জিলহজ মাসের করণীয় আমল ও কোরবানির ফজিলত
জিলহজ মাসের দশদিনের ফযীলতঃ
আল্লাহ তা’আলার অশেষ মেহেরবানী যে, তিনি নেককার বান্দাদের জন্য এমন কিছু সুযোগ করে দিয়েছেন, যেখানে তারা প্রচুর নেক আমল করার সুযোগ পায়, যা তাদের দীর্ঘ জীবনে বারবার আসে আর যায়। এসব সুযোগের মধ্যে সব চেয়ে বড় ও মহত্বপূর্ণ হচ্ছে জিলহজ মাসের প্রথম দশদিন।
জিলহজ মাসের ফযীলত সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের কতক দলীল :
১। আল্লাহ তা’আলা বলেন : কসম ভোরবেলার। কসম দশ রাতের। (সূরা ফাজর : ১-২) ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন : এর দ্বারা উদ্দেশ্য জিলহজ মাসের দশ দিন।
২। আল্লাহ তাআলা বলেন : তারা যেন নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করে। (হজ : ২৮) ইবনে আব্বাস বলেছেন : অর্থাৎ জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন।
৩। ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এ দিনগুলোর তুলনায় কোনো আমল-ই অন্য কোন সময় উত্তম নয় । তারা বলল : জিহাদও না ? তিনি বললেন : জিহাদও না, তবে যে ব্যক্তি নিজের জানের শঙ্কা ও সম্পদ নিয়ে বের হয়েছে, অতঃপর কিছু নিয়েই ফিরে আসেনি। (বুখারী)
৪। ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর নিকট কোন দিন প্রিয় নয়, আর না তাতে আমল করা, এ দশ দিনের তুলনায়। সুতরাং তাতে তোমরা বেশী করে তাহলীল, তাকবীর ও তাহমীদ পাঠ কর। (তাবারানী ফীল মুজামিল কাবীর)
৫। সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাহিমাহুল্লাহর অভ্যাস ছিল, যিনি পূর্বে বর্ণিত ইবনে আব্বাসের হাদীস বর্ণনা করেছেন : যখন জিলহজ মাসের দশ দিন প্রবেশ করত, তখন তিনি খুব মুজাহাদা করতেন, যেন তার উপর তিনি শক্তি হারিয়ে ফেলবেন। (দারামী, হাসান সনদে)
৬। ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন : জিলহজ মাসের দশ দিনের ফযীলতের তাৎপর্যের ক্ষেত্রে যা স্পষ্ট, তা হচ্ছে এখানে মূল ইবাদাতগুলোর সমন্বয় ঘটেছে। অর্থাৎ সালাত, সিয়াম, সাদকা ও হজ, যা অন্যান্য সময় আদায় করা হয় না। (ফাতহুল বারী)
৭। উলামায়ে কেরাম বলেছেন : জিলহজ মাসের দশদিন সর্বোত্তম দিন, আর রমযান মাসের দশ রাত, সব চেয়ে উত্তম রাত।
এ দিনগুলোতে যেসব আমল করা মুস্তাহাবঃ
১। সালাত : ফরয সালাতগুলো দ্রুত সম্পাদন করা, বেশী বেশী নফল আদায় করা। যেহেতু এগুলোই আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার সর্বোত্তম মাধ্যম। সাওবান রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শোনেছি : তুমি বেশী বেশী সেজদা কর, কারণ তুমি এমন কোন সেজদা কর না, যার কারণে আল্লাহ তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন না এবং তোমরা গুনা ক্ষমা করেন না। (মুসলি) এটা সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য।
২। সিয়াম : যেহেতু অন্যান্য নেক আমলের মধ্যে সিয়ামও অন্যতম, তাই এ দিনগুলোতে খুব যত্নের সাথে সিয়াম পালন করা। হুনাইদা বিন খালেদ তার স্ত্রী থেকে, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জনৈক স্ত্রী থেকে বর্ণনা করেন : রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিলহজ মাসের নয় তারিখ, আশুরার দিন ও প্রত্যেক মাসের তিন দিন রোজা পালন করতেন। (ইমাম আহমদ. আবূদাউদ ও নাসায়ী) ইমাম নববী জিলহজ মাসের শেষ দশ দিনের ব্যাপারে বলেছেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাব।
৩। তাকবীর, তাহলীল ও তাহমীদ : পূর্বে ইবনে ওমরের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে : তাতে রয়েছে, তোমরা বেশী বেশী তাকবীর, তাহলীল ও তাহমীদ পড়। ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ইবনে ওমর ও আবূহুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহুমা এ দশ দিন তাকবীর বলতে বলতে বাজারের জন্য বের হতেন, মানুষরাও তাদের দেখে দেখে তাকবীর বলত। তিনি আরো বলেছেন, ইবনে ওমর মিনায় তার তাবুতে তাকবীর বলতেন, মসজিদের লোকেরা তা শুনত, অতঃপর তারা তাকবীর বলত এবং বাজারের লোকেরাও, এক পর্যায়ে পুরো মিনা তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠত।
ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু এ দিনগুলোতে মিনায় তাকবীর বলতেন, প্রত্যেক সালাতের পর, বিছানায়, তাঁবুতে, মজলিসে ও চলার পথে। স্বশব্দে তাকবীর বলা মুস্তাহাব। যেহেতু ওমর, ইবনে ওমর ও আবূহুরায়রা স্বব্দে তাকবীর বলেছেন।
মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত, এ সুন্নতগুলো জীবিত করা, যা বর্তমান যুগে প্রায় পরিত্যক্ত এবং ভুলে যাওয়ার উমক্রম হয়েছে, এমনকি নেককার লোকদের থেকেও, অথচ আমাদের পূর্বপুরুষগণ এমন ছিলেন না।
৪। আরাফার দিন রোজা : হাজী ছাড়া অন্যদের জন্য আরাফার দিনের রোজা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত, তিনি আরাফার দিনের রোজার ব্যাপারে বলেছেন : আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, ইহা পূর্ববর্তী এক বছর ও পরবর্তী এক বছরের গুনার কাফ্ফারা হবে। (মুসলিম)
৫। নহরের দিন তথা দশই জিলহজের ফযীলত : এ দিনগুলোর ব্যাপারে অনেক মুসলমানই গাফেল, অথচ অনেক আলেমদের নিকট নিঃশর্তভাবে এ দিনগুলো উত্তম, এমনকি আরাফার দিন থেকেও। ইবনুল কাইয়ূম রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন : আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম দিন, নহরের দিন। আর তাই হজ্জে আকবারের দিন। যেমন সুনানে আবূদাউদে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বড় দিন হলো নহরের দিন, অতঃপর মিনায় অবস্থানের দিন। অর্থাৎ এগারোতম দিন। কেউ কেউ বলেছেন : আরাফার দিন তার থেকে উত্তম। কারণ, সে দিনের সিয়াম দুই বছরের গুনার কাফ্ফারা। আল্লাহ আরাফার দিন যে পরিমাণ লোক জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন, তা অন্য কোন দিন করেন না। আরো এ জন্যও যে, আল্লাহ তাআলা সে দিন বান্দার নিকটবর্তী হন এবং আরাফায় অবস্থানকারীদের নিয়ে ফেরেশতাদের সাথে গর্ব করেন। তবে প্রথম বক্তব্যই সঠিক : কারণ, হাদীস তারই প্রমাণ বহন করে, এর বিরোধী কিছু নেই। যাই হোক, উত্তম হয় আরাফার দিন নয় মিনার দিন, হাজী বা বাড়িতে অবস্থানকারী সবার উচিত সে দিনের ফযীলত অর্জন করা এবং তার মুর্হূতগুলো থেকে উপকৃত হওয়া।
ঈদুল আজহার বিধানঃ
ঈদ এ উম্মতের বৈশিষ্ট্য এবং দীনের একটি উজ্জল নিদর্শন। তোমার দায়িত্ব এটা গুরুত্ব ও সম্মানসহ গ্রহণ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন : এটাই হল আল্লাহর বিধান; যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে, নিঃসন্দেহে তা অন্তরের তাকওয়া থেকেই। (হজ : ৩২)
ঈদের ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত কিছু আদব ও আহকামঃ
১। তাকবীর: আরাফার দিনের ফজর থেকে শুরু করে তাশরীকের দিনের শেষ পর্যন্ত, তথা জিলহজ মাসের তের তারিখের আসর পর্যন্ত তাকবীর বলা। আল্লাহ তাআলা বলেন : আর তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর নির্দিষ্ট দিনসমূহে। (বাকারা : ২০৩)
তাকবীর বলার পদ্ধতি: আল্লাহর যিকির বুলন্দ ও সর্বত্র ব্যাপক করার নিয়তে পুরুষদের জন্য মসজিদে, বাজারে, বাড়িতে ও সালাতের পশ্চাতে উচ্চ স্বরে তাকবীর পাঠ করা সুন্নত।
২। কুরবানী করা: ঈদের দিন ঈদের সালাতের পর কুরবানী করা। রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি ঈদের আগে যবেহ করল, তার উচিত তার জায়গায় আরেকটি কুরবানী করা। আর যে এখনো কুরবানী করেনি, তার উচিত এখন কুরবানী করা। (বুখারী ও মুসলিম) কুরবানী করার সময় চার দিন। অর্থাৎ নহরের দিন এবং তার পরবর্তী তাশরীকের তিন দিন।
যেহেতু রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তাশরীকের দিন কুরবানীর দিন। (সহীহ হাদীস সমগ্র : ২৪৬৭)
৩। পুরুষদের জন্য গোসল করা ও সুগন্ধি মাখা: সুন্দর কাপড় পরিধান করা, ঢাকনার নিচে কাপড় পরিধান না করা, কাপড়ের ক্ষেত্রে অপচয় না করা। নারীদের জন্য ঈদগাহে যাওয়া বৈধ, তবে আতর ও সৌন্দর্য প্রদর্শন পরিহার করে। মুসলিম নারীদের জন্য কখনো শোভা পায় না যে, সে আল্লাহর ইবাদাতের জন্য তাঁরই গুনাতে লিপ্ত হয়ে ধর্মীয় কোন ইবাদাতে অংশ গ্রহণ করবে। যেমন সৌন্দর্য প্রদর্শন, সুসগন্ধি ব্যবহার ইত্যাদি করে ঈদগাহে উপস্থিত হওয়া।
৪। কুরবানীর গোস্ত ভক্ষণ করা: ঈদুল আজহার দিন রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খানা খেতেন না, যতক্ষণ না তিনি ঈদগাহ থেকে ফিরে আসতেন, অতঃপর তিনি কুরবানী গোস্ত থেকে ভক্ষণ করতেন।
৫। সম্ভব হলে ঈদগাহে হেঁটে হেঁটে ঈদগাহে যাওয় : ঈদগাহতেই সালাত আদায় করা সুন্নত। তবে বৃষ্টি বা অন্য কোন কারণে মসজিদে পড়া বৈধ, যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা পড়েছেন।
৬। মুসলমানদের সাথে সালাত আদায় করা এবং খুতবায় অংশ গ্রহণ করা: উলামায়ে কেরামদের প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, ঈদের সালাত ওয়াযিব। এটাই ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন: অতএব তোমরা রবের উদ্দেশ্যেই সালাত পড় এবং নহর কর। (কাউসার : ২)
উপযুক্ত কোন কারণ ছাড়া ঈদের সালাতের ওয়াজিব রহিত হবে না। মুসলমানদের সাথে নারীরাও ঈদের সালাতে হাজির হবে। এমনকি ঋতুবতী নারী ও যবতী মেয়েরা। তবে ঋতুবতী নারীরা ঈদগাহ থেকে দূরে অবস্থান করবে।
৭। রাস্তা পরিবর্তন করা: এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যাওয়া ও অপর রাস্তা দিয়ে ঈদগাহ থেকে বাড়ি ফেরা মুস্তাহাব। যেহেতু তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম করেছেন।
৮। ঈদের সুভেচ্ছা জানানো: ঈদের দিন একে অপরকে সুভেচ্ছা বিনিময় করা: যেমন বলা- আমাদের থেকে ও তোমাদের থেকে নেকআমলসমূহ কবুল করুন। বা এ ধরণের অন্য কিছু বলা।
এ দিনগুলোতে সাধারণ ঘটে যাওয়া কিছু বেদআত ও ভুল ভ্রান্তি থেকে সকলের সতর্ক থাকা জরুরী, যেমন:
১। সম্মিলিত তাকবীর বলা : এক আওয়াজে অথবা একজনের বলার পর সকলের সমস্বরে বলা থেকে বিরত থাকা।
২। ঈদের দিন হারাম জিনিসে লিপ্ত হওয়া: গান শোনা, ফিল্ম দেখা, বেগানা নারী-পুরুষের সাথে মেলামেশা করা ইত্যাদি পরিত্যাগ করা।
৩। কুরবানী করার পূর্বে চুল, নখ ইত্যাদি কর্তন করাঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী দাতাকে জিলহজ মাসের আরম্ভ থেকে কুরবানী করা পর্যন্ত তা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।
৪। অপচয় ও সীমালঙ্ঘন করা: এমন খরচ করা, যার পিছনে কোন উদ্দেশ্য নেই, যার কোন ফায়দা নেই, আর না আছে যার কোন উপকার। আল্লাহ তাআলা বলেছেন: আর তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদেরকে ভালবাসেন না। (আনআম : ১৪১)
কোরবানির দিনের ফজিলতঃ
১। এ দিনের একটি নাম হল ইয়াওমুল হজ্জিল আকবর বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন। যে দিনে হাজীগণ তাদের পশু জবেহ করে হজকে পূর্ণ করেন। হাদিসে এসেছে : ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কোরবানির দিন জিজ্ঞেস করলেন এটা কোন দিন? সাহাবাগণ উত্তর দিলেন এটা ইয়াওমুন্নাহার বা কোরবানির দিন। রাসূলে কারীম (সাঃ) বললেন : এটা হল ইয়াওমুল হজ্জিল আকবর বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন।
২। কোরবানির দিনটি হল বছরের শ্রেষ্ঠ দিন। আব্দুল্লাহ ইবনে কুর্ত (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলে কারীম (সাঃ) বলেছেন : আল্লাহর নিকট দিবস সমূহের মাঝে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন হল কোরবানির দিন, তারপর পরবর্তী তিনদিন।
কোরবানীর বৈধতা ও তার কতক বিধানঃ
কুরবানীর অনুমোদনের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা বলেন-অতএব তোমরা রবের উদ্দেশ্যেই সালাত পড় এবং নহর কর। (কাউসার : ২)
তিনি আরো বলেন : কুরবানীর উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন বানিয়েছি। (হজ: ৩৬)
কুরবানী সুন্নতে মুয়াক্কাদা। সামর্থ থাকা সত্বে তা ত্যাগ করা মাকরুহ। আনাস রাদিআল্লাহু আনহুর হাদীসে রয়েছে, যা বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। তারা বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তরতাজা ও শিং ওয়ালা দুটি মেষ নিজ হাতে যবেহ করেছেন এবং তিনি তাতে বিসমিল্লাহ ও তাকবীর বলেছেন।
কুরবানীর পশু: উঠ, গরু ও বকরী ছাড়া কুরবানী শুদ্ধ নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন : তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে, যেসমস্ত জন্তু তিনি রিয্ক হিসেবে দিয়েছেন তার উপর। (হজ : ৩৪)
কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার জন্য ত্রুটি মুক্ত পশু হওয়া জরুরী: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: কুরবানীর পশুতে চারটি দোষ সহনীয় নয়: স্পষ্ট কানা, স্পষ্ট অসুস্থ্য, হাড্ডিসার ও ল্যাংড়া পশু। (তিরমিযী : কিতাবুল হজ : ৩৪)
যবেহ করার সময়: ঈদের সালাতের পর কুরবানীর সময় শুরু হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে সালাতের পূর্বে যবেহ করল, সে নিজের জন্য যবেহ করল। আর যে খুতবা ও ঈদের সালাতের পর কুরবানী করল, সে তার কুরবানী ও সুন্নত পূর্ণ করল। (বুখারী ও মুসলিম)
যে সুন্দর করে যবেহ করার ক্ষমতা রাখে তার উচিত নিজ হাতে কুরবানী করা। কুরবানীর সময় বলবে: কুরবানীকারী নিজের নাম বলবে অথবা যার পক্ষ থেকে করবানী করা হচ্ছে তার নাম বলবে।
যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার; হে আল্লাহ, এটা আমার পক্ষ থেকে এবং আমার উম্মতের মধ্যে যারা কুরবানী করেনি, তাদের পক্ষ থেকে। (আবূ দাউদ ও তিরমিযী)
অংশীদারির ভিত্তিতে কোরবানি করাঃ
অংশীদারির ভিত্তিতে কোরবানি কারাকে ভাগে কোরবানি দেয়া বলা হয়। ভেড়া, দুম্বা, ছাগল দ্বারা এক পরিবারের পক্ষ থেকে একটা পশু কোরবানি করতে পারবেন। আর উট, গরু, মহিষ দ্বারা সাত জনের নামে সাতটি কোরবানি করা যাবে। তবে অংশীদারি ভিত্তিতে কোরবানি করার দুটি পদ্ধতি হতে পারে-
১। সওয়াবের ক্ষেত্রে অংশীদার হওয়া। যেমন-কয়েক জন মুসলিম মিলে একটি বকরি ক্রয় করল। অত:পর একজনকে ঐ বকরির মালিক বানিয়ে দিল। বকরির মালিক বকরিটি কোরবানি করল। যে কজন মিলে বকরি খরিদ করেছিল সকলে সওয়াবের অংশীদার হলো।
২। মালিকানার অংশীদারির ভিত্তিতে কোরবানি। দুজন বা ততোধিক ব্যক্তি একটি বকরি কিনে সকলেই মালিকানার অংশীদার হিসেবে কোরবানি করল। এ অবস্থায় কোরবানি শুদ্ধ হবে না। অবশ্য উট, গরু ও মহিষের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি জায়েয কি নাজায়েয অর্থাৎ উট বা গরুর এক সপ্তাংশ একটি পরিবারের তরফ থেকে যথেষ্ট হবে কি? – সে ব্যাপারে উলামাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বলেন, যথেষ্ট নয়। কারণ, তাতে ৭ জনের অধিক ব্যক্তির শরীক হওয়া বৈধ নয়। তা ছাড়া পরিবারের তরফ থেকে একটি পূর্ণ দম (জান) যথেষ্ট হবে। আর ৭ ভাগের ১ ভাগ পূর্ণ দম নয়। (ফাতাওয়া শায়খ মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম, ৬/১৪৯)। অনেকের মতে একটি মেষ বা ছাগের মতই এক সপ্তাংশ উট বা গরু যথেষ্ট হবে। (শুমাইমিরী, মাজালিসু আশরি যিলহাজ্জাহ, পৃ. ২৬; আল-মুমতে ইবনে উসাইমীন, ৭/৪৬২-৪৬৩)।
মূলত এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে উলামাগণ দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন:
১ম পক্ষ: মুসাফির ও মুক্বীম উভয় অবস্থায় ১টি উট বা গরু বা মহিষে ৭ জন বা ৭টি পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানি করাকে যথেষ্ট মনে করেন।
২য় পক্ষ: মুসাফির অবস্থায় উট বা গরু বা মহিষে ৭জন বা ৭জনের পক্ষ থেকে কোরবানি করাকে যথেষ্ট মনে করেন। কিন্তু এ পক্ষ মুক্বীম উভয় অবস্থায় ১টি উট বা গরু বা মহিষে ৭টি পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানি করাকে যথেষ্ট মনে করেন না। এদের মতানুযায়ী, মুক্বীম অবস্থায় একটি পরিবারের পক্ষ থেকে একটি পশুই কোরবানি করতে হবে।
কোরবানিতে অংশগ্রহণ ও সাত ভাগা প্রসংগে প্রথম পক্ষের প্রমাণাদি ও বক্তব্য:
অন্যান্য ইবাদতের ন্যায় কোরবানিকেও আল্লাহ বিভিন্নভাবে আদায় করার বিধান দান করেছেন। ফলে আমরা উট, গরু, ছাগল ,ভেড়া, দুম্বার যেকোন একটা কোরবানি করতে পারি, আবার সবগুলো একসাথেও করতে পারি। আবার এককভাবে উট, গরু, মহিষ কোরবানি করতে না পারলেও সাত জন অংশগ্রহণ করতে পারি। কিন্তু একটি জন্তুতে সাত জনের অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে নানাবিধ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। যেমন বলা হয়ে থাকে, শুধু সফরের অবস্থায় সাত জন অংশগ্রহণ করতে পারবে, তবে তাদের একই পরিবারের অন্তর্ভূক্ত হতে হবে, বিভিন্ন পরিবারের হলে নয়। এ বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই- ইবনু আববাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূল (সাঃ)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। এমতাবস্থায় কোরবানির ঈদ উপস্থিত হলো। তখন আমরা সাতজনে একটি গরু ও দশজনে একটি উটে শরীক হলাম। (তিরমিযী নাসাঈ, ইবনু মাজাহ)।
আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একটি গরু সাতজনের পক্ষ কোরবানি করা যাবে…। (তিরমিযী)
হাদিসে বর্ণিত সাতজনে একটি গরুতে শরীক হয়েছিলাম এ সাতজন শব্দের অর্থ বুঝতেই অনেকে ভূল করেছেন এবং মনে করেছেন একটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাতের অধিক হলে সেই পরিবারের জন্য একটি গরু বা উট যথেষ্ট নয়; অথচ একটি গরু বা উট শুধু এক পরিবার নয়, বরং সাতটি পরিবারের জন্য যথেষ্ট। আর সেই পরিবারগুলোর সদস্য সংখ্যা যতই হোক না কেন। কারণ হাদিসে সাতজন বলতে সাতজন কর্তা ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে যাদের প্রত্যেকে একেকটা পরিবারের মালিক। যেমন- আপনি এক পরিবারের কর্তা, সুতরাং আপনার উপরই কোরবানির বিধান বলবৎ হবে। আপনার সন্তান ও স্ত্রীর উপর এ বিধান বলবৎ হবে না। তবে হ্যাঁ তাদের কারো নামে যদি এ পরিমাণ সম্পদ থাকে যে, তারা কোরবানি দেয়ার সমর্থ্য রাখে। তবে কারো কারো মতে তাদের উপর কোরবানির বিধান বলবৎ হয়ে যাবে। তিরমিযী শরীফে লিখিত আবু আইয়ুব হতে বর্ণিত সহিহ হাদিস দ্বারা এ কথাই সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, যা নিম্নরূপ:
আতা বিন ইয়াসার বলেন, আমি আবু আইয়ুব (রা.) কে প্রশ্ন করলাম যে, নবী (সাঃ) এর যুগে কোরবানি কিভাবে করা হতো? তখন তিনি বললেন, এক ব্যক্তি তার ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে একটি একটি ছাগল কুরবনী করত, সেখান থেকে তারা খেত এবং অন্যদের খাওয়াত, আর মানুষ এভাবে আনন্দিত হতো ও গর্ববোধ করত। আর সে প্রথা বর্তমানকাল পর্যন্ত চলে আসছে।
ইমাম শাওকানী (রাহ.) নায়লুল আওতার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, সঠিক কথা হচ্ছে যে, একটি ছাগল একটি পরিবারের থেকে যথেষ্ট হবে যদিও তারা ১০০ জনের পরিবার অথবা ততধিক হয়। নবী (সাঃ) এর সুন্নাতের এটাই ফায়সালা। (তুহফাতুল আহওয়াযী, ৫/৯২)।
ইবনুল কাইয়িম (রাহ.) বলেন, নবী (সাঃ) এর তরীক্বা হচ্ছে যে, একটি ছাগল এক ব্যক্তি ও তার পরিবারের সকল সদস্যের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে যদি তাদের সংখ্যা অনেক হয়। ( তুহফাতুল আহওয়াযী, ৫/৯১)।
নবী (সা.) এর যুগে এক ব্যক্তি যেহেতু একটি ছাগলের কোরবানিতে অংশগ্রহণ করত ও সাত ব্যক্তি একটি গরু কিংবা উটে অংশগ্রহণ করত, সুতরাং সাধারণ ভাবেই বুঝা যায় যে, একটি ছাগল এক ব্যক্তি ও তার পরিবারের জন্য যখন যথেষ্ট ছিল, তখন সাত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে একটি গরু কেন যথেষ্ট হবে না।
ইবনে আববাস (রা.) এর হাদিসে বর্ণিত যে সমস্ত সাহাবায়ে কেরামগণ সাতজন করে একটি গরুতে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তারা প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের লোক ছিলেন।
জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, গরু সাত জনের পক্ষ হতে এবং উট সাত জনের পক্ষ হতে কোরবানি করা যাবে। (মুসলিম, আবূ দাউদ)।
ভারতবর্ষের মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রাহ.) বলেন, অবশ্যই উট এবং গরুর কোরবানিতে বিভিন্ন পরিবারের অংশগ্রহণ প্রমাণিত যেমন ছাগলে একই পরিবারের সদস্যদের অংশগ্রহণ প্রমাণিত। (তুহফাতুল আহওয়াযী, ৫/৯৩)।
আল্লামা নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী (রাহ.) বলেন, উট এবং গরুর কোরবানিতে সাত ব্যক্তির অংশগ্রহণ সঠিক যদিও তারা বিভিন্ন পরিবারের হয়ে থাকে। (আর-রওযাতুন নাদিয়াহ, পৃ. ১২৮)।
আল্লামা ওবায়দুল্লাহ রহমানী মুবারকপুরী (রাহ.) বলেন, আর কোরবানি প্রসঙ্গে অধিকাংশ ইমামগণের মত হচ্ছে, কোরবানিতেও হাদি তথা হজ্জের পশুর ন্যায় অংশ গ্রহণ বৈধ যদিও অংশগ্রহণকারীগণ একই পরিবারের সদস্য হয়, কিংবা বিভিন্ন পরিবারের হয় এবং তারা নিজেদের মধ্যে আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয় হোক। তরে ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) শর্তারোপ করেছেন যে, একই পশুতে বিভিন্ন জনের অংশগ্রহণ তখনই বৈধ যখন তারা পরস্পরের নিকটাত্মীয় হবে। (মিরআতুল মাফাতীহ, ৫/১৭৭)।
ইমাম তিরমিযী (রাহ.) মন্তব্য করেন যে, ১টি জন্তুতে সাতজনের অংশগ্রহণের উপর বিজ্ঞ সাহাবা কেরামের আমল প্রমাণিত এবং পরবর্তীতে ইমাম সুফইয়ান সাওরী, ইবনুল মুবারাক, শাফেয়ী, আহমাদ ও ইসহাক এর উপর আমল করেছেন। (তুহফাতুল আহওয়াযী, পৃ৮৮)।
তাছাড়া, একটি গরু যে সাতটি ছাগলের সমান তা নবী (সাঃ) এর নিম্নোক্ত হাদিস দ্বারাও প্রমাণিত: ইবনু আববাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী (সাঃ) এর কাছে এসে বলল যে, আমার উপর একটি হজ্জের পশু কোরবানি করা ওয়াজিব হয়ে আছে কিন্তু আমি তা ক্রয় করতে পারছি না। তখন নবী (সাঃ) তাকে নির্দেশ প্রদান করলেন যেন সে সাতটি ছগল ক্রয় করে সেগুলোকে জবেহ করে। (আহমাদ, ইবনু মাজাহ)।
ইমাম নববী (রাহ.) মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যায় বলেন, একটি গরু সাতজনের পক্ষ যথেষ্ট হবে, আর প্রতিটা গরু সাতটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত হবে। লক্ষনীয় যে, আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রাহ.), ওবায়দুল্লাহ রহমানী মুবারকপুরী (রাহ.), নবাব সিদ্দিক হাসান খান (রাহ.) প্রমুখ উলামায়ে কিরাম কেউই কোরবানির ভাগাভাগিতে অংশগ্রহণের সাথে সফরের কোন শর্তের কথা উল্লেখ করেননি।
সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের স্থায়ী কমিটি নামক ফাতাওয়া বোর্ড ফাতাওয়া প্রদান করেছে যে, একটি পরিবারের হোক কিংবা বিভিন্ন পরিবারের হোক এবং তারা আত্মীয়ই হোক কিংবা অনাত্মীয় হোক। (ফাতাওয়া আল-লাজনাহ আদ-দায়েমাহ, ১১/৪০১)। আল্লামা ইবনু উসাইমীন বলেন, একটি ছাগল একজনের পক্ষে যথেষ্ট এবং উট এবং গরুর সাত ভাগের এক ভাগ ঐ পরিমাণ যথেষ্ট যে পরিমাণের জন্য একটি ছাগল যথেষ্ট। (আহকামুল উযহিয়্যাহ ওয়ায যাকাত, পৃ. ৭)।
দ্বিতীয় পক্ষের প্রমাণাদি ও বক্তব্য:
নিজের ও নিজ পরিবারের পক্ষ হতে একটি পশুই যথেষ্ট:
এ বিষয়ে বর্ণিত হাদিসে মা আয়িশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি শিংওয়ালা সুন্দর সাদা-কালো দুম্বা আনতে বললেন, .. অত:পর এ দুআ পড়লেন-(আল্লাহ নামে, হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ ও তার পরিবার-পরিজন এবং তার উম্মতের পক্ষ থেকে কবূল করে নিন। এরপর উক্ত দুম্বা কোরবানি করলেন। (সহিহ মুসলীম, হাদিস নং ১৯৬৭)।
বিদায় হজ্জে আরাফার দিনে সমবেত জনমন্ডলীকে উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ ( সা.) বলেন, হে জনগণ! নিশ্চয়ই প্রত্যেক পরিবারের উপরে প্রতি বছর একটি করে কোরবানি ও আতীরাহ। ইমাম আবু দাউদ বলেন, আতীরাহ প্রদানের হুকুম পরে বহিত করা হয়। [তিরমিযী, আবু দাউদ প্রভৃতি, মিশকাত, হা/১৪৭৮; এ হাদিসটির সনদ শক্তিশালী (ইবনু হাজার, ফতহুল বারী, ১০/৬); সনদ হাসান, আলবানী, সহিহ নাসাঈ, হ/৩৯৪০; সহিহ আবু দাউদ, হা/২৪২১; সহিহ তিরমিযী, হা/১২২৫; সহিহ ইবনু মাজাহ, হা/২৫৩৩]।
সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে পরিবার পিছু একটি করে বকরী কোরবানি করার রেওয়াজ ছিল। যেমন- সাহাবী আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) বলেন, একজন লোক একটি বকরী দ্বারা নিজের ও নিজের পরিবারের পক্ষ হতে কোরবানি দিতেন। অত:পর তা খেতেন ও অন্যকে খাওয়াতেন এবং এভাবে লোকেরা বড়াই করত। এ নিয়ম রাসূলের যুগ হতে চলে আসছে যেমন তুমি দেখছ। (সহিহ তিরমিযী, হা/১২১৬; সহিহ ইবনু মাজাহ, হা/২৫৪৬; মিরআত, ২/৩৬৭, ৫/১১৪) ।
একই মর্মে ধনাঢ্য সাহাবী আবু সারীহা (রা.) হতে সহিহ সনদে বর্ণিত ইবনু মাজার একটি হাদিস উদ্ধৃত করে ইমাম শাওকানী বলেন,সঠিক কথা হচ্ছে, একটি বকরি একটি পরিবারের পক্ষ হতে যথেষ্ট, যদিও সে পরিবারের সদস্য সংখ্যা শতাধিক হয় এবং এভাবেই নিয়ম চলে আসছে। (সহিহ ইবনু মাজাহ, হ/২৫৪৭; নায়লুল আওতার, ৬/১৪৪)।
মিশকাতের ভাষ্যকার ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রাহ.) বলেন, যারা একটি ছাগল একজনের জন্য নির্দিষ্ট বলেন এবং উক্ত হাদিসগুলোকে একক ব্যক্তির কোরবানিতে পরিবারের সওয়াবে অংশীদার হওয়ার তাবীল করেন বা খাস হুকুম মনে করেন কিংবা হাদিসগুলোকে মানসূখ বলতে চান, তাদের এ সব দাবী প্রকাশ্য সহিহ হাদিসের বিরোধী এবং তা প্রত্যাখ্যাত ও নিছক দাবী মাত্র । (মিরআত, ২/৩৫১, ৫/৭৬)।
রাসূল (সা.) মদীনায় মুক্বীম অবস্থায় নিজ পরিবার ও উম্মতের পক্ষ হতে দুটি করে খাসি এবং হজ্জের সফরে মিনায় গরু ও উট কোরবানি করেছেন। (মুত্তাফাক্বুন আলাইহ, মিশকাত, হা/১৪৫৩; বুখারি, ১/২৩১; সহিহ আবূ দাউদ, হা/১৫৩৯)।
কোরবানিতে শরীক হওয়া:
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রা.) বলেন, আমরা রাসূল (সা.)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। এমতাবস্থায় কোরবানির ঈদ উপস্থিত হলো। তখন আমরা সাতজনে একটি গরু ও দশজনে একটি উটে শরীক হলাম। (তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত, হা/১৪৬৯; সনদ সহিহ)।
জাবির (রা.) বলেন, আমরা আল্লাহর রাসূল (সা.) এর সাথে হজ্জ ও উমরার সফরে সাথী ছিলাম।….. তখন আমরা একটি গরু ও উটে সাতজন করে শরীক হয়েছিলাম। (সহিহ মুসলিম, হা/১৩১৮) সফরে সাত বা দশজন মিলে একটি পরিবারের ন্যায়, যাতে গরু ও উটের মতো বড় পশু জবেহ ও কুটাবাছা এবং গোশত বণ্টন সহজ হয়। জমহুর বিদ্বানগণের মতে হজ্জের হাদির ন্যায় কোরবানিতেও শরীক হওয়া চলবে। (মরআত, ২/৩৫৫, ৫/৮৪)।
আনাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) হজ্জের সফরে মিনায় নিজ হাতে ৭টি উট (অন্য বর্ণনায় এরও অধিক) দাড়ানো অবস্থায় নহর করেছেন এবং মদীনায় (মুক্বীম অবস্থায়) দুটি সুন্দর শিংওয়ালা খাসি কোরবানি করেছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) তার সফরসঙ্গী স্ত্রী ও পরিবারের পক্ষ হতে একটি গরু কোরবানি করেন। (বুখারি, ১/২৩১; সহিহ আবু দাউদ, হা/১৫৩৯) অবশ্য মক্কায় (মিনায়) নহরকৃত উটগুলো সাহাবীগণের পক্ষ থেকেও হতে পারে।
আলোচনা: ইবনু আববাস (রা.) এর হাদিসটি নাসাঈ, তিরমিযী ও ইবনু মাজাহতে, জাবির (রা.) বর্ণিত হাদিসটি সহিহ মুসলিম ও আবুদাউদে এবং আনাস (রা.) বর্ণিত হাদিসটি সহিহ বুখারিতে সংকলিত হয়েছে। সহিহ মুসলিম ও সহিহ বুখারিতে যথাক্রমে হজ্জও মানসিক অধ্যায়ে এবং সুনানে কোরবানি অধ্যায়ে হাদিসগুলো এসেছে। যেমন-(১) তিরমিযী কোরবানিতে শরীক হওয়া অধ্যায়ে ইবনু আববাস, জাবির ও আলী (রা.) থেকে মোট তিনটি হাদি এনেছেন। (২) ইবনু মাজাহ উক্ত মর্মের শিরোনামে ইবনু আববাস,জাবির, আবূ হুরায়রা ও আয়েশা (রা.) হতে যে পাঁচটি হাদিস (৩১৩১-৩৪ নং) এনেছেন, তার সবগুলোই সফরে কোরবানি সংক্রান্ত। (৩৬) নাসাঈ কেবলমাত্র ইবনু আববাস ও জাবির (রা.) থেকে পূর্বের দুটি হাদিস (২৩৯৭-৯৮ নং) এনেছেন। (৪) আবু দাউদ শুধুমাত্র জাবির (রা.) এর পূর্ববর্ণিত সফরে কোরবানির হাদিসটি এনেছেন। তিনটি সহিহ সনদে (২৮০৭-৯ নং), যার মধ্যে ২৮০৮ নং হাদিরটিতে কোন ব্যাখ্যা নেই।
বিভ্রাটের কারণ: মিশকাত শরীফে ইবনু আববাস (রা.) এর সফরের হাদিসটি (১৪৬৯ নং) এবং জাবির (রা.) বর্ণিত ব্যাখ্যাশুন্য হাদিসটি (১৪৫৮ নং ) সংকলিত হয়েছে। সম্ভবত জাবির (রা.) বর্ণিত মুত্বলাক্ব বা ব্যাখ্যাশুন্য হাদিসটিকে ভিত্তি করেই মুক্বীম অবস্থায় গরু বা মহিষে সাতভাগা কোরবানির নিয়ম চালু হয়েছে। অথচ, ভাগের বিষয়টি সফরের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা ইবনু আববাস ও জাবির (রা.) বর্ণিত বিস্তারিত হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে। (মিশকাত, হা/১৪৬৯; মুসলিম , হা/১৩১৮; বুখারি, ১/২৩১) আর একই রাবীর বর্ণিত সংক্ষিপ্ত হাদিসের স্থলে বিস্তারিত ও ব্যাখ্যা সম্বলিত হাদিস দলীলের ক্ষেত্রে গ্রহণ করাই মুহাদ্দিসগণের সর্ববাদীসম্মত রীতি।
তাছাড়া, মুক্বীম অবস্থায় মদীনায় রাসূল (সা.) বা সাহাবায়ে কেরাম কখনো ভাগে কোরবানি করেছেন বলেও জানা যায় না। ইমাম মালিক (রাহ.) কোরবানিতে শরীক হওয়ার বিষয়টিকে মাকরূহ মনে করতেন। (মুওয়াত্বা মালেক, পৃ. ২৯৯)।
উভয় পক্ষের প্রদানকৃত দলীল সমূহের পর্যালোচনা: মুক্বীম অবস্থায় সাতটি পরিবারের সকল সদস্যের পক্ষ থেতে সাতটি ভাগ দিয়ে একটি উট বা গরু বা মহিষ ক্রয় করে করে কোরবানি করার ব্যাপারে উপরে উল্লেখিত উভয় পক্ষের উপস্থাপিত প্রমাণিত প্রমাণাদিকে বিশ্লেষণমূলক পর্যলোচনা করলে যে বিষয়টি আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে, জাবির (রা.) বর্ণিত আবু দাউদদের ব্যাখ্যা শূন্য হাদিসটির কারণেই মুসাফির ও মুক্বীম অবস্থায় কোরবানিতে ভাগাভাগি নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথমত: এ হাদিসটিতে কেবল বলা হচ্ছে, গরুতে সাতজন আর উটে সাতজন। এখানে সফর না মুক্বীম তা বলা হয়নি। কিন্তু এটি যে সফরের হাদিস তা জাবির (রা.) বর্ণিত অন্যান্য হাদিসগুলো দ্বারা প্রমাণিত।
দ্বিতীয়ত: জাবির (রা.) বর্ণিত সফরের হাদিসগুলো ইমাম আবূ দাউদ যে অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন এ ব্যাখ্যাশূন্য হাদিসটিও সে অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন।
সর্বোপরি, উভয় পক্ষের মতের স্বপক্ষে উপস্থাপিত দলীলাদি পর্যালোচনা করলে আমাদের সামনে তিনটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, তা হলে:
১। সফর ও মুক্বীম অবস্থায় একটি পরিবারের পক্ষ থেকে একটি পশু কোরবানি করার ব্যাপারে উভয় পক্ষই একমত।
২। ভাগে কোরবানি জায়েয।
৩। সফর ও মুক্বীম অবস্থায় সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে ভাগে একটি পশু কোরবানি করা যায়।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কিছু কথা না বললেই নয়, তা হলো- হাদিসে বলা হয়েছে, সাতজনের পক্ষ থেকে (মুসলিম, মিশকাত, হা/১৪৫৮), কিন্তু আমাদের সমাজে কোরবানি করা হচ্ছে সাত পরিবারের পক্ষ থেকে। বলা যায়, সফর অবস্থাতেও সাত পরিবারের পক্ষ থেকে অনুমতি নেই। আরো স্পষ্ট হলো, সাত জনের প্রেক্ষাপট কেবল সফর অবস্থায় সৃষ্টি হয়। মুক্বীম অবস্থায় কোরবানি পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত, যেমন- রাসূল (সা.) করতেন। মূলত, এক্ষেত্রে সফরের হাদিসগুলোকে আম হিসেবে ধরা যাচ্ছে না। কারণ, এ হাদিসগুলো রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তার সাহাবীগণ (রা.) মুক্বীম অবস্থায় যে ভাগা কোরবানি করতেন, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোন হাদিস নেই। রাসূল (সা.) প্রতি বছর দুটি করে খাসি কোরবানি করতেন। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত, হা/১৪৫৩) অথচ, দঃখের বিষয় বর্তমানে কেবল সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে নয়; বরং মুক্বীম অবস্থায় সাত পরিবারের বর্তমানে কেবল সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে নয়; বরং মুক্বীম অবস্থায় সাত পরিবারের ৭-এর অধিক ব্যক্তির পক্ষ থেকে একটি গরু কোরবানি দেওয়া হচ্ছে।
আজকাল পরিবারের পক্ষ থেকে একটি ছাগল কোরবানির সাথে একটি গরুর ভাগা নেওয়া হচ্ছে মূলত গোশত বেশী পাবার স্বার্থে। নিয়ত যখন গোশত খাওয়া, তখন কোরবানির উদ্দেশ্য কিভাবে হাছিল হবে? কোরবানি হলো পিতা ইবরাহীমের সুন্নাত, যা তিনি পুত্র ইসমাঈলের জীবনের বিনিময়ে করেছিলেন। আর তা ছিল আল্লাহর পক্ষ হতে পাঠানো একটি পশুর জীবন অর্থাৎ দুম্বা। অতএব ইবরাহীম ও মুহাম্মাদী সুন্নাতের অনুসরণে নিজের ও নিজ পরিবারের পক্ষ হতে আল্লাহর রাহে একটি জীবন তথা একটি পূর্ণাঙ্গ পশু কোরবানি দেওয়া উচিত, পশুর দেহের কোন খন্ডিত অংশ নয়। পরিশেষে, মনে রাখতে হবে কোরবানি হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত ও আল্লাহ রাববুল আলামিনের নৈকট্য লাভের উপায়। তাই তা আদায় করতে হবে সময়, সংখ্যা ও পদ্ধতিগত দিক দিয়ে শরীয়ত অনুমোদিত নিয়মাবলি অনুসরণ বা শুধু সদকা (দান) নয়।। কোরবানির উদ্দেশ্য শুধু গোশত খাওয়া নয়, শুধু মানুষের উপকার করা নয় বা শুধু সদকা (দান) নয়। কোরবানির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ রাববুল আলামীনের একটি মহান নিদর্শন তার রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে আদায় করা।
কুরবানীর গোস্ত ভণ্টন করা :
কুরবানী পেশকারী ব্যক্তির জন্য সুন্নত হচ্ছে কুরবানীর গোস্ত নিজে খাওয়া, আত্মীয় ও প্র্রতিবেশীদের হাদিয়া দেয়া এবং গরীবদের সদকা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন :
অতঃপর তোমরা তা থেকে খাও এবং দুস্থ-দরিদ্রকে থেকে দাও। (হজ : ২৮)
তিনি আরো বলেন : তা থেকে খাও। যে অভাবী, মানুষের কাছে হাত পাতে না এবং যে অভাবী চেয়ে বেড়ায়-তাদেরকে খেতে দাও। (হজ : ৩৬)
পূর্বসূরীদের অনেকের পছন্দ হচ্ছে, কুরবানীর গোস্ত তিনভাগে ভাগ করা। এক তৃতীয়াংশ নিজের জন্য রাখা। এক তৃতীয়াংশ ধনীদের হাদীয়া দেয়া। এক তৃতীয়াংশ ফকীরদের জন্য সদকা করা। পারিশ্রমিক হিসেবে এখান থেকে কসাই বা মজদুরদের কোন অংশ প্রদান করা যাবে না।
কুরবানী পেশকারী যা থেকে বিরত থাকবে : যখন কেউ কুরবানী পেশ করার ইচ্ছা করে আর জিলহজ মাস প্রবেশ করে, তার জন্য চুল, নখ অথবা চামড়ার কোন অংশ কাটা হারাম, যতক্ষণ না কুরবানী করে। উম্মে সালমার হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জিলহজের দশ দিন প্রবেশ করে এবং তোমাদের কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা করে, সে তখন থেকে চুল ও নখ কর্তন থেকে বিরত থাকবে। ইতিপূর্বে যা কর্তন করেছে, সে জন্য তার কোন গুনা হবে না।
কুরবানী দাতার পরিবারের লোক জনের নখ, চুল ইত্যাদি কাঁটাতে কোন সমস্যা নেই।
কোন কুরবানী তাদা যদি তার চুল, নখ অথবা চামড়ার কোন অংশ কেঁটে ফেলে, তার জন্য উচিত তাওবা করা, পুনরাবৃত্তি না করা, তবে এ জন্য কোন কাফ্ফারা নেই এবং এ জন্য কুরবানীতে কোন সমস্যা হবে না। আর যদি ভুলে, অথবা না জানার কারণে অথবা অনিচ্ছাসত্বে কোন চুল পড়ে যায়, তার কোন গুনা হবে না। আর যদি সে কোন কারণে তা করতে বাধ্য হয়, তাও তার জন্য জায়েয, এ জন্য তার কোন কিছু প্রদান করতে হবে না। যেমন নখ ভেঙ্গে গেল, ভাঙ্গা নখ তাকে কষ্ট দিচ্ছে, সে তা কর্তন করতে পারবে, তদ্রূপ কারো চুল বেশী লম্বা হয়ে চোখের উপর চলে আসছে, সেও চুল কাঁটতে পারবে অথবা কোন চিকিৎসার জন্যও চুল ফেলতে পারবে।
কোরবানিঃ
পশু উৎসর্গ করা হবে এক আল্লাহর এবাদতের উদ্দেশ্যে যার কোন শরিক নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন শুধু তার এবাদত করার জন্য। যেমন তিনি বলেন : ‘আমি জিন ও মানুষকে এ জন্য সৃষ্টি করেছি যে তারা শুধু আমার এবাদত করবে।’ আল্লাহ তাআলা তার এবাদতের জন্য মানব জাতিকে সৃষ্টি করলেন।
এবাদত বলে,—যে সকল কথা ও কাজ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন; হোক সে কাজ প্রকাশ্যে বা গোপনে। আর এ এবাদতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তার উদ্দেশ্যে পশু জবেহ করা। এ কাজটি তিনি শুধু তার উদ্দেশ্যে করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন :—
‘বল, আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তার কোন শরিক নাই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।’
ইবনে কাসীর রহ. বলেন : এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নির্দেশ দিয়েছেন যে সকল মুশরিক আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে পশু জবেহ করে তাদের যেন জানিয়ে দেয়া হয় আমরা তাদের বিরোধী। সালাত, কোরবানি শুধু তার নামেই হবে যার কোন শরিক নাই। এ কথাই আল্লাহ তাআলা সূরা কাওসারে বলেছেন : ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কোরবানি কর।’
অর্থাৎ তোমার সালাত ও কোরবানি তারই জন্য আদায় কর। কেননা মুশরিকরা প্রতিমার উদ্দেশে প্রার্থনা করে ও পশু জবেহ করে। আর সকল কাজে এখলাস অবলম্বন করতে হবে। এখলাসের আদর্শে অবিচল থাকতে হবে।
যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে পশু উৎসর্গ বা জবেহ করবে তার ব্যাপারে কঠোর শাস্তির কথা
আবু তোফায়েল থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : আমি আলী ইবনে আবি তালেবের কাছে উপস্থিত ছিলাম। এক ব্যক্তি তার কাছে এসে বলল :‘নবী কারীম স. গোপনে আপনাকে কি বলেছিলেন ?’ বর্ণনাকারী বলেন : আলী রা. এ কথা শুনে রেগে গেলেন এবং বললেন : ‘নবী কারীম স. মানুষের কাছে গোপন রেখে আমার কাছে একান্তে কিছু বলেননি। তবে তিনি আমাকে চারটি কথা বলেছেন। বর্ণনাকারী বলেন,এরপর লোকটি বলল : ‘হে আমিরুল মোমিনীন ! সে চারটি কথা কি ? তিনি বললেন :
১। যে ব্যক্তি তার পিতামাতাকে অভিশাপ দেয় আল্লাহ তাকে অভিশাপ দেন।
২। যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে পশু জবেহ করে আল্লাহ তার উপর লা’নত করেন।
৩। ঐ ব্যক্তির উপর আল্লাহ লা’নত করেন যে ব্যক্তি কোন বেদআতীকে প্রশ্রয় দেয়।
৪। যে ব্যক্তি জমির সীমানা পরিবর্তন করে আল্লাহ তাকে লা’নত করেন।
এ কাজগুলো এমন, যে ব্যক্তি তা করল সে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে কুফরির সীমানায় প্রবেশ করল।
এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম নবভী রহ. বলেন : আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে পশু জবেহ করার অর্থ এমন, যেমন কোন ব্যক্তি প্রতিমার নামে জবেহ করল অথবা কোন নবীর নামে জবেহ করল বা কাবার নামে জবেহ করল। এ ধরনের যত জবেহ হবে সব না-জায়েজ ও তা খাওয়া হারাম। জবেহকারী মুসলিম হোক বা অমুসলিম।
যা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে জবেহ করা হয় তা হারাম ঘোষণা করা হয়েছে:
‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু, রক্ত, শুকর মাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে জবেহকৃত পশু আর শ্বাস রোধে মৃত জন্তু,শৃংগাঘাতে মৃত জন্তু এবং হিংস্র পশুতে খাওয়া জন্তু ; তবে যা তোমরা জবেহ করতে পেরেছ তা ব্যতীত, আর যা মূর্তি পূজার বেদীর উপর বলি দেয়া হয় তা এবং জুয়ার তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ণয় করা, এ সব হল পাপ-কার্যৃ। ইবনে কাসীর রহ. বলেছেন যা কিছু আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে জবেহ করা হয় তা যে হারাম এ ব্যাপারে মুসলিমদের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত।
যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে পশু জবেহ করে সে জাহান্নামে যাবে।
সালমান রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : এক ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে একটি মাছির কারণে। অন্য এক ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে একটি মাছির কারণে। এ কথা শুনার পর লোকেরা জিজ্ঞেস করল এটা কীভাবে হবে ? তিন বললেন : দু ব্যক্তি এক সম্প্রদায়ের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল। সে সম্প্রদায়ের নিয়ম হল যে ব্যক্তি তাদের কাছ দিয়ে যাবে তাকে তাদের প্রতিমার উদ্দেশ্যে কিছু উৎসর্গ করতে হবে। সে সম্প্রদায়ের লোকেরা এ দুজনের একজনকে বলল : আমাদের এ প্রতিমার জন্য কিছু উৎসর্গ কর ! লোকটি উত্তর দিল আমার কাছে তো এমন কিছু নেই যা আমি এ প্রতিমার জন্য উৎসর্গ করতে পারি। তারা বলল একটি মাছি হলেও উৎসর্গ কর। সে একটি মাছি উৎসর্গ করল। তারা তাকে ছেড়ে দিল। ফলে সে জাহান্নামে যাবে।তারপর তারা দ্বিতীয় ব্যক্তিকে অনুরূপ কথা বলল। সে উত্তরে বলল আমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য কিছু উৎসর্গ করি না। তারা তাকে হত্যা করল। ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করল।
বর্ণিত এ হাদিস থেকে আমারা কয়েকটি শিক্ষা লাভ করতে পারিঃ:
১। শিরক কত বড় মারাত্মক অপরাধ তা অনুধাবন করা যায়। যদি তা খুব সামান্য বিষয়েও হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন : ‘যে আল্লাহর সাথে শরিক করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত অবশ্যই নিষিদ্ধ করবেন এবং তার আবাস জাহান্নাম। জালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।’
২। যে লোকটি জাহান্নামে গেল সে কিন্তু উক্ত কাজ করতে ইচ্ছুক ছিল না। কিন্তু সে মুশরিকদের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য কাজটি করেছিল।
যে লোকটি জাহান্নামে গেল সে মুসলিম ছিল, কিন্তু সামান্য বিষয়ে শিরক করার কারণে জাহান্নামে গেল।
৩। তাওহীদ ও এখলাসের ফজিলত কত বেশি তা অনুধাবন করা যায়।
৪। যে লোকটি জান্নাতে প্রবেশ করল সে তাওহীদের জন্য নির্যাতন সহ্য করল, নিহত হল তবু শিরকের সাথে আপোশ করল না।
কোরবানির ফজিলতঃ
(ক) কোরবানি দাতা নবী ইবরাহিম আ. ও মুহাম্মদ সা.-এর আদর্শ বাস্তবায়ন করে থাকেন।
(খ) পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কোরবানি দাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন করেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :—
‘আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন ; সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে।’
(গ) পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও অভাবীদের আনন্দ দান। আর এটা অন্য এক ধরনের আনন্দ যা কোরবানির গোশতের পরিমাণ টাকা যদি আপনি তাদের সদকা দিতেন তাতে অর্জিত হত না। কোরবানি না করে তার পরিমাণ টাকা সদকা করে দিলে কোরবানি আদায় হবে না।
মৃত ব্যক্তির পক্ষে কোরবানিঃ
মূলত কোরবানির প্রচলন জীবিত ব্যক্তিদের জন্য। যেমন আমরা দেখি রাসূলুল্লাহ স. ও তার সাহাবাগণ নিজেদের পক্ষে কোরবানি করেছেন। অনেকের ধারণা কোরবানি শুধু মৃত ব্যক্তিদের জন্য করা হবে। এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। তবে মৃত ব্যক্তিদের জন্য কোরবানি করা জায়েজ ও একটি সওয়াবের কাজ। কোরবানি একটি সদকা। আর মৃত ব্যক্তির নামে যেমন সদকা করা যায় তেমনি তার নামে কোরবানিও দেয়া যায়।
যেমন মৃত ব্যক্তির জন্য সদকার বিষয়ে হাদিসে এসেছেঃ
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত : এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল—হে রাসূল ! আমার মা হঠাৎ ইন্তেকাল করেছেন।কোন অসিয়ত করে যেতে পারেননি। আমার মনে হয় তিনি কোন কথা বলতে পারলে অসিয়ত করে যেতেন। আমি যদি এখন তার পক্ষ থেকে সদকা করি তাতে কি তার সওয়াব হবে ? তিনি উত্তর দিলেন : হ্যাঁ।
মৃত ব্যক্তির জন্য এ ধরনের সদকা ও কল্যাণমূলক কাজের যেমন যথেষ্ট প্রয়োজন ও তেমনি তাঁর জন্য উপকারী।
এমনিভাবে একাধিক মৃত ব্যক্তির জন্য সওয়াব প্রেরণের উদ্দেশ্যে একটি কোরবানি করা জায়েজ আছে। অবশ্য যদি কোন কারণে মৃত ব্যক্তির জন্য কোরবানি ওয়াজিব হয়ে থাকে তাহলে তার জন্য পূর্ণ একটি কোরবানি করতে হবে।
অনেক সময় দেখা যায় ব্যক্তি নিজেকে বাদ দিয়ে মৃত ব্যক্তির জন্য কোরবানি করেন। এটা মোটেই ঠিক নয়। ভাল কাজ নিজেকে দিয়ে শুরু করতে হয় তারপর অন্যান্য জীবিত ও মৃত ব্যক্তির জন্য করা যেতে পারে। যেমন হাদিসে এসেছেঃ
আয়েশা রা. ও আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. যখন কোরবানি দিতে ইচ্ছা করলেন তখন দুটো দুম্বা ক্রয় করলেন। যা ছিল বড়, হৃষ্টপুষ্ট, শিংওয়ালা, সাদা-কালো বর্ণের এবং খাসি। একটি তিনি তার ঐ সকল উম্মতের জন্য কোরবানি করলেন ; যারা আল্লাহর একত্ববাদ ও তার রাসূলের রিসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছে, অন্যটি তার নিজের ও পরিবার বর্গের জন্য কোরবানি করেছেন।
মৃত ব্যক্তি যদি তার সম্পদ থেকে কোরবানি করার অসিয়ত করে যান তবে তার জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যাবে।
কোরবানির গোশত যতদিন ইচ্ছা ততদিন সংরক্ষণ করে খাওয়া যাবে। ‘কোরবানির গোশত তিন দিনের বেশি সংরক্ষণ করা যাবে না’—বলে যে হাদিস রয়েছে তার হুকুম রহিত হয়ে গেছে। তাই যতদিন ইচ্ছা ততদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
তবে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এ বিষয়ে একটা সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : সংরক্ষণ নিষেধ হওয়ার কারণ হল দুর্ভিক্ষ।দুর্ভিক্ষের সময় তিন দিনের বেশি কোরবানির গোশত সংরক্ষণ করা জায়েজ হবে না। তখন ‘সংরক্ষণ নিষেধ’ সম্পর্কিত হাদিস অনুযায়ী আমল করতে হবে। আর যদি দুর্ভিক্ষ না থাকে তবে যতদিন ইচ্ছা কোরবানি দাতা কোরবানির গোশত সংরক্ষণ করে খেতে পারেন। তখন‘সংরক্ষণ নিষেধ রহিত হওয়া’ সম্পর্কিত হাদিস অনুযায়ী আমল করা হবে।
কোরবানির পশুর গোশত, চামড়া, চর্বি বা অন্য কোন কিছু বিক্রি করা জায়েজ নয়। কসাই বা অন্য কাউকে পারিশ্রমিক হিসেবে কোরবানির গোশত দেয়া জায়েজ নয়। হাদিসে এসেছে :—
‘তার প্রস্তুত করণে তার থেকে কিছু দেয়া হবে না।’
তবে দান বা উপহার হিসেবে কসাইকে কিছু দিলে তা না-জায়েজ হবে না।
মুসলিম ভাইদের প্রতি আহব্বান : আপনারা উপরে বর্ণিত নেকআমল ছাড়াও অন্যান্য নেকআমলের প্রতি যত্নশীল হোন। যেমন আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা-সাক্ষাত করা, হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করা, একে অপরকে মহব্বত করা এবং গরীব ও ফকীরদের উপর মেহেরবান হওয়া এবং তাদের আনন্দ দেয়া ইত্যাদি।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি আমাদেরকে তাঁর পছন্দনীয় কথা, কাজ ও আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
সম্পাদনায়- মাহবুব এইচ শাহীন/প্রকাশক ও সম্পাদক/কাগজ২৪