সেলিনা জাহান প্রিয়ার গল্প: ‘অ-মানব’-(৫২ তম পর্ব)
অ-মানব-৫২-তম-পর্ব
———————– সেলিনা জাহান প্রিয়া
আলফু মিয়া মনে মনে বলে । কি আশ্চর্যও ব্যাপার । আমার মাথায় ধরে না । এই লোকটা মানুষ গুলো কে কেমন করে তাঁর কথা শুনাচ্ছে । অ-মানব আপন মনে চুপ চাপ বসে আদা দিয়ে দুধ চা খাচ্ছে । কোন কথা নেই । আলফু মিয়া বলে তা বাবা তোমার নাম কি ? তুমি দেখতে মাসাল্লাহ অনেক সুন্দর মিয়া । আচ্ছা মালেক মিয়া কে তুমি কি করে চিন ? তোমার কোন আত্মীয় হই নাকি ?
অ-মানব আকাশের দিকে চেয়ে বলল চাচা আকাশের মেঘ কি আমাদের কিছু হয় । কিন্তু দেখুন সে আমাদের বৃষ্টি দিয়ে যাচ্ছে । ছায়া দিচ্ছে । এই জগত হলো একটা রহস্য
। যারা এই জগত নিয়ে ভাবে তারা এক ধরনের মানুষ । আবার কিছু মানুষ আছে জগত সংসার নিয়ে ভাবার সময় নাই । আপনি বললেন না আমার নাম কি ? আসলে আমরা একে অন্য কে চেনার সহজ মাধ্যম হল নাম । কিন্তু মানুষ দেহ দেখে –মানে চেহারা দেখে নাম বলে । আপনি এখন বাজারে গেলে সবাই আলফু বলবে । কারন সবাই আপনার চেহারা দেখে চিনে যে আপনি আলফু । কিন্তু আপনি এখন মরে জান সবাই বলবে আলফুর লাশ । আলফু কই সবাই বলবে মারা গেছে । তাহলে মানুষের দেহের কোন নাম নাই । নাম হল তাঁর আত্মার । কিন্তু আত্মা কেউ চিনে না।
আলফু মিয়া বলল খুবেই কঠিন কথা , কোন দিন এভাবে চিন্তা করি নাই ।
কিন্তু বাবা তোমার নাম কি ?
অ-মানব বলল আমার দেহের নাম মানব আর আমার আত্মার নাম- অ । আপনি
আমাকে অ-মানব ডাকতে পারেন ।
—– তোমার ধর্ম ।
—– দেখুন মানুষের সৃষ্টির একটা আদি ধর্ম আছে । তা হল মানুষ মানুষের জন্য । মানুষ সকল প্রানির জন্য । মানুষ সকলের শান্তির জন্য । আমি শান্তি চাই । শান্তি মানে
আপনার হাত মুখ পা শরীর, কথা ব্যবহার দ্বারা অন্য সকল প্রানি নিরাপদ মানেই আপনি শান্তির পক্ষে । যে শান্তির পক্ষে সে স্রষ্টার পক্ষে ।
——- আলফু মিয়া বলল তোমার মাথায় কিছুটা দোষ আছে। তবে তুমি মানুষ ভাল । কারন তুমি শান্তির পক্ষে । কিন্তু তোমার নামটা আমাকে হাসাইলো । কি নাম তোমার অ-মানব । এটা কোন নাম হল ?
—— দেখুন চাচা আপনি হলেন মানব । আর আমি হলাম অ-মানব । পার্থক্য টা কি জানেন ?
———- না কি পার্থক্য বল শুনি ।
———– তাহলে একটু আরাম করে বসি । বিকালে খুব বৃষ্টি হবে । আপনার যে জিনিস পত্র ভাল করে রাখুন আর রান্না করার জন্য কাঠ চিরে রেখেছন তা ঘরে নিয়ে রাখুন । কারন বৃষ্টি হবে দুপুরের ।
———— আলফু মনে মনে বলে আসলেই পাগল । আকাশ পরিষ্কার । বৃষ্টি হবার কোন লক্ষণ নাই । আর সে বলে বৃষ্টি হবে । রুস্তম কে ডেকে আলফু মিয়া বলে
মালেকের লঞ্চের কি খবর ?
সোহরাব এক গাল হেসে বলে আমরা দুই জন আর হোটেলের ম্যানেজার আরও অনেক মানুষ একে অন্যের কাছে বলে দিয়েছি , মুখের হরতাল । কেউ মালেক মিয়ার সাথে কথা বলবেন না। মালেক মিয়ার মাকে বৃদ্ধা আশ্রম থেকে ফিরিয়ে তাঁর বাড়িতে সম্মানের সহিত রাখার জন্য এই সংগ্রাম । তাঁর যারা জানে তারা তাঁর লঞ্চে উঠছে না।
অ-মানব বলল আলফু চাচা আমি একটু ঘুমাব ।
—– তা ঘুমাইলে হবে দুপুরে খাবে না। আমার বাড়ি নদীর ঐ পাড়ে । তুমি বরং একটা কাজ কর । আমার দুই পালোয়ান সোহরাব আর রুস্তমের সাথে যাও । তারা আমার ভাতিজা হয় । বুদ্ধি কম কিন্তু গায়ে ঘোড়ার মত শক্তি । অ-মানব বলল তাই হউক একটু ঘুমাতে পারলে হয় ।
দুই জন মিলে অ-মানব কে নিয়ে গেল তাদের ঘরে । একটা শীতল পাঠি বিছিয়ে অ-মানব ঘুমিয়ে গেল । সোহরাব বলল আজব মানুষ বালিশ ছাড়া ঘুমায় । চল আমরা যাই ।
মালেক মিয়া কিছু বুঝতে পারছে না। কেউ তাঁর সাথে সকাল থেকে কথা বলে না।
মালেক মিয়ার কাজ করে লাল চান আর কদম আলি ।
মালেক মিয়া বলল কি রে ঘটনা কি ? আজ বাজারে কি হয়েছে ।
লালচান বলল কাকু বাজারে সকাল বেলা একটা পাগল মানুষ । আমাদের লঞ্চের সামনে
দাঁড়িয়ে খালি খালি হাসতে লাগে । সে কি হাসি । প্রথম তাঁকে দেখে পাগল মনে হয় নাই । মাথার চুল একটু লম্বা, মুখে দাড়ি আছে । খুব পরিষ্কার জামা কাপড় । পায়ে দামি জুতা । আমি তো মনে করেছি কোন সাহেব । সাথে কোন ব্যাগ নাই । খাতা কলম ো নাই । মালেক মিয়া রাগ হয়ে বলল আরে লাল চান কাজের কথা আগে বল দেখি । পড়ে তোর গরুর রচনা শুনব ।
———– কাকু আগে থেকে না বললে বুঝবেন না তো
———— ঠিক আছে বলল তুই সংক্ষেপে বল । না হয় আমার হাতে লাথি খাবি ।
———— আচ্ছা বলছি কাকু । লোকটা লঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলো । আর
হাসতে লাগলো ।
————- ঐ লাল চান টা ঐ বেটা হাসলে আমার কি সমস্যা ।
————- কাকু কইতে দেন ।
————- আচ্ছা বল শুনি ।
—————- বেটা হাসতে হাসতে হাসতে মাটিতে বসে পড়ল । আমরা সবাই তাঁর
কাছে গেলাম । বেটা মাটিতে বসে হাসতে হাসতে মাটিতে নতুন জামা
কামড় পড়া অবস্তায় গড়াগড়ি দিল ।
———— তাঁর পড় বল ?
———— একজন বলল ঐ মিয়া এত হাসির কি হইল । পাগল বলল যেটা সেটা আমি
বলতে পারব না।
———– কি বলল ? কেন বলতে পারবি না ?
————- কাকু আপনি যদি ঐ কথা শুনার পড় আমাকে আবার মাইর দেন । গত
বছরের মাইরের বেদনা এখনো যায় নাই ।
————– তরে তো এখনি মারা উচিৎ । আমার নাম মালেক ব্যাপারী সবাই মিয়া
ডাকে । জানিস তো মিয়া রা কেমন অত্যাচারি ছিল ।
কদম আলি বলল কাকু মিয়ারা আপনার মতো অত্যাচার করত না। আপনি তাদের চেয়ে ভাল । আমি বলছি পরের ঘটনা । তবে একটু পানি খেয়ে নেই ।
কাকু ঐ পাগল লঞ্চের নাম দেখে হেসেছে ।
—————- কেন লঞ্চের নাম মায়ের দোয়া খারাপ কি ?
—————- খারাপ কিছু না। সেই পাগল বলল যার লঞ্চের নাম মায়ের দোয়া তাঁর
মা থাকে বৃদ্ধা আশ্রমে ।
————– আমার মা বৃদ্ধা আশ্রমে থাকলে তাঁর কি সমস্যা ?
————- আমার ও কথা সেইটা । আপনার মা আপনার সিদান্ত । কিন্তু সেই লোক
বাজারে সকল মানুষ কে বলল যে তাঁর মাকে অন্যায় ভাবে বৃদ্ধা আশ্রমে
রাখা হয়েছে । একজন মায়ের প্রতি এটা অন্যায় । মা কে লালন পালন
তাঁর সন্তানের করা উচিৎ । কারন মা তাদের লালন পালন করে বড়
করেছে ।
————– থাম থাম লেকচার দেয়া লাগব না। আমার মা আমার দরদ নাই । কথায়
বলে না মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশী । আচ্চা লাল চান তাঁর পড় তুই
বল শুনি বাজারে কি সিদান্ত হল । আমি কি বাজারের মানুষের খাই না
পরি । বল শুনি ।
—————- এক গাল হেসে লালচান বলল কাকু সেই পাগল বাজারের মানুষ কে
নিষেধ করেছে আপনার সাথে যেন কেউ কথা না বলে । মানুষটার
কথার মধ্যে যাদু আছে । তাঁকে আবার আশ্রয় দিয়েছে আপনার সব
চেয়ে অপ্রিয় মানুষ । যাকে দেখলে আপনি ভয় পান ।
—————– আমি আবার কাকে ভয় পাই । ঐ আলফু আমার বয়সের বড় ।
তাছারা সে আগে ডাকাত ছিল তাই একটু সম্মান করি ।
——————- লাল চান বলল কাকু ঠিক বলেছেন এই সমাজে ভাল মানুষের কোন
দাম নাই । কেউ তাঁরে ভয় পায় না। সবাই আজ কাল চোর ডাকাত
কে সম্মান করে ।
মালেক মিয়া বলল আমিও মালেক মিয়া দেখব কে কে আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পাড়ে । কেউ যদি কথা না বলে তাতে আমার কিচ্ছু আসে যায় না। আমি এই সমাজের খাই না পড়ি । লাল চান বলল কাকু একটা কথা বলি যদি রাগ না করেন ।
রাগ করার আর কি আছে ! কোথাকার কোন পাগলের কথা বাজারে মানুষ শুনে । এই বাজারের আমি কার উপকার না করেছি ? কি বলবি বল আমি বাড়িতে যাব । দুপুর হয়ে গেছে গা গোসল দিতে হবে । লালচান আর কদম আলি একসাথে বলল কাকু আমরা আর আপনার সাথে কাজ করব না। আমি কদম আলি বাজারে বাদাম বা ঝাল মুড়ি বিক্রি করব । লাল চান বলল আমি তো কাকু এত নিচু কাজ করিতে পারব না। আমি একটা পান সিগারেটের দোকান দিব ।
—————– তা তোরা থাকবি না কেন ?
————- কাকু এটা এক মায়ের জন্য যুদ্ধ বলতে পারেন । আমার মা নাই । কদম আলির আছে । কদম আলি মায়ের জন্য যদি বউ কে তালাক দিয়ে জেল খাটতে পাড়ে । তাহলে আমি নন মেট্রিক লালচান এক মায়ের জন্য আপনার চাকুরী ছেড়ে পান সিগারেটের ব্যবসা করে খাব। দরকার হলে কামলা দিয়ে খাব । কিন্তু যার মায়ের প্রতি ভালোবাসা নাই তাঁর কাছে থাকব না।
মালেক মিয়া বোকার মত তাঁর চাকরের দিকে চেয়ে আছে । কোন দিন তারা তাঁর মুখের দিকে চেয়ে কথা বলে নাই । কত বার বের করে দিয়েছে আবার পায়ে ধরে চাকুরী নিয়েছে । আজ কি আমার মায়ের জন্য আমার চাকুরী ছেড়ে যায় । আচ্ছা দেখি
কোথাকার পানি কোথায় যায় ।
মালেক মিয়া চাকরদের সাথে আর কোন কথা না বাড়িয়ে বলল রাতে এসে তোদের পাওনা নিয়ে যাবি । এমন সময় লঞ্চের ম্যানেজার বলল লঞ্চে যাত্রী খুব কম ছিল ।
তবে লঞ্চ রাতে আসলে বুঝা যাবে কিন্তু লঞ্চের সারেঙ আর চাকুরী করবে না ।
আমিও চাকুরী আর করব না, এই বলে ম্যানেজার বিদায় হয় । রাগে মালেক মিয়ার মাথায় রক্ত চলে আসে । কিন্তু কি করবে কেউ চাকুরী করতে না চাইলে কি জোর করে করানো যাবে । মনে মনে বলে ভাত ছিটাইলে কাকের অভাব নাই । মালেক মিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে চার দিক অন্ধকার করে মেঘ আসতেছে । বাজারের গদি ঘর থেকে বের হয়ে একটা রিকসা নিতে যাবে এমন সময় রিক্সার চালক বলে আপনি রিক্সায় উঠবেন না। মালেক মিয়া বলে কেন তরে টাকা দিব না। রিক্সাওয়ালা বলে আপনার টাকা লাগবে না। আরও দুই রিকসা কে বলে কিন্তু কেউ রাজি হয়না । রাগের মাথায় মালেক মিয়া হেঁটে বাড়ির দিকে রওনা হয় । পিছন থেকে শুনে এক রিক্সাওয়ালা অন্য রিক্সাওয়ালাকে বলছে । টাকার গরম দেখায় । নিজের মায়েরে পালতে পাড়ে না । আবার বাহাদুরি দেখায় । মালেক মিয়া কি বলবে আর রিক্সাওয়ালাকে নিজের মতো করে হাটতে থাকে আর বৃষ্টি শুরু হয় । এমন জায়গায় বৃষ্টি নামে ধারে কাজে কোন বাড়ি নাই । শেষ পর্যন্ত বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে আর তাঁর মায়ের কথা মনে পড়ে যায় ।
এমনি এক বৃষ্টির সময় তাঁর মা তাঁকে নিয়ে একটা গাছ তলে দাড়ায় । আর মা তাঁর কাপড়ের আঁচলটা তাঁর মাথায় ধরে রাখে যাতে তাঁর মাথায় বৃষ্টির পানি না পড়ে ।
চলমান—