ে বলল আমি এই খানে । কিছু বলবেন ।গেদু মিয়া বউ বলল আমাকে চিন ?
—— পরিচয় দেন ।
—– আমি ঐ গেদু মিয়ার বিবি ।
—— তা তো বুঝলা তা আপনার নাম্বার কত ?
—– নাম্বার মানে ?
—– গেদু সাহেবের কত নাম্বার বিবি ?
—– এর মানে কি ?
—– গেদু মিয়া যে রাতে বোয়াল মাছ নিয়ে গেল । মাছটা কেমন সাধ ছিল ?
—— কথা বদলাও কেন ?
—– দেখুন কথা বদলাই না।এখন আমি সাপ ধরব ।
—– এই বাড়িতে কোন জঙ্গল নাই । সাপ কি আকাশ থেকে আসবে ?
—— তাহলে আপনি গত কালের মত বাজি ধরেন ।
—— ঠিক আছে বাজি ? যদি সাপ না পাও তাহলে কি ?
—— আপনি যা বলবেন । তাই হবে
—— সাপ না পাওয়া গেলে আগামী এক বছর আমার বাড়িতে বিনা বেতনে থাকতে
হবে ।
—– খাবার দিবেন তো ? আমি আবার না খেয়ে থাকতে পারি না। গেদু মিয়া বলল আর সাপ পাইলে কি হবে ? এটা আগেই বলে নাও । অ-মানব কিছুটা হেসে বলল আমি যাযাবর মানুষ তাই কাউকে চাকর রাখতে পারি না। আমার সর্ত দুই টা । আপনার আগের বউয়ের হাতে খিচুড়ি । আর আপনার সৎ মায়ের সাথে একটা দেখা আপনাকে নিয়ে ।
—– গেদু মিয়ার বউ বলল ঠিক আছে তুমি তোমার কাজ শুরু কর সর্ত মঞ্জুর । গেদু মিয়ার বউ আর গেদু মিয়া একটা চেয়ারে বসল । ডাক্তারের বউ -মানব কে বলল ভাই তুমি সাবধানে সাপ খুঁজ । আমার খুব ভয় লাগছে । গ্রামের অনেক মানুষ এসেছে সাপ ধরা দেখতে । অ-মানব । বাড়ির পিছনে গেল । নাক দিয়ে মাটির গন্ধ নিতে লাগলো । আর একটু একটু করে সামনে বা পিছনে যেতে লাগলো । অ-মানবের কাজ কাম দেখে আজ সবাই হাসছে । গেদু মিয়ার বউ মুখে পান দিয়ে বলল যাই হউক একটা মাগনা চাকর পাওয়া যাবে । মনে মনে বলে আমি গফুর ডাকাতের মেয়ে । আমাকে চিনে না। এক সময় অ-মানব বলল সাপ তো একটা না। বেশ কয়েকটা । গরুর ঘরের পিছনে এই মাটির ডিবি তে আছে । এই বলে অ-মানব মাটি কাটতে লাগলো । দুই কোপ দেয়ার পড়ে একটা বড় ইদুরের সুড়ঙ্গ দেখতে পেল । অ-মানবের সাথে আরও দুই জন মাটি খুড়তে লাগলো । কিছু সময়ের মধ্যে গর্ত থেকে শব্দ আসতে লাগলো ফুস ফুস । সবাই চিৎকার দিয়ে উঠল । অ-মানব একে একে বিশেষ কায়দায় তিনটা জাতি সাপ বের করে আনলো । সাপ দেখে সবাই অবাক । কেউ কেউ বলছে এটা লোকটা মানুষ না কি ডাকাত ? কত সাহস দেখছ একে একে তিনটা জাতি সাপ ধরে ফেলল । একজন সাপ মারতে চাইলে অ-মানব বলল কেন মারবেন ?
আপনারা ভাল কর চিন্তা করুন । আমাদের ফসলের জমিতে ইঁদুর কত ক্ষতি করে ফসলের । এই সাপ বেশীর ভাগ সময় ঐ সকল ইঁদুর খেয়ে আমাদের উপকার করছে । সাপের শরীরের আঘাত না লাগলে সাপ আমাদের কামড় দেয় না । অ-মানব সাপ নিয়ে নদীর দিকে হাটতে লাগলো । গ্রামের মানুষ অ-মানের পিছনে । একজন বলছে এই মানুষটার কোন সাধারন মানুষ না । মনে হয় সাথে জীন আছে । নদীর পাড়ে একটা বেশ বড় একটা জঙ্গল সেই খানে অ-মানব সাপ গুলো ছেড়ে দিল । ডাক্তারের বউ বলল আল্লাহর কি রহমত আমার মেয়ে সব সময় ঐ জায়গায় খেলত । ডাক্তার বলল কোথায় ঘর কোথায় বাড়ি আল্লাহ্ যেন আমার দিকে তাকাইল । গেদু মিয়া বলল ডাক্তার আমি যাই । গ্রামের মানুষ এক সাথে বলল ঐ মানুষ না আসা পর্যন্ত যাওয়া যাবে না। অ-মানব এসে ডাক্তারের বউ কে বলল আপা খুব খুদা লেগেছে । ডাক্তারের বউ বলল তোমার জন্য আমি বালতিতে পানি ভরে রেখেছি । এই নাও গামছা যাও ভাই আগে গোছল করে এসো । অ-মানব গেদু মিয়া বলল আপনারা চলে যান । আপনাদের কিছুই করতে হবে না। গেদু মিয়া ভাই আমি কিন্তু সাপ মারি নাই । খুব আদর করে জঙ্গলে ছেড়ে এসেছি । খুব ভাল সাপ তাদের যে হেতু মারি নাই । তাই আমি যে কোন কিছু বললে ওরা শুনবে । গেদুমিয়ার বউ বলল – ভয় দেখাইয়া লাভ নাই । তবে আমিও গফুর ডাকাতের মেয়ে আমি কথা দিলাম আপনাকে আসা করি খুব তারা তারি তাদের হাতের খিচুড়ি খেতে পারবেন । এই বলে গেদু মিয়ার বউ আর গেদু মিয়া বিদায় নেয় । ডাক্তারের বউ এক গ্লাস গরম দুধ অ-মানের হাতে দিয়ে বলে ভাই আমি তোমারে কি নামে ডাকব । আমাকে না বলে তুমি কোথাও যাবে না। ময়না কে একটু রাতে পড়াবে । সময় পেলে তোমার ভাইয়ের সাথে বাজারে ফার্মেসিতে বসবে । আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছি । ডাক্তার হাসতে হাসতে বাজারে চলে গেল ।
আজগর আলি জানালার পাশে বসে আছে । বাজার থেকে একটা আইসক্রিম কিনে অ-মানব আজগর আলির কাছে আসলো ।
—— চাচা সালাম নিবেন
—— আজগর আলি বলল আরে তোমার কণ্ঠ তো সে মানুষের মত যে খুব ভাল কথা বলে ।
—– চাচা আমি অমানুষ না । অ-মানব । অমানুষ মানে খারাপ মানুষ আর অ-মানব মানে যে মানুষ হতে চায় । এই নেন গরমে আইসক্রিম খুব মজা । আপনার জন্য নিয়ে আসলাম ।
—– ইস বাবা খুব ভাল কাজ করেছ ।আইসক্রিম ছোট বেলা থেকে খুব প্রিয় ।
—— আপনার ছেলেদের কি অবস্থা ।
—— আদর বেড়েছে । কিন্তু তারা সিদান্ত নিতে পারছে না। কে কোন জমি নিবে ।
——চাচা যাদের মন ভাল না। তারা কোন দিন ভাল সিদান্ত নিতে পাড়ে না।
—— তুমি ঠিক বলেছ ।
—— আমি একটা কথা বলব শুনবেন । মনের সাহস থাকলে আর চোখ ছাড়া দুনিয়া দেখা যায় ।
—– বাজান এটা ঠিক বলেছ । এখন বল কি বলতে চাও ?
—– ছেলেদের বলেন আজ রাতে ডেকে যে আপনাকে তিন জন মিলে ৩০ হজার টাকা টাকা দিতে বলবেন । আর বলবেন এই তারা যেন এক সপ্তাহের মধ্যে সিদান্ত নেয় ।
—– টাকা তাদের কাছ থেকে নিতে হবে না। টাকা আমার কাছে আছে । বল মনের সাহসে কি করতে হবে ।
—— আমার কথা কাউকে বলা যাবে না। আপনি ভোরের রেল গাড়িতে ঢাকা চলে যাবেন । বিমান বন্দর রেলস্টেশনে নেমে বলবেন যেন ফার্মগেইটের গাড়িতে তুলে দিতে । ফার্ম গেইটে ইসলামী আই হাসপাতাল । মানুষ কে বললেই দেখিয়ে দিবে। আপনি চলে যান । আপনি বুড়া মানুষ এত টাকা সাথে আছে কেউ বুঝবে না। মনে রাখবেন ভাত সামনে এনে দিলাম এখন মুখে তুলে খাওয়ার ব্যাপার আপনার। চোখ ভাল হলে আপনাকে একটা সুন্দর দেখে বিয়ে করিয়ে দিব । কি বলেন ?
—– অ-মানব তুমি ঠিক বলেছে । এত সকালে ষ্টেশনে একা কি ভাবে যাই ।
—– আমি আজানের সময় আসব । আপনাকে রেল গাড়িতে তুলে দিব ।
—– বাবা আমি পারব তো ।
—– কেন পারবেন না ? মানুষ শরীরের জুরে বাচে আর কয়দিন । মানুষ বাচে তার মনের জুড়ে । আপনার মন আপনার সব চেয়ে বড় বন্ধু । অ-মানব আজগর আলির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সন্ধ্যা ডাক্তারের বাড়িতে আসে । অ-মানব খুব অবাক হয় । তার বিছানায় নতুন চাদর নতুন বালিশ । দুধ চায়ে আদা দিয়ে
অ-মানবের হাতে দেয় । অ-মানব একটু হেসে বলে আমার বোনের ভয় দূর হল ?
ময়না কে অ-মানবের কাছে দিয়ে বলল ভাই তুমি ওকে একটু পড়াও । আর বল তোমার জন্য কি রান্না করব । অ-মানব বলল অনেক দিন হল খিচুড়ি খাই না । আজ রাতে মনে হয় আবার বৃষ্টি হবে তুমি সবজি দিয়ে খিচুড়ি রান্না কর ।
ঠিক আছে ভাই তাই হবে …………।।