সেলিনা জাহান প্রিয়ার গল্প: ‘অ-মানব’-(৫০ তম পর্ব)

অ-মানব-৫০-তম-পর্ব
————————  সেলিনা জাহান প্রিয়া
আজগার আলি বাজারে এসে দুইটা আইস ক্রিম একটা চায়ের ফ্লাক্সে ভরে তাঁর নতুন বিবির জন্য নিয়ে গেল।

— কি গো এই বয়সে কেউ আইস ক্রিম খায় ।
— আজগর আলি তাঁর বউ কে বলল দেখ মন টা ভাল না । গ্রামে একটা মানুষ এসেছিল । যে কিছু মানুষ কে তাঁর ভুল গুলো কি ধরিয়ে দিয়ে গেল । সেই মানুষটা আমাকে একদিন আইস ক্রিম কিনে খাওয়াইছিল । তখন আমি চোখে দেখি না।
সেই মানুষটা কাউকে কিছু না বলেই চলে গেল । বাজারে গেলাম সবাই একেই কথা মানুষটা কে ছিল জানার খুব ইচ্ছা । চেয়ার ম্যান এসে বল নাও চাচা মিষ্টি খাও কিন্ত কিসের মিষ্টি টা বলব না । আজগর আলি বলে মা মরল দুই দিন চেয়ার ম্যানের দয়ামায়া নাই । আজগর আলি এসে তাঁর বউ কে বলল যার জন্য তোমাকে পেলাম আজ
সেই মানুষটা গ্রাম ছাড়া । তাঁকে একবেলা ভাত খাওয়াতে পারলাম না।
ডাক্তারের বউ বলে মানুষটা না বলে চলে গেল । ডাক্তারের ছোট মেয়ে বলে মা মাম তো বলে আসে যে বলে যাবে । সে না বলে এসেছে না বলে চলে গেল । মামা আমাকে একটা জিনিস শিখিয়ে দিয়ে গেছে ।
ডাক্তার বলল কি মা ? কি শিখিয়েছে ?
আব্বু আর আম্মু কে বলা যাবে না। মামা বলেছে যাদের প্রান আছে তাদের তারা সবাই
কথা বলতে পাড়ে । প্রতিটা প্রানির ভাষা আদালা । অনেক ভালবাসলে তাদের সেই ভাষা বুঝা যায় ।
—– তা মা মনি তুমি কার ভাষা বুঝলে ?
— বললাম তো বলব না।
ডাক্তারের বউ ডাক্তার কে বলল আরে তুমি কার সাথে কি বল ? ও ছোট মানুষ ঐ
পাগলে কি না কি বলেছে টাই খুকি বিশ্বাস করে ।
খুকি রাগ হয়ে বলল আমার মামা কে কিন্তু কিছু বল না। মামা কিন্তু বাতাসের সাথে কথা বলতে পাড়ে । অ-মানব মামা বলে মানুষ যা কথা বলে তা বাতাসে রেকড হয়ে থাকে আর ঐ রেকড কে মুছতে পাড়ে না।
খুকির মা একটু রাগ হয়ে বলল যাও তো খুকি এত পাকামি কথা বলে না । যাও গিয়ে পড়তে বস ।
—- আরে আমার তো কোন পড়া বাকি নেই । মামা সব শিখিয়ে গেছে ।
ডাক্তার বলল পাগল মামা কি কি সিখাইল আমার খুকি কে?
—- জান আব্বু মামা আমাকে তিনটা জিনিস সিখাইছে ভাষা , অংক, প্রকৃতি আর
বিজ্ঞান ! তবে আমাকে বলেছে আমি কেবল বিজ্ঞান ক্লাসে ভর্তি হয়েছে । আমাকে অনেক পড়তে হবে ।
—– ঠিক আছে মা তুমি অনেক বড় হও । যাও পড়তে বস ।
ডাক্তার লক্ষ্য করলো তাঁর মেয়ে কিছুটা অন্য রকম ।
ডাক্তার সন্দ্যায় একটা পেপের পড়ছে । মেয়ে এসে বলল আব্বু পেপারে তোমার প্রিয় খবর কি কি ?
—- কেন মা সব খবরেই ভাল লাগে ।
—- এটা কেমন কথা একজন মানুষের সব খবর কোন দিন ভাল লাগে না। অ-মানব
মা বলেছে একমাত্র শয়তানের সব খবর শুনে ভাল লাগে কারন মন্দ হলে সে খুশি হয় । ভাল হলে সেই ভালো মাঝে কি করে মন্দ প্রবেশ করানো যায় সে সেই চেষ্টা করে ।
ডাক্তার বলল মা তুমি বড় হয়ে পেপার পড়া যখন শিখবে তখন কিন্তু দেখবে পেপার না পড়লে ভাল লাগে না।
—– আব্বু আমি তো রোজ পেপার পড়ি ।
—– তুমি পেপার পড়তে পাড় ।
—– হ্যা পাড়ি । আজ এই পেপার পড়া শেষ । তুমি যে কোন নিউজ জানতে চাও ।
আমাকে বল । দেখ আমি বলে দিচ্ছি ।
ডাক্তার তো অবাক তাঁর ছোট মেয়ে যে ভাল করে বাংলা পড়তে পাড়ে না। সে কি না সব নিউজ কোথায় কি আছে বলে দিচ্ছে । বিন্দু মাত্র কোন ভুল নাই । মেয়ে বলল বাবা
অ-মানব মা বলেছে যে মানুষ একমাত্র প্রানি যে মানুষের কুলে জন্ম নিয়ে মানুষ হয় না। তাঁকে মানুষ হওয়ার জন্য লিখা পড়া ধর্ম কর্ম সমাজ থেকে অনেক কিছু শিখতে হয় ।
মেয়ের কথা শুনে ডাক্তার চুপ । এতটুকু মেয়ে কি সুন্দর করে কথা বলে ।
ডাক্তার বোকার মতো মেয়েকে দেখতে থাকে ।
বিকেল বেলা সবাই আজ ডাক্তারের দোকানে কে এই অ-মানব তাঁকে নিয়েই যত আলোচনা । গ্রামে একটা কথা সবার মুখে অ-মানব কোন জীন বা আউলিয়া ছিল ।

মোহন গঞ্জ ট্রেন থেকে অ-মানব নেমে যায় । একটা লোকাল ট্রেনে অ-মানব মোহন গঞ্জ এসেছে । নেত্রকোনা জিলার একটা থানা । ভাটি অঞ্চলের মানুষ এই খানে এসে রেল গাড়িতে উঠে । মোহন গঞ্জ বেশ বড় বাজার । রেল থেকে নেমে মনের ইচ্ছায় হাটতে থাকে অ-মানব । খুব কাছেই একটা লঞ্চ ঘাট । এই লঞ্চ ভাটি অঞ্চলে যাওয়া যায় । একটা লঞ্চ ডাকছে মধ্যপাড়া বাজার আর একটা ডাকছে ছাতক সুনাম গঞ্জ । অ-মানব লঞ্চের দিকে একটু হাসছে ।
এমন সময় একজন বলল কি ভাই এই লঞ্চের দিকে তাকিয়ে একা একা পাগলের মতো
হাসছেন কেন ।
——- অ-মানব বলল পাগলের সুখ মনে মনে তাই তো পাগল একা একা হসে ।
——- আরেক জন বলল দেখতে মনে হয় না পাগল কিন্তু এমন করে হাসছেন কেন ?
অ-মানব হাসতেই লাগলো । হাসতেই লাগলো । অনেক মানুষ তাঁর দিকে চেয়ে আছে ।
মাথায় বাবরী চুল , মুখ ভর্তি দাড়ি কিন্তু এমন করে হাসছে কেন ? অ-মানব হেসেই চলছে তো হেসেই চলছে । অন্য একজন মানুষ বলল মনে হয় নতুন পাগল ।
এমন সময় একজন মহিলা একটু রঙ্গ করে বলল মনে হয় কঠিন ধরা খাইছে । অ-মানব এবার হাসিয়ে থামিয়ে সবাইকে বলল – আমারা মানুষ আর মানুষের কিছু কাজ না বুঝেই মজা লাই ।
——- একজন বলল কেমন ?
——- এই লঞ্চে লিখা মায়ের দোয়া কিন্তু এই লঞ্চের মালিকের মা থাকে গাজী পুর বৃদ্ধা আশ্রমে । তাই মায়ের দোয়া এই লিখা দেখে আমি হাসছি । সবাই চুপ করে গেল ।
আর কেউ কোন কথা বলে না। কারন সবাই জানে এই বিষয়টা । কিন্তু মায়ের দোয়া
এই লিখটা কেউ কোন দিন চিন্তা করে নাই । অ-মানব সবাই কে বলল কি ভাই সবাই হাসেন । আপনাদের হাসতে লজ্জা লাগে না। মায়ের দোয়া লিখা আর সেই মা থাকে বৃদ্ধা আশ্রমে । আপনাদের একটা নীরব প্রতিবাদ একটা মায়ের চোখের জল মুছে যেতে পাড়ে । একজন বলল ভাই চমৎকার একটা কথা ? কিন্তু এই লঞ্চের মালিক তো আমাদের কারো কথা শুনে না। অ-মানব বলল কথা শুনার দরকার নাই । লঞ্চের মালিক আপনাদের সাথে কথা বলার জন্য হাত পা ধরে কাঁদবে ।
একজন বলল আমরা চাই তাই হউক কিন্তু করব কিভাবে ? একজন অ-মানব কে বলল ভাই আপনে আমার সাথে আসেন । মোহন গঞ্জ বাজারে মানুষের ভীর জমে গেল ।
সবাই জানে মায়ের দোয়া লঞ্চের মালিক মালেক ভুঁইয়া খুব খারাপ মানুষ । সে কাউকে ভয় পাইনা । তাঁর মা খুবেই ভাল একজন মহিলা । কিন্তু সে তাঁর মাকে বৃদ্ধা আশ্রমে রেখেছে । একজন অ-মানবের চা নিয়ে আসলো আর বলল ভাই উপায় বলেন ।
অ-মানব বলল একজন মায়ের জন্য ভালবাসা । যারা মা বাবা কে দেখা শুনা করে না। খাবার দেয় না তাদের জন্য । একজন মানুষ এসে বলল কে গো বাবা তুমি । তোমার হাসি দেখে আমি ভাবলাম নতুন পাগল । আসলেই বাবা তুমি পা গল না । পাগল আমরা । যেই দিন মালেক তাঁর মাকে এই লঞ্চে করে নিয়ে আসে বৃদ্ধা আশ্রমে নেয়ার জন্য । মহিলা লঞ্চ থেকে নামছে আর কাঁদছে ।
অ-মানব সবাই কে বলল কিছু কিছু কাজে আমরা এক হতে পাড়ি । কিছু কিছু কাজ কেউ শুরু করে আর কেউ শেষ করে । সবার দ্বারা সব কাজ শেষ করা সম্ভব হয় না। তবে শুরু করা তো যায় । আপনারা একজন মায়ের চোখের পানি দেখলেন দুঃখ দেখলেন ।। আর আমি ঐ পানির মাঝে দেখেছি ভালবাসা । হয়ত আমরা জগতের সব মায়ের দুঃখ দূর করতে পারব না। তবে আপনরা যদি আজ থেকে একজন মায়ের জন্য
কিছুটা ভালবাসা দেন আর কষ্ট করেন তাহলে জগতে অনেক মা তাদের কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে । এই জগত সংসার সবাই বদলায় না। কেউ রাস্তা দেখায় কেউ বানায় আর সবাই সেই রাস্তা ব্যবহার করে উপকৃত হয় । অ-মানবের কথা সবাই এক ধ্যানে শুনছিল । যে মহিলা তাঁকে ব্যাঙ্গ করেছিল সে এসে বলল ভাই আমাকে ক্ষমা করুন । আপনার হাসির রহস্য যে এত কঠিন জানা ছিল না। কিন্তু আমরা কি করব ? কি ভাবে পারব
মাকে বৃদ্ধা আশ্রম থেকে ফিরিয়ে এনে সম্মানের সহিত রাখতে । আর মায়ের দোয়া লঞ্চের মালিক কি আমাদের কথা শুনবে ?
অ-মানব বলল তাঁর সাথে আমরা কোন কথা বলব না । সেই কথা বলবে আমাদের সাথে । চিৎকার করে বলবে ভাই কথা বল ? আমার কি অপরাধ আমার সাথে কথা বলল ।
মানুষ কথা বলা ছাড়া থাকতে পাড়ে না। যদি আপনরা আমাকে কথা দেন সবাই আমার কথা রাখবেন আমিও কথা দিচ্ছি মায়ের দোয়া আপনরা সবাই জয়ী হবেন । মোহন গঞ্জ বাজারে হাজার জাহার মানুষ হয়ে গেল । সবাই বলল হ্যা আমরা আছি আপনার সাথে ।

 চলমান —

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!