সেলিনা জাহান প্রিয়ার গল্প: ‘অ-মানব’-(৫৩ তম পর্ব)
অ-মানব-৫৩-তম-পর্ব
———————— সেলিনা জাহান প্রিয়া
আলফু মিয়া বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে । আসার আর সময় পেলে না। সোহরাব বলে পাগল তাহলে ঠিক বলেছিল বৃষ্টি হবে। তাই হচ্ছে । আলফু মিয়া বলল ঠিকেই বলেছিস ।
তা পাগল অ-মানব কি ঘুম থেকে উঠেছে । সোহরাব বলল না চাচা জান উঠে নাই । এক মিনিটে ঘুমিয়ে গেল । জগতের কোন চিন্তা নাই । আমি তার চেহারাটা ভাল করে দেখলাম । মনে হয় নিষ্পাপ মানুষ । সব সময় মুখ ভরা হাসি । কারো দিকে চেয়ে দেখে না। আলফু মিয়া বলল রুস্তম আলি কোথায় ? চাচা জান সেই বৃষ্টি দেখে আর আসলো না। তার নাকি বৃষ্টির পানি মাথায় লাগলে জ্বর উঠে । বৃষ্টি কমলে আসবে । আলফু মিয়া ঠিক আছে । বৃষ্টি কমলে মানুষটারে নিয়া । মোহনের হোটেলে ভাল করে খয়াবি । রাতে আমার সাথে বাড়িতে যাবে । একটা নৌকা বলে রাখিস ।
বৃষ্টি শেষ হল । চার দিক থেকে টিনের চালের পানি জমিতে পড়ছে । সোহরাব তার ঘরে এসে দেখে অ-মানব আপন মনে ঘুমে আছে । পাশে রুস্তম ঘুমাচ্ছে । সোহরাব দু জন ডাকে দু জনের ঘুম ভাঙে । অ-মানব ঘুম থেকে উঠে বলল কি বৃষ্টি শেষ । সোহরাব বলল শেষ মানে আজ চাচা খুব অবাক হয়েছে । অ-মানব বলল কেন আগে কোন দিন অবাক হয় নাই ।
——– কি যে বলেন আগে তো ডাকাত ছিল । সেই রকম ডাকাত । তার নাম শুনলে সাত ভাটি জেলের মানুষ কাপড় নষ্ট করে ফেলত । আপনে তার ঘরে আছেন দেখে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না।
——- রুস্তম বলল থাম তো দেখি । কোন কালে ডাকাত ছিল তা বলে কি ? এখন সে ভাল মানুষ । সবাই তার কাছে ন্যায় বিচার পায় । সোহরাব বলল চলেন ভাই মহাজন মোহন মিয়ার হোটেলে আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে ।
——- আমি হোটেলে খাব আর তোমরা ।
—— আমাদের খাবার বাড়ি থেকে আসে । আমারা খাওয়া শেষ । গতিতে রুস্তম যেয়ে খাবে । আপনি আমার সাথে চলেন ।
——- আচ্ছা চল বলে সোহরাব কে নিয়ে মোহন মিয়ার হোটেলে খেতে যায় ।
মোহন মিয়া খুব রসিক মানুষ । নতুন কাউকে দেখলে জামাই কেমন আছেন বলে সালাম দেয় । আসলে তার কোন মেয়ে নাই সাতটাই ছেলে সাত ছেলের নাম গুলো খুব চমৎকার । হিলটন মিলটন নিউটন প্লোটন , সবার ছোট টার নাম শেরাটন । অ-মানব সেই হোটেলে যাওয়া মাত্র । পান মুখে মোহন মিয়া বলল জামাই বাবু সালাম । অ-মানব বলল জান দোয়া করি আপনার একটা মেয়ে হউক ।
———– মোহন মিয়া বলল কি বলেন জামাই বাবু । আর কোন সম্ভাবনা নাই । আপনার দোয়া মনে হয় কবুল হবে না।
————- অ-মানব বলল আপনার একজন মেয়ে মেয়ে করে সাত ছেলে ।
————– আপনি দেখি সবেই জানেন । আজ যা যাদু দেখাইলেন । আপনার কোথায় জামাই বাবু সারা বাজারের মানুষ এক হয়েছে । আজ আমার হোটেলে খালি আপনারে নিয়ে আলোচনা । অ-মানব বলল তা আমাকে জামাই ডেকে আপনার ক্ষতি হবে । আমাকে আমার নামে ডাকবেন । মানুষের সাথে মজা করলে কিন্তু আপনার এক সময় বার টা বাজবে ।
————- কি ভাবে জামাই বাবু ।
————- এই যে আমাকে জামাই ডেকেছেন । তাহলে এটা আমার শ্বশুরের হোটেল ।
জামাই রা খেলে কোন দিন শ্বশুরের হোটেলে পয়সা দেয় না। সবাই কে বলল ভাই আপনাদের যা মনে চায় খান । আমার শ্বশুরের হোটেল । বিল লাগবে না।
মোহন মিয়া একটা হাসি দিয়া বলে ভুল হইছে জামাই বাবু । অ-মানব বলল আবারো একেই ভুল করলেন । সবাই মিষ্টি দই মনের মতো খাবেন । অ-মানব বলল মোহন চাচা ছেলেদের নাম বিজ্ঞানীদের নামে রাখলেন কিন্তু আপনি একদম বাংলা সাহিত্যের মত র্যে গেলেন । আজ সব জামাই ফ্রি খাবে । সবাই বলল আজ ফ্রি । মোহন মিয়ার হোটেলের একমন মিষ্টি আর দই আজ শেষ । কিছুই বলিত পারিল । সবাই খায় আর বলে শ্বশুরের হোটেলের খাবার অনেক মজা ।
মোহন মিয়ার খবেই খারাপ । এত গুলো খাবার খেয়ে গেল কেউ এক টাকাও দিল ।
এমন সময় একজন নতুন মানুষ হোটেলে প্রবেশ করলো । মোহন মিয়া আর জামাই না বলে বলল আরে কে আছিস টেবিল ভাল করে পরিষ্কার করে কাস্টমার বসতে দে । অ-মানব বলল চাচা জামাই ডাকা এক ঘণ্টায় ভুলে গেলেন । মোহন চাচা আজকের সব বিল আমি যাবার সময় দিয়ে যাব । যদি বিশ্বাস থাকে তবে আপনি সত্যি মেয়ের বাবা হবেন । মোহন মিয়া বলল আজ যেই শিক্ষা বাবাজি তুমি দিয়েছ । আমার সারা জীবন মনে থাকবে । বিচারে আমি টাকা পাই না। তবে একটা কথা যত দিন এই এলায় আছেন আমার হোটেলের খাবার ফ্রি । আর আমি আজ থেকে কাউকে জামাই ডাকব না। অ-মানব বলল আপনি না ডাকলেও আপনাকে কেউ কেউ কিন্তু শ্বশুর ডাকবে । আজ যারা ফ্রি খেলো তারা হয়ত আর খাবে না। কিন্ত তারা আপনাকে শ্বশুর ডাক ছারবে না।
অ-মানব মোহন মিয়ার হোটেল থেকে খাওয়া শেষ করে সোহরাব কে নিয়ে আলফু মিয়ার গদির দিকে গেল ।
মালেক মিয়ার মন খুবেই খারাপ । তার বিবি আছিয়া এসে বলল আজ কি হল আপনার মন দেখতাছি খুবেই খারাপ ? মালেক মিয়া বলল না কিছু হয় নাই । আমি একটু মায়ের ঘরে যাব । আমার মা যেই ঘরটায় থাকত । আছিয়া বেগম শাশুড়ির কথা শুনে একটা মুখ ভেংছি দিয়ে বলে । আজ দেখি মায়ের জন্য তোমার তোমার কলিজায় দরদ উতলাইয়া উঠছে । আসল কথা বললেই পারতা । এত ভনিতার কি দরকার । তোমার মা কি মানুষ । সারা দিন আমার সাথে ঝগড়া ছাড়া থাকতেই পারত না। যাও বাড়িতে শান্তিতে ছিলাম । মনে হয় সেই শান্তি নষ্ট করার জন্য কোন তাবিজ করেছে ।
মালেক মিয়া কোন কথা না বলে তার মায়ের ঘরে গেল । তার মায়ের ঘরে এখন রান্নার খড়ি আর মুরগী থাকে । মায়ের চকি টা তে কোন বিছানা নাই । আছিয়া খুব চিন্তায় পড়ে গেল গত এক বছরে কোন দিন মায়ের কথা মুখে আনে নাই । আজ কি হইল ।
ভাবতে ভাবতে মালেক মিয়া কে বলল লালচান আর কদম কোথায় ।
———- তারা আর কাজ করবে না ?
———- এই ছোট লোক গুলোর কি হইছে যে কাজে করবে না?
———– মালেক মিয়া বলল ওদের কি তুমি জিজ্ঞাসা কর । কাল থেকে লঞ্চ বন্ধ হয়ে যাবে । কেউ আমার লঞ্চে চাকুরী করবে না।
———– দেশে কি মানুষের অভাব পড়ছে । ভাত ছিটাইলে কাকের অভাব নাই । আমাদের কি টাকা পয়সার অভাব পড়ছে ।
————– বাজারের কোন মানুষ আমার সাথে কথা বলে না। এমন কি রিকসা ওয়ালা পর্যন্ত তার রিক্সায় তুলে না।
———– কি বল পাগলের মতো । আজ কি হইছে তোমার । মনে হয় কেউ তাবিজ করেছে । সকালে আমি কবিরাজের বাড়ি যাব । আমার স্বামী সংসারে কেউ কালু যাদু করেছে । আমার নাম আছিয়া বেগম ।
—————– মালেক মিয়া বলল শুন আমাদের বাজারের একজন পাগল মানুষ আসছে । সেই মানুষটার কথা সবাই শুনে । সে আমার সাথে কাউকে কথা বলা নিষেধ করেছে । এত বৃষ্টি আমাকে কোন রিকসা ওয়ালা পর্যন্ত তার গাড়িতে নেয় নিল না। ঐ পাগলের কথা শুনে আমার কাজ ছেড়ে দিল কদম আর লাল চান ।
—————- আচ্ছা দেখি কত বড় পাগল । কিন্তু তুমি তোমার মায়ের ঘরে গেলা কেন ? এটা তো বুঝলাম না। কোন দিন তো মায়ের ঘরে যাও না। তোমার মা
সারাদিন ঝগড়া ছাড়া কোন দিন ভাল কথা বলেছে ।
——— থাক সে কথা যে মছিবত আসছে তাই নিয়া চিন্তা কর আছিয়া বেগম। সামনে আর কি আছে কে জানে । আমার একটা ধমকে বাজার পর্যন্ত কেপে উঠত আর সেই আমি বাজারে একদিনেই আবুল হয়ে গেলাম ।
———— কোন চিন্তা কর না। তুমি ঘুমাও । আজ আর বাজারে যাওয়া লাগবে না। আমি সকালে কবিরাজের কাজে যাব । যেই কবিরাজ দেখবা পাগলরে একটা বান মেরে মুখ দিয়ে রক্ত নিয়ে আসবে ।
খুব চিন্তায় পড়ে গেল মালেক মিয়া । জীবনে এভাবে লজ্জা পেতে হবে কোন দিন ভাবে নাই । মনে মনে চিন্তা করছে । আমার মায়ের জন্য মানুষ কত ভালবাসা দেখায় কিন্তু আমি কি করব ? আছিয়া তো কোন আমার মায়ের নাম পর্যন্ত শুনতে পাড়ে না। আছিয়া কে আমি অনেক ভালবেসে বিয়ে করেছি । বিয়ের সময় তার মাকে কথা দিয়েছি তার মেয়েকে আমি বিন্দু মাত্র কষ্ট দিব না। আচ্ছা যাই হউক রাত শেষ হউক সকালে একটা ব্যবস্থা করব ।
আলফু মিয়া চা খেতে খেতে বলল বাবাজি অ-মানব । আপনি আসলেই একটা কাজের মানুষ । মোহন মিয়া সবার সাথে ফাজলামি করে । জামাই বলে ডাকে । চিনা নাই জানা নাই । আজ শিক্ষা হয়েছে । অ-মানব বলল চাচা মানুষ যে কখন কি কাজে মাজা পায় মানুষ তা নিজেই জানে না। এই ধরুন এখন এই বৃষ্টি ভেজা পথে কেউ যদি পিচিল খেয়ে পড়ে যায় । আপনি দেখবেন সবাই বোকার মতো হেসে দিবে । কিন্তু হাসা কি উচিৎ তাঁকে উদ্ধার করা উচিৎ । মানুষ বড় রহস্য ময় প্রানি । তাঁকে বুঝা বড় মুশকিল । আলফু বলল বাবাজি ঠিক কথা বলেছে । তোমার আদা দিয়ে দুধ চা খুব মজা লাগে । তা তুমি কি সব সময় এভাবে চা খাও । অ-মানব একটু হেসে বলল চাচা মানুষ কখন কি ভাবে আর কোথায় মারা যাবে সে নিজে জানে না । এই যে আপনি আজ সবার কাছে প্রিয় এই আপনি একদিন সবার কাছে ভয়ের মানুষ ছিলেন । এখন সেই ভয় আর আপনার ভালনাসা মিলে আপনি হয়েছেন মহত ।
রুস্তম এসে বলল মহাজন চাচা আপনাদের নৌকা ঘাটে বাঁধা । আজ কে আর সন্ধ্যায় বাজারে মালেক মিয়া এসে নাই ।
অ-মানব বলল তাঁকে বাজারে আসতে হবেই । আলফু মিয়া বলল চল বাজান বাড়িতে যাই অনেক রাত হয়ে গেল । অ-মানব বলল রাত মানে কি জানেন চাচ ।
আলফু বলল রাত মানে অন্ধকার । অ-মানব বলল আলোর অভাব মানেই রাত । যদি ঐ আকাশের নক্ষত্র গুলো আলো না দিত । তাহলে সারা সৃষ্টি অন্ধকার হয়ে যেত ।
এই দুনিয়া আলো মানেই আমরা একে অন্যকে দেখতে পাচ্ছি জানতে পাচ্ছি । আলো মানেই সৃষ্টিকর্তার অশেষ দান । তাই জীবন কে আলোকিত যারা না করে তারা অন্ধকারে চলে যায় । অন্ধকার মানেই অজানায় সব হারিয়ে ফেলা । আমার কাজ মানুষকে একটু আলো দিয়ে অ-মানব থেকে মানব হাওয়া । জগতে আমি মানব খুঁজি কোন মানব পাই না। সবাই আপন স্বার্থে ঠিকানা ভুলে আছে ।
চলমান—