ঈদও শহুরে উৎসব!

 

 

 

প্রায় প্রতি ঈদের ভোর- সকাল দেখি। অন্ধকার থাকতে ঢাকা থেকে বের হয়ে যাই। ঈদে ঢাকার মানুষ দেখার সুযোগ কম হয়। সবুজ মাঠ, খাল- নদী- প্রকৃতি, ফাঁকা রাস্তা সব কিছু মিলিয়ে একটা অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে। সাভার পার হওয়ার পর থেকে রাস্তায় মানুষে হাঁটাচলা শুরু হয়। হঠাৎ করেই মনে হয় অন্ধকার কোথায় যেন পালিয়ে গেল! যত এগুতে থাকি, রাস্তায় মানুষ বাড়তে থাকে।

ফেরি থেকে নামার পর থেকে মূলত গ্রাম, গ্রামের মানুষ দেখি। রাস্তার পাশে অসংখ্য ঈদের জামাত। শিশু-কিশোর, যুবা- বৃদ্ধ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। কেউ নিমের ডাল দিয়ে দাঁত ব্রাশ করছেন, অনেকে রাস্তা দিয়ে আসছেন- যাচ্ছেন। কোনও কোনও কৃষক খেতে যাচ্ছেন, ঈদের দিনেও।

মানুষের ভেতরে আনন্দ বা উৎসাহ উদ্দীপনা তেমনটা পরিলক্ষিত হয় না। বিশেষ করে ঈদের যে আনন্দ, যে উৎসব, কেনাকাটা তার কোনও লক্ষণ গ্রামের এসব মানুষ দেখে তা দৃশ্যমান হয় না।

অধিকাংশ মানুষের গায়ে নতুন পাঞ্জাবি বা জামা থাকে না। নতুন লুঙ্গি পরেছেন, এমন মানুষের সংখ্যাও খুব বেশি চোখে পড়ে না। নতুন শাড়িতে গ্রামীণ নারীর যে প্রতিকৃতি, তা দৃশ্যমান হয় না। এই ঘন্টা তিনেক চলার পথে, উৎসবের আমেজ অনুভব করতে পারি না।

গ্রামের যে প্রকৃত চিত্র, তা কী এমনই? না, প্রকৃত চিত্র দেখতে পাই না? গ্রামে গিয়েও বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করেছি। দৌলতদিয়া থেকে রাজবাড়ি, পাংশার মাঝামাঝি পর্যন্ত এলাকায় কী অনেক বেশি গরীব মানুষের বসবাস? পরবর্তীতে আরও কিছু জেলায় ঈদের গ্রাম দেখার সুযোগ হয়েছে।

উপলদ্ধি হয়েছে, গরীব মানুষ কম- বেশি সব অঞ্চলেই আছে। হতে পারে, রাজবাড়ি- পাংশা অঞ্চলে বেশি। কোনও পরিসংখ্যান বা তথ্যের ভিত্তিতে বলছি না। তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি। কিন্তু দেশের অনেক অঞ্চলের চিত্র এর চেয়ে খুব আলাদা নয়। গত কয়েক বছর শহর- গ্রাম পর্যবেক্ষণ করে, ঈদ বিষয়ে আমার ধারণা।

০১. বাংলাদেশের ঈদ মূলত শহরের মানুষের উৎসব। জেলা বা উপজেলা শহরেও ঈদের আমেজ অনুভব করা যায়। অধিকাংশ গ্রামের ঈদ বড় বেশি বিবর্ণ- মলিন।

০২. দেশের অধিকাংশ মানুষের আর্থিক সঙ্গতি ঐ পর্যায়ে পৌঁছেনি, যা দিয়ে তারা ঈদকে আনন্দ- উৎসবে পরিণত করতে পারে।

০৩. ঈদে নতুন পোষাক, শপিং নিয়ে অতি মাতামাতি মূলত শহরকেন্দ্রিক। এই মাতামাতি অধিকাংশ মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছায় না।

০৪. ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষের আয় বেড়েছে, বেড়েছে কেনার সামর্থ্য’- কথাগুলো পুরোপুরি অসত্য নয়, পুরোপুরি সত্যও নয়। গ্রামের মানুষের আয় বেড়েছে। একজন দিন মজুর ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করেন। এই অর্থের প্রায় পুরোটা খরচও হয়ে যায়। তাছাড়া দেশের কোনও অঞ্চলের দিন মজুরদেরই সারা বছর কাজ থাকে না।

০৫. শ্রমের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কৃষক সবজি ছাড়া ধান- পাট- রবিশস্য উৎপাদন করে ন্যায্য মূল্য পায় না। ফলে সারা বছরই তাকে একটা টানাটানির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তার ঘরে খাবার থাকে, মানে ধান থাকে। হাতে নগদ অর্থ থাকে না। ঈদে পরিবারের সবার নতুন পোষাক কিনতে পারে না। নগদ অর্থের অভাবে অধিকাংশ কৃষকের ঈদ উৎসব দৃশ্যমান হয় না।

০৬. দিন মজুর আয় করে, যখন কাজ থাকে। চাল কিনে খেতে গিয়ে আয়ের বড় অংশ ব্যয় হয়ে যায়। তার জীবনযাপনে পরিবর্তন এসেছে। আগে পান্তা ভাত খেয়ে কাজে যেত। এখন গ্রামে রেস্টুরেন্ট হয়েছে। সকালে রেস্টুরেন্ট থেকে পরোটা খেয়ে মাঠে যায়। সবাই নয়, অনেকে। সকালে নাস্তাতে তার খরচ হয় ১৫ থেকে ২০ টাকা।

০৭. অধিকাংশ দিন মজুরের বাড়িতে ঘর ছিল না। একটি ঘর তুলেছে, তুলছে। ঘর জমানো টাকা দিয়ে তোলেনি, এনজিও থেকে লোন নিয়েছে। আয় থেকে খাওয়া এবং লোনের কিস্তি শোধ করতে পুরোটা ব্যয় হয়ে যায়। কাজ যখন থাকে না, লোন শোধ করার উপায় থাকে না। এক এনজিও’র লোন শোধ করার জন্যে আরেক এনজিও থেকে লোন নেয়।

০৮. কৃষকও বিল্ডিং বা টিনের ঘর তোলার পেছনে অনেক টাকা ব্যয় করে। প্রবাসী অর্থের বড় অংশ ব্যয় হয় ঘর তৈরির কাজে।

০৯. যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হয়েছে। গ্রামে ইট- টিনের ঘরের সংখ্যা বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবে একটা উন্নতি দৃশ্যমান হয়। হ্যাঁ, উন্নতি অবশ্যই হয়েছে। দিন মজুরদের আয় বৃদ্ধি, উন্নতির চিত্র বহণ করে। চালের দাম ছাড়াও তার আরও অনেক খরচ বেড়েছে। কোক- চিপস – বিস্কুট গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এসবই আয় বৃদ্ধি, কেনার সামর্থ্য বৃদ্ধির প্রমাণ। আগে কিনতে পারত না, এখন কিনতে পারছে, অসত্য নয়। তবে টানাপোড়েন দূর হয়নি।

১০. সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে কৃষক। দিন মজুররা তুলনামূলকভাবে ভালো আছে। কৃষক ভালো না থাকলে উৎসব রঙিন হয় না। দিন মজুর আগে পেট ভরে ভাত খেতে পারত না। এখন পারে। এর থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না যে, গ্রামের মানুষ ভালো আছে।

মনে রাখতে হবে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ মানুষ কৃষক। দিন মজুর সেই জনগোষ্ঠীর ছোট্ট একটি অংশ। মূল অংশ কৃষক, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ ভাগ। তার ভালো থাকা না থাকার উপর নির্ভর করে অনেক কিছু, উৎসবও।

১১. মানুষ আগের চেয়ে ভালো আছে মানে, কৃষক উৎপাদন বাড়িয়েছে বলে ভালো আছে। এখনও গ্রামের মানুষের ভালো থাকা মানে, ভাত খেতে পারা না পারা। ভাত খেতে পারার হিসেবে মানুষ ভালো আছে। ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় কৃষক সুখে নেই। দিনমজু্র পেট ভরে ভাত খেতে পারছে, কাজ থাকা সাপেক্ষে।

১২. ৭ দিন কাজ না থাকলে তার ভাতে টান পড়ে। ‘দিন আনি দিন খাই’- অবস্থার তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি। কাজের সন্ধানে শহরের দিকে ছুটে আসা কমেনি। ছোট- বড় দুর্যোগে দিন মজুর- কৃষক নিঃস্ব হয়ে পড়ে। তাদের সামর্থ্য বাড়েনি। এটা ভালো থাকার নমুনা নয়।

গ্রামের মানুষের আর্থিক টানাপোড়েন আগের চেয়ে ভিন্নতর হয়েছে। আনুষাঙ্গিক খরচ বেড়েছে, বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়।

আয় বেড়েছে, ব্যয় বেড়েছে তার চেয়ে বেশি। গ্রামে রেস্টুরেন্ট হয়েছে। মাঝরাত পর্যন্ত চা পান, টক শো দেখা তর্ক- বিতর্ক চলে। গ্রামীণ যে উৎসব, রঙিন উৎসব হারিয়ে গেছে। ঈদ হয়ে গেছে শহুরে মধ্যবিত্ত- উচ্চবিত্তের উৎসব। ৬০ বা ৭০ লাখ মধ্যবিত্ত শহর থেকে গ্রামে ছুটে যায়, শহরে বসে আমরা ভাবি- এটাই বাংলাদেশ। আসলে তা নয়। সমগ্র বাংলাদেশের খুব ক্ষুদ্র অংশ এটা। সাড়ে ষোলো কোটি মানুষের প্রায় নব্বই ভাগ গ্রামে বাস করে।

শহরের কিছু মানুষ দু’তিন দিন গ্রামে থাকলেই, গ্রামের মানুষের জীবনে উৎসব রঙিন হয়ে যায় না। ঈদের দিনেও তারা যদি পেট ভরে ভাত খেতে পারে, সেটাই তাদের ভালো থাকা। ঈদ উপলক্ষে তাদের বাড়তি আয় নেই, ব্যয়ও করতে পারে না।

গোলাম মোর্তোজা : সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
s.mortoza@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!