আনন্দানুভূতি ও গভীর শংকা নিয়ে দেশের পথে
আনন্দানুভূতি ও গভীর শংকা নিয়ে দেশের পথে
সিডনীর কথকথা-৫০
রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্যন্যাপ
ঊসধরষ-ৎধহবংযসধরঃৎধ@মসধরষ.পড়স
“ফিরে চল মাটির টানে
যে মাটি আঁচল পেতে
চেয়ে আছে মুখের পানে….”
বিখ্যাত এই গানটির উপরে বর্ণিত কলি কতই না প্রিয় ও আবেগ সঞ্চারিত ! দূরদেশ থেকে স্বদেশে ফেরার প্রাক্কালে এমন কোন বাঙালিকে হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না যাঁর মনে ঐ স্তবকটি অনুরনণ তোলে না। আটমাস কয়েকদিন অষ্ট্রেলিয়ার সিডনী নগরীতে থেকে দেশে ফেরার প্রাক্কালে আমার মনেও অনুরূপ প্রতিক্রিয়ার অনুভব। হয়তো বিমান থেকে নেমে দেশের মাটিতে যখন পা ফেলবো তখন আবার নি:শব্দেই হয়তো গেয়ে উঠবো
“ও আমার দেশের মাটি
তোমার পরে ঠেকাই মাথা”
বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাংলার কবি-শিল্পীরা কত অসাধারণ রচনাই না যুগ যুগ ধরে স্বদেশ প্রেমের অনুভূতি বাঙালী চিত্তে সঞ্চারিত করে চলেছে; আমার মত নীরস, কাঠখোট্টা মানুষের মনেও কবি শিল্পীদের চিরস্মরণীয় ঐ পংক্তিগুলি অসাধারণ প্রেরণা আজও সৃষ্টি করে চলেছে।
অষ্ট্রেলিয়াতে প্রথমদফা আসি ২০০০ সালে। ভিসা ছিল ছয় মাসের। ঐ বছরেই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক ক্রীড়া উৎসবের আয়োজন হয়েছিল সিডনী নগরীতে-সিডনী অলিম্পিক। এ নিয়ে তখন দেশের কোন কোন পত্রিকায় সিরিজ লিখেছি। সে এক অসাধারণ প্রাণ চাঞ্চল্য লক্ষ্য করেছিলাম এখানকার নারী পুরুষ শিশু-কিশোর, যুবা-বৃদ্ধকে আহার নিদ্রা ত্যাগ করে উৎসবে মেতে উঠতে দেখেছিলাম ঐ অলিম্পিককে কেন্দ্র করে। বড় ছেলে প্রবীর টিকিট কেটেছিল একটি খেলা পরিবারের সবাই মিলে দেখবো বলে। কিন্তু বিধি-বাম। আকষ্কিক দুর সংবাদ এলো পাবনা থেকে। মেজ ভাই, পাবনা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান বীরেশ মৈত্র তার্ট এ্যাটাকে পরলোগমন করেছে। দ্রুত ছুটতে হলো তার শেষ কৃত্যে যোগ দিতে-তাই খেলাটি দেখার যে অপূর্ব সুযোগ এসেছিল তা কাজে লাগানো গেল না।
তবে একটি আনন্দের কথা আজও আমরা ভুলি নি। ঐ দফা সিডনী ছয় মাসের ভিসায় আসার পর আমাদের নাতির জন্ম হলো- নাম দিলাম অনির্বাণ। অনির্বাণ শব্দটি নিলাম পৃথিবীব্যাপী ঘুরে (………) যখন সিডনী এসে দৌড়াতে থাকলো-মনে পড়ে গেল সদৃশ্য এবং একই সাথে মনে পড়লো শিখা অনির্বাণ। সেই অনির্বাণ আজ এইচ.এস.সি পড়ছে-আর ক্রিকেটে অলরাউন্ডার হিসেবে আন্তর্জাতিক ম্যাচেও যোগদিতে শুরু করেছে।
এ রকম বহু সুখ স্মৃতি সিডনীকে ঘিরে, সিডনীস্থ আমাদের বর্ধিত পরিবারকে ঘিরে, এখানে প্রবাসী বাঙলী সংস্কৃতি সেবী, রাজনীতিক ও পেশাজীবীদেরকে ঘিরে। এ স্মৃতি শুধুমাত্র কথার কথা নয়-রীতিমত তা অন্তত: আমার কাছে বিশাল এক আনন্দঘন অভিজ্ঞতা যার জন্যে আমি গর্ব অনুভব করি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই সবার কাছে বিদায়ের এই লগ্নে।
বস্তুত:ই সিডনী আমাদের (……) এ পরিণত হয়েছে। ঘুরে ফিরেই এখানে আসি-আসতে বাধ্য হই প্রবীরের পীড়াপীড়িতে। প্রবীর ভাবে দেশে থাকলেই তার বাবা-মায়ের উপযুক্ত চিকিৎসা হবে না, তাদের স্বাস্থ্য ভাল থাকবে না তাই সিডনীর স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, সুচিকিৎসার আধুনিকতম ব্যবস্থাদির সুযোগ নিয়ে সে আমাদেরকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু আমি ৮৬তে এবং সহধর্মিনী পূরবী যে ৭৬ এ পা রাখতে চলেছে এবং আর ভাবনায় নেই। তাই বার বার আসা-চিকিসাদির সকল সুযোগ গ্রহণে তাবৎ ব্যবস্থা-এগুলির স্মৃতি নিয়েই ফিরছি শীঘ্রই দেশের মাটিতে।
বিশাল দেশ অষ্ট্রেলিয়া। সম্ভবত: ছয় সাতটি ভারতের আয়তনের যোগফলের সমান। তবে তার রাজ্য (প্রদেশের সংখ্যা মাত্র ৭/৮টি)। কিন্তু সারা অষ্ট্রেলিয়ার জন সংখ্যা বর্তমানে বাড়তে বাড়তে হয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র আড়াই কোটি। কিন্তু জনসংখ্যা রাষ্ট্রীয়ভাবে আদৌ নিয়ন্ত্রণ করা হয় না-বরং অধিক সংখ্যক সন্তানকে রাষ্ট্র স্বাগত জানায়।
এসব নিয়েই অষ্ট্রেলিয়া একাই একটি মহাদেশ-যাকে ঘিরে রেখেছে প্রধানত: প্রশান্ত মহাসাগরের সুবিশাল অসীম জলরাশি। এই মহাদেশের আদি বসতি ছিল আদিবাসীদের। কিন্তু ইংল্যান্ড থেকে কয়েক শত-বছর আগে আদালতে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের এই জেলে দীপান্তরিত করা হয়। তারা ক্রমে ক্রমে যখন সংখ্যায় বৃদ্ধি পায় তখন তাদের বাসস্থানের জন্য জমি এবং খাবার দাবারের প্রয়োজন বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই পর্য্যায় সংঘাত শুরু হয় এখানে আসা বৃটিশ কয়েদীদের সাথে।
তখন তারা ইংল্যান্ড থেকে উৎখাত অস্ত্রপাতি আমদানী করতে শুরু করে। শুরু হয় যুদ্ধ ইংরেজদের সাথে অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের। যুদ্ধ হয় দীর্ঘস্থায়ী। বলাই বাহুল্য, যুদ্ধটি ছিল অসম কারণ অষ্ট্রেলীয় আদিবাসীদের হাতে ইট পাটকেল আর তীর ধনুক। এই অস্ত্র নিয়েই আদিবাসীরা দীর্ঘমেয়াদী লড়াই চালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও, শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
ইংরেজরা আদিবাসীদেরকে পরাজিত করে তাদেরকে ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ করে সেগুলি দখল করে নিয়ে নিজেদের বসবাসের জন্য উন্নত ধরণের বাড়ীঘর নির্মাণ করে। অনেক আদিবাসী নারীকে নিয়ে ইংরেজরা দৈহিতক সম্পর্ক স্থাপন করায় বহু শিশু ঐভাবে জন্মও নেয়।
ধীরে ধীরে রাস্তাঘাট নির্মিত হয় যান বাহান চলাচল শুরু হয়। শুরু হয় স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। এই ভাবে দেশটি ক্রমান্বয়ে দ্বিতীয় ইংল্যান্ডের মতই গড়ে ওঠে। এখন অষ্ট্রেলিয়া বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ। ফল-কৃষি ও পশুপালন দুধ, মাখন, মাছ-মাংসের প্রাচুর্য্যের দেশ।
আদিবাসীরা ক্রমান্বয়ে শক্তিহীন হয়ে পড়ে তাদের সংখ্যা কমতে কমতে আজ সম্ভবত: ৫ থেকে ১০ লাখের বেশী না। অবশ্যসঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য এ বিষয়ে আমার হাতে নেই কিন্তু কয়েক বছর আগে শুনেছিলাম সংখ্যাটা ৫ লক্ষ। নিশ্চিতভাবে ইতিমধ্যে তাদের সংখ্যা বেড়েছে তবে ১০ লাখ নাও পৌঁছে থাকতে পারে। আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতি, তাদের শিল্পকর্ম অত্যন্ত উন্নত। তাদের জন্যে তৈরী করা এবং অত্যন্ত যত্নে সংরক্ষণ করা মিউজিয়াম দেশের বেশ কয়েকটি শহরে রয়েছে। এগুলি এদেশের ইতিহাস জানতে অনিসন্ধিৎসু দেশী-বিদেশী পর্য্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষনীয়।
অতীতের চাইতে কিছুটা উন্নত হলেও আদিবাসীরা শিক্ষা-দিক্ষা-চাকুরী-ব্যবসায় প্রভৃতিতে এখনও যথেষ্ঠ অনুন্নত। তাদের ভাষা সংস্কৃতি ও যথেষ্ঠ পরিমাণে পিচিয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের করণীয় বিস্তর কারণ অষ্ট্রেলিয়া একটি অত্যন্ত উন্নত (……) (বহু সংস্কৃতির ও বহুভাষী) দেশ। তবে সত্যও বটে ইংরেজী ভাষার অন্তরালে স্থান নিতে বাধ্য হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ও রাষ্ট্রের করণীয় বিস্তর কারণ যত বেশী ভাষা যত বেশী সংস্কৃতি উন্নত হবে নাগরিকরাও ততই উন্নত হবে পারষ্পারিক নৈকট্য ও মর্য্যাদা বোধও বাড়বে।
এবারে অষ্ট্রেলিয় বাঙালি মূলত: সিডনীর প্রবাসী বাঙালিদের প্রসঙ্গে আসি। অষ্ট্রেলিয়ায় যে সংখ্যক বাঙালি এ যাবত অভিবাসন করেছেন তার সিংহভাগই সিডনীতে। এখানকার পরিবেশ, আবহাওয়া অনেকটাই বাংলাদেশের আবহাওয়ার অনুরূপ নীতিশীতোষ্ণ। অবশ্য আজকের বাংলাদেশকে কোনক্রম্ইে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া সম্পন্ন দেশ বলে অভিহিত করা যায় না। বাংলাদেশ এখন কার্য্যত: অত্যন্ত উষ্ণ একটি দেশে পরিণত হয়েছে। বছরে দুটি মাস বাদে বাকী ১০টি মাসই প্রচন্ড গরম-শীতকাল কার্যত: উধাও। দুটি মাস শীত থাকলেও তেমন একটা শীত অনুভূত হয় না ৫/৭ দিন ছাড়া। তাই গরম শীতবস্ত্রের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
আমি যতটুকু অনুভব করেছি, সিডনীস্থ বাঙালি সমাজ সার্বিকভাবে দেশের সংস্কৃতি বজায় রেখে চলতে অত্যন্ত সক্রিয় ও সচেষ্ট। বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলেছেন বাঙালি শিল্পীরা এবং শিল্পানুরাগীরা। মাতৃভাষা বাংলাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই সাধ্যানুযায়ী সচেষ্ট ভাবা অনুরোগীরা। কাজটি দুরূই অত্যন্ত দুরুই কারণ বাড়ী থেকে বের হলেই সব কিছু ইংরেজী ভাষাতেই করতে হয়। কি স্কুলে কি কলেজে, কি বিশ্ববিদ্যালয়ে, অফিসে, আদালতে, ক্লাবে, লাইব্রেরীতে, শপিংমল এ এবং এক কথায়, শুধই ইংরেজীর ব্যবহার। একটি আন্তর্জাতিক ভাষার এই দাপুটে বিচরণের মধ্যে অপর সকল ভাষাই বহুলাংশে কোনঠাসা হয়ে আছে। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ও অপরাপর উল্লেখযোগ্য ভাষা শিক্ষাদান এবং জীবন ও চাকুরী বাকুরীসহ সকল আর্থিক ক্ষেত্রে তার ব্যবহার যতদিন শুরু না হবে ততদিন অপরাপর ভাষা পর্দাল অন্তরালেই থেকে যাবে হয়তো।
এত সব প্রতিকূলতার মধ্যেও বেশ কয়েকটি বাংলা পত্রিকার (অন্যান্য ভাষাতেও) প্রকাশ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বাংলা পত্রিকাগুলি দৈনিক প্রকাশিত হোক-এমন ভাবনা এখনও বাস্তব সম্মত নয়। তবে সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা, অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আকৃতির হলেও, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া, নারী উন্নয়ন ও সেগুলির পর্য্যালোচনা নিয়ে প্রকাশিত হওয়া অবশ্য প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সাপ্তাহিক পত্রিকা যখেষ্ট আকর্ষণে সক্ষম হবে কিনা, যথেষ্ট সংখ্যক বাংলা টাইপিষ্ট ও সংবাদ কর্মী পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে। যথেষ্ট লড়াই করে এখানে সকলকে বাঁচতে হয়ে-বিপুল পৈত্রিক সম্পত্তির বা ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিক তো কেউ নন। তাই যাঁরাই কাজ করবেন ঐ সাম্পাহিকগুলিতে তাদের উপযুক্ত বেতন না দিলে কাউকে আকৃষ্ট করা সম্ভব না। তবে কেউ ফুলটাইম, আবার কেউ পার্ট টাইম কাজ করবেন-এ রকম কিছু একটা ভেবে দেখার প্রস্তাব রাখলাম বাংলা সাংবাদিকতা, বাংলা সাহিত্যিক, কবি প্রভৃতি তৈরীর স্বার্থ।
এখানকার পত্রিকাগুলি বর্তমানে মাসিক আকারে (তবে সাহিত্যপত্র নয়) প্রকাশিত হচ্ছে যেমন মুক্তমঞ্চ, স্বদেশ বার্তা প্রভৃতি। ছাপা এবং মুদ্রণশৈলী ও বিষয়বস্তু আকর্ষণীয়। প্রবন্ধ, কলামগুলিও যথেষ্ট মানসম্মত এবং বিষয় বৈচিত্র সম্পন্নও বটে। আশা করি যাঁরা এগুলি প্রকাশ করছেন তাঁরা আমার উপরোক্ত প্রস্তাবগুলি সক্রিয়াভাবে ভেবে দেখবেন। পত্রিকাগুলি আমার বেশ কিছু লেখা প্রকাশ করেছে।
এই দফা সিডনী সফর আমার ও পরিবারের সদস্যদের জন্য বিশেষ আনন্দের সকল শুভাকাংখীর জন্যও বটে।
মধ্য জানুয়ারীতে সিডনী এলাম আমাদের আদরের নাতনী ঈহিতা মৈত্রের বিয়েকে সামনে রেখে। প্রচুর ধুমধাম সহকারে এই উৎসবটি সুসম্পন্ন হওয়ায় তৃপ্তি সবাই অনুভব করেছি মেতে থেকেচি বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে। বাঙালী হিন্দু এবং অষ্ট্রেলিয় খৃষ্টান দম্পতি উভয় সংস্কৃতির পৃথক পৃথক অনুষ্ঠান এবং সবশেষে মিলিত সম্বর্ধনা উৎসবে বহুজনের আগ্রহ অংশগ্রহণ উৎসবের সাফল্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। নাতি অনির্বাণ এবারই প্রথম বিদেশে (ওয়েষ্ট ইন্ডিজ) ক্রিকেট থেকে এলো।
আবার আমার একুশে পদক প্রাপ্তি যেন সিডনীর সাংস্কৃতিক বাঙালি মহলকেও বিপুলভাবে উৎসাহিত করলো। কত যে অভিনন্দন বার্তা, কত সম্বর্ধনা, কত ক্ষেত্রে প্রধান বা বিশেষ অতিথির আমন্ত্রণ, যা সিডনীর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংগঠনগুলির কাছে আমাকে কৃতজ্ঞতা টাকে আবদ্ধ করেছে।
সংবাদকর্মী আনিসুর রহমান সাখাওয়াত নয়ন ও তার সহধর্মিনী অনিলা পারভীনসহ ঘন্টাব্যাপী যে সাক্ষাতার নিয়ে ফেইস বুকে বিশ্বজোড়া তার ব্যাপক প্রচার করলেন তা ভুলবার নয়। ক্যাম্বেলটন বাংলা স্কুলের নিষ্ঠাবান শিক্ষিকা সেলিমা বেগম ও তারিক তাঁর স্কুলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যে সম্বর্ধনার আয়োজন করেছিলেন তা এতই মুগ্ধ করেছিল যে স স্মৃতি বহন করবো আরও অনেকদিন।
জন্মভুমি টেলিভিশন সম্ভবত: ২০ ফেব্রুয়ারিতে নিলেন মস্ত ইন্টারভিউ যা প্রচারিত হলো ৬০ মিনিটেরও বেশী সময় ধরে। সে এক অনবদ্য আন্তরিকতামূলক অনুষ্ঠান ।
আরও অনেকে নানা সংগঠনে আমন্ত্রণ জানিয়ে সম্মানিত করেছেন।
এখানকার আওয়ামীলীগ, আওয়ামী যুবলীগ নেতা নোমান শামীম একাধিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে সম্মানিত করেছেন।
অপর মিডিয়া কাম সামাজিক সংস্কৃতিক সংগঠন আবুল কালাম আজাদ এর নবধারা নিউজ সর্বশেষ আজীবন সম্মাননা দিয়ে অভিভূত করলেন এই তো দিন কয়েক আগে। একটি অসাধারণ অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রাণভরে উপভোগ করেছি।
এখানে থাকাকালে এপ্রিলের শেষে এসেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথম দিন তাঁর সম্বর্ধনার বিশাল আয়োজনে শরীক হয়েছিলাম বিশেষ আমন্ত্রণে। এ অনুষ্ঠানটি আরও সমৃদ্ধ করা যেত সঙ্গে একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করে ও সিডনীর কৃতী বাঙালিদের সাথে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে।
আপাদমস্তক বাঙালি, বাঙালিত্বের ধারক, বাঙালী সংস্কৃতির উপাসক স্নেহভাজন সিরাজুল সালেকিন প্রসঙ্গে। সালেকীন অসাধারণ নিষ্ঠা নিয়ে বিপুল সংখ্যক সংগীত ও নৃত্য শিল্পী গড়ে তুলেছেন হাজার হাজার ঘন্টা সময় ব্যয় করে একটি মাত্র লক্ষ্যে-সিডনীতে বাঙালির নতুন প্রজন্ম বাঙালি সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীতকে আপনা করে নিক। তার হাতে গড়া সংগঠন “প্রতীতি” যে উচ্চমানের অনুষ্ঠানদি দিয়ে সেই প্রচেষ্টা অব্যাবহত রেখেছে তা এক কথায় অতুলনীয়। পহেলা বৈশাখ, রবন্দ্র জন্ম ও প্রয়াণ, নজরুল জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকী, সুকান্ত, পৌষ উৎসবসহ নানা কিছুর আয়োজনে জীবনভর তার ব্যস্ততা। দেশেও প্রগতিশীল ছাত্র-আন্দোলনি ছিল সালেকিনের ব্যাপক অবদান।
প্রতীতি সিডনীতেই শুধু নয়-গোটা অষ্ট্রেলিয়ায় নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন নানা সময়ে করেছে-ছায়ানট উদীচীর সাথেও আছে তার সক্র্রিয় যোগাযোগ।
প্রতীতি ও সালেকিন ও এখানকার সাংস্কৃতি কর্মীরা এক অবিভাজ্য বন্ধনে আবদ্ধ। গোটা অষ্ট্রেলিয়া ব্যাপী প্রতীতির সাংগঠনিক প্রসার ও বিস্তৃতি ঘটুরক কামনা করি। এ আকাংখা পূরণও হবে বিশ্বাস রাখি।
এই সব সুখ-স্মৃতি অতীতের সকল সিডনী সফরের স্মৃতিকে ছাপিয়ে উঠেছে যা মনে থাকবে বহুদিন।
আবার বেদনার্ত চিত্তে দেশে ফিরতে হচ্ছে সে দুশ্চিন্তাও কম নয়। আমাদের মেজ মেয়ে মালবিকা দীর্ঘদিন যাবত ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্বদ্যিালয় হাসাপাতালে আই.সি.ইউতে কঠিন কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। মালবিকাকে আমরা কুমকুম বলে ডাকি। কুমকুমের জন্ম ১৯৭০ সালে। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধকালে সে মায়ের কোলে আজ গ্রামে কাছে এক গ্রামে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে অবিরাম পাক-বাহিনীর গুলিতে পাখীর মত মানুষ মারার দৃশ্য দেখেছে-শিশুচিত্ত আতংকিত হয়েছে। আর সেখান থেকেই তার দেহে নানা রোগের উৎপত্তি। আমাদের কুমকুম মুক্তিযুদ্ধ সচেতনভাবে দেখেনি কিন্তু তার বেদনা আজও সয়ে বেড়াচ্ছে। তাকে বাঁচনোর আপ্রাণ চেষ্টা করছি আমরা সবাই- শুভাকাংখী আরও অনেকে।
ফিরে গিয়ে ক্রমান্বয়ে সুস্থ হয়ে উঠছে আদরের মেয়ে কুমকুম অন্তরে এই কামনা নিয়েই দেশে ফিরছি বেদনাহত শংকিত উদ্বিগ্ন আশাবাদী চিত্তে।
সিডনী বাসী সকল সুহৃদ ভাল থাকুন।
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপিগরীয়সি।
লেখক : রণেশ মৈত্র, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।