একজনের অর্জন, অনেকের যন্ত্রণা
ইংরেজি ভাষায় লিখে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায় তাহমিমা আনাম, তাতে আমাদের এত কষ্ট পাওয়ার কারণ কী! তাহমিমা একজন বাংলাদেশের লেখক, তার লেখা গল্পকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। বিষয়টি তো বাংলাদেশের জন্যে গর্বের। তিনি বিদেশে টাকা পাচার করেননি, বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধী কোনো কাজ করেননি।
পুরস্কার পাওয়ার জন্যে রাষ্ট্রীয় মেকানিজম ব্যবহার করেছেন, তার বিরুদ্ধে সেই অভিযোগ করারও তো সুযোগ নেই। তার প্রাপ্তি আমাদের এত যন্ত্রণার কারণ হবে কেন? আপনার বিবেচনায় তাহমিমা আনাম ভালো লেখেন না, এই তো বলতে চাইছেন? সেই দায় তো জুরি বোর্ডের। বিশ্বসাহিত্যের বর্তমান মান বিবেচনায়ই নিশ্চয় তাকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। লবিংয়ের কথা বলছেন? আপনারা ভালো লিখে লবিং করে একটা পুরস্কার এনে দেখান তো!
আর তাহমিমা আনাম পুরস্কার পেলে লবিংয়ের কথা মনে আসে, অরুন্ধতী রায়ের ক্ষেত্রে লবিংয়ের কথা মনে আসে না।
ড. ইউনূসকে গালি দেন, আর অমর্ত্য সেনের বই বগলে নিয়ে ঘোরেন। এখন বলবেন, তাহমিমার সঙ্গে অরুন্ধতীর আর অমর্ত্য সেনের সঙ্গে ড. ইউনূসের তুলনা চলে না।
তুলনা করার রীতিতে আমিও বিশ্বাস করি না। ড. ইউনূস, অমর্ত্য সেন দু’জন সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্র- ধরণের মানুষ। অমর্ত্য সেনের প্রতিষ্ঠান নেই। তার কাজ মূলত অ্যাকাডেমিক। ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠান আছে। একাডেমিক কাজের বাইরেও তার কর্মপরিধি বিস্তৃত। প্রতিষ্ঠান তৈরি করলে, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সব বিষয় নিয়ে কথা বলা যায় না। ‘কেন কথা বললেন না’- এই যুক্তিতে ড.ইউনূসকে গালি দিয়ে যখন অমর্ত্য সেনকে কাছে টানা হয়, আপত্তিটা সেখানে।
প্রথমেই বলে রাখি, অমর্ত্য সেন আমার প্রিয় ব্যক্তিত্বদের একজন। অরুন্ধতী রায়ও। লেখার জন্যে তো বটেই, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে তার যে সাহসী দায়বদ্ধতা তা আলাদাভাবে অনুপ্রাণিত করে। তাদের সম্মান দেখানোতে মোটে অখুশি নই।
অমর্ত্য সেনের চেয়ে ড. ইউনূস সারা পৃথিবীতে অনেক বেশি পরিচিত এবং অনেক বেশি সম্মান পেয়ে থাকেন।
গত ৭ জুন ব্রাসেলসসে ইউরোপীয় পার্লমেন্টের শতাধিক সদস্যর উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখলেন নোবেল লরিয়েট ড. ইউনূস। তাঁর এই বক্তব্য শুনতে আসা পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে আরো ছিলেন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী এরনা সোলবার্গ ।
ড. ইউনূস বক্তৃতা করলেন, তারা শুনলেন। আমাদের পক্ষে গুরুত্বটা একটু ভেবে দেখা সম্ভব!
ভারতীয় সংসদও ড.ইউনূসকে নজিরবিহীন সম্মান দেখিয়েছে। ড. ইউনূসের যত বই পৃথিবীর যত ভাষায় প্রকাশিত হয়ে, যে পরিমাণ বিক্রি হয়- আর কোনো নোবেল বিজয়ীর বই এত বিক্রি কোনোকালে হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। ড. ইউনূস বাংলাদেশের মানুষ হওয়ায়, অন্য যে কোনো নেবেল বিজয়ীর চেয়ে তাকে বেশি পছন্দ করি। সম্মান দেখানোয় এগিয়ে রাখি।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পৃথিবীর সেরা দল নয়। আমার- আপনার ভালোবাসা- পছন্দের তালিকার এক নম্বর অবস্থানে সব সময় বাংলাদেশ, তালিকায় এগিয়ে থাকা এক নম্বর দলটি নয়।
তাহমিমা আনাম ইংরেজি ভাষায় লিখতে শুরু করেছেন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাচ্ছেন। তার লেখা নিয়ে আলোচনা- সমালোচনা হতে পারে। আপনি তার লেখা পছন্দ নাও করতে পারেন। পোষাক কর্মীদের নিয়ে গল্প লিখে তিনি একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। এতে বাংলাদেশের গৌরব বৃদ্ধি পেয়েছে, কমেনি।
এখন তার সমালোচকদের বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে, তার পুরস্কার পাওয়াটা খুবই অন্যায় হয়েছে। তার গল্প বাস্তবতা বিবর্জিত, সাহিত্য মূল্যহীন ইত্যাদি কথা বলা হচ্ছে।
নিশ্চয়ই তাহমিমা আনামের চেয়ে ভালো গল্প বাংলা ভাষায় তো বটেই, এই বাংলাদেশেও লেখা হয়েছে। সেগুলোকে অনুবাদ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবা উচিত। তাই বলে এখন যেটা পুরস্কার পাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে কেন? দেশের নয়, দূরেরটা ভালো- এটা কেমন নীতি!
পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার পাওয়া লেখককে নিয়ে আনন্দিত হবো। তার চেয়ে অনেক ছোট কোনো পুরস্কার যদি দেশের কোনো লেখক পান এবং তার লেখা যদি অপছন্দও করি, তার অর্জন নিয়েই সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হবো।
যোগাযোগ, লবিংয়ে পুরস্কার?
বাংলা একাডেমি, আনন্দ বা নোবেল, পৃথিবীর কোন পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক নেই? আর লবিং করলেই পুরস্কার পাওয়া যায়? সব কিছু এত সহজ! লবিং করে নোবেল অর্জন করে দেখান তো! দূরের কেউ পুরস্কার পেলে তিনি মহৎ, পাশের কেউ পেলেই যত আপত্তি। ‘আমি নই কেন’- মূল কারণ তো এটাই, মুখে যাই বলেন।
অনেককেই দেখি ‘প্রিয় লেখক’র তালিকায় হুমায়ূন আহমেদ বা দেশের কোনো লেখকের নাম বলতে লজ্জ্বা পান। মার্কেজ, মিলান কুন্ডেরা বা পাওলো কোয়েলোর নাম বলেন। অনুবাদ দু’একটি বা ভূমিকা ছাড়া এসব লেখকের বই কয়জন কয়টা পড়েছেন? হিপোক্রেসী সর্বত্র।
ইংল্যান্ডে বসবাস করার সামর্থ্য থাকা বা মাহফুজ আনামের মেয়ে হওয়া কোনো অপরাধ নয়। ইংরেজি ভাষায় লিখতে পারা, সেটাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে উপস্থাপন করতে পারাটা তার যোগ্যতা। মাহফুজ আনামের চেয়ে অর্থবান এবং প্রভাবশালী আরও অনেকের সন্তান দেশের বাইরে থাকেন। তারা ইচ্ছে করলেই লবিং করে সব কিছু অর্জন করে ফেলতে পারেন না। সেটা সম্ভব না।
তাহমিমা আনামকে নিয়ে এখন যা হচ্ছে, তা তার লেখার মূল্যায়ন নয়। তিনি পুরস্কার পাওয়ায় ঈর্ষান্বিত হয়ে হীনমন্যতা থেকে সমালোচনা করা হচ্ছে। আমাদের এই হীনমন্যতার উর্ধ্বে ওঠাটা জরুরি হয়ে পড়েছে । রাজনীতিবিদরা পারেন না বলে আমরা সমালোচনা করি। লেখকরাও একই কাতারে পড়বেন কেন!
একজন তাহমিমা আনাম অনেকের জন্যে অনুপ্রেরণা হতে পারেন, তিনি অনেকের যন্ত্রণার কারণ হবেন কেন! আপনারা অনেকে যেহেতু মনে করছেন ‘আরও ভালো’ লেখেন, সেটাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে নিয়ে যাওয়ার পেছনে সময় ব্যয় করেন। ‘তাহমিমা কেন পুরস্কার পাবেন’ এই যন্ত্রণায় মাথার চুল ছিড়লে লিখবেন কখন!
‘পুরস্কার পাওয়ায় অখুশি নই, তার লেখার সমালোচনা করছি’- এই যুক্তি খুব দূর্বল। আপনি তাহমিমাকে তাচ্ছিল্য করে লিখছেন, পুরস্কার পাওয়ার পর- আগে নয়। পুরস্কার না পেলে আপনি তাকে নিয়ে এভাবে লিখতেন না।
গোলাম মোর্তোজা : সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
s.mortoza@gmail.com