সেলিনা জাহান প্রিয়ার গল্প: ‘অ-মানব’-(৫৫ তম পর্ব)
অ-মানব-৫৫-তম-পর্ব
——————– সেলিনা জাহান প্রিয়া
আরে খাজা মিছির আলি যে , বসেন । আলফু খুব অবাক হল কারন খাজা মিছির আলি খুব যাদু টুনা জানে । এলাকার মানুষের বিশ্বাস সে যে কোন মানুষ কে যাদু চালান দিয়ে মেরে ফেলতে পাড়ে । অ-মানব তার সাথে আর হাত মিলাই নাই । অ-মানব নিজের মতো করে পত্রিকা পড়ে হাসছে । আর একটু একটু করে চা খাচ্ছে ।।
খাজা মিছির আলি খুব অবাক হল অ-মানব তার দিকে একবার ও তাকাচ্ছে না।
অ-মানব পড়ে যাচ্ছে আর হাসছে । এবার আলফু মিয়া কে উদ্দেশ্য করে খাজা মিছির আলি বলল আলফু ভাই একটা কথা বলার জন্য আপনার এ খানে আসছি । আমি একটা খুব খারাপ খুয়াব দেখেছি । বাজারে এসে শুনলাম আপনার এখানে এক পাগল আসছে । সে নাকি মালেক মিয়ার মা কে ফিরে আনার জন্য কিছু মানুষ নিয়ে দল পাকাচ্ছে । মালেকের মা । মালেকের সমস্যা আমারা কেন এই ব্যাপারে জড়াব ? আমাদের কাজ হল গ্রামের মানুষের উপকার করা । আজ কাল শুনেছি বৃদ্ধা আশ্রম নাকি বুড়ো মানুষের জন্য খুবেই নিরাপদ । দুনিয়ার নামি দামি দেশে মানুষ বুড়ো হলে সবাই বৃদ্ধা আশ্রমে থাকে ।। আর আপনি সমাজের নামি মানুষ আপনি কি করে পাগল ছাগল জাগা দেন ?
আলফু মিয়া বলল খাজা সাহেব আপনি ঠিক বলেছেন । কিন্তু আমি যেই মানুষটা জাগা দিয়েছি তাঁকে আমার ভাল লাগে । আর আপনি জাগে পাগল বলছেন সে কিন্তু আপনার সামনেই বসা । তার নাম অ-মানব । আপনি একটু কথা বলেন ।।
খাজা মিছির আলি মাথার পাগড়ী টা ঠিক করে অ-মানব কে বলল এই যে বাবা নাও একটু আদার লাগাও হাতে । আদর দেয়া ছুয়াবের কাজ । অ-মানব হাতের পেপার রেখে একবার ভাল করে তাকালো খাজা মিছির আলির দিকে । খাজা মিছির আলি বলল কিছু বলবেন বাবাজি । আপনাকে পেয়ে খুব ভাল হল । আপনি নাকি বাজারের সব মানুষ কে এক সাথে করে ফেলেছেন । কাজটা ঠিক করেন নাই । মালেক সাব খুবেই ভাল মানুষ ।
আপনে কেন তার পিছনে লাগছেন । তার মায়ের ভাল মন্ধসে কি ভাল বুঝে না ? বৃদ্ধা আশ্রম বৃদ্ধাদের জন্য ভাল । মালেক মিয়া যা করেছে মায়ের জন্য ভাল করেছে ।
অ-মানব খাজা মিছির আলির দিকে খুব শান্ত হয়ে তাকিয়ে বলল – আপনি বলছেন যে বৃদ্ধা আশ্রম বুড়ো মানুষের জন্য ভাল । আমি ও মনে করি ভাল কিন্তু কাদের জন্য ভাল জানেন । যাদের জগত সংসারে কেউ নাই । ঠিক ইয়াতিমদের জন্য ইয়াতিম খানা আর বৃদ্ধাদের জন্য বৃদ্ধা আশ্রম । তবে যার সন্তান আছে তাদের মা বাবা কেন বৃদ্ধা আশ্রমে থাকবে ? আপনি বলেন ?
——– খাজা মিছির আলি বলল মালেকের মা ভাল থাকবে বলেই মালেক তাঁকে বৃদ্ধা আশ্রমে রেখে এসেছে ।
———- অ-মানব বলল আচ্ছা খাজা সাব আপনার খুব মালেক সাহেবের জন্য দরদ লেগেছে বুঝতে পারছি । মাত্র দুই দিনেই একজন মানুষ পেলাম যে মালেক সাহেবের পক্ষে কথা বলতে এসেছে । ভালই হল । এই সোহরাব আর রুস্তম একটা কাজ কর ।
সোহরাব আর রুস্তম বলল কি কাজ ভাইজান বলেন ? অ-মানব বলল খাজা মিছির আলি সাহেবের মায়ের খুব বয়স হয়েছে । খাজা সাহেবের বাড়িতে থাকার চেয়ে বৃদ্ধা আশ্রমে থাকা ভাল কি বলেন আলফু চাচা জান । আমি মনে করি সোহরাব আর রুস্তম মিলে খাজা মিছির আলি সাহেবের মাকে মালেক সাবের মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেই । একেই এলাকার মানুষ এক সাথে থাকলে খুব ভাল হবে ।
খাজা মিছির আলি বলল আরে মিয়া আমার মাকে নিয়া আপনার চিন্তা করতে হবে না।
আপনি এত বেশী বুজেন কেন । ছোট মানুষ আপনি আর যদি আলফু মিয়ার অথিতি না হতেন আপনাকে এই বাজার ছাড়া করতে আমার ১০ মিনিট লাগতো ।
আলফু মিয়া বলল খাজা সাব রাগ করেন কেন ? অ-মানব একটা যুক্তি দেখালও । আমার তো মা নাই । মা থাকলে বুজতাম যে ই জামানা আসছে মা কোথায় রাখলে ভাল হতো । কিন্তু আমার বউ আমার মায়েরে মনে হয় তার কলিজায় রাখছে । আমার মায়ের জন্য তার যে কি মায়া ছিল এক মাত্র উপর আল্লায় জানে । আমার মায়ের কব্রের পাশে বেলি ফুল লাগাইছে । রাতের বেলায় সেই বেলি ফুলের গন্ধ বাতাসে ভেসে আসলে আমার বউ বলে আমার মায়ের ভালবাসা নাকি বাতাসে ভেসে আসছে । আমাকে বলে সে নাকি বেলি ফুলের মাঝে আমার মায়ের গন্ধ পায় ।
খাজা মিছির আলি একদম চুপ হয়ে গেল আর তার বলার মতো কিছুই নাই । বার বার অ-মানব কে দেখছে । অ-মানব বলল একটা কথা বলি খাজা মিছির আলি সাহেব । সব সাপ দিয়ে খেলা দেখাতে নেই । কিছু কিছু সাপ আছে যারা ছোবল দেয়ার সময় সাপুরে চিনে না। খাজা সাব বলল আপনি কি বলতে চান আমাকে পরিষ্কার করে বলেন ?
অ-মানব বলল একটু আদা দিয়ে দুধ চা খান । আপনাকে একটা কথা বলি সোহরাব আর রুস্তম মানুষ জন নিয়ে তোমরা বাহিরে যাও । শুধু আলফু চাচা আর আমি খজা সাব থাকব । সবাই বাহিরে চলে গেল আলফু মিয়া বলল আজ একটা খুব দুঃখের সংবাদ শুনতে হবে । খবরটা আমাদের মোহন মিয়ার । মোহন হোটেলের মালিকের । খাজা মিছির আলি সাহেব আপনি তো মানুষের অনেক কিছু বলতে পারেন এখন বলুন মোহন মিয়ার কি খবর আজ হবে । দেখছেন আকাশের দিকে আকাশটা আজ কত নীরব ।
নীরব আকাশ আমার খুব ভয় লাগে । অ-মানবের কথা শুনে খাজা মিছির আলি বলল আকাশের সাথে মোহন মিয়ার কি সম্পর্ক ? আকাশ আকাশের জায়গায় মোহন মিয়া মোহন মিয়ার জায়গায় । অ-মানব বলল আপনার মাঝে আর আমার মাঝে সেই রকম একটা আকাশ মাটির মতো গরমিল । আপনি মানুষের বিশ্বাস নিয়ে ব্যবসা করেন আর আমি মানুষের বিশ্বাসের মাঝে তাদের সুখের আনন্দ খুজে পাই ।
খাজা মিছির আলি বলল তোমার কথার কোন আগামাথা কিছুই বুঝি না। তবে আমার কথা শুনে রাখ মালেক মিয়া কিন্তু তার মাকে তোমার কোন চাপে পড়ে কোন দিন আনবে না।অ-মানব আবার বলল খাজা সাহেব আকাশ দেখে কি মনে হয় আজ আবার বৃষ্টি হবে । একটু আকাশ টা দেখেন তো । খাজা মিছির আলি আকাশ থেকে বলে তুমি যে একটা পাগল ঠিক বুঝতে পারছি / পরিষ্কার আকাশ বৃষ্টি হবে কোথায় থেকে । অ-মানব বলল আমি যে পাগল এটা আমি জানি । কারন একমাত্র পাগল মানুষ গুলো মানুষের উপকার করে বিনিময়ে কিছুই নেয় না। তারা বার বার মানুষের কাছ থেকে দুঃখ কষ্ট পায় । কিছু দিন পড়ে সেই সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যায় আবার উপকার করে ।
খাজা সাহেব আমি অ-মানব ! মালেক মিয়ার মা এই গ্রামে আসবে । আপনি যদি কোন যাদু টুনা করে আটকাতে পারেন তাহলে বাকি জীবন আমি আপনার বাড়িতে গরুর রাখাল হিসাবে থাকব । আর যেই দিন মালেক মিয়ার মা আসবে সেই দিন থেকে আপনার ব্যবসা কিন্তু শেষ হবে । যাওয়ার সময় মোহন মিয়ার হোটেলে হয়ে যাবেন ।
আপনি হোটেলে যাওয়া মাত্রই মোহন মিয়ার একটা দূর সংবাদ আসবে । এটা শুনার পড় আমি আশা করব আমাকে নিয়ে আপনি চিন্তা বাদ দিবেন ।
আলফু মিয়া বলল কি দূর সংবাদ । অ-মানব বলল আগে খাজা মিছির আলি সাব হোটেলে যাক ।
মিছির আলি খুব রাগ পেল । মনে মনে বলে পাগলের নামজান্ত কোথাকার ! খাজা মিছির আলি বলল আলফু ভাই গেলাম । অচেনা মানুষ বাড়ি ঘরে জায়গা না দেয়াই ভাল । আমি আসি একটা কথা মনে রাখবেন । আপনি যে অ-মানব কে জায়গা দিয়েছেন । আসলে সে একটা অমানুষ । অ-মানব বলল সময় বলে দিবে কথা । কারন সময় কাউকে ক্ষমা করে না।
খাজা মিছির আলি আলফু মিয়ার ঘর থেকে বের হয়ে দেখে বাহিরে অনেক মানুষ । সবাই মনে হয় পাগলটারে দেখতে আসছে । কোথায় থেকে যে পাগল ছাগল আসে । বেটা আমাকে চিনে না। আমার বাড়িতে একটা গরু জবাই দিয়ে সবাই কে বলল অ-মানব এই গ্রামের জন্য অভিশাপ । এমন কিছু কাজ করব । অ-মানবের বাচ্চারে মানুষ পিটাইয়া গ্রাম ছাড়া করব ।
অ-মানব মনে মনে হাসছে । আলফু মিয়া বলল খাজা মিছির আলি কিন্তু মানুষ কে যাদু করে মেরে ফেলতে পাড়ে । অ-মানব একটা হাসি দিয়ে বলে তাহলে তো দেশে কোন সরকার থাকতো না। খালি সবাই খাজা মিছির আলির কাছে এসে বলল আমি বিরোধী দল এই নেন টাকা । হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ । চাচা মানুষকে বনের বাঘে খায় না । খায় মনের বাঘে । খাজা মিছির আলি দূর থেকে মোহন মিয়ার হোটেলের দিকে দেখছে । একবার মনে মে বলে আচ্চা যাই দেখি অ-মানব বলল আমি যাওয়া মাত্র নাকি দূর সংবাদ শুনবে । আচ্ছা হোটেলে যাই । হোটেলের সামনে থেকে ভিতরে প্রবেশ করতেই মোহন মিয়া বলল খাজা ভাই যে আসেন আসেন । খাজা মিছির আলি মনে মনে হেসে হেসে হোটেলে প্রবেশ করলো আর এমন সময় খবর এলো মোহন মিয়ার বউ মারা গেছে । খাজা মিছির আলি এক দম চুপ হয়ে গেল । আরে অ-মানব কি তাহলে এই কথা বলেছে ? অল্প সময়ের মধ্যে সারা বাজারে মানুষ জেনে গেল । মাইকে ঘোষণা দিচ্ছে । আলফু মিয়া অ-মানবের দিকে তাকিয়ে আছে । অ-মানব হাতের পেপার রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে ।
আলফু মিয়া বলল বাবা তুমি কে আমাকে একটু বলবে ? অ-মানব বলল চাচা আমি আপনাদের মতো মানুষ হতে চেষ্টা করছি আমি আসলে একটা অ-মানব ।
আলফু মিয়া আর কিছুই বলে না। আকাশের দিকে তাকায় পরিষ্কার আকাশ টা মেঘে ভরে গেছে । অ-মানব গদি ঘর থেকে বের হয়ে আকাশের দিকে দুই হাত মেলে ধরে আর বৃষ্টি শুরু হয় । আকাশ যেন ফেটে পড়ছে বৃষ্টিতে । অ-মানব সেই বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে । খাজা মিছির আলি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আকাশের দিকে তাকায় । জীবনে কোন দিন সে এমন মানুষ দেখে নাই । মনে মনে বলে আজ থেকে আর মানুষ কে ঠকাবো না । আমি ও ভাল কাজ করব ।। আসলেই সে মানুষ না অ-মানব ।
চলমান———–