কথা রাখলেন না ধর্মমন্ত্রী, হজযাত্রীদের অনিশ্চয়তায় রেখে চলে গেলেন হজে
কথা রাখলেন না ধর্মমন্ত্রী। ‘কাউকে রেখে হজে যাবো না’- এমন ঘোষণার পরও অনেক হজযাত্রীর হজে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যেই গত শনিবার সন্ধ্যায় সৌদি আরব পাড়ি জমালেন ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। এ দিকে এ বছর হজ কার্যক্রমে চরম অব্যবস্থাপনার জন্য সরকারকে দায়ী করছে বেসরকারি এজেন্সি মালিকদের সংগঠন হাব।
চলতি বছর হজ কার্যক্রমে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি অব্যবস্থাপনা হয়েছে। প্রাক-নিবন্ধন থেকে শুরু করে প্রতিটি পদে পদে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে। একের পর এক ফ্লাইট বাতিলে এ বছর হজের শিডিউল বিপর্যয় ঘটে। এর মধ্যে গত ১০ আগস্ট বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলেমদের এক কর্মশালায় ধর্মমন্ত্রী ঘোষণা দেন- একজন হজযাত্রীকে বাকি রেখেও তিনি হজে যাবেন না। কিন্তু এর পরও ফ্লাইট বিপর্যয় অব্যাহত থাকে। সর্বশেষ ভিসা থাকার পরও এজেন্সির প্রতারণায় বিমানের টিকিট না থাকায় হজে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকা হজযাত্রীরা গত শনিবার দুুপুরে আশকোনা হজ ক্যাম্পে বিক্ষোভ করেন। তারা জানান, প্রায় তিন শ’ হজযাত্রীর টিকিট দেয়নি সাতটি এজেন্সি। অথচ এ দিনই সন্ধ্যা ৬টায় বাংলাদেশ বিমানের বিজি-৯০৭৯ ফ্লাইটে ১৪ সদস্যের একটি দল নিয়ে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের নেতৃত্বে হজে যান। প্রতারণার শিকার অনেক হজযাত্রীর অভিযোগ, হজ ক্যাম্পে হজযাত্রীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকলেও ধর্মমন্ত্রী কোনো খবরও নিতে আসেননি। আবুল কালাম আজাদ নামে এক হজযাত্রী বলেন, আমরা হজ ক্যাম্পে তিন-চার দিন ধরে অপেক্ষা করছি। কিন্তু ধর্মমন্ত্রী বা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা খবর নিতেও আসেননি।
হজ অব্যবস্থাপনার জন্য সরকারকে দুষছে হাব : এ বছর হজে চরম অব্যবস্থাপনার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় তথা সরকারকে দায়ী করেছে বেসরকারি হজ এজেন্সি মালিকদের সংগঠন হাব। গতকাল আশকোনায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে হাবের মহাসচিব শাহাদাত হোসাইন তসলিম হজ অব্যবস্থানার জন্য ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, সৌদি আরব, হজ সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দায়ী করে বলেন, হজ ফ্লাইট বাতিল হওয়ার জন্য অনেকেই হাবকে দায়ী করে ছিলেন। কিন্তু হজ ফ্লাইট বাতিলের জন্য ছয়টি কারণ রয়েছে। কারণগুলো হলোÑ ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে মোয়াল্লেম ফি প্রদান করা, সৌদি সরকার কর্তৃক আকস্মিকভাবে দুই হাজার সৌদি রিয়াল চার্জ ধার্য করা, শুরু থেকেই ই-ভিসা প্রিন্টিংয়ের জটিলতা, ৯১ হজ এজেন্সির সময়মতো মোয়াল্লেম না পাওয়া, মদিনায় আট দিনের থাকার বিধান মানায় ফ্লাইটের তারিখ পছন্দের বাধ্যবাধকতা এবং শুরুর দিকে বিমান ভাড়া তিন হাজার টাকা বৃদ্ধি।
হাব মহাসচিব বলেন, প্রতি বছর মোয়াল্লেম ফি ধর্ম মন্ত্রণালয় গ্রহণ করে সৌদি আরবে পাঠায়। কিন্তু এ বছর এজেন্সিকে আইবিএনের মাধ্যমে পাঠাতে বলা হয়। বাড়ি ভাড়ার শর্ত হিসেবে আইবিএন অ্যাকাউন্ট করা এবং মোয়াল্লেম ফি স্থানান্তর করার শর্ত দেয়া হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় এজেন্সির কাছ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি মোয়াল্লেম ফি নেয় এবং সৌদিতে ৩০ জুনের মধ্যে বাড়ি ভাড়া করতে বলে। ৩০ জুনের মধ্যে বাড়ি ভাড়া করতে হলে ১৫ মের মধ্যে মোয়াল্লেম ফির টাকা ফেরত দিতে হতো। কিন্তু ধর্ম মন্ত্রণালয় জুলাই মাসে এ টাকা ফেরত দেয়। এতে বাড়ি ভাড়ায় দেরি হয়।
তিনি বলেন, বাড়ি ভাড়ার প্রতিকূলতা কাটিয়ে এজেন্সিগুলো যখন হজযাত্রী পাঠাতে ভিসা সংগ্রহে ব্যস্ত সে সময় ২০১৫ ও ২০১৬ সালের হজকারীদের জন্য দুই হাজার রিয়াল অতিরিক্ত চার্জ আরোপ, ই-ভিসা প্রিন্টিং জটিলতা ও ৯১টি এজেন্সি সময়মতো মোয়াল্লেম ফি না পাওয়ায় আকস্মিক বিমানের ফ্লাইটে যাত্রী সঙ্কট দেখা দেয়। এতে হজ ফ্লাইট বাতিল হয়।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় প্রসঙ্গে তসলিম বলেন, হজ এজেন্সির দায়িত্ব হজযাত্রীদের সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া। ৪২-৪৫ দিনের আগের প্যাকেজে আবাসন ও খাবারের ব্যবস্থাসহ সব সুবিধা নিশ্চিত করা। হজ নীতিমালার কোথাও এজেন্সিদের বলা হয়নি যে এজেন্সিগুলো তাদের হজযাত্রীদের প্রথম দিকে, মাঝের দিকে বা শেষের দিকে নিয়ে যেতে হবে। হজযাত্রীদের আসা-যাওয়ার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা রয়েছে সৌদি আরবের আইন অনুসারে। তাই হজ ফ্লাইটের শিডিউল নির্ধারণ করা উচিত সৌদি আরবের বাধ্যবাধকতা আমলে নিয়ে। ফ্লাইট শিডিউল নির্ধারণে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে চাইলেও তথ্য গ্রহণে সংশ্লিষ্টদের উৎসাহ দেখা যায়নি।
তিনি আরো বলেন, মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হজ প্যাকেজ নির্ধারিত বিমান ভাড়ার থেকে হজ ফ্লাইটের সন্ধিক্ষণে অতিরিক্ত ৩ হাজার টাকা ভাড়া বৃদ্ধির প্রয়াস গ্রহণ করা হয়। এটাও হজযাত্রী সঙ্কটের একটি কারণ। যদিও প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপে এ সমস্যা নিরসন করা হয়।
হাব মহাসচিব বলেন, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় হজযাত্রী প্রতি ৩০০ টাকা প্রশিক্ষণের জন্য গ্রহণ করে। এ বছর এ খাতে সর্বসাকুল্যে ৩ কোটি ৮০ লাখ গ্রহণ করেছে। বিনিময়ে কোনো প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। এতে হজযাত্রীদের অধিকার ক্ষুন্ন হয়।
শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেন, কিছুসংখ্যক হজযাত্রী হজ ক্যাম্পে অবস্থান করছেন, যাদের ভিসা করা হয়েছে কিন্তু তাদের টিকিট করা হয়নি। হাবের পক্ষ থেকে এটি নিরসনের চেষ্টা চলছে। এটি দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে। তিনি বলেন, হজযাত্রীদের বিমানের টিকিটের টাকা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে ব্লক থাকার কথা। সে টাকা শুধু বিমান ভাড়া খাতে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বা সৌদি এয়ারলাইন্সের অনুকূলে পে-অর্ডারের মাধ্যমে পরিশোধ করার বিধান রয়েছে। অন্য কোনো খাতে এ টাকা বরাদ্দ করার সুযোগ নেই। কোনো হজযাত্রীর ভিসা থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক টিকিটের টাকা সরবরাহ করতে বাধ্য। এ কারণে যদি কোনো হজযাত্রীর টিকিট না পেয়ে থাকেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে তার টিকিটের টাকা সংগ্রহ করে প্রতারিত হজযাত্রীদের সৌদি আরবে পাঠানো হবে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, সৌদি সরকার বাংলাদেশ বিমানকে আরো আটটি নতুন স্লট দিয়েছে। এতে টিকিটপ্রাপ্ত হজযাত্রীদের সৌদি যাওয়া নিয়ে সব সঙ্কট কেটে গেছে।
এ দিকে প্রতারণা কমাতে হজ এজেন্সির সংখ্যা কমানোর সুপারিশ সংসদীয় কমিটিতে উত্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি বজলুল হক হারুন। এ ছাড়া হজ নীতিমালার আমূল পরিবর্তন করা হবে বলেও জানান তিনি। গতকাল আশকোনায় হজ ক্যাম্পে বি এইচ হারুন বলেন, হজযাত্রীদের সাথে কিছুসংখ্যক এজেন্সি ও মধ্যস্বত্বভোগীর প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আমরা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে জিডি করেছি। পরে এটি মামলায় রূপ নেবে।
তিনি বলেন, সরকারি কোটার হজযাত্রীদের কোনো অভিযোগ নেই। অথচ এজেন্সির অপপ্রচারের কারণে সরকারি কোটায় হজযাত্রীর সংখ্যা বেশি হয় না। আগামীতে সরকারি কোটায় হজযাত্রী বাড়াতে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নেয়া হবে।
হারুন বলেন, সৌদি আরবের সাথে এ দেশের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে শেষ মুহূর্তে বিমানের ৮টি অতিরিক্ত ফ্লাইটের অনুমতি দিয়েছে। এতে হজযাত্রী পরিবহন নিয়ে আর কোনো সঙ্কট নেই।
সূত্র-নয়া দিগন্ত অনলাইন