নুরুল মুহাম্মদ কাদের এর গল্প-কি পেলাম তোমায় ভালো না ভেসে

 

কি পেলাম তোমায় ভালো না ভেসে

——————————  নুরুল মুহাম্মদ কাদের

১৯৯৫ সালে লেটার মার্কসহ এসএসসি পাশ করি। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ার পূর্ব সময় পর্যন্ত আমার প্রিয় শিক্ষক আলহাজ্ব মনজুর আহমদ চৌধুরীর (স্কুলে প্রধান শিক্ষক) আদেশে নিজ স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পাঠদান করি। এসএসসি পাশের পর বাবা আমাকে শহরে নিয়ে আসেন এবং চট্টগ্রামস্থ আমার এক আত্মীয়’র সাথে মেসে থাকার ব্যবস্থা করে চলে যান। মেসে প্রতি সিটের ভাড়া ছিল ১৭৫ টাকা। টিনসেডের এ বাসায় গ্রীষ্মকালে কি পরিমান গরম ছিল তা বলা বাহুল্য। প্রথম পর্যায়ে মেস থেকে অতিদুরে ৩ জন ছেলে-মেয়ে পড়িয়ে দুবেলা ভাতের ব্যবস্থা হলো। পরে এসে বাবা আমাকে ভর্তি করিয়ে দেন চট্টগ্রাম পলিটেকনিকেল কলেজে। ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস পর শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। প্রতিদিন ট্রাকে করে নিয়ে যেত মিছিল করতে। একদিন মিছিলে যেতে অস্বীকার করলে ছাত্র নেতাদের সাথে কথাকাটির একপর্যায়ে আমাকে বাধ্য করায় কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে শুরূ করি টিউশনি। গনিত-ইংরেজি বিষয়ে ভালো ছিলাম বলে টিউশনিতে বেশি বেতন পেতাম। টিউশনির টাকা বাবার জন্য নিয়মতিভাবে পাঠাতাম এবং নিজে খুব সৌখিনভাবে চলতাম। আমার স্কুলে প্রধান শিক্ষক আমার লেখাপড়ার খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন যে, আমি কলেজে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। তিনি আমার বাসায় এসে পুনরায় কলেজে ভর্তি করে দিলেন এবং একটি লজিং এর ব্যবস্থা করে দেন। লজিং-এ ৮ম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছাত্রীটি আমার প্রেমে পড়ে। তার প্রেম এতই আবেগময় ছিল আমি কলেজ থেকে যে সময় আসিনা কেন তিনি খাবারগুলি গরম করে দিতেন এবং প্রায় সময় আমার কাপড়গুলি গুছিয়ে রাখতেন। অসুস্থ হলে খুবই চিন্তিত হতেন ইত্যাদি…। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর বাবার অনুরোধে লজিং ছেড়ে দিই। পরে জেনেছিলাম আমার সে ছাত্রীটি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে এবং লেখাপড়া ছেড়ে দেন। ১৯৯৮ সালে ২৯ শে আগস্ট বাবার মুত্যুর হয়। বাবার মৃত্যুতে পর সংসারের পুরো দায়িত্বভার পরে আমার উপর। এমনকি বাবার প্রায় দুলক্ষাধিক ঋণ টিউশনির টাকা দিয়ে শোধ করি। টিউশনি করে নিজের লেখাপড়া খরচ ও মায়ের জন্য টাকা পাঠাতাম। বাবার মৃত্যুর পর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম মাকে আমি কোন বিষয়ে না করবনা এবং প্রতিষ্ঠিত হইয়ে মাকে শহরে নিয়ে আসব। সবচেয়ে দামী টিউশনির ছাত্রীটিকে বিয়ে দিতে চাইলে সে পালিয়ে আমার নকিট আত্মীয়য়রে বাসায় এসে আমার প্রতি তার গভীর ভালোবাসার কথা প্রকাশ করে। আমার এ ছাত্রীটিরও আবেগময় ভালোবাসা দেখে এবারও টিউশনি ছেড়ে দিই। পরে ওর সাথে এক শিল্পপতির ছেলের বিয়ে হয়। এরপর যে কয়েটি ছাত্রছাত্রীকে পড়াতাম সব কয়টি ছাত্রী আমার প্রতি কম-বেশি অনুরাগী ছিল। একসময় টিউশনি ছেড়ে দিয়ে মেসের বাসায় শুধুমাত্র ছেলে পড়াতাম এবং স্থানীয় একটি দৈনিক প্রত্রিকায় নিয়মিত লিখতাম। ২০০০ সালে ‘বাঁশখালী কেন বিষখালী’ শিরোনামে একটি তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার কর্তৃপক্ষের রোষানালে পড়ে একটি মার্কেটিং কোম্পানীর চাকরিতে যোগ দিয়ে কোচিং পেশাা ও লেখালেখি ছেড়ে দিই। ২০০৪ সালে মার্কেটিং কোম্পানীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশ ডাক বিভাগে সরকারি চাকরিতে যোগ দিই। প্রথম পোষ্টিং ছিল একটি সাব পোস্ট অফিসে। আফিসে চারজন স্টাফের মধ্যে তিনজনই নারী। একজনের সাথে একটু ভালোভাবে কথা বললে অন্যজন ঈর্ষায় জ্বলতো। তিন মাসের মাথায় নিজ উদ্যোগে অন্যত্র বদলি হয়। ২০০৫ সালে ডাক বিভাগের চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগদান করি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর গোপনীয় শাখায় চাকরিকালীন এলাকার বেশ কয়েকটি মামলা মিমাংসা করে সকলের মাঝে প্রসংশিত হই। ২০০৫ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার সেরা গাল্পিক নির্বাচিত হই। ২০০৭ সালে দীর্ঘ দশদিন ধরে টাইফয়েড় জ্বরে আক্রান্ত হলে ব্যাচেলার মেসটিতে দিনের বেলায় সঙ্গী ছিল শুধুমাত্র মূঠোফোনটা। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অন্তীম মূহুর্তে একা হয়ে বলেছিলেন আই নিড সাওয়ান টু টক। সে সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সুস্থ হলে বিয়ে করার। তারপর বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা। প্রথম দেখাতেই মেয়েটিকে ভালো লেগেছিল। মেয়েটির মেধা, হাতের লেখা দেখে বড় ভাই ও আমার খুব ভালো লাগে। দীর্ঘ মুঠোফোনালাপে তার প্রিয়-অপ্রিয় সবকয়টি বিষয় নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে গেলেও মাতৃহীনা ও পারিবারিক অবস্থা আরও মেয়েটির এক আত্মীয়র নানান কথায় তার সাথে বিয়ে হলোনা। মেয়েটি প্রিয় বন্ধুকেও নাকি বলেছিল ‘আমার সাথে এক সুন্দর ছেলের সাথে বিয়ে হতে পারে’। পরে জেনেছি আমার সাথে বিয়ে না হওয়ায় মেয়েটি প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে। তারপর যে মেয়েটি দেখেছিলাম সে ছিল নিজ উপজেলার। বাংলায় অনার্স-মাস্টার্স পাস মেয়েটিকেও বিয়ে করার মানস নিয়ে দীর্ঘ সময় কথা হল। সে ছিল আমার লেখার ভক্ত এবং বলতেন বাংলায় অনার্স হলেও আমি লেখকের মতো হতে পারবনা। তার কথাই ছিল সারল্য আর সত্যময়। মুঠোফোনে তিনি তাকে বিয়ে করার অনুরোধ করলেও কেন জানি তার সাথেও হলনা বিয়েটা। ২০০৭ সালে আমার বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খাওয়ার মধ্য দিয়ে পরিচিত হলো তার মামাতো বোনের। বন্ধুর নানান প্রশাংসা ও গ্রাম্য মেয়ে হিসেবে আমার মায়ের সেবাপ্রাপ্তি আর গ্রামে বসাবরত আমার অপরাপর ভাইদের মিলামলি হবে বলে বিয়ে কারার আলোচনা হয় এবং পাত্রীর পক্ষের অনুরোধে সাপ্তাহের মধ্যে মেয়েটির সাথে বিয়ে হলো আমার। তাপর শুরূ হলো কষ্টের নতুন অধ্যায় আর জীবনের নতুন সূচনা। আমি নিশ্চিত হলাম মেয়েটির সবটুকু জেনেও পরম বন্ধু আমার সাথে প্রতারনা করেছে। বিয়ের মাধ্যমে আমার জীবনে নেমে হতাশা আর অস্থিতিশীলতা। প্রতিদিন ক্ষরিত হতো কোমল হৃদয় । জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত হয়ে নির্জীব জীবনের খেলাঘরে এক কোনায় পড়ে আছি। নিজের বিয়ে থেকে শিক্ষা নিয়ে লিখলাম ‘বিয়ে ও সংসার’ নামক একটি গ্রন্থ। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মহোদয় কর্তৃক মোড়ক উন্মোচনের পরপরই প্রায় পাঁচ শতাধিক বই বিক্রি হয়। লাল-নীল কষ্টগুলি কখনও নির্ঘুম রাতে হারিয়ে যায় অতীতের মাঝে। অতীতে যারা ভালোবাসার হাত ছানি দিয়ে ডেকেছিল তাদেরকে মূল্যয়ন করেনি ভালোবসার জ্ঞানের অভাবে কর্মজীবনে উদ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে কাজের জন্য প্রশংসিত হই। এলাকার মানুষ ভালো ও সৎ চরিত্রবান ছেলে হিসেবে মূল্যায়ন করে। মা প্রতিয়িনত দোয়া করে। প্রায় ১০টি সামাজিক সংগঠনে নিস্বার্থ সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। সমাজের নানামূখী কাজের মূল্যায়ন হিসেবে ২০১০ সালে নিজ উপজেলার আলোকিত মানুষ হিসেবে পরিচিত পাই। যাদের ভালোবাসার হাতছানিকে ফিরিয়ে দিয়েছি তারা কেমন আছেন জানিনা তবে জীবনটা বুঝি পশ্চিমাকাশের রক্তিম আভা কিংবা কারও অভিশাপে একজন অসুখী মানুষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!