খালেদা জিয়ার কারাবাসের এক বছর
সম্পাদকীয় ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
কারাগারে এক বছর পূর্ণ হলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার। পুরানো ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডের পুরানো কেন্দ্রীয় কারাগারের একমাত্র বন্দি খালেদা জিয়া।
গত বছরের এই দিনে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুনীির্ত মামলায় সাজা হওয়ার পর খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই তিনি জামিনে বের হয়ে আসবেন বলে ধারণা করা হলেও তা হয়নি। আইনি মারপ্যাঁচে তার কারাবন্দিত্ব আরও দীঘাির্য়ত হবে, নাকি সহসা তিনি মুক্তি পাবেন তা নিয়ে ঘোরতর অনিশ্চয়তা রয়েছে।
গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড দেয় বিশেষ আদালত। কারাগারে থাকা অবস্থায় এই মামলায় উচ্চ আদালত তার সাজা আরও পাঁচ বছর বাড়িয়ে ১০ বছর করেছে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের আরেকটি মামলায় তার সাজা হয়েছে সাত বছর। যে মামলায় খালেদা জিয়া কারাগারে আছেন, সেটিতে গ্রেপ্তারের দেড় মাসের মাথায় জামিন মিললেও তার মুক্তির পথে বাদ সেধেছে আরও ৩৫ মামলা। একটি মামলায় জামিন হলে, অন্য মামলা সামনে আসছে। এভাবেই পার হয়েছে এক বছর।
তার আইনজীবীরা বলছেন, কারামুক্ত হতে চারটি মামলায় জামিন পেতে হবে। জিয়া অরফানেজ মামলায় হাইকোর্টের ১০ বছরের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করা হলে জামিন আবেদন করবেন তার আইনজীবীরা। চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্টে করা আপিলের জামিন আবেদন করা হয়েছে। এ ছাড়া কুমিল্লার হত্যা মামলা ও মানহানির একটি মামলায় তার জামিন হয়নি এখনো। এসব মামলার ১৬টি অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে রয়েছে। উচ্চ আদালতে ১১টির বিচার স্থগিত আছে। আর বাকি ২০টি মামলার কোনোটিতে অভিযোগপত্র জমা পড়েছে, কোনোটি তদন্তের পর্যায়ে আছে। গতকালও একটি মামলায় বিশেষ আদালতে হাজির করা হয় খালেদা জিয়াকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ৪টি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের গত দশ বছরে ৩২টি মামলা দায়ের হয়েছে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আইনের সাধারণ প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা কঠিন হবে। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় রাজপথ উত্তপ্ত করা। যতদিন পর্যন্ত রাজপথ উত্তপ্ত না হবে, ততদিন পর্যন্ত খালেদা জিয়াকে আইনি প্রক্রিয়ায় জেল থেকে বের করা যাবে না। এটি আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তিনি বলেন, আইনী প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা এইজন্য কঠিন যে, বর্তমান সরকার সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া তাকে মুক্ত করা যাবে না। রাজনৈতিক কারণেই তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হয়েছে। এই মামলাগুলোর যতটা না আইনী ভিত্তি রয়েছে, তার চেয়ে বড় উদ্দেশ্য হলো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘কেবল সরকারের অবৈধ হস্তক্ষেপে দেশনেত্রী কারামুক্ত হতে পারছেন না। তাকে অন্যায়ভাবে আটকে রাখা হয়েছে।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে মুক্ত করতে হবে। এর জন্য আইনি লড়াই যেমন চলবে, তেমনি সাংগঠনিক কমর্সূচিও অব্যাহত থাকবে।
এদিকে পরিবার, চিকিত্সক ও দলের নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দি থেকেও তার মনোবল এতটুকুও টলেনি। তবে শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পুরনো রোগগুলো বেড়ে গেছে। চোখেও প্রচন্ড ব্যথা, পা ফুলে গেছে। একা একা হাটতে পারেন না। খালেদা জিয়ার এক ব্যক্তিগত চিকিত্সক বলেছেন, অসুস্থ খালেদা জিয়া চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন। অস্বাস্থ্যকর বদ্ধ স্যাঁতস্যাতে পরিবেশে তাকে থাকতে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ তাকে সুচিকিত্সা থেকে বঞ্চিত করছে।
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়া সাধারণত শান্ত ও চুপচাপ থাকেন। কারা কর্মকর্তাদের কাছে তিনি কোনো চাহিদার কথা জানান না। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়েন। এরপর প্রায় প্রতিদিনই সকালের নাস্তা হিসেবে রুটি ও সবজি খান। নাস্তার পরে পত্রিকা পড়েন। এরপর গোসল করেন, পরে জোহরের নামাজ পড়েন। জোহরের নামাজ শেষে তিনি মাঝে মাঝে অজিফা পড়েন। কখনো তিনি ডে-কেয়ার সেন্টারের বারান্দায় পায়চারিও করেন। দুপুরের খাবার খান বিকাল চারটা থেকে সাড়ে চারটার দিকে। বিকালে আসরের নামাজের পর হাঁটাহাঁটি করে সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর বিটিভি দেখেন। এরপর এশার নামাজের পর রাতের খাবার খান। খাবার শেষে আবার কিছু সময় টিভি দেখেন। জানা যায়, খালেদা জিয়ার তত্তাবধানের জন্য তাঁর দীঘির্দনের গৃহকর্মী ফাতেমাও কারাগারে আছেন। এছাড়াও দিনে কতর্ব্যরত নারী-কারারক্ষীরা কাছে থাকেন। খালেদা জিয়ার সেবায় কারাগারের ভেতরে সাবর্ক্ষণিক একজন নারী ফার্মাসিস্ট, প্রয়োজন হলে একজন চিকিৎসক থাকেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় খালেদা জিয়ার কক্ষ ঘিরে একজন নারী উপ-কারাধ্যক্ষের নেতৃত্বে সাবর্ক্ষণিক চারজন নারী কারারক্ষী থাকেন। কারাগারের বাইরে আছেন একজন উপকারাধ্যক্ষের নেতৃত্বে একদল কারারক্ষী।
প্রসঙ্গত, এই মামলায় সাজা হওয়ার আগে খালেদা জিয়া ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি রাজনীতিতে যোগ দেয়ার পর মোট চারবার গ্রেপ্তার হন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন। সর্বশেষ তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত বিশেষ সাব জেলে আটক করে রাখা হয় তাকে। সাবজেলে ৩৭২ দিন কাটানোর পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান।