কমরেড নির্মল সেন স্মরণ কেউ কথা রাখেনি… আজও হৃদয়ে চলে রক্তক্ষরণ

 

আমার জবানবন্দী, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই-সহ অসংখ্য নন্দিত বইয়ের লেখক ও কলামিস্ট, প্রখ্যাত সাংবাদিক, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, দেশবরেণ্য রাজনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড নির্মল সেনের আজ চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই ঢাকার তোপখানা রোডস্থ কমরেড নির্মল সেন মিলনায়তনে উপস্থিত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম দেশের খ্যাতনামা সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যমের বিশিষ্টজনরা উপস্থিত থেকে এই মহান ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা জানাবেন। এসে দেখলাম তার বাম ঘরানার বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হয়েছেন। কমরেড নির্মল সেন স্মরণ জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলির আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু অতীব দুঃখের সাথে দেখলাম সেই মহান কমিটির আহ্বায়ক এবং সদস্য সচিবও উপস্থিত হননি। পরিবারের পক্ষ থেকে কোটালিপাড়ায় আলাদা অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। এখানে একমাত্র সমীরণ দাদাকেই দেখতে পেলাম। পরিবারের পক্ষ থেকে যখন তাঁর স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে বেদীতে সমীরণ দাদা উপস্থিত হলেন তখন তাঁর পাশে আর কেউ নেই। আমি আর সুফিয়ান ভাই পাশে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম। তার পরপরই জাগো গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার এবং জামাল শিকদারের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হলো। এর পরই বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সমিতি’র পক্ষ থেকে আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম। সাথে ছিলেন আলতাফ সরদার। বাসদের কমরেড খালেকুজ্জামান, সাইফুল হক, শওকত হোসেন আহমেদ, রুহিন হোসেন প্রিন্স, জোনায়েদ সাকী, শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, মোসাদ্দেক হোসেন স্বপন, কামাল উদ্দিন, মহিন উদ্দিন চৌধুরী লিটন, বাহারানে সুলতান বাহার, মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসা, আবু সুফিয়ান, সমীরণ রায়, আনসার আলী দুলাল, জামাল সিকদার প্রমুখ।

nirmol_sen_2অস্থায়ী নির্মল সেন স্মৃতি বেদীতে যেসব সংগঠন শ্রদ্ধা নিবেদন করে তার মধ্যে রয়েছে-শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, কমরেড নির্মল সেন স্মরণ জাতীয় কমিটি, নির্মল সেন পরিবার বর্গ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক বামমোর্চা, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-(মার্কসবাদী), বাসদ (মাহবুব), গণসংহতি আন্দোলন, ঐক্য ন্যাপ, বাংলাদেশ সংযুক্ত তাঁতী সমিতি, বাংলাদেশ সংযুক্ত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ আখ চাষী ইউনিয়ন, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, কোটালী পাড়া সমিতি, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী (রাজশাহী জেলা)সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক ও সমাজিক সংগঠন।
নির্মল সেন ১৯৩০ সালের ৩ আগস্ট গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার দিঘীরপাড় গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। মাতার নাম লাবণ্য প্রভা সেনগুপ্ত। নির্মল সেন বড় হযেছেন ঝালকাঠির কলসকাঠির পিসি বাড়িতে। সেখান থেকে তিনি বিএম একাডেমি থেকে ১৯৪৪ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাস করেন। তিনি বরিশাল বিএম কলেজ থেকে আইএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ও মাস্টার্স পাস করেন।
স্কুলজীবন থেকে নির্মল সেনের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের মাধ্যমে। দীর্ঘ দিন তিনি শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রাজনীতি করতে গিয়ে তাকে জীবনের ১৬টি বছর জেলে কাটাতে হয়েছে।
১৯৫৯ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে নির্মল সেন সাংবাদিক জীবন শুরু করেন। তিনি দৈনিক আজাদ, দৈনিক পাকিস্তান পরে দৈনিক বাংলায় সাংবাদিকতা করেন। তিনি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। নির্মল সেনের উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ, মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্র, বার্লিন থেকে মস্কো, মা জন্মভূমি।
কমরেড নির্মল সেনের আত্মা আমাদের অভিশাপ দিচ্ছে। তিনি একসময় অভিমান করে সাংবাদিকদের কোনো সংগঠনের কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতেন না। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকে যখন নৃশংসভাবে বেডরুমে হত্যা করা হলো তখন সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সেই সময় সাংবাদিক নির্মল সেন বেঁচে ছিলেন, কিন্তু অসুস্থ। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সাংবাদিকদের একটি অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিয়েছিলেন এবং কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন, আমি সাংবাদিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ দেখতে চাই। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু সেদিন অনেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সাংবাদিকের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করব। কিন্তু তার কথা কেউ রাখেনি। এমনকি তার মৃত্যুবার্ষিকীতে তাদের কাউকে দেখা যায়নি। হয়তো অনেকেই ব্যস্ত রয়েছেন! সবাই একদিন না ফেরার দেশে চলে যাবে। নির্মলদা’র চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে তারপরেও অনেকে এসেছেন। তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আর যারা আসেনি তারা যখন চলে যাবে না ফেরার দেশে, তাদের অনুষ্ঠানে হয়ত কাউকে দেখা যাবে না। দাদা আপনি অভিশাপ দিয়েন না। আপনার আত্মার শান্তি কামনা করছি। আমরা যেন সকল ভেদাভেদ-মতভেদ ভুলে গিয়ে সাংবাদিকদের অধিকার আদায় এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি।

লেখক-

মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসা
মহাসচিব
বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সমিতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!