ইউনিপেটুইউর এমডি-জিএম কারাগারেও বিলাসী জীবনযাপনে
১০ মাসে এক লাখে দুই লাখ টাকা লাভ করুন এমন মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিপুল অর্থ-বিত্ত গড়েছেন মাল্টি লেভেল কোম্পানি (এমএলএম) ইউনিপেটুইউ বাংলাদেশ লিমিটেডের; এমডি মুনতাসির হোসেন ইমন। প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া টাকায় বেশিরভাগ সময় দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। রাত কাটাতেন পাঁচ তারকা হোটেলে। কিন্তু এক সময় ধরা পড়ে তাদের প্রতারণার জাল। তারপর গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে রয়েছেন। কিন্তু সেখানেও বিলাসী জীবনযাপন করছেন মুনতাসির হোসেন ইমন, জিএম জামশেদুর রহমানসহ কারাবন্দি প্রতিষ্ঠানটির অন্য কর্মকর্তারা। গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ রয়েছেন তারা। হরদম মোবাইল ফোনে কথা বলেন। এমনকি ফেসবুকও ব্যবহার করছেন এসব প্রতারক। খাচ্ছেন বাইরে থেকে আনা খাবার। আরও নানা ধরনের সুবিধা নিচ্ছেন তারা।
ভুক্তভোগীরা জানান, ইউনিপেতে টাকা রাখুন, ১০ মাসে এক লাখে দুই লাখ টাকা লাভ করুন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়–ন এমন চটকদার সেগানে প্রায় ৬ লাখ বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করে অল্প কদিনেই ইউনিপেটুইউ বাংলাদেশ লিমিটেডের শীর্ষ কর্মকর্তারা হাতিয়ে নেন ৩ হাজার একশ কোটি টাকা। বিনিয়োগকারীদের কষ্টার্জিত সেই অর্থে বিলাসী জীবনযাপন করতেন প্রতিষ্ঠানটির এমডি মুনতাসির হোসেন ইমন, জিএম জামশেদুর রহমানসহ অন্য কর্মকর্তারা। তারা বিদেশেও টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১২ সালে রাজধানীর উত্তরা ও হাতিরপুল থেকে প্রতিষ্ঠানটির এমডি ও জিএমকে গ্রেপ্তার করে মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ। তারপর থেকে কারান্তরীণ ইমন ও জামশেদুর রহমান। কিন্তু কারাগারে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করে বিশেষ সুবিধা নিচ্ছেন তারা।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর জেলার আনোয়ার হোসেন গতকাল বলেন, কারাগারে তাদের কোনো ধরনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। তারা মোবাইল ফোনও ব্যবহার করছেন না। প্রায় প্রতিদিন তাদের সেল তল্লাশি করা হয়। তিনি বলেন, আসামিদের প্রতিপক্ষ গ্রুপ হয়তো ফায়দা নিতে এ ধরনের অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, একশ্রেণির অসাধু কারা কর্মকর্তাদের বাগে রেখে কারাগারে বসেই মোবাইল ফোনে ইউনিপেটুইউর প্রতারণার নেটওয়ার্ক সচল রেখেছেন ইমন ও জামশেদুর রহমান। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মালয়েশিয়া এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থাকা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছেন। কারাগারে গত ৬ মাস ধরে গ্রামীণফোন ও বাংলালিংকের দুটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন ইমন। এ ছাড়া রবির একটি ফোন ব্যবহার করছেন জামশেদুর রহমান।
কারাগার ছাড়াও হাজিরা দিতে আদালতে আনা-নেওয়ার পথে এমনকি আদালত চত্বরেও তারা পান বাড়তি সুবিধা। অর্ধশতাধিক মামলার আসামি হয়েও অন্য আসামির মতো হাতকড়ার বেড়ি থাকে না তাদের হাতে। কিছু সময়ের জন্য তাদের আশপাশে থাকে না কোনো পুলিশ সদস্যও। ওই সময়টুকুর জন্য তারা থাকেন উন্মুক্ত। চাহিদামতো সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। এই প্রতারকচক্রের আত্মসাৎকৃত কোটি কোটি টাকা এখন ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক ও এনসিসি ব্যাংকের ১১০টি অ্যাকাউন্টে জমা রয়েছে। ভিন দেশের ব্যাংকেও রয়েছে তাদের কোটি কোটি টাকা। সেসব টাকারও কোনো কূলকিনারা হয়নি।
এদিকে বছরান্তে দ্বিগুণ লাভের আশায় ইউনিপেটুইউতে টাকা ঢেলে অনেক আগেই রাস্তায় বসেছেন বিনিয়োগকারীরা। স্ত্রী কিংবা মায়ের হাতের বালা বা গলার হার, এমনকি বসতভিটা বিক্রি করে তারা বিনিয়োগ করেছেন। এসব বিনিয়োগকারীরা দেনার দায়ে এখন ঘুরছেন পথে পথে। পাওনা টাকা ফেরত চাইতে গেলে তাদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে ইমনের সঙ্গে কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের নেতাদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে ইউনিপেটুইউর এজেন্টরাও। সন্ত্রাসী ও এজেন্টদের হুমকি-ধমকিতে ঘর ছেড়ে অনেক গ্রাহকই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানা এবং আদালতের দারস্থ হয়েও পার পাচ্ছেন না তারা।
জানা গেছে, গত রবিবার বিকাল ৫টার দিকে রাজধানীর শান্তিবাগ এলাকা থেকে প্রভাবশালী এ প্রতারক চক্রের সহযোগী ইউনিপেটুইউর এমডি ইমনের মা হাসিনা মোশারফকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। বিভিন্ন অভিযোগে ওই নারীর বিরুদ্ধে ৪৯টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা (ওয়ারেন্ট) রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার দেখিয়ে গত সোমবার হাসিনা মোশারফকে ঢাকা থেকে নিয়ে গেছে ফরিদপুর সদর থানার পুলিশ। অল্প সময়ের ব্যবধানে গত সোমবার তিনি অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নিয়েছেন।
অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে এ প্রতারক চক্রের অন্যতম সদস্য প্রতিষ্ঠানটির এমডি ইমনের স্ত্রী ফারজানা ইয়াসমীন পালিয়ে বর্তমানে মালয়েশিয়ায় রয়েছেন। সেখানে বসেই স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন তিনি।
এদিকে পাওনা টাকা ফেরত চাওয়ায় হুমকি পেয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালতে (নম্বর-৪) ইউনিপেটুইউর শীর্ষ কর্তাদের বিরুদ্ধে ৪০৬, ৪২০ ও ৫০৬ ধারায় একটি মামলা করেছেন মো. মনজুর হোসেন নামে এক ভুক্তোভোগী। মামলায় আসামি করা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির এমডি ইমন, চেয়ারম্যান শহিদুজ্জামান শাহীন, জিএম জামশেদুর, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) খন্দকার মুকিত আল মামুন, পরিচালক এমএ তাহের, এমডির স্ত্রী ফারজানা ইয়াসমীন ও মা হাসিনা মোশারফ এবং জিএমের স্ত্রী পেয়ারা বেগমকে। প্রভাবশালী চক্রটির প্রতারণার ফাঁদে পড়ে ইউনিপেটুইউতে কোটি টাকা লগ্নি করেছিলেন মনজুর হোসেন। মামলা করে তিনিও এখন বিপাকে আছেন। ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে গতকাল জানিয়েছেন তিনি।
ভুক্তভোগী মনজুর হোসেন বলেন, ইউনিপেটুইউর চটকদার বিজ্ঞাপন; এমডি, জিএম, চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মনমুগ্ধকর প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে ৭২ আইডির মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে ১ কোটি ৫২ লাখ ৭১ হাজার ২০০ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। তাদের প্রতারণার গোমর ফাঁস হলে এবং প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতনরা গ্রেপ্তার হওয়ায় তিনিসহ বিপাকে পড়েন অন্য বিনিয়োগকারীরা। জব্দ করা অর্থ ছাড়া অন্যান্য অ্যাকাউন্ট থেকে তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রথমে তাদের নিবৃত করেছিলেন প্রতারক চক্রের সদস্যরা। কিন্তু টাকা দেয়নি।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জজ বিশেষ আদালতে একটি বিশেষ মামলার (২/১৪) হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন ইউনিপেটুইউর এমডি ইমন, জিএম জামশেদুরসহ তার মামলার অন্য আসামিরা। সেদিন পাওনা টাকা ফেরত চাইতে গিয়েছিলেন মনজুরও। এ সময় আদালত চত্বরে বসেই তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেন ইমন। এর পরই মোহম্মদপুরের বাসার সামনে পথ আটকে মোটরসাইকেলে আসা দুযুবক এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ব্যবহার করে ইউনিপেটুইউ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার হুমকি দিয়ে গেছে তাকে। প্রাণশঙ্কায় এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলেও জানান মনজুর হোসেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু মনজুরই নয়, তার মতো ক্ষতিগ্রস্ত অনেক গ্রাহকই তাদের বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরত চাইতে গেলে নামধারী সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে জীবননাশের হুমকি দিচ্ছে ইমনের ক্যাডাররা। টাকা ফেরত পেতে যেসব বিনিয়োগকারী আইনের আশ্রয় নিয়ে মামলা করেছেন তাদের মামলা প্রত্যাহার করার জন্য অব্যাহতভাবে জীবননাশের হুমকি দিচ্ছে সন্ত্রাসীরা।
সূত্র জানায়, প্রায় অর্ধশত ওয়ারেন্ট থাকা সত্ত্বেও ইউনিপেটুইউর এমডির পলাতক স্ত্রী ফারজানা ইয়াছমিন প্রতিমাসেই মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করছেন। তিনি মালয়েশিয়াতে একটি ক্যাসিনো পরিচালনা করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
উৎস-কর্পোরেট সংবাদ।