আমার দেখা একাত্তরের বিজয় দিবস
আমার দেখা একাত্তরের বিজয় দিবস
রণেশ মৈত্র
১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর আমাদের সুমহান বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির জীবনের ভয়াবহ কষ্ট , বর্বর পাকিস্তানি হানাদার দখলদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার এবং তার ভয়াবহ তান্ডব-লীলায় অবসান ঘটিয়ে ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্নে যে আত্মসমর্থনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুষ্ঠান যুদ্ধ বিধ্বস্ত ঢাকা মহানগরীতে ঘটলো, আকাশের বিদায়ী সুর্য যেন তখন ভোরের লাল টুকটুকে সূর্যের মত মনে হচ্ছিল বাঙালি জাতির কাছে। গোটা পৃথিবী তাকিয়ে ছিল এই ঘটনাটির দিকে। হর্ষোৎফুল্ল জনতার মুহুর্মুহু করতালি ও বিজয় মিছিল ঢাকা শহরে কতটা ঘটেছিল – কতটা স্বতঃস্ফুর্ততার সাথে রাজপথ প্রকম্পিত করেছিল জানি না তবে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত কোটি কোটি বাঙালি সেদিন তাদের অন্তরে গভীর আনন্দে সীমাহীন চাঞ্চল্য ও উদ্দীপনা নিয়ে উৎসবমুখরতার স্বাদ ও তৃপ্তি অনুভব করেছিল। তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
সৌভাগ্য আমার, কিঞ্চিত হলেও তা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ঐদিনই এবং ঐ সময়েই আমার ঘটেছিল শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যার খবরে হৃদয় বেদনার্ত থাকা সত্ত্বেও। অতীতে বলেছি এবং কখনও কখনও হয়তো লিখেও প্রকাশ করেছি – পাবনা প্রথম দফা মুক্ত হয়েছিলো তার জেলা শহরে প্রথম দফায় আসা ২০০ শত সদস্য বিশিষ্ট পাকিস্তানী সেনা কনটিঞ্জেন্টের সকল অস্ত্রসজ্জিত, আধুনিক সামরিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত সেনা-কর্মকর্তা ও জওয়ানদেরকে হত্যা করে (তৎকালীন যোদ্ধাদের ভাষায় finish করে)। তার পর পরই পাবনার হাইকমান্ড বসে আমরা সিদ্ধান্ত নিই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা বন্ধু এডভোকেট আমজাদ হোসেনসহ কাউকে না জানিয়ে চলে যাব পশ্চিম বাংলায়, ভারত সরকারের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করে কিছু প্রশিক্ষক ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ফিরে যুবক-যুবতীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সম্ভাব্য দ্বিতীয় দফার পাকিস্তানী সেনা হামলার কবল থেকে পাবনাবাসীকে রক্ষা করার জন্যে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এপ্রিলের পহেলা বা ৩১ মার্চ দু’খানা পঞ্চাশ টাকার নোট সংগ্রহ করে এক বস্ত্রে ছুটে গেলাম কলকাতায়। এক আত্মীয়ের বাসায় উভয়েই উঠলাম এবং সরকারের কাউকে না চেনার সমস্যা দূর করার মাধ্যম হিসাবে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করলাম স্থানীয় সিপিআই এর সাথে। এবং তাঁরাও যদিও অচেনা ব্যক্তিগতভাবে, তবুও নাম শুনে কি করে জানি না, তাঁরা চিনে এবং বিশ্বাস করে ফেললেন। তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন জননেত্রী পরম শ্রদ্ধেয় ইলামিত্রের বাড়িতে। তিনি ও তাঁর স্বামী কমরেড রমেন মিত্র শোনা মাত্র যোগাযোগ করলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের প্রাদেশিক সাধারণ সম্পাদক বিশ্বনাথ মুখার্জীর সাথে। পরদিন দেখা করলাম তাঁর সাথে। তিনি সব কিছু শুনে নিয়ে গেলেন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জীর কাছে। অজয় মুখার্জী সব শুনে আস্থায় নিলেন আমাদেরকে তবে বললেন, তাঁদের সকল সমর্থন ও সহযোগিতার আকাংখা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা কিছু করতে অপারগ কারণ বিষয়টি পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের। তাই তিনি আমাদের বাসার ঠিকানা এবং ফোন নম্বর নিয়ে রাখলেন এবং বললেন তিনি খোদ প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে যোগাযোগ করে যত শীঘ্রসম্ভব আমাদেরকে জানাবেন।
তিনি যোগাযোগ-কথাবার্তা শেষ করে তিন দিন পর আমাদেরকে ডেকে পাঠালেন। ছুটলাম মহাকরণে। মুখ্যমন্ত্রী বললেন প্রধানমন্ত্রীও আপনাদের সাথে সহানুভুতি জানিয়েছেন এবং আমরা চাইলে এখুনি আমাদেরকে দিল্লীর দুটি রিটার্ন টিকেট এবং প্যাসেজ মানি দিতে পারেন। আবার ইতোমধ্যে তাজউদ্দিন সাহেব এসে পৌঁছেছেন এবং আগামীকাল দিল্লী থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত কলকাতায় আসছেন তাজউদ্দিন সাথে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে। তাতেও দিল্লী যাওয়ার সমান ফলই অর্জিত হবে। আমরা দ্বিতীয় বিকল্পকে গ্রহণ করার কথা তাঁকে জানিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। ইতোমধ্যে সন্ধ্যের আকাশবানীর খবরে জানলাম ১০ এপ্রিল অর্থাৎ দু’দিন আগেই পাবনার পতন ঘটেছে পাক সামরিক বাহিনীর কঠিন আক্রমণে পাবনার বহু ক্ষয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। কোন পথই আর খোলা নেই পাবনার সাথে যোগাযোগ করার । তাই আমরাও দেশে ফেরার বদলে কি করা যায় ভাবতে লাগলাম। আমজাদ সহেব চলে গেলেন তাজউদ্দিন সাহেবের ঠিকানায় এবং যোগাযোগ করে জানলেন দিল্লী গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আজউদ্দিন সাহেব আলোচনা করবেন এবং তার উপরেই পরবর্তী করণীয় নির্ভর করছে। অপরদিকে ইলা মিত্রের বাসায় গিয়ে আমার দেখা হলো প্রগতিশীল কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সাথে। তিনি সদ্য যুদ্ধরত ভিয়েতনাম সফর করে এলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন-যা পরবর্তী কোনো সুযোগে লেখার ইচ্ছে রইলো। এলেন কমরেড মণি সিংহও । তিনি ২৫ মার্চের পর রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙ্গে বেরিয়ে আগরতলায় যান। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভা শেষ করে সদ্য কলকাতা এসেছেন। কলকাতায় অবস্থানরত বাংলাদেশের কমরেডদের সাথে এবং সিপিআই নেতাদের সাথে দেখা করে সম্ভবত দিল্লী যাবেন। মনি দা জড়িয়ে ধরে পাবনার খবর সবিস্তারে
শুনলেন, শুনে বললেন, চলে এসে খুব ভালো করেছেন। অবস্থানরত প্রয়োজনীয় প্রবীণ ও তরুণকে এখানে আসার ব্যবস্থা করান। আর জেলা ওয়ারী রিক্রুটিং ক্যাম্প স্থাপন করার লক্ষ্যে পাবনা জেলার সীমান্তের কাছাকাছি কোথাও জায়গা বাসাভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা করুন এবং রিক্রুটিং ক্যাম্প স্থাপন করে সেখানে প্রগতিশীল তরুণদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করুন এবং সাথে রাজনৈতিক-সামরিক ভাবে বিশ্বাসযোগ্য হবে কি-না তা পর্যবেক্ষণ করুন। হলে তালিকা তৈরি করে পার্টির কলকাতায় প্রতিষ্ঠতব্য হেড অফিসে পাঠালে আমরা তাদের গেরিলা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবো।
খুব গ্রহণযোগ্য মনে হলো এই কথা শুনে। ছুটলাম নদীয়া জেলার করিমপুরে সেখানকার সিপিআই নেতাদেরকে খোঁজ করে ছোট একটি দালান বাড়ি ভাড়া পাওয়া গেল। সেখানে ঈশ্বরদীর সামসুজ্জামান সেলিম, কামাল আহমেদ ও পাবনার আরো কয়েকজনকে নিয়ে দিন কয়েক সেখানে থেকে আর একটি মাঝারি ধরণের মাঠসহ কাঁচা বাড়ির সন্ধান পেয়ে দালান বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে সেখানে আমাদের ক্যাম্প স্থাপন করলাম। পাবনা জেলার ন্যাপসিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন কমীর্দের গেরিলা প্রশিক্ষণের রিক্রুটিং ক্যাম্প বা ইয়ুথ ক্যাম্প হিসেবে। এর পরের নয় মাসের কথা অনেক দীঘর্। তার বর্ণনার লোভ সামলে এখন আলোচ্য ১৬ ডিসেম্বর প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
হঠাৎ ফোনে পরদিন খবর এলো ১২ ডিসেম্বর (যতদুর মনে পড়ে) তলবটা এসেছিলো কোলকাতা পার্ক সার্কাসে অবস্থিত আমাদের দলীয় প্রধান কার্যালয় থেকে-ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ ডেকেছেন। আমি জানালাম, পরদিন ১৩ ডিসেম্বর আমার রিক্রুটিং ক্যাম্প থেকে ৩০ জন যুবক গেরিলা প্রশিক্ষণে যাবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা গাড় নিয়ে আমাদের ক্যাম্পের সামনে এলে তাদেরকে বিদায় জানানোর পর সময় থাকলে ঐদিন বিকেলে যাব। কিন্তু যদি ঐ বৃহৎ ব্যাচকে পাঠাতে সন্ধ্যা হয়ে যায় তবে আমাকে পরদিন অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর যেতে হবে। তাঁরা এতে সম্মতি দিলেন। ১৩ ডিসেম্বরে সংশ্লিষ্ট সামরিক কর্মকর্তার আসতে বিকেল হয়ে গেল এবং ছেলেদেরকে পাঠাতে পাঠাতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল। আমি ছিলাম আমার প্রতিষ্ঠিত নদীয়া জেলার করিমপুর ক্যাম্পের পরিচালক আর পরবতীর্তে যোগ দেন পাবনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টি তৎকালীন অন্যতম নেতা কমরেড প্রসাদ রায় সহকারী পরিচালক হিসেবে।। তাঁরও কলকাতা যাবার প্রয়োজন ছিল কিন্তু আমাকে যেতে হচ্ছে দেখে তিনি থেকে গেলেন।
১৪ ডিসেম্বর ভোরে করিমপুর থেকে বাসে রওনা হয়ে কৃষ্ণনগর এবং সেখান থেকে বিদ্যুৎ চালিত টে্েরন শিয়ালদা-সেখান থেকে ট্যাক্সি বা ট্রাম যোগে পার্ক সার্কাসের ন্যাপ কার্যালয়ে পৌঁছতে পৌছতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। ক্ষুধার্ত বোধ করলাম। সকালে দু’খানা রুটি খেয়ে রওনা দিয়েছি পথি পার্সস্ত কৃষ্ণনগরে শুধুমাত্র এক পেয়ালা চা। তাই পার্ক সার্কাসে অফিসে ঢুকবার আগে সামনের পথি পার্শু¯ ’হোটেলে একটি বৃহদাকার গরম তন্দুর রুটি, সবজি ও এক পেয়ালা চা খেয়ে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে নিয়ে অফিসে ঢুকলাম। কিন্ত অফিস কর্মচারী ছাড়া কর্মকর্তারা কেউ ছিলেন না। জানানো হলো তাঁরা সন্ধ্যার পরে আসবেন। নেতারা আসার জন্য বিকেল তিনটে অবধি অপেক্ষা করে চলে গেছেন। সৈয়দ আলতাফ হোসেন তখন ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক। মতিয়া চৌধুরী ছিলেন তখন কোলকাতার বাইরে। বসে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম-আনন্দবাজার ও ইংরেজী দৈনিক স্টেটস্ম্যান। ইতোমধ্যে এডভোকেট হাসান আলী (বেবী মওদুদের প্রয়াত স্বামী) এলেন। হাসান আলী আমার জুনিয়র বন্ধু অমায়িক ব্যবহার। মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত নতুন বাংলার (সাপ্তাহিক পত্রিকা) তিনি ছিলেন সম্পাদক। তাঁর সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে সন্ধ্যা নেমে এলো। হাসান আলী চমৎকার এক পেয়ালা চা খাওয়ালেন।
তখনই আলতাফ ভাই (সৈয়দ আলতাফ হোসেন) এসে পৌঁছালেন। কুশল বিনিময়ের পর তিনি বললেন, কী বুঝছেন রণেশ বাবু যুদ্ধের পরিস্থিতি ? আমি বললাম আলতাফ ভাই, আপনার কাছেই তো তা জানতে চাইছি। তিনি বললেন, পাবনা অঞ্চলের খবর ? উত্তরে বললাম, পাবনা অঞ্চলে বাকশালপšী’দের ভয়ানক দাপট। সে দাপট আরও বেড়েছে নকশালরা পাক বাহিনীর সাথে প্রকাশ্যে তাদের জীপে উঠে গণহত্যা বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা হত্যায় লিপ্ত হওয়ার ফলে। তাই তাদের অধ্যুষিত পাবনা শহর এবং অপর কতিপয় অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকতেই পারছে না। তবে অবশিষ্ট অপরাপর এলাকায় ভালই যুদ্ধ চলছে এবং কোন কোন এলাকা ইতোমধ্যেই শত্রুমুক্ত হয়েছে। কোন কোন এলাকায় আবার আমাদের পক্ষে বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে রাজাকারদের দ্বারা। আলতাফ ভাই জানতে চাইলেন, পাবনা জেলায় গণহত্যা কি কোথাও হয়েছে ? হয়ে থাকলে তার খবর পেয়েছেন কি ? কললাম, কিছু কিছু খবর পেয়েছি ? তবে তা ভালো করে যাচাই-বাছাই করতে হবে। এর মধ্যে একটি হলো- পাবনা জেলার সুজানগর থানার পদ্মা নদীর তীরে সাত বাড়িয়ায় নদী সংযোগ থাকায় এই গ্রামের বহু ছেলে এনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে এবং ওখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় পেয়েছে। এই খবর পেয়ে স্থানীয় এক রাজাকারের নেতৃতে পাক বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সেনা গাড়ি নিয়ে এনে পুরো গ্রামটি জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঐ গ্রামে সন্তান-সন্ততি নিয়ে আমার স্ত্রী পূরবীও আশ্রয় নিয়েছিলেন স্থানীয় কলেজের এক অধ্যাপকের বাড়িতে। আকস্মিক ঐ ঘটনায় বিহবল হয়ে বাচ্চাদেরকে নিয়ে তিনি ঐ বাড়ির পিছনে অবস্থিত একটা খালে ১২ ঘন্টা (তার চারিদিকে গাছ-গাছালি ঝোপের আড়াল) আশ্রয় নিয়ে বহু পরিবার-পরিজনের আত্মরক্ষা করেন। ঐ ঘটনায় বার শত (১২০০-১৪০০) থেকে চৌদ্দশত মানুষ শহীদ হন। অসংখ্য ঘর-বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আগুনে পুড়ে ছাই হয়। বিকেলে হঠাৎ বৃষ্টি নেমে পড়ায় পাক-সেনারা ছুটে পালিয়ে যায় এবং সে কারণে আরও অনেক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে সাতবাড়িয়ার মানুষ বেঁচে যায়। এ খবর আমার স্ত্রী-সন্তানদের কাছে শুনেছি।
তিনি ঐ মাসের শেষ দিকে ভারতে চলে আসার পর। এ ছাড়া ডেমরাতে (ফরিদপুর থানাধীন) আর একটি গণহত্যার খবর পাওয়া গেছে। হাসান আলী শুনে বললেন দাদা, এই ঘটনাবলী লিখে নতুন বাংলার জন্যে দেবেন। আমরা নতুন বাংলা ছাপবোই এবং ব্রিফিং করে বা প্রেস রিলিজ দিয়ে কোলকাতার পত্রিকা ও নিউজ এজেন্সী, বেতার, টেলিভিশনকেও জানাব। তখনও ভারতে টেলিভিশন হয়নি সুতরাং বিদেশী টেলিভিশনের কথা বলছিলেন হাসান আলী । হঠাৎ অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ হাসতে হাসতে এলেন। বললাম, প্রফেসার সাহেব, হাসছেন যে? কোন সুখবর আছে? বললেন, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হয়েছি, সুখবর তো থাকারই কথা তবে এখনই তা বলার পর্যায়ে আসেনি। এলে জানাব। প্রশ্ন করলাম, ডেকেছেন কেন? বললেন, ওহ, হ্যাঁ, আপনাকে ২/৩ দিন কোলকাতায় থাকতে হবে। কাজ আছে । কি কাজ? তা কাল বিকেলে অফিসে আসলে বলবো। এ বলেই তিনি আবার বেরিয়ে গেলেন। অতঃপর কিছুক্ষণ অন্যদের সাথে কথাবার্তা বলে রওনা হলাম গড়িয়ার দিকে ছোট ভাই পরেশের বাড়িতে। যথারীতি পরদিন ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে এলাম পার্টি অফিসে । দেখি কয়েককজন সাংবাদিকের সাথে প্রফেসার সাহেব আলাপ করছেন। আলাপ শেষে তিনি বললেন, কাল সকালে ৮টার আগে স্নান করে নাস্তা করে চলে আসুন। দলে বলে সবাই রওনা হবো বাস ট্যাক্সি নিয়ে যশোর। সেখানকার টাউন হল ময়দানে ন্যাপের স্বাধীন বাংলার মাটিতে প্রথম জনসভা। যশোর ক’দিন আগেই শত্রুমুুক্ত হয়েছে। সেখানে ন্যাপের জনসভা এবং সেখানে এবং সেখানে যেতে হবে। এক বিশেষ রোমাঞ্চকর অনুভুতিতে আচ্ছন্ন হলাম। খুশিতে ভরে উঠলো মনটা। চলে এলাম আবার গড়িয়ায়।
সকাল সকাল রাতের খাবার খেয়ে শুতে গেলাম। স্ত্রী পূরবীকে জানালাম পরদিন (১৬ ডিসেম্বর) ভোরে যশোর যাবার কর্মসূচীর কথা। তিনি কিছুটা যেন সংশয় ভরা মনে বললেন, জনসভাটি নিরাপদে সম্পন্ন হতে পারবে তো? বললাম, নিশ্চয়ই তা হবে। ফিরে আসবো রাতেই। ফিরে এসে অভিজ্ঞতা জানাব। পরদিন ভোরে দেখি বাড়ির অপর সকলে যেন কিছুটা ভীতিগ্রস্ত। ছোটভাই পরেশ বলে উঠলো, দাদা, না গেলে চলে না? ভয় ভীতির কারণ নেইতা তো নয়। হেসে সাহস দিয়ে বললাম, গাড়িতে জায়গা থাকলে তোমাদেরকেও নিয়ে যেতাম। ঘাবড়াবে না। ভালভবেই ফিরে আসবো। আমার হাতে একটা এক ব্যান্ডের ছোট পকেট ট্রানজিস্টর। তখন এটাই সবার হাতে হাতে থাকতো। দ্রুত সন্তান ও প্রাতরাশ সেরে দৌড়ে বাসে উঠে পাক সার্কাসের দিকে ছুটলাম। হন্তদন্ত হয়ে নেমে দৌড়ে বাসে উঠে পাক সার্কাসের দিকে ছুটলাম। যে বাসটা, ওতে উঠে বসেন। হাতে ঐ পকেট ট্রানজিস্টর। গাড়িতে উঠতে যাব এমন সময় হকার এলো অনেকগুলি পত্রিকা হাতে নিয়ে। বড় বড় শিরোনামে ঢাকায় অসংখ্য বুদ্ধিজীবি হত্যা। আনন্দবাজার, যুগান্তর (বর্তমানে অবলুপ্ত), স্টেটস্ম্যান ও টাইম্স অব ইন্ডিয়া কিনে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসতেই দেখি আর যারাই উঠেছেন তাঁদের সবারই হাতে এক বা একাধিক পত্রিকা। অশ্রু সজল নয়নে কোথায় ভেসে গেলে যশোর যাত্রার আনন্দময় রোমাঞ্চকর অনুভুতি। খবরগুলি পড়তে ও পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলাম কখন যে গাড়িটা ছেড়ে দিয়েছে তা টের পাইনি। বুঝতে পারিনি বহরে আর কতগুলি পাড় আছে। ঘন্টা খানেকের কিছুক্ষণ আগেই সম্বিত ফিরলো। খুললাম ট্রানজিস্টর ভলিউম কম করে কানের কাছে ধরে রাখলাম।
কয়েক মিনিট পর পরই হিন্দি ইংরেজী বাংলায় প্রচারিত হচ্ছে জেনারেল ম্যাকেশর চরম বার্তা জেনারেল নিয়াজীর কাছে। তিনি বলছেন অবিলম্বে আত্মসমর্পণ নয়তো বিপদ ঘনিয়ে আপনাদের সবার জন্য। অবিলম্বে আত্মসমর্পণ করুন। পালাবার পথ নেই। ঢাকা মহানগরী ইতিমধ্যেই আমাদের মুক্তিবাহিনী দিয়ে ঘেরাও হয়ে গেছে। পাক-সেনারা অবরুদ্ধ। রেলপথ, নদীপথ, বিমানপথ সব অচল করে দেওয়া হয়েছে। সড়ক পথ তো আগেই ধ্বংশ করা হয়েছে। কিন্তু পাক-বাহিনীর কোন জবাব পাওয়া যাচ্ছিল না। আমরা দুপুরের পর পরই পৌছে গেলাম যশোর টাউন হল ময়দানে। জনসভা শুরু করা হলো। বিপুল জনসমাগম। সভাপতিত্ব করেছেন ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। বক্তৃতা করলেন তৎকালীন যশোর জেলা ন্যাপের সভাপতি এডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক (প্রয়াত), সৈয়দ আলতাফ হোসেন ও বেগম মতিয়া চৌধুরী। দেশী-বিদেশী অসংখ্য সাংবাদিক এই জনসভা কভার করতে এসেছেন। বিপুল জনসমাগম হয়েছে। আমি মাঠে স্রোতাদের মধ্যে। ২/৩ জন পরিচিতকে পেলাম শীর্ণদেহ। কাউকেই সুস্থ সতেজ বলে মনে হলো না। শেষ ঘোষণা বাংলাদেশের বিজয়ের ঘোষণা বাংলাদেশের বিজয় শোনা পর্যন্ত যেন কারও মনে স্বস্তি নেই। এক ধরে অনিশ্চয়তার শিকার তারা অনেকেই। নয় মাসের অবরুদ্ধ জীবনের ছায়া সবারই চোখে মুখে। দেখতে দেখতে শীতের বিকেল গড়িয়ে গেল। সূর্য লাল হতে শুরু করেছে। হঠাৎ ট্রেনজিস্টার খুলতেই প্রচারিত হলো নিয়াজীর আত্মসমর্পণ। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত। মঞ্চের দিকে তাকিয়ে দেখি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ সভাপতির ভাষণ দিচ্ছেন। ছুটলাম মঞ্চের দিকে। ছুটে গিয়ে মতিয়া চৌধুরীকে খবরটি জানালাম এবং ট্রানজিস্টার খুলে শুনালামও। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে কানে কানে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদকে খবরটি বললেন। তিনি তৎক্ষণাৎ তা মাইকে ঘোষণা দিলেন। সাথে সাথে আনন্দের করতালি। অনেকে অশ্রুসজল নয়নে তালি দিয়ে যেন নাচতে শুরু করলেন। কী আনন্দ। কী আনন্দ। কারা যেন ছুটে দিয়ে মিষ্টি এনে মঞ্চের নেতাদের দিলেন-নেতারা একটি করে মুখে দিয়ে বাকীটা সকলকে দিয়ে দিয়ে দিলেন। সভার সমাপ্তি ঘোষিত হলো। আমরা ছুটে এসে বাসে উঠলাম। গন্তব্য কলকাতা। কণ্ঠে জয়ধ্বনি।
এভাবেই কেটেছিল আমার সেই ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর।
কাগজ টুয়েন্টিফোর বিডি ডটকম এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
- প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।