করোনার দ্বিতীয় ঢেউ: জরুরী করণীয়
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ: জরুরী করণীয়
রণেশ মৈত্র
সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
বিগত মার্চের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে প্রথম আঘাত করেছিল করোনা ভঅইরাস। বিগত নয় মাসে, স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রকাশিত তথ্যমতে, প্রায় সাত হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আর আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে চার লক্ষ। এই নিবন্ধটি সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত হওয়ার মুহুর্তে সংখ্যা দুটি আরও বাড়বে এমন আশংকা এমন কি বিশেষজ্ঞ মহলগুলিরও।
স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রতিদিন বিকেলে যে তথ্য করোনার ব্যাপারে প্রকাশ করে চলেছেন তার সঠিকতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।কারণ ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে সুদীর্ঘ নয় মাসে তাদের হিসেব অনুসারেই পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ২৬ লক্ষ মানুষের। চিত্রটি মারাত্মকভাবে হতাশাব্যঞ্জক। আমরা সবাই জানি, আমাদের দেশে প্রতিদিন নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে যত লোকের মৃত্যু ঘটে, তার শতকরা পাঁচ শতাংশের হয়তো হাসপাতালে ঘটে থাকে। বাদ বাকী ৯৫ শতাংশ মৃত্যু ঘটে হাসপাতালের বাইরে-বিনা চিকিৎসায় বা টোটকা চিকিৎসায়। আবার নানা রোগে যাঁরা প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন, তার হয়তো দুই থেকে তিন ভাগ ম াত্র হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
যে হারে চিকিৎসা বা মৃত্যুর কথা উল্লেখ করলাম, তা নিতান্তই অনুমান নির্ভর কারণ এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা আজও আমাদের দেশে গড়ে ওঠে নি। সংখ্যায় যদি কিছু কম-বেশী হয়ও-তা যে সত্যের অনেকটা কাছঅকাছি তাতে কোন সন্দেহ নেই। নেই এ কারণে যে আমাদের দেশে স্বাধীনতার আসন্ন পঞ্চাশ বছর পূর্তির লগ্নেও হাসপাতালের সংখ্যা, ডাক্তারের সংখ্যা, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীদের সংখ্যা মোট রোগাক্রান্তের শতকরা দশ ভাগও না। যে কিছু সংখ্যক হাসপাতাল এ যাবত গড়ে তোলা হয়েছে তাতে সঙ্গতিসম্পন্ন মানুষেদেরও খুব অল্প সংখ্যকই ভর্তির সুবিধা পাচ্ছেন-বাদ-বাকী সবাইকেই গুনতে হচ্ছে “ঠাঁই নাই-ঠাঁই নাই”। সঙ্গতি সম্পন্ন পরিবারগুলির বিপুল সংখ্যক রোগীই যেখঅনে হাসপাতালে স্থানাভঅবে ভর্তি হতে পারছেন না সেখানে সঙ্গতিহীণ দারিদ্র্যপীড়িত লক্ষ লক্ষ রোগীর তো হাসপাতাল পর্য্যন্ত পৌঁছানোর যান বাহনের ভাড়া বহনের ক্ষমতাটুকুও নেই। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রায় সকলেই ঢাকায় সরকারি বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে কাজ করেন আর অংশত: চট্টগ্রামে। বাদ বাকী বিশাল বাংলাদেশ?
উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে যে শুধুমাত্র সন্তান সম্ভবা নারীদের সন্তান প্রসবের আংশিক সুবিধা মাত্র আছে, আর সর্দি, কাশি,পেট খারাপের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কিছু ট্যাবলেট মাত্র পাওয়া যায় এ নিয়ে নিশ্চয়ই কোন বিতর্কের অবকাশ নেই। শতকরা নারীর সন্তান প্রসব হাসপাতালেই হতে হবে, এমন কোন বিধান আজও আমাদের দেশে বাধ্যতামূলক করা হয় নি। আবার এ ব্যাপারে সচেতনতারও যে অভাব আছে তাও সত্য। উপজেলা ও জেলা পর্য্যায়ের হাসপাতালগুলিতে সন্তান সম্ভবা নারীদের আধুনিক চিকিৎসা বা সন্তান প্রসবের বিজ্ঞান সম্মত ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আবার চিকিৎসাক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং এক ধরণের চিকিৎসকদের সীমাহীন অর্থ লোভের কারণে স্বাভাবিক প্রসবযোগ্য মায়েদের অনেককেই অপারেশনের মাধ্যমে প্রসবের ব্যবস্থা করতে দেখা যায়। অসহায় নারীরা এর শিকার হয়ে অনেকেই নানা জটিলতায় জীবন ভর ভুগতে বাধ্য হন। অকাল মৃত্যুও ঘটে অনেক মায়ের-অনেক শিশুর।
চিকিৎসা ব্যবস্থার এহেন বিপর্য্যস্ত পরিস্থিতির চিত্র অনেক সময়ই সংবাদপত্রের পাতায় উঠে এলেও, তা নিরসনে কর্তৃপক্ষের যথাযথ হস্তক্ষেপ খুব কমই দৃশ্যমান হয়। ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বাস্থ্য সেবার ব্যাপক বিপর্য্যয় প্রতিদিন দেশের সর্বত্র ঘটিয়ে চলেছে অবাধে। করোনাকালে স্বাস্থ্য বিভঅগের ও সরকারি হাসপাতালগুলির দুর্নীতি ও বেসরকারি বহু হাসপাতাল ও ক্লিনিকে বিরাজমান ভয়াবহ পরিস্থিতির চিত্র জনসমক্ষে ধরা পড়েছে।
প্রয়োজন হলো ঊর্দ্ধতন মহলের দ্রুত হস্তক্ষেপের। জাতীয় সংসদে প্রধান মন্ত্রী বলেছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধে সরকার প্রস্তুত। তৃণমূল পর্য্যায়ে কিন্তু এই প্রস্তুতি কারও নজরে পড়ছে না। প্রথমেই উল্লেখ করা যায়, টেষ্টিং কিটসের কথা। জেলা উপজেলাগুলিতে করোনা শনাক্ত করার জন্য অপরিহার্য্য প্রয়েঅজন ব্যাপক সংখ্যক মানুষের করোনা পরীক্ষা। প্রতি উপজেলায় প্রতিদিন ৫০০ করে মানুষের পরীক্ষা বিনামূল্যে বাধ্যতামূলকভাবে করা প্রয়েঅজন। কিন্তু উপযুক্ত নির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় টেষ্টিং কিটস ও জনবলের প্রচ- অভাব। দ্বিতীয় ঢেউ যে ভয়াবহ আকারে সমগ্র আমেরিকা ও ইউরোপ জুড়ে এবং এশিয়ার ভারতেও ছড়িয়ে পড়েছে তা গভীরভাবে আতংকজনক। বাংলাদেশেও এর লক্ষণ স্পষ্ট। নতুন করে রোগাক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যাবৃদ্ধি তার সুস্পষ্ট ইংগিত দেয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন শীতের প্রকোপে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু একথা বলার পর একটি কথাও বলেন নি উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবিলায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কিকি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সকলে যেন পরীক্ষা করে জানতে পারে তাঁর ও তাঁদের দেহে করোনা সংক্রমণ ঘটেছে কি না। তা নিশ্চিত করার জন্য দেশ ব্যাপী সরকারিভাবে কি কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার বিস্তারিত উল্লেখ তাঁর বক্তব্যে নেহায়েতই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু মানুষ হতাশ হয়েছে।
যে কথা সরকারিভাবে বলা হচ্ছে বারংবার, তা হলো বাইরে যেতে হলে সকলেই বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে হবে, বার বার হাত ধুতে হবে, স্যানিটাইজার সঙ্গে রাখতে হবে। এগুলি যথার্থ উপদেশ কারণ এগুলি সবারই মানা প্রয়োজন করোনা প্রতিরোধ করতে হলে। তবুও বেশীর ভাগ মানুষ মাস্ক পরছেন না দেখে কোথাও কোথাও ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে নির্দেশ অমান্যকারীদেরকে জেল-জরিমানার শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এতে কারওই আপত্তি নেই। এর সাথে অবশ্যই ভাবতে হবে যাঁরা মাস্ক পরছেন তাঁরা একটা মাস্ক দিয়েই মাসের পর মাস চালাচ্ছেন কিনা, মাস্কগুলি বিজ্ঞানসম্মত কি না-যারা কিনতে পারছেন না তাদের জন্য বিজ্ঞান সম্মত মাস্ক প্রাপ্তির ব্যবস্থা কি? সরকার বাইরে যাওয়া শতভাগ লোককে মাস্ক পরে যেতে বলার সাথে সাথে একই বিষয়টিকেও গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে। সরকারিভাবে ওষুধের দোকানগুলিতে বিজ্ঞান সম্মত মাস্ক সরবরাহ করার জন্যে এবং নকল ও বিজ্ঞান সম্মত নয় এমন সকল মাস্ক বাজার থেকে কার্য্যকরভাবে প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা অবশ্যই প্রয়োজন।
কিটস নাই ঢাকার বাইরে কোথাও এ কথা অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত। পত্রিকায় দেখলাম-মার্কিন রাষ্ট্রদূত ঢাকায় একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার কাছে বেশ কিছু সংখ্যক মাস্ক ও অপরাপর স্বাস্থ্য সামগ্রী হস্তান্তর করলেন। আমাদের এমব্যাসি ও হাইকমিশনগুলিকে মানসম্মতও মাস্ক নানা দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে কিনে বা সংগ্রহ করে পাঠানোর জন্য নির্দেশ জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজন। কিটস এর ক্ষেতেও একই সুপরিশ করবো।
কিটস দ্বারা নমুনা নেওয়া যাবে কিন্তু পরীক্ষা কোথায় হবে? তার জন্য সর্বত্র পিসিআর ল্যাবের প্রয়োজন কিন্তু তা ঢাকা সহ মাত্র কয়েকটি শহরে আছে তাও জেলা বা বিভাগীয় হেডকোয়ার্টারের হাসপাতালগুলিতে। বিশাল বাংলাদেশের অপরাপর জেলা উপজেলায় আদৌ সে ব্যবস্থা আজও নেওয়া হয় নি। প্রত্যাশা এই যে কার্য্যকরভাবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধ করার লক্ষে সর্বত্র যথেষ্ট সংখ্যক ল্যাব অতি সত্বর জরুরী ভিত্তিতে স্থাপন করে দ্রুত করোনা পরীক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে প্রয়োজনে চিকিৎসা এবং নেগেটিভ ফল এলে তাঁদেরকে নিশ্চিন্ত হওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
চিকিৎসা হবে কোথায়? ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরে কোন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড আজও স্থাপন করা হয় নি। প্রয়োজনের তুলনায় ওয়ার্ডের বা স্থানের স্বল্পতা প্রতিটি হাসপাতালে রয়েছে-রয়েছে করোনা ছাড়া প্রচলিত রোগাক্রান্তদের অসম্ভব ভীড়। তবু একদিকে যেমন এসত্বেও প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ড অবশ্যই স্থাপন করতে হবে, তেমনই সকল হাসপাতালে প্রয়োজনীয়সংখ্যক আই.পি.ইউ, ভেন্টিলেশন ও অক্সিজেন মজুত রাখার ও করোনা চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের ব্যবস্থাও অপরিহার্য্য।
আশার কথা, শীঘ্রই করোনা ভ্যাকসিন বাজারে আসছে, বিদেশী খ্যাতনামা কোম্পানীগুলি এমন আশাবাদের সৃষ্টি করছেন। উৎসাহের সাথে ঐ খবরগুলি আমাদের সংবাদপত্রগুলিও প্রকাশ করে চলেছে তৃণমূল পর্য্যায়ে ঐ আশাবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রধান মন্ত্রীও বলেছেন, সরকার এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন ভ্যাকসিন কেনার জন্যে। খবরটি আশাপ্রদ।
কিন্তু এর পরেও তো কথা আছে।
এক.আমদানীকৃত ভ্যাকসিন পরিবহন ও দেশের নানাস্থানে সংরক্ষণের বিজ্ঞান সম্মত ব্যবস্থা আছে কি?না থাকলে দ্রুত সে ব্যবস্থা নিতে হবে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে।
দুই. আমদানীকৃত ভ্যাকসিন ধাপে ধাপে কারা পাবেন তার সঠিক অগ্রাধিকার নির্ণয় করে সেগুলি তাঁদের দেহে প্রয়োগের ব্যবস্থা নির্ণয় অবিলম্বে করা প্রয়োজন। প্রথম অগ্রাধিকার ডাক্তা, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী এবং তাঁদের পরিবার পরিজন, পুলিশ পেতে অধিকারী।
তিন. এর পরে যাটোধ সকর নারী-পুরুষ।
চার.সকল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার পরিজন।
পাঁচ.সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ক্রীড়াবিদ, সংস্কৃতি কর্মী প্রভৃতি।
ছয়. অত:পর শহর ও গ্রামের সকল নাগরিক যাতে স্বল্পমূল্যে ভ্যাকসিন পান তারও ব্যবস্থা সরকারিভঅবেই করতে হবে। এই ব্যবস্থাগুলি নিলে দেশবাসী নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সঠিকভঅবে প্রতিকার করা হয়তো সম্ভব হবে।