সেলিনা জাহান প্রিয়ার গল্প: ‘অ-মানব’-(৪৪ তম পর্ব)
অ-মানব-৪৪-তম-পর্ব
——————— সেলিনা জাহান প্রিয়া
রাত তিনটা বাজে চেয়ারম্যান সাহেবের মায়ের মায়ের কাছে অ-মানব গেল । চেয়ারম্যানের মা বলছে । আল্লাহ্ আমাকে নেয় না কেন । আর তো বাচতে ইচ্ছা হয় না। নবাবের মেয়ে কে বিয়ে করিয়ে এনেছি । এখন বিবি সাব হয়েছে । আমার নামে আমার ছেলের কাছে বিচার দেয় । আমি কি আমার ছেলের কামাই খাই । আর কত কি বলছে অ-মানব বয়স্ক মহিলার দিকে এক পলকে চেয়ে আছে । কেনু মিয়া বলল ভাই জান চলেন । অ-মানব বলল আরে আপনি আমাকে জালাতন করছেন কেন ? চেয়ারম্যান সাব আমার দেখাশোনা করতে বলছে । কেনু বলল আপনি বুঝেন না এই মহিলা পাগল । অ-মানব কেনুর দিকে রাগ চোখে তাকাল । চেয়ারম্যানের মায়ের কাছে গিয়ে বসল অ-মানব । চেয়ারম্যানের মা বলল এই কে তুমি আমার কাছে কেন । আমি কি চেয়ারম্যান নাকি ? যাও চেয়ারম্যানের কাছে যাও । অ-মানব বলল খালামনি আমি আপনার কাছে আসছি । চেয়ারম্যানের কাছে না।
—– আমার কাছে কেন ? আমি কারো কাছে কিছু চাই না। আমার পোলার বউ আমার কোন কথা শুনে না।
—– অ-মানব বলল খালা আজ থেকে শুনবে । আপনার কি পায়ে অনেক ব্যাথা ।
—— হ্যাঁ , আমার পায়ে অনেক ব্যাথা ।
—— আচ্ছা আমি আপনার পা টিপে দিচ্ছি ।
অ-মানব চেয়ারম্যানের মায়ের পা খুব সুন্দর করে টিপে দিতে লাগলো । তার পর মাথায় হাত দিয়ে খুব সুন্দর করে মাথা ম্যাসেজ করে দিল । অ-মানব কেনু মিয়া কে বলল ভাই যাও তো গামছাটা ভিজিয়ে নিয়ে এসো । ভিজা গামছা দিয়ে চেয়ারম্যানের মায়ের পা হাত মুছে দিল । কেনু মিয়া কে বলল যাও একটু সরিষার তেলের বোতল নিয়ে এসো । সরিষার তেল তার হাত পায়ে সুন্দর করে মেখে দিল । অল্প সময়ের মধ্যে বয়স্ক মানুষটা ঘুমিয়ে গেল । কেনু মিয়া বলল আরে ভাই আপনি তো জাদু জানেন । গত এক এক বছরে সে রাতে ঘুমায় না । অ-মানব বলল কেনু মিয়া চল আমারা ঘুমাতে যাই । আসলে মানুষ একটু ভালবাসার কাঙ্গাল । একটু মমতার কাঙ্গাল । জিবনে মানুষ যার কাছে একটু ভালবাসা পায় মমতা পায় সে তাঁকে আঁকড়ে ধরে বাচতে চায় । জিবনে মানুষ যখন কারো কাছে ভালবাসার বদলে কষ্ট পায় সে তখন পাগলামি করে। এই চেয়ারম্যানের মা আশা করে তার ছেলের বউ তাঁকে অনেক ভালবাসুক । কিন্তু সে তার কাছে পায় অবহেলা। এটাই তার দুঃখ । আর সে যে খারাপ ব্যবহার করে এটাও তার মমতা । কেনু মিয়া তুমি তো তার মেয়ের মেয়ে কে ভালবাস তাই না?
——— হ্যাঁ ।
———- তাহলে আজ থেকে তুমি চেয়ারম্যানের বউয়ের কোন কথা শুনবে না। এই বুড়া মহিলা যা বলে তাই শুনবে ।।
অ-মানব আর কেনু মিয়া মনের সুখে ঘুমিয়ে গেল ।
সকাল ১১ টা বাজে । আজগর আলির চোখের অপারেশন হয়েছে তিন দিন হল । ডাক্তার একটা কালো চশমা দিয়েছে । আজগর আলি আজ অনেক খুশি কারন সে চোখে এখন দেখতে পায় । মনে মনে বলে এই অ-মানব আমার মনের ভিতরে একটা শক্তি দিয়েছে । আমি কিনা সেই ময়মনসিংহ থেকে একা একা ঢাকা । জানালা দিয়ে আজ মনের সুখে আকাশ দেখছে । ইস কত দিন হল আকাশ দেখা হয় না। একটু পড়ে ডাক্তার আসে বলল আজ আপনার ছুটি । কালো চশমা পড়ে একা একা বের হল হাসপাতাল থেকে । গায়ের জামাটা দিকে চেয়ে দেখে খুব ময়লা । মনে মনে বলে আমি হলাম ১০০ বিঘা জমির মালিক । এমন ময়লা কাপড় দেখলে মানুষ কি মনে করবে । হাতের লাঠি টা ঠিক আছে । ফার্ম গেইট পুলিশ বক্সসের সামনে এক লোক আমরা বিক্রি করছে দুটা মিষ্টি দেখে আমারা কিনে নিল । পকেটে হাত দিয়ে দেখে এখনো ১১ হাজার টাকা আছে । ফার্ম ভিউ মার্কেট থেকে নতুন পাঙ্গাবি আর পায়জামা কিনে মাথায় একটা নতুন টুপি পড়ে নিল । আর বাটা থেকে জুতা কিনে পড়ে নিল । হাতে একটা ঘড়ি কিনে পড়ল । এখন আর আগের সেই আজগর আলি নাই । পোশাক বদলে সে একটা সেলুনে গিয়ে নাপিত কে বলল চুল দাড়ি যেন ঠিক করে কেটে কলপ দিয়ে দেয় ।
দুপুর বেলা বিমান বন্দর রেল স্টেশনের পাশে একটা হোটেলে বসে আসগর আলি দেশে মুরগী দিয়ে তিন প্লেট ভাত খেল । নতুন কেনা ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিল । মনে মনে আজগর আলি বলে জিবনে এই সাহস টা আগে করতে পারলে আরও ভাল হত । রেল গাড়ির জন্য আজগর আলির অপেক্ষা । চার পাশ ভাল করে দেখছে । মাঝে মাঝে চোখের মেডিসিন দিচ্ছে । আজ সে নিজেকে খুব সুখী মনে করছে । কত দিন পড় মানুষ গুলো দেখতে পাচ্ছে । যার চোখ নাই তার কিছুই নাই ।
অ-মানব কে চেয়ারম্যান এসে বলল কি ব্যাপার আমার মা সকাল থেকেই ঘুমে । সে তো প্রতিদিন বেলা বারটায় ঘুমায় । কেনু বলল তুমি নাকি ভাই রাতে মায়ের অনেক সেবা করেছ । আমি শুনে খুশি হলাম । অ-মানব একটু হেসে বলল যেই কাজ আপনার করা উচিৎ আমি সেই কাজ করলাম । মা হল একটা মানুষের জন্মের মুল মাটি । মানুষ যদি সেই মাটি থেকে দূরে সরে যায় তাহলে কি শান্তি পায় ।
—– চেয়ারম্যান বলল সারা দিন কত কাজ ? একবার চেয়ারম্যান হলে বুঝতে মিয়া !!
—– তাই আপনি অনেক কাজ করেন ? কিন্তু কেন করেন যে কাজে আপনি মা থেকে মাটি থেকে সরে যাবেন। সেই কাজ করে কি লাভ ? চেয়ারম্যান সাব আপনার মাথার চুল অনেক সুন্দর । আপনি দিনে কতবার মাথার চুল ঠিক করেন । কিন্তু এই এত যত্নের চুল মাথা থেকে পড়ে গেলে আপনি কি সেই পড়া চুলের যত্ন নেন ?
—– না পড়া চুলের যত্ন কেন নিব ?
—– ঠিক আপনার মা যত দিন আছেন আপনি ঠিক সেই চূলের মত যত্নে আছেন । যে দিন মা থাকবে না। সেই দিন বুঝবেন । অবহেলা কি জিনিস ? আপনার মা আজ ঘুম থেকে উঠলে সব কাজ বাদ দিয়ে নিজের হাতে নাস্তা নিয়ে মায়ের কাছে যাবেন । মায়ের কথা গুলো মন দিয়ে শুনবেন । আর বলবেন মা তোমার কথা ঠিক । মা যদি কিছু ভুল বলে তা বলবেন মা ঠিক বলেছ ?
—– ঠিক আছে তাতে যদি মা ভাল হয় ।
চেয়ারম্যানের বউ এসে অ-মানব কে বলল ঐ মিয়া তোমার নাম কি ? তুমি আসার পর গ্রামের মানুষ সব উল্টা পাল্টা কাজ করছে । আমার শাশুড়ি একজন পাগল মহিলা, এই পাগল মহিলার কথা এত মনোযোগ দিয়ে শুনে কি লাভ হবে ? আর তুমি এই বাড়িতে আজকের পর থাকবে না। যেই দেশ থেকে এসেছ সেই দেশে যাও । যত মরা আমার বাড়িতে । কাল রাতে তুমি আমার শাশুড়িরে ঘুমের কিছু খাওয়াইছ । না হয় এত বেলা করে কেউ ঘুমায় । চেয়ারম্যান বলল আরে সালেহা কি শুরু করলা । কার সাথে কি ভাবে কথা বলতে হয় সেটা কি তুমি ভুলে গেছ । উনি মেহমান মানুষ ।
——- চেয়ারম্যানের বউয়ের দিকে চেয়ে অ-মানব একটু হেসে বলল আমি কিন্তু সব জানি । পড়ে কিন্তু সব বলে দিব ।
—- সালেহা বেগম বলল ঐ মিয়া জান কি বলবে ?
—– আমি বললে পড়ে কিন্তু আপনি আমাকে আর থামাতে পারবেন না।
—– চেয়ারম্যান বলল ভাই অ-মানব কিছু বলতে হবে না। তুমি আমার সাথে বাজারে চল । তার পর ইউনিয়ন অফিসে যেতে হবে রাজ্জাক মেম্বার আর গেদু মিয়া আসবে তোমার সাথে বিষয়টা শেষ করতে চায়। অ-মানব বলল ঠিক আছে চলেন যাই । চেয়ারম্যানের বউ সালেহা বেগম কে কেনু মিয়া বলল খালা আপনার কিন্তু খবর আছে । আমার জানা মতে এই লোক গ্রামের সবার গোপন কথা জানে। আমার মনের গোপন কথা সে আমাকে রাতেই বলে দিসে । না জানি সে আপনার কোন কথা জানে । যদি চেয়ারম্যান কে বলে দেয় আপনার কপালে কি জানি আছে? সালেহা বেগম চিন্তায় পরে গেল। কেনু তো ঠিকই বলছে। এবার সালেহা বেগম কেনু কে বলল যা গিয়ে চেয়ারম্যান কে বল মেহমান নিয়ে যেন দুপুরে বাহিরে না খায়। আমি মেহমানের জন্য ভালো কিছু রান্না করছি। কেনু বলল ঠিক আছে খালা আমি যাচ্ছি ।
আজগর আলি রেল স্টেশনে বসে আছে । কিছুক্ষণ পরে তার ট্রেন আসবে। নতুন জামা কাপড় জুতা পরা আজগর আলি ভাবটা একটু অন্ন রকম দাড়ি চুলে কলপ করায় বয়স বুঝা না। আজগর আলি চেয়ে দেখে তার পাশে এক্তু দূরে একজন বয়স্ক মহিলা কাদতেছে আজগর আলি তাই চেয়ে চেয়ে দেখছে। মহিলার পোশাকে বুঝা যায় যে সে ভদ্র ঘরের মানুষ। আজগর আলি তার সিট থেকে উঠে ভদ্র মহিলার কাছে যায় । গিয়ে জানতে চায় আপনি কান্না করছেন কেন? ভদ্র মহিলা কাপড়ের আচল দিয়ে চোখ মুছে বলে আপনাকে বলে আর কি হবে? আমি অনেক আশা করে এই ঢাকায় ছেলের কাছে এসেছিলাম । কিন্তু ছেলের বউ আমাকে রাখতে চায় না। বলে একটা ঘর আপনাকে রাখি কি করে ? এদিকে গ্রামেও যেতে পাড়ি না । কিস্তিতে টাকা তুলে আরেক ছেলে কে দিয়েছিলাম । আমার সেই ছেলে টাকা নিয়ে যে কোথায় গেল তারও কোন খবর নাই । তাই এখানে বসে কান্না করছি। এই শহরে কাউ কে চিনি না। সারাদিন কিছু খাই নাই। মানুষের কাছে হাত পেতে খাবার চাইতে লজ্জা লাগে। জীবনে কোন দিন মানুষের কাছে হাত পাতি নাই । আজগর আলি বলল যে সন্তান তার পিতা মাতাকে কষ্ট দেয় তাদের কথা চিন্তা না করাই ভালো। আপনি উঠুন হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নেন । যার কেউ নাই তার আল্লাহ্ আছে। মনে করেন আল্লাহ্ আমাকে পাঠাইছে । আমারও আপনার মতো অবস্থা কিন্তু আমি আমার জমি জমা ছেলে মেয়েদের দেই নাই । এক সপ্তাহ আগেও আমি অন্ধ ছিলাম । আমার ছেলেরা আমাকে চিকিৎসা করায় নাই । কারণ আমি চোখে দেখলে আমার জমি জমা নিতে পাড়বে না। সাত বছর পর আমি একা একাই ঢাকা এসে নিজেই নিজের চোখ ডাক্তার দেখিয়ে ভালো করলাম।
আজগর আলি মহিলাকে খুব যত্ন করে হোটেলে খাওয়াইল তার পর মহিলাকে বলল যদি আল্লাহ্ কে বিশ্বাস করেন তাহলে যতদিন বেঁচে আছেন আমার সাথেই থাকবেন । রাস্তায় মরার চেয়ে আমার মতো বুড়া মানুষের সেবা করে মরেন । আমি আপনাকে কিছু জমি লিখে দিয়ে যাবো যেন আমি মরার পরেও আপনার কষ্ট না হয় ।
আজগর আলি ঐ মহিলা কে নিয়ে ট্রেনে উঠল বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশে ।
চলমান……………