কাইয়ুমকে গুলি করে সন্ত্রাসী শফিক
অনলাইন ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
‘শীর্ষ সন্ত্রাসী শফিককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম রাহাতকে সঙ্গে নিয়ে কেন তুমি এসএম কাইয়ুমের বাসায় গুলি করতে গেলে? জবাবে শফিক আমাকে বলে, মেয়রের (কামরুজ্জামান কামরুল) নির্দেশে রাহাতকে নিয়ে যাই।’ রাহাত হত্যা মামলার বাদী ফারহানা সুমা নিজেই ২১ অক্টোবর রাতে প্রতিবেদককে ফোন করে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য প্রকাশ করেন। মেয়র কামরুজ্জামান কামরুলের প্রত্যক্ষ মদদেই এই শফিক এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার বিরুদ্ধে হত্যা, আগ্নেয়াস্ত্রসহ অন্তত দুই ডজন মামলা রয়েছে। পুলিশের দেয়া একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে মেয়র কামরুজ্জামান কামরুলের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গভীর সখ্য থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, গোয়েন্দা প্রতিবেদনে মেয়রের অন্ধকার জগতের ভয়াবহ সব তথ্য তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যখন জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ সমন্বয় করে উদ্যোগ নেয়, তখন তার কারণে সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তিনি স্বীয় স্বার্থ, কর্তৃত্ব বিস্তার ও সুবিধা আদায়ের জন্য বিভাজন সৃষ্টি করে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনকে অস্থিতিশীল করতে চান।’
নথিপত্রে দেখা গেছে, শহরের সাঁটিরপাড় এলাকার বাসিন্দা মমতাজ উদ্দিন সুবেদারের ছেলে শফিকুল ইসলাম শফিক পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী। নরসিংদী মডেল থানা সন্ত্রাসীদের যে তালিকা করে, তাতে প্রথমেই আছে শফিকের নাম। নরসিংদীর এক সাংবাদিক জানিয়েছেন, ‘প্রকাশ্যে সন্ত্রাসীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বারবার শফিককে পুলিশের কব্জা থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন মেয়র। বিগত পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী এসএম কাইয়ুমের সঙ্গে মেয়র কামরুজ্জামান কামরুলের দ্বন্দ্বের বিষয়টি গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও ওঠে আসে।
এ বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হয় মেয়র কামরুল ইসলাম কামরুলের মুঠোফোনে। কিন্তু তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি। পরে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য চেয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। তারও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
এদিকে কামরুল ইসলাম বিগত পৌর নির্বাচনে যে হলফনামা দিয়েছেন, তাতে দায়রা জজ ও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালসহ বিভিন্ন বিচারিক আদালতে তার ৭টি মামলা থাকার তথ্য দেন। এর মধ্যে ৫টি মামলায় তিনি খালাস পেয়েছেন বলে দাবি করেন।
জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম, বীর প্রতীক যুগান্তরকে বলেন, ‘নরসিংদীর মাটিকে সন্ত্রাসমুক্ত করব। তালিকা পেলে সবাইকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেব।’ মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল নিজেই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছেন- গোয়েন্দা সংস্থার এমন প্রতিবেদন সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘এর আগের ডিসির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে ওইসব প্রতিবেদন দেন।’ নিয়মানুযায়ী কোনো ডিসির পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রতিবেদন দেয়ার সুযোগ নেই বলা হলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘তাহলে এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’ শীর্ষ সন্ত্রাসী শফিকুল ইসলাম শফিক আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিজের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেছেন, তা দেখেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো সন্ত্রাসী যদি ছবি তুলে তাহলে কীভাবে বুঝব? তবে সেই সন্ত্রাসী যদি এটা করে থাকে, তাহলে আমি তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেব।’
পুলিশ সুপার আমেনা বেগম বলেন, ‘সন্ত্রাসী শফিক বিভিন্ন মামলায় জামিনে আছেন। অভিযোগ পেলে তাকে গ্রেফতার করা হবে। এসএম কাইয়ুমের বাসায় রাহাতকে সঙ্গে নিয়ে শফিক গুলি করতে যায়। এরপরও তাকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না জানতে চাইলে এসপি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, ‘যুগান্তরের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখছি। এসব প্রতিবেদন থেকে অনেক তথ্য মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে কাজে আসবে।’
একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও এসএম কাইয়ুমের সঙ্গে প্রকাশ্যে বিরোধের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ‘মেয়র কামরুলের নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে স্থানীয় জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা এসএম কাইয়ুম ২০১৫ সালের পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আরেক স্থানে বলা হয়, স্থানীয় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কামরুলের গভীর সখ্য ও চলাফেরা থাকার কারণে ভয়ে প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। এসব কারণে নরসিংদীর চারজন সংসদ সদস্য মেয়রের অপরাজনীতির বিরোধিতা করেন। এ চার সংসদ সদস্যের নামও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। তারা হলেন- সাবেক মন্ত্রী রায়পুরা উপজেলার এমপি রাজিউদ্দিন রাজু, পলাশ উপজেলার এমপি কামরুল আশরাফ খান পোটন, শিবপুরের এমপি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি বেগম রহিমা খাতুন। এছাড়া জীবদ্দশায় সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত অ্যাডভোকেট আসাদোজ্জামানসহ বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতারা কামরুজ্জামান কামরুলের বিরোধিতা করেছেন। এমনকি তার অপকর্মের বিরোধিতা করায় রাস্তা সম্প্রসারণের নামে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য বেগম রহিমা খাতুনের বাড়ির দেয়ালটিও ভেঙে ফেলেছিলেন মেয়র কামরুল। এ বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রশাসন বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হয়। পরে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর গোচরে আসে। তাঁর সানুগ্রহ নির্দেশনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ ও একান্ত সচিব-২ জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দিলে বিষয়টির নিষ্পত্তি করা হয়। বর্তমানে আপাতত নিষ্পত্তি হলেও বেগম রহিমা খাতুন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মেয়র কামরুজ্জামান কামরুলের কিছু কার্যক্রম নরসিংদী জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও জেলা আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছে। ২০১৫ সালের পৌর নির্বাচনে দাখিলকৃত হলফনামায় তিনি সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করেছেন অষ্টম শ্রেণী পাস। অতীতে তিনি এক তরুণীকে ধর্ষণ ও পরবর্তী সময়ে তাকে হত্যা মামলার আসামি করা হলেও প্রভাব বিস্তার করে মামলার কাগজপত্র গোপন করেছেন। এ ছাড়া নরসিংদী সদর থানা আন্তঃজেলা ডাকাতি মামলার আসামি হিসেবে স্বীকারোক্তিমূলক জবাবন্দি দেন। ১৯৯২ সালে তৎকালীন প্রথম শ্রেণীর মেজিস্ট্রেট দিল জুয়ারা বেগম তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।’
মেয়রের বিরুদ্ধে জেলা পরিষদের জমি দখলের অভিযোগের তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘তিনি সাবেক পৌর কমিশনার মানিক হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার সরাসরি সম্পৃক্ত পাওয়া যায়। জেলার চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করে। বর্তমানে এ মামলাও বিচারাধীন।’
প্রতিশোধ নেন যেভাবে : স্থানীয় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার মেয়রের অবৈধ আবদার রক্ষা না করলে সামাজিক আন্দোলনের হুমকি দেন। এভাবে মেয়রের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিরোধিতা করে একজন জেলা জজ, জেলা প্রশাসক ও একজন পুলিশ সুপারকে অপমানিত হয়ে বদলি হয়ে আসতে হয়। এ বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের এক স্থানে বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি বিষয় তুলে ধরা হয়। বলা হয়, ‘শিলমান্দি ইউনিয়নে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জনপ্রিয় ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল বাকিরকে বাদ দিয়ে দলীয় মনোনয়নে বিরোধিতা করেন কামরুল। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে যাকে দলীয় মনোনয়ন দিতে মেয়র জেলা কমিটিকে সুপারিশ করেন, তিনি আগের নির্বাচনে মেম্বার পদে নির্বাচন করে জামানত হারিয়েছেন। এ সিদ্ধান্ত না মেনে বিদ্রোহী প্রার্থী হন আবদুল বাকির। একইভাবে হাজীপুর ইউনিয়নে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ইউসুফ খান পিন্টুকে মনোনয়ন দেয়া হয়। এতে করে সংক্ষুব্ধ মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত প্রার্থী পিন্টু এবং বিদ্রোহী প্রার্থী বাকিরকে হারিয়ে দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশের ওপর তীব্র চাপ প্রয়োগ করেন। স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হওয়ায় উভয়েই নির্বাচিত হন। ফলে ক্ষুব্ধ মেয়রের নেতৃত্বে জেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশ তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। এ ধারাবাহিকতায় পুলিশ সুপারকে নাজেহাল করতে না পারলেও জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে স্থানীয় এমপি ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম বীর প্রতীকের হস্তক্ষেপে মেয়রের এ অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়।’ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পেছনে মেয়র তার অনুগত কয়েকজন সাংবাদিককে ব্যবহার করেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘যেখানে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী কাজ করার ক্ষেত্রে সমন্বয় ও ঐক্যের প্রয়োজন, সেখানে মেয়র কামরুজ্জামান কামরুলের এ ধরনের অপচেষ্টা প্রশাসন ও সরকারের জন্য ক্ষতিকারক।’
এসব গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেয়ার পরও কীভাবে মেয়র ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছেন- জানতে চাইলে নরসিংদীর একজন সাংবাদিক যুগান্তরকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কেন্দ্রে থাকা কয়েকজন রাজনীতিক তাকে শেল্টার দেন। ভুল তথ্য দিয়ে মেয়র রাজনৈতিক নেতাদের বিভ্রান্ত করেন। স্বার্থের মোহে সবাই প্রকৃত বিষয়টি এড়িয়ে মেয়রকে আগলে রাখেন। এখানেই সমস্যা।’
তথ্য-যুগান্তর।